http://www.banglanews24.com/
নকলের ভরসায় বার তিনেক ম্যাট্রিকে পাশ দেয়ার চেষ্টা করিয়া অবশেষে ক্ষান্ত দিয়া
দিলেন চৌধুরী আলম। তারপর কিছুদিন ইতিউতি ঘুরিলেন। কি করিবেন, কি করা যায়, অল্পসময়ে
অধিক উপার্জনের সমস্ত নাড়ি নক্ষত্র পুক্ষানুপুক্ষ বিবেচনা করিয়া বিদেশ যাওয়াটাকেই
শেষ পর্যন্ত বাছিয়া লইলেন। তাহাদের উপজেলার নাঈম মাষ্টারের ছেলে মোখলেছ জার্মানী
থাকে। কিছুদিন আগে যখন দেশে আসিয়াছিল গলায় বিরাট ক্যামেরা আর হাতে আলোজ্বলা ঘড়ি
পড়িয়া। মনে হয় সমস্ত উপজেলায় যেনো আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। টেরি কাটা সিঁথি নিয়ে যে
যখন বাজারে আসিত তখন সে এবার বিয়ে করিবে কিনা তাহা জানিবার জন্যে কন্যাদায়গ্রস্ত
পিতারা প্রায় উন্মাদ হইয়া পড়িয়েছিলেন। সেই সব গুনবতী কন্যাদের মহান পিতাদের বাড়িতে
বাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষা করাই শেষ পর্যন্ত অসম্ভবে যাইয়া দাড়াইয়াছিল তাহার জন্যে।
বাড়িতে নানা পদের আর্শ্চয জিনিসপাতি নিয়া আসিয়াছে সে। মেশিন টিপিয়া মশলা বাটনা করা
যায়, ভাত রান্না করিবার জন্যেও মেশিন আনিয়াছে। যদিও গ্রামে বিদ্যুৎ পাওয়াই মুছিবত।
বিদ্যুৎ একদিন থাকেতো তিনদিন থাকে না। কিন্তু সেটা বড় কথা নহে, বড় কথা হইলো সে
সমস্ত মেশিন নাঈম মাষ্টার তাহার কাচারী ঘরে কাঁচের পাল্লা দেয়া আলমারীতে সাজাইয়া
রাখিয়াছেন, সেগুলো দেখিতে প্রায়ই এ গ্রামের সে গ্রামের লোক তাহার বাড়ির কাঁচারীতে
যাইয়া বসেন। সম্ভ্রমের সহিত সেগুলোকে নাড়াচাড়া করিয়া নাঈম মাষ্টারের ভাগ্যে নিয়া ঈর্ষান্বিত
হন ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
পিতাকে বুঝাইয়া সুঝাইয়া বংশের ভাগে পাওয়া কিছু জমিজমার বেশ অনেকখানিই বন্ধক
দিয়া আর ভগ্নীপতিদের নিকট হইতে কিছু ঋন লইয়া দালালের সহিত পরামর্শ আর আঁতাত করিয়া
জার্মান যাইবার ব্যবস্থা সেও করিয়া লইল। তারপর এক শুভদিন দেখিয়া মায়ের দোয়া মাথায়
লইয়া উড়োজাহাজে চাপিয়া বসিল। আসিয়া নামিল জার্মান দেশে। প্রথমে পুলিশের হ্যাঁপা।
বহুকষ্টে সে হ্যাপা কাটাইয়া ইমিগ্রেশন পার হইয়া বিমানবন্দরের বাহিরে আসিয়া পড়িল। মুগ্ধ বিস্ময়ে চারপাশে ঘাড় ঘুরাইয়া যতোই তাকাইতেছিল তাহার বাক ততোই রুদ্ধ হইয়া
আসিতেছিল। খুশী হইয়া মনে মনে তিনবার কহিল, সুভানাল্লাহ – সুভানাল্লাহ – সুভানাল্লাহ। দেশ হইতে আসিবার সময় দালাল
তিনজনের ঠিকানা দিয়াছিলেন, কাহাদের সাথে তাহাকে
যোগাযোগ করিতে হইবে, সে নিজেও তাহার
ভগ্নীর শ্বশুরকূলের এক নিকট আত্মীয়ের ঠিকানা নিয়া আসিয়াছে। এখন তাহাদের খুঁজিয়া
বাহির করিয়া যোগাযোগের পালা। ভগ্নীর শ্বশুরকূলের আত্মীয়ের তাহাকে এয়ারপোর্টে নিতে
আসিবার কিঞ্চিত সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কাহাকেও সেরকম দেখা যাইতেছে না। কোনদিকে
যাইবে কোথায় খুঁজিবে ভাবিতে ভাবিতে দিশাহারার ন্যায় সামনে পা বাড়াইলো। দরজার
বাহিরে আসিতেই ঠান্ডা একখানা দমকা বাতাস তাহাকে কাবু করিয়া ফেলিল। বুঝিতে
পারিতেছিল না, কি করিবে? বোঝা না বোঝার দোলার মাঝেই সাথে করিয়া আনা কিছু শীতের
কাপড় বাহির করিয়া পড়িয়া ফেলিল। শুরু হইলো তাহার যাত্রা অজানার উদ্দেশ্যে।
পরিচিত বাঙ্গালী ভাইদের পরামর্শে উকিল ধরিয়া, দেশ হইতে পিতা আর ভগ্নীপতির
সাহায্যে কিছু ভুয়া কাগজপত্র আনিয়া, পাসপোর্টের নাম ঠিকানা বদল করিয়া রাজনৈতিক
আশ্রয়প্রার্থীর কেস ঠুকিয়া দিল। দেশে সে অমুক বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিল, অমুক
তকুম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ তাহাকে সরকারী দলের রোষানলে আনিয়া
ফেলিয়াছে, তাহার এখন বাংলাদেশে জীবন বিপন্ন ইত্যাদি প্রভৃতি বহু মিথ্যার আশ্রয়
লইয়া সে জজ সাহেবদের মন গলানোর চেষ্টা করিল। যদিও প্রথম দুইবার অকৃতকার্য হইলো,
তৃতীয়বার আবার নতুন নাম ঠিকানা, নতুন কাগজপত্র লইয়া আবার চেষ্টা দিল, এবার অন্য আর
এক শহর হইতে। দান দান তিনদান। এইদানে জজসাহেব কিঞ্চিত বিগলিত হইয়া
বিবেচনার জন্যে তাহার মামলা নথীভুক্ত করিলেন। কিন্তু পেট পুড়ে আগের শহরের জন্যে, তাছাড়া পরিচিত না থাকিলে কাজও পাওয়া যায়
না। তাই সে আপাতত পুরনো শহরেই ডেরা গাড়িলো। কেইসের তারিখ আসিলে সে আসিয়া নতুন শহরে
হাজিরা দিয়া যায়, মাসে মাসে সরকারের ঘর হইতে পাঠানো হাত খরচ নিয়া, পুলিশের খাতায়
সহী দিয়া আবার পুরনো শহরে ফিরিয়া যায়। সেখানে সে একটি রেষ্টুরেন্টে সপ্তাহে
সাতদিনই দশ থেকে বারো ঘন্টা ধোয়াপোঁছার কাজ করিয়া থাকে। থাকে কিছু বাঙ্গালী
ভাইয়ের সহিত একটি বাড়ি ভাগাভাগি করিয়া সব ব্যাচেলররা। বেশিরভাগ দিনই রেষ্টুরেন্ট
হইতে খাইয়া আসে বিধায়, খাওয়ার খরচও তাহার বাঁচিয়া যায়। মাস না ঘুরিতেই পয়সা, মাস
না ঘুরিতেই হাত লাল।
কিন্তু শেষ রক্ষা হইলো না। এইখানেও তাহারা কাগজপত্র নিয়া আবার সন্দেহ
প্রকাশ করতে লাগিলেন। গাট্টি পুট্টি বাঁধিয়া না আবার ফিরিয়া যাইতে হয় এই
দুশ্চিন্তায় প্রায় পাগল হইয়া যাইবার দশা হইল তাহার। এতো টাকা খরচ করিয়া আসিয়া যদি এতোদিন
পর খালি হাতে ফিরিয়া যাইতে হয়, তাহা হইলে কি হইবে তাহার উপায়। দেশে ফিরিয়াই বা
করিবে কি? অনেক ভাবিয়া শেষে সহদেশীদের পরামর্শমতো একটা জার্মান বুড়ি যোগাড় করা
হইলো। বুড়ির শরীর ভর্তি অনেক দয়া। তিনি পয়সার বিনিময়ে এইসব বিপদগ্রস্ত বালকদের
উদ্ধার করিয়া থাকেন। একেবারে বিয়েতে চৌধুরী আলমের কেমন যেনো বাধো বাধো লাগিতে
লাগিল। সারা জীবন বিবাহ নিয়ে অনেক স্বপ্ন, কল্পনা ছিল তাহার। এ কিসের মধ্যে সে
পড়িয়া যাইতে লাগিল। অনেক ভাবিয়া ঠিক করিল কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করিবে। যে যে যার যার
বাসায় থাকিবে। শুধু কাগজের স্বামী – স্ত্রী হইবেন তাহারা, তাতে পয়সা গেলেও ধর্ম,
সমাজ আর কুমারত্বতো টিকিয়া থাকিল, এইগুলাই যদি না থাকিবে তাহলে এই জীবন রাখিয়া আর
কি লাভ। বুড়ি মহিলা মেমসাহেব তাতেও রাজি। চৌধুরী আলম হইবে তাহার চার নম্বর
বাঙ্গালী স্বামী। এর আগেও তিনি আরো তিনজন বাঙ্গালী বালককে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার
করিয়াছেন। এই পেশায় তিনি বিস্তর অভিজ্ঞ। আগের স্বামীদের নিকট হইতে পোলাও, রোষ্ট
খাইতে শিখিয়াছেন, শাড়ি আনিয়া দিয়াছিল একজন বাংলাদেশ হইতে, তাহাও প্যাচাঁইতে জানেন
অঙ্গে, বাংলাদেশ ও তাহার পারিবারিক কালচার সম্পর্কেও যৎসামান্য জ্ঞান আছে। নেহাত পুলিশ ধরিলেও কোন সমস্যা হইবে না, ম্যানেজ করিয়া
লইতে পারবেন। কিন্তু তাহাকে তাহার টাকা প্রথমেই দিয়া দিলে ভাল, তাহার এখন কিঞ্চিত
হাত টান যাইতেছে।
টাকার অঙ্ক শুনিয়া চৌধুরী আলমের পিলে চমকাইয়া গলায় আটকাইয়া বাধিয়া গেলো
প্রথমে। কিন্তু এরচেয়ে যোগ্য পাত্রীও আর নাই। জার্মান পাসপোর্ট হইল একখানা
সারাজীবনের নিশ্চয়তাপত্র। টাকাটা ভাবিলেই শুধু চলিবে না। আজকাল পুলিশের সন্দেহ আর
উৎপাতও সাংঘাতিক বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু এতো টাকা তাহার হাতে সত্যই নাই। টাকা পাওয়া
মাত্রতো সে দেশে পাঠাইয়া দেয়। তাছাড়া যিনি এই বুড়ি জার্মান মেম যোগাড় করিয়া
দিয়াছেন তাহাকেও কিছু কমিশন দিতে হইবে। সেইটাও একদম ছোট কিছু না। যাহা ছিল তাহা
অগ্রীম দিয়া, বাকি টাকা মাসে মাসে পরিশোধ করিবে অঙ্গীকার করিয়া, পরিচিতজনদের
সাক্ষী রাখিয়া তাহারা কাগজপত্রে সই সাবুদ করিল। মাসে মাসে গভর্মেন্ট হইতে পয়সা আসা
মাত্র সে মেম বুড়ির হাতে নিজে যাইয়া টাকা দিয়া আসিতো। আর রেস্টুরেন্টে কাজ করিয়া
যাহা পাইতো তাহা প্রতি মাসে পিতার কাছে টাকা পাঠাইতে লাগিল। প্রথমে বন্ধকী জমি
ছুটাইতে পিতাকে অনুরোধ করিল। এই না শুনিয়া ভগ্নীপতি তেলে বেগুনে জ্বলিয়া গেলেন।
তাহার টাকা আটকাইয়া রাখিয়া এহেন মশকরা। বেঈমান শ্যালক আর তাহার চাইতেও ততোধিক
বেঈমান শ্বশুরের সাথে আর কোন সম্পর্কই রাখিবেন না তিনি। বিবাহের পর থাকিয়া এই
বাড়ির জন্যে কি তিনি কম কিছু করিয়াছেন? নাবালগ শালা শালীদের পড়াশোনা বিয়েশাদী
কোনটায় চুপ থাকিয়াছেন? নিজের আপন রক্তের ভগ্নীদের জন্যে যাহা তিনি করেন নাই, তাহার
চাইতে অনেক বেশি শালীদিগদের জন্যে করিয়াছেন। এই কর্মের এই প্রতিদান? কন্যার নিকট
এই সংবাদ শুনিয়া নিরুপায় পিতা প্রথমেই ছুটিলেন তাহার “বাড়ির মাথা” স্বচ্ছল বড়
জামাইকে ঠান্ডা করিতে। যাহাই হোক কিছু বড় জামাই এর হাতে গুঁজিয়া দিয়া তাহাকে
ঠান্ডা করিয়া আসিলেন পিতা। তিন চার বছর না ঘুরিতেই বিস্তর দেনা শোধ করিয়া ফেলিল
কৃতিমান ছেলে চৌধুরী আলম। আরো দেনা শোধ করিতে পারিত কিন্তু এইদিকে মেমবুড়িকেও মাসে
মাসে টাকা দিতে হয়। আজকাল মাঝে মাঝে এইটা ঐটা বায়না করে তাহাও সাথে কিনিয়া দিতে
হয়। হোক না কাগজের তবুও বউ বলিয়া কথা।
এর মাঝে আর এক অঘটন ঘটিয়া গেলো। মেম বুড়ির দেনা যখন প্রায় শোধ করিয়া
আসিয়াছে কোন দুর্বৃত্ত যাইয়া পুলিশের কাছে রিপোর্ট করিয়া দিলো। পুলিশ আসিয়া তাহাকে
মেম বুড়ির বাসায় না পাইয়া থানায় তলব করিল। সেই যাত্রায় বিস্তর মিথ্যা কথা বলিয়া
রক্ষা পাইলেও দুশ্চিন্তায় পড়িয়া গেলো। বারবার আল্লাহ বাঁচাইয়া দিবেন না। কিছু একটা
করা দরকার। সবার পরামর্শে সে মেম বুড়ির সাথে তাহার বাড়িতে থাকিতে লাগিল। ইহাতে আর
এক গোল বাধিল। সংসারের বিস্তর খরচাই বাড়ি ভাড়া, বিল আজকাল তাহাকে বহন করিতে হয়।
তাহার ওপর আছে মেম বুড়ির মদ, সিগারেট, দামি ফল, মাংসের খরচা। শুধু তাহাই নহে
মেমবুড়ি ঘরের কুটোটিও নাড়তে চায় না, রান্না হইতে শুরু করিয়া পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার
যাবতীয় গৃহস্থালী কাজও তাহাকেই করিতে হয়। নইলে মেম এমন অকথ্য জার্মান ভাষায়
গালাগালি শুরু করেন চিৎকার করিয়া যে ঘরে টেকাই দায় হইয়া পড়ে। হাড় কালা করিয়া
খাটিয়া যাহা রোজগার করিতো আজকাল মেমবুড়ির চাহিদা মিটাইতে তাহাও সুড়সুড় করিয়া বাহির
হইয়া যাইতো। বারবার সে তাহার অভীষ্ট লক্ষ্য হইতে দূরে সরিয়া বা পড়িয়া যাইতে লাগিল।
ঐদিকে বাড়ি হইতে পিতার নিদারুন তাগাদা ঋন শোধ করিবার জন্যে। চৌধুরী আলম কাহাকেও
কিছু কইতে পারে না, সইতেও পারে না। নিদারুন মানসিক পীড়নের মধ্যে তাহার কালাতিপাত
হইতে লাগল। কি করিবে উপায় না দেখিয়া সে, সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেট খাওয়া, আফটার
শেভ ব্যবহার করা, সস্তার জামা কাপড় পড়া ইত্যাদি শুরু করিয়া দিলো। ইহা করিয়া যে
কয়টা পয়সা সে বাঁচাইতে পারে। এইভাবে বছর পাঁচেক সময় লাগিল তাহার ঘরে বাইরে সমস্ত দেনা
শোধ করিতে। এবার কিছু নতুন ধানী জমি কেনাতে হাত দিবে মনস্থ করিয়া বাবাকে পত্র দিল।
প্রত্যুত্তরে তাহার পিতা জানাইলেন, ছোট বোন সেয়ানা হইয়া গেছে, জমি কেনার চাইতেও
তাহার বিবাহ দেয়া অতীব জরুরী। হাতে একখানা সুপাত্র আছে, সে টাকার বন্দোবস্ত করিলেই
তিনি শুভকাজে হাত দিতে পারেন। চৌধুরী আলম শুধু সম্মতিই দিল না, সমস্ত বন্দোবস্ত
সহকারে পিতাকে বারংবার বলিয়া দিল, বিবাহ এমনভাবে সম্পন্ন করিতে হইবে যেনো সবাই
বুঝিতে পারে চৌধুরী বংশের মেয়ের বিবাহ হইতেছে, জার্মান প্রবাসী চৌধুরী আলমের
ভগ্নীর বিবাহ হইতেছে।
সবার সম্মতিনুসারে বিরাট ধূমধামের মধ্যে দিয়া ভগ্নীর বিবাহ হইয়া গেলো। সোনা
গহনা, ফার্নিচার, খাওয়া দাওয়ার সমস্ত খরচ মিটাইতে চৌধুরী আলমের সে বছরের পুরা
রোজগার চলিয়া গেলো। চৌধুরী আলম আস্তে আস্তে খেয়াল করিতে লাগিল টাকা উপার্জন সে করে
বটে কিন্তু দেশ হইতে বাবা মা, ভাই, বোন, বোনের জামাইরা কি করিয়া তাহার টাকা খরচ
হইবে তাহা আগেই প্ল্যান করিয়া ফেলে। তাহার ইচ্ছা বা স্বাধীনতার কিংবা মতামতের
মূল্য সেখানে খুবই সামান্য। চিঠিতে তাহার স্বাস্থ্য, শরীর, মন, ঈদে সে কি খাইয়াছে
কিংবা কি করিয়াছে এধরনের শারীরিক মানসিক অবস্থার খোঁজ খবর নেয়া আজকাল প্রায়ই
নাইয়ের কোটায় গিয়া ঠেকিয়াছে। বরং চিঠি জুড়িয়া আজকাল বিশদভাবে লিখা থাকে আরো কিছু
টাকা হইলে আরো কিছু আরামের রসদ কিনিয়া তাহারা হয়তো আরো একটু আনন্দ করিয়া থাকিতে
পারিতো। সে কবে দেশে আসিতে পারিবে, আদৌ আসিতে পারিবে কি না, সে খোঁজটুকুও সেইভাবে
আজকাল আর কেউ নেয় না। প্রতিটি চিঠিতে সে এই লাইনটি খুঁজিয়া বেড়ায়, তোমাকে দেখিতে
ইচ্ছা করিতেছে, তুমি কবে বাড়ি আসিবে। কিন্তু লাইনটির সাক্ষাত আজকাল আর মিলে না। মা
নিজে পত্র লিখিতে পারেন না, ইহাকে তাহাকে ধরিয়া লিখান, মা হয়তো বলেন লিখিতে,
কিন্তু যাহা্রা লেখেন, তাহারা লেখেন না বা লেখাটা দরকারী মনে করে না। এইভাবে আশা
নিরাশায় দিন কাটিয়া রাত্রি আসে। রাত্রি কাটিয়া ভোর হয়।
এখন চৌধুরী আলম ভুল উচ্চারণে হইলেও বেশ কাজ চলিয়া যাইবার মতো জার্মান বলিতে
পারেন। বন্ধুরা বেশ গাড়ি হাকিয়া বেড়ায়। তাহারও বহুদিনের শখ, একটু গাড়ি চালাইয়া
দাপাইয়া বেড়াইবে। আস্তে আস্তে ড্রাইভিং এর কোর্স করিয়া নিয়া তিন চারবার অকৃতকার্য
হওয়ার পর ডয়েচ ড্রাইভিং লাইসেন্সও হাসিল করিলেন। মনের আনন্দ আর মনে থাকিতে চায় না।
প্রায় গাড়ি হাকাইয়া এই সিটি ঐ সিটি চলিয়া যান। পুরনো বন্ধু বান্ধবের সহিত সাক্ষাত
করেন, খোঁজ খবর করেন। বুড়ি মেমকেও হাত করিবার রাস্তা সে খুঁজিয়া পাইয়াছে। আগেরমতো
সব এতো দুর্বিসহ লাগে না। কিছুটা সহিয়া আসিয়াছে।
হাতে কিছু পয়সা জমিয়াছে, সাথে শরীরে কিছু মেদ। আর সপ্তাহে সাতদিন জানে
খাটিতে ইচ্ছে করে না। তাই কিছু ভাল কাপড় চোপড়ও খরিদ করিলেন। মাঝে সাঝেই ক্যামেরায়
নিজের ছবি তুলিয়া নিজেই মুগ্ধ নয়নে নিজের দিকে তাকাইয়া থাকেন। হাতে কাগজ আসিলেই
প্রথমে যে জিনিসটি তিনি করিবেন তাহা হইলো দেশে গিয়া একটি সুকন্যা দেখিয়া বিবাহ। মেম
বুড়ির সাথে ইহা নিয়া মাঝে মাঝে আলোচনাও করেন। মেমবুড়ির সুবাদে এখানেও তাহার কিছু
এদেশী বান্ধবী আছে, তাহাদের সাথে সময় সুযোগমতো মেলামেশা করেন তিনি। কিন্তু বিবাহের
একান্ত আশা আর্দশ বাংগালী রমনীকেই। জার্মান মেয়েরা যে খারাপ তাহা নহে, বরং
অনেকদিকে হয়তো দেশি মেয়েদের থাকিয়াও ভাল। কিন্তু মুসলমান না, কলেমা জানে না, পর্দা
করে না এগুলো আসলে সব বিরাট সমস্যা। এভাবেই প্রায় আট বছর তাহার কাটিয়া গেলো একাকী
সুদূর প্রবাসে। আট বছর পর পুলিশের কাছ হইতে বহু কাংখিত সেই চিঠি আসিয়া হাজির হইল,
যাহাতে লেখা আজ হইতে তাহাকে জার্মান দেশে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেয়া হইলো। সে
এখন চাহিলে এই দেশের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করিতে পারে। এই আনন্দে দিশেহারা হইয়া
চৌধুরী আলম প্রথমে জার্মানের বাঙ্গালী মসজিদে বিরাট আয়োজন করিয়া মিলাদ পড়াইল।
যথাসময়ে কাগজপত্র জমা দিয়া নাগরিকত্বের আবেদন করিয়া দিয়া দেশে আসার যোগাড়যন্ত্রে
মন দিল। বহুদিন কাটিয়া গেলো অনাথের মতো প্রবাসে, এইবার তাহাকে রুখিবে কে?
পিতাকে ফোন করিয়া এই সুসংবাদ জানাইয়া টেলিফোনে মাকে চাইলো। মা শুনিয়ে যারপর
নাই খুশী হইলেন, আল্লাহর দরবারে সিন্নী মানত করা ছিল তাহাও সামনের জুম্মাবারেই
মসজিদে পৌঁছাইয়া দিবেন বলিলেন। এবার লজ্জা লজ্জা গলায় চৌধুরী আলম কহিলেন, বিবাহের
বয়সতো তাহার প্রায় যায় যায়। তাহার জন্যে একখানা সুন্দরী, গুনী পাত্রীর সন্ধান
করিয়া রাখিতে, আসিয়া এইবার এই শুভকাজও সে সমাধা করিয়া যাইতে চায়। বিস্তর টাকা পয়সা
সে বাড়িতে পাঠাইয়াছে, ধুমধাম করিয়া বিবাহ করিবে, বাবাকে বলিয়া সব আয়োজন যেনো মা
করিয়া রাখেন। এইখানে বাঁধলো গোল। বাবার কানে কথা মা পৌঁছাইয়া দিলেন। বাবা কহিলেন
বিবাহ করিবে ঠিকাছে। কিন্তু টাকাপয়সাতো তিনার হাতে নাই। সমস্ত টাকা তিনি ব্যবসা,
জমিতে লাগাইয়া ফেলিয়াছেন। বিবাহের খরচ তাহাকেই যোগাইয়া আনিতে হইবে। তিনার দ্বারা
সম্ভব না। চৌধুরী আলম ইহা শুনিবা মাত্র প্রায় মূর্ছা যায় যায় অবস্থা। এই দশ বছরে
তাহার সঞ্চয় বলিতে কিছুই নাই। যাহা আয় করিয়াছিল নিজের কাছে এক কড়িও না রাখিয়া
সমস্তই পিতার কাছে পাঠাইয়া দিয়াছিল সরল বিশ্বাসে। আজ তার এই প্রতিদান। তাহার হৃদয়
চূর্ণ বিচূর্ন হইয়া গেলো। সে পণ করিলো ঠিকাছে নিজের দায়িত্ব নিজেই লইয়া সে দেশে
গমন করিবে। দ্বিগুন উৎসাহে ঝাপাইয়া পড়িয়া সে কাজে লাগিল আর প্রতিটি সেন্ট সে নিজের
কাছে রাখিয়া দিল। এখন থেকে টাকাই তাহার বাবা – ভাই – বন্ধু আপনজন। টাকা দিয়া সে
কাহাকেও আর বিশ্বাস করিতে রাজি না। বাড়িতে চিঠি লেখা, ফোন করা ইত্যাদি যোগাযোগ
তাহার কিঞ্চিত কমিয়া গেলো। মাসে মাসে আগের মতো মানিঅর্ডার না পাইয়া বাবা ভাই
ভগ্নীপতি তাহার প্রতি বেশ রুষ্ট হইলেন। অবশেষে পকেটভর্তি জার্মান মার্ক নিয়া প্রায়
তের বছর পর এক সকালে সে প্রথমবারের মতো স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলো।
অনেক অনেক বছর পরে দেশে আসিয়া বিমানবন্দরে আপনজনদেরকে দেখিয়া প্রথমে
বাকরুদ্ধ হইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। বাবা আরো কতো বুড়িয়ে গেছেন, মাকেও কেমন যেনো
কাহিল লাগছে। ছোট বোনটাকে এইটুকু দেখিয়া গিয়াছিল, তাহার বাচ্চা পায়ে পায়ে কাছে
আসিয়া তাহাকে মামা বলিয়া জড়াইয়া ধরিল। বিমানবন্দর হইতে মাইক্রোবাস রিজার্ভ করিয়া
সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইল, বাকি কুশলাদি কথাবার্তা পথে যাইতে যাইতে হইবে।
প্রথম কয়েকদিন চলিল সবার আনাগোনা, কুশল বিনিময়, দেখা সাক্ষাত পালা, উপহার
বিনিময়পালা। একটা ঘোরের মধ্যে চৌধুরী আলমের প্রথম কিছুদিন কাটিয়া গেলো। যখন তাহার
কানে উপহার সম্বনীয় কিছু অসন্তোষ আসিতে লাগিল তখন আস্তে আস্তে তাহার ঘোর কাটিতে
আরম্ভ করিল। সে একা উপার্জন দিয়া পরিবারের সবার জন্যে উপহার কিনিতে হইলে এমনিতেই
তাহার জন্যে অনেক, এরমধ্যে তাহার টিকিট, বিয়ের খরচ, টুকটাক সংসারের অন্যান্য খরচতো
আছেই। চৌধুরী আলমের মনে অনেক আশা ছিল তাহার পরিজন তাহাকে এতোদিন পর কাছে পাইয়া,
শুধু তাহাকেই ভালবাসিবে, সেই মূখ্য হইবে, উপহার হইবে গন্য। ভালবাসার কাছে
উপহার কি বস্তুর নাম? কিন্তু বাস্তবে উলটা
ঘটিয়া গেলো। এতো খরচা করিয়া, সাধ করিয়া, যে ছোট বোনের বিবাহ সে দিল, তাহার স্বামীর
জন্যে সে কোট নিয়া আসিয়াছিল জার্মান হইতে। প্রথম দেখিবে ছোটবোনের স্বামী বলিয়া
কথা। কাঁদো কাঁদো মুখে, সে কোট তাহার ছোটবোন ফেরত লইয়া আসিল। কহিল, এই কোটের জন্যে
সে স্বামী ও শ্বশুর বাড়িতে বিস্তর অপমানিত হইয়াছে। তাহারা গরীব বলিয়া ঠিক ততো গরীব
না যাহা তাহার ভাইজান ভাবিয়াছে। দুই চারিটা ভালো কাপড় চোপড় কোট প্যান্ট তাহাদেরও
আছে। এই ধরনের সস্তা কমদামী জিনিস দিয়া তাহাদের না অপমান করিয়া বরং কিছু না দিলেই
তাহাদের তাহারা খুশী থাকিতো। চৌধুরী আলম টাশকিত হইয়া নিশ্চুপ হইয়া গেলেন, আশি
মার্কের কোট তিনি নিজে কোনদিন পরিধান করেননি। দশ মার্কের ওপরে
কোন কাপড়ই তিনি নিজের জন্যে প্রথমাবস্থায় কিনেন নাই। সেই জায়গায় আশিটি মার্ক খরচ করিয়া কেনা কোটে
লোকে অপমানিত হইয়া গেলো। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। সে কোন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না।
কি করিয়া সে বিদেশে উপার্জন করে তাহাও কেউ তাহার কাছে জানতে চায় নাই। কি চাকুরী করিলে কতো টাকা রোজগার তাহা জানার প্রতিও কারো আগ্রহ নাই। সবাই ব্যস্ত তাহার কাছ হইতে কতো খসানো যায় সেই চিন্তায়।
No comments:
Post a Comment