Sunday 14 October 2012

ইংলিশ ভিংলিশ আর ডাচ ভাচ



খুব ছোটবেলা থেকেই আমি হার্ডকোর হিন্দী সিনেমা ভক্ত। একদম কুট্টিকালের সিনেমা জীবনই ধরতে গেলে শুরু হয়েছে ভিসিআর, ভিসিপি তারপর জিটিভি ভিটিভি সনি এলটিভি দিয়ে। এরমধ্যে জিতেন্দ্র মানে জিতুজী আর মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন সেই সময়ের প্রিয় নায়ক। জিতুজী নায়ক মানে নায়িকা হলো শ্রীদেবী কিংবা জয়াপ্রদা। জয়াপ্রদার মধ্যে আবার ভাল মেয়ে ভাল মেয়ে ভাব প্রবল আর শ্রীদেবীর মধ্যে একটা উইটি লুক ছিল যার ছিলাম আমি যাকে বলে ফিদা। মাওয়ালী সিনেমা এতোটাই ভাল লাগল, এতোটাই ভাল লাগল যে চান্স পেলেই রামা রামা রামা রামা রে। চান্স কি করে পাবো? গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ এলে কিংবা এমনিতেও কেউ বেড়াতে এলে, ভিসিআর দেখতে চাইতো। দেখতে চাইলেই হলো আমি আর ভাইয়া পটিয়ে পটিয়ে মাওয়ালী আর জাষ্টিজ চৌধুরী আনাতাম। পম পম, ছোটবেলা থেকেই নাচ গানের বিশাল ভক্ত তাও যদি হয় আবার জিতুজীর। একটা সময়ের পর সেই ক্রেজ আবার মধ্যগগনে আনিল কাপুর আর মাধুরী উড়িয়ে নিয়ে গেলেন।

আমরা যে শহরে থাকি, সে শহর বাদে অন্য অনেক শহরে হিন্দী সিনেমা মুক্তি পায় মাঝে মাঝে। কিছুদিন আগে মনে হলো এক থা টাইগার না দেখলে এ জীবন বৃথা। গেলাম রাতের শোতে দেখলাম এক থা টাইগার। ক্যায়া ফিল্ম হ্যায়। ফিল্ম কা মাফিক ফিল্ম হ্যায়। শেষ হওয়ার পরও আমার মনে হতে লাগল কেন শ্যাষ হয়ে গেলো? এতো ছোট কেন? আরো একটু বড় হওয়া দরকার ছিল। পাঠা সাল্লুকে আমার এতো অপছন্দ, ধরমজীর মতো ওর মধ্যে একটা ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার ভাব আছে। সেই দাবাং এর পাঠাকেও এই সিনেমা দেখে ক্ষমা করে ফেললাম। সকালের শোতে দেখলাম বারফি। সেটাও অসাধারণ লাগলো। রাজ কাপুরের নাতি রাজ কাপুরের নাক রেখেছে। ঐ দুই সিনেমায় ট্রেলার দেখিয়েছিল “ইংলিশ ভিংলিশ”। তখনই ভাবলাম, এই সিনেমা মিস করা যাবে না। অনলাইনে দেখলাম ইংলিশ ভিংলিশ। আর একবার ফিদা হলাম শ্রীদেবীর কিন্তু তারচেয়েও বড় ফিদা হলাম, সিনেমার কাহিনীর। অনেক অনেক বছর আগে যখন এই ডাচল্যান্ডে উড়ে এসেছিলাম এক অক্ষর ডাচ না জেনে, কিভাবে এখানে সারভাইভ করেছিলাম সেগুলো অনেকদিন পর আবার স্মৃতির মনি কোঠায় ঝলক দিয়ে গেলো।

কফিশপের দৃশ্যটা যে কি সত্যি, সেটা যারা এই পরিস্থিতিতে পড়েননি তারা অনুভব করতে পারবেন না। প্রথম কথাতো দেশে সবসময় সব ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের সাথে একজন থাকে। একা কোথাও ছাড়ে না বলতে গেলে। আর এখানে আসা মাত্র, এসে গেছিস যা চড়ে খা। তারপর অন্যদেশের পয়সা চিনি না। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি নিজের টার্ন এলে কি চাই, কতোটা চাই, কিভাবে চাই গুছিয়ে মনে মনে দশবার রিহার্সেল দিয়ে রেখেছি। অথচ যে না নিজের টার্ন আসলো, নার্ভাসনেস আর সামনের ক্যাশে বসা আছেন যিনি তার অর্ধেয্য তাড়াতে যা বলবো তা ভুলে গেছি। ডাচ ভুলে টেনশনে ইংরেজীতে বলা শুরু করেছি। পয়সা দিতে গিয়ে বেড়াছেড়া অবস্থা। কতোদিন বাসা থেকে বলে দিয়েছে, পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে, ইউ টেক ইয়োর টাইম। কিন্তু পরদেশে, অজানা অচেনা লোক, ভাষা সংস্কৃতি যে কিভাবে আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়, ভুক্তভোগী ছাড়া তা কেউ উপলব্ধি করবেন না। অথচ সবাই উপদেশ দিতেন এভাবেই ডাচ প্র্যাক্টিস করতে হবে, এভাবেই মূলধারার জীবনের সাথে মিশে যেতে হবে।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এসেছি এখানে এসে এক অক্ষর সংবাদপত্র পড়তে পারি না। উলটে পালটে ছবি দেখে অনুমান করার চেষ্টা করি, কি আছে ওতে লেখা কি হতে পারে। শুধু অক্ষর জ্ঞান ছিলো বলে, পত্রিকা উলটো করে ধরিনি, সোজা দিকটাই ধরে রাখতাম। কি কষ্ট আর কি কষ্ট। বাজার করতে পারি না। সারাদিন ডিকশনারী ঘাটতে ঘাটতে মাথা ব্যাথা করে। অনেক স্পাইসের ইংরেজী নামওতো জানি না যে ডাচ ট্রান্সলেশন খুঁজবো। তখন ইন্টারনেটে এতো ইনফরমেশন গুগল ট্রান্সলেটর, গুগল ম্যাপ কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের কিছু খুঁজতে গেলে কি মুশকিল ছিল। ইয়াহু আর একটা কি যেনো সার্চ ইঞ্জিন ছিলো তা দিয়ে খুঁজতে যেতাম, মাত্র বাংলাদেশে কিংবা বাংলায় ওয়েবসাইট বানানো শুরু হয়েছে যাকে বলা চলে। মিনিমাম সব ইনফরমেশন দিয়ে নাম কা ওয়াস্তে সব ওয়েবসাইট। টিভি মানে শুধু বিবিসি কিংবা সিএনএন, ডিস্কোভারী কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফীক চ্যানেল। হয় যুদ্ধ দেখো নয় পশুপাখি। মাঝামাঝি আছে এমটিভি। আরো আছে ফ্রান্স চ্যানেল, টার্কিস চ্যানেল, জার্মান চ্যানেল কিন্তু ডাচ সাবটাইটেল দেয়া।

তবে শ্রীদেবী মানে শশীযে একবারে নিজে নিজে ম্যাপ মিলিয়ে ভাষা শেখার স্কুলটা খুঁজে পেয়েছে সেটা বেশ অবাক লাগলো কিন্তু অসম্ভব না। এটা হতেও পারে কারো বেলায় আবার নাও হতে পারে। এতোটা সাহস কেউ করবে কিনা সেটাও হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কতো জায়গায় জেনে বুঝে এড্রেস নিয়ে যাওয়া সত্বেও টেনশানে ভুল স্টপেজে নেমে পড়েছি। বাসের বোতাম না টিপলে বাস থামবে না সেটাও জানতে ছয়মাস লেগে গেছে। ডাক্তার, ঔষধ আর অন্য বিড়ম্বনার কথা নাহয় নাই বললাম। তবে শেষটায় শ্রীদেবী মানে শশীর আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার দৃশ্যটা খুব মধুর লেগেছে। কামনা করি এরকম অনেক শশীই যারা পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এভাবে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাক। নিজের গন্ডীর মধ্যে জীবনকে জয় করে নিক। অনেক অনেকদিন পর শ্রীদেবীকে শশীরুপে দেখে খুব ভাল লাগলো। শশীর মাঝে নিজেকে দেখে আরো আপন লাগলো।

তানবীরা
১৪.১০.২০১২


No comments:

Post a Comment