Saturday 1 June 2013

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (তৃতীয় পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=5993f554cae2c2e223665fb434e22aab

চৌধুরী আলম শেষ পর্যন্ত এক বড় ভাইকে ম্যানেজ করিলেন তাহার দোকান পাহারা দিবার জন্যে। ঐ বাঙালি বড় ভাই বহুদিন ধরিয়া জার্মানি আছেন। বেকার সাজিয়া সরকারের ঘর হইতে সরকারি ভাতা তুলেন আবার এমনি বাহিরে অন্যান্য সকলের বিপদে আপদে পয়সার বিনিময়ে সাহায্য তথা উপকার করিয়া থাকেন। বিশ্বস্ততার জন্যে বাঙালি সমাজে উনার প্রায় আলআমিন পর্যায়ের খ্যাতি আছে। মাসিক একখানা মাসোহারার মৌখিক চুক্তি করিয়া, অন্যান্য বন্ধুবর্গের আশ্বাসে কিছুটা নিশ্চিন্ত হইয়া, সারাজীবনের সম্বলখানি অন্যের জিম্মায় রাখিয়া, নানাবিধ উপহার সামগ্রী লইয়া প্রায় সাত বছর পর চৌধুরী আলম পরিবারের সহিত দেখা করিবার উদ্দেশ্যে স্বদেশের পানে রওয়ানা হইলেন। প্লেনে বসিয়া নানাবিধ কল্পনা তাহার মনে রঙ ছড়াইলো, স্ত্রী তাহাকে দেখিয়া কিরূপ ব্যবহার করিবে? সাত বছর হইয়াছে বটে বিবাহের কিন্তু সাত মাসও একসাথে সংসার হয় নাই। সেকি এখনো সেই লাজুক বধূটি আছে? কন্যা তাহাকে চিনিতে পারিবে কি পারিবে না? পিতামাতার সাথে এতোদিন পর সাক্ষাৎ, কেমন আছেন তাহারা? অনেক কি বুড়িয়ে গেছেন? এইরকম সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে তাহার চোখ কখন যেনো লাগিয়া আসিল। আধো ঘুমে আধো জাগরণে পুরো যাত্রা কাটিয়া গেলো আশা আর আকাঙ্ক্ষার দোলাচলে।

বিরাট কোন ঝামেলা ছাড়াই সমস্ত মালপত্র বুঝিয়া পাইয়া তিনি এয়ারপোর্ট হইতে বাহির হইলেন। তাহাকে বরণ করিতে পিতামাতা, শ্বশুর শ্যালক, স্ত্রী কন্যা সকলেই এয়ারপোর্টে উপস্থিত হইয়াছেন দুই গাড়ি সমেত। দেখিয়া তাহার প্রাণ ভরিয়া গেলো। কন্যাকে কাছে ডাকিলে লাজুক মুখে আগাইয়া আসে আবার লজ্জা পাইয়া পালাইয়া যায়। বুকে জড়াইয়া ধরিতে পারিতেছেন না। সকলেই সান্ত্বনা দিলেন, নতুনতো পরিচিত হইলেই বাবার কোলে ঝাপাইয়া পড়িবে। বাবা বলে কথা, রক্তের টান, যাইবে কোথায়? তাহাকে বরণ করিতে তাহার বাটি হইতেও সবাই শ্বশুর বাড়িতে জড়ো হইয়াছেন। রান্না খাওয়া সারা বাড়িতে উৎসবের আমেজ লাগিয়া রহিয়াছে। নিরিবিলিতে যে একটু স্ত্রীর সহিত কথা কহিবেন সে সুযোগও পাইতেছেন না। তিন চারদিন এইভাবে কাটিয়া গেলে, পিতামাতা কহিলেন, কখন বাড়ি যাইবে সে? দুই চারিদিনের মধ্যেই স্ত্রী কন্যা নিয়া বাড়ি আসিবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিতামাতাকে বাড়ি পাঠাইয়া দিলেন চৌধুরী আলম।

আরো দু’চারি দিন বিশ্রাম লইয়া চৌধুরী আলম স্ত্রীকন্যাসহ একখানা মাইক্রোবাস ভাড়া করিয়া নিজ গ্রামে উপস্থিত হইলে, তাহাকে দেখিতে সমস্ত গ্রাম ঝাটাইয়া লোক আসিল। বিদেশ ফেরত চৌধুরী আলম ও তাহার শহরবাসী স্ত্রীকন্যাকে দেখিয়া অনেকেই গোপন ঈর্ষায় লাল হইলেন, মুখে যদিও অন্য কথা কহিলেন। আন্তরিকতার সহিত তাহার খোঁজ খবর লইলেন, তাহাকে কারণে অকারণে তাহাদের কতো মনে পড়ে সেই গাঁথাও জানাইলেন। শ্রেণীভেদে এই শ্রেণীর লোকদের তিনি পঞ্চাশ টাকা-একশ টাকা নজরানা দিলেন। এইভাবে প্রথম কয়েকদিন কাটিয়া গেলো। পিতা আগেই খোঁজ রাখিয়াছিলেন কোথায় কোথায় ধানি জমি বিক্রয় হইবে। একটু অবসর হইতেই পুত্রের সহিত সেই সমস্ত নিয়া বিস্তর আলোচনা করিলেন। পুত্রকে সাথে করিয়া সেইসব জমি দেখিয়া দরদস্তুর করিয়া বায়না করিলেন। পকেটে অনেক কাঁচা টাকাতো ছিল, জমিই ভবিষ্যত পিতার এই অমূল্য উপদেশ স্মরণ করিয়া তাহাতে কোন দ্বিধা রাখিলেন না। আশে পাশে দশ গ্রামে ছড়াইয়া গেলো, চৌধুরী আলম প্রায় জমিদারি খরিদ করিতেছেন, টাকা কোন বিষয় না তাহার কাছে। এরমধ্যেই গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব আসিলেন তাহার কাছে। মসজিদের উন্নতির জন্যে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। সেইখানেও নগদে পঞ্চাশ হাজার টাকা সাহায্য করার ওয়াদা দিলেন। ইহা শুনিয়া চৌধুরী আলমের পিতা কিঞ্চিৎ গোস্বা হইয়া পুত্রকে প্রশ্ন করিলেন-
আমাকে না জানাইয়া এরকম ওয়াদা দিবার মানে কি?

পুত্র উত্তর দিলেন- পিতাজী, শুধু জমি কিনিলেই চলিবে? অত্র এলাকায় মানসম্মান ইজ্জত কামাইতে হইবে না? মসজিদে দান করিলে যতো দ্রুত সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তি হইবার সুযোগ থাকে, শত বিঘা জমি কিনিয়াও তাহা পারিবেন না।

পুত্রের বুদ্ধি দেখিয়া পিতাজী গর্বে আর রা করিতে পারিলেন না। দুইহাত খোদার দরবারে তুলিয়া শোকরানা আদায় করিলেন।

হুজুর তারপরের জুম্মাবারের খুতবায় বারংবার চৌধুরী আলমের নাম স্মরণ করিলেন। জুম্মা শেষ হইতেই সমাজের বিশিষ্টজনের সামনে চৌধুরী আলম তাহার পিতাজীকে সাথে লইয়া পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল মসজিদের ইমাম হুজুরের হাতে দিলেন। ঠিক হইলো, মসজিদের বাইরের দেয়ালের একপাশে চৌধুরী আলমের নাম দানবীর হিসাবে খুদিয়া রাখা হইবে। সমাজে তাহার তথা চৌধুরী পরিবারের ইজ্জত আর একদফা আকাশ স্পর্শ করিল।

চৌধুরী আলমের এইরূপ টাকার খোলামকুচি খেলায়, টাকা দিয়া ইজ্জত কিনিবার নেশায় তাহার স্ত্রী মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট হইতেছিলেন। গ্রামে এসব করিয়া কি লাভ হইবে? সব যাইবে বারো ভূতের পেটে। তাহারা কি গ্রামে আসিবেন? অথচ স্বামী আসিবার পূর্ব হইতেই বাবার সহিত কতো শলা-পরার্মশ ছিল তাহার, এই ঢাকার এককোনে ছোট একফালি জমির, মেয়ে বড় হইতেছে, তাহার ভবিষ্যত। ইহা লইয়া এক প্রত্যুষে স্বামীর সহিত তাহার কিঞ্চিৎ বচসা হইয়া গেলো।

স্ত্রী গম্ভীর মুখে কহিলেন, এইখানে জমি কিনিয়া কি হইবে? আপনার কি ভবিষ্যতে গ্রামে চাষবাস করিবার ইচ্ছা নাকি? তাহা হইলে শহরের কন্যা বিবাহ করিবার কি প্রয়োজন ছিল?
কোন ব্যাপারে প্রায় রা না করা স্ত্রীর মুখ হইতে এহেন বাণী শুনিয়া চৌধুরী আলম প্রায় স্তব্ধ হইয়া গেলেন প্রথমে। তাহার পর নিজেকে সামলাইয়া লইয়া কহিলেন, জমিজমা না কিনিলে, আমি যে এখন এতো ধনী হইয়াছি, তাহা দশগ্রামের লোকে জানিবে কি করিয়া? নাম কামাইতে হইলে, সমাজে বিশিষ্ট স্থান পাইতে হইলে কি লোককে জানাইতে হইবে না? বিষয় সম্পত্তি লাগিবে না?

কান্না মাখা গলায় স্ত্রী কহিলেন, শুধু লোকের জানাই আপনার কাছে সব? আমার আর আমার কন্যার ভবিষ্যত?

এইবার কিঞ্চিৎ বিপাকে পড়িয়া গেলেন চৌধুরী আলম। আস্তে আস্তে কহিলেন, আস্তে ধীরে টাকা পয়সা জমাইয়া শহরে বাড়ি তিনি নিশ্চয়ই করিবেন। ইহা নিয়া এতো ব্যস্ত হইবার এখনই কিছু নাই। জীবনতো আর শেষ হইয়া যায় নাই। শহরে বাড়ি করিলেতো আর এখানকার মতো সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তি হইতে পারিবেন না। শহরের পাড়ায় পাড়ায় নিশ্চয়ই তাহার ধন সম্পদের চর্চা লোকে করিবে না।

স্ত্রী খানিক বুঝিলেন খানিক বুঝিলেন না। খানিক মানিলেন আর খানিক মানিলেন না। এইখানে বাধা দিয়া পারিবেন না বুঝিতে পারিয়া ছল করিয়া চৌধুরী আলমকে লইয়া বাপের বাড়ি আসিয়া উঠিলেন আবার। বাবাকে ধরিয়া পড়িয়া কহিলেন স্বামীকে বুঝাইতে। স্বামী বুঝিলো বটে কিন্তু সাথে আনা টাকার বিরাট অংশ তিনি গ্রামে জমিদারী জুটাইতে খরচ করিয়া ফেলিয়াছেন, হাতে যাহা আছে তাহাতে ঢাকায় জমি হইবে না। তাহার পরেও শ্বশুরের পরামর্শে আর স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে তিনি একখন্ড জমি দেখিতে গেলেন। জমি পছন্দ হইয়া গেলো, পরে যদি না পান, কিংবা দাম বাড়িয়া যায়? তাই শ্বশুরের পরামর্শে হাতে থাকা বাকি টাকা দিয়া তিনি সেই জমি বায়না দিলেন, জার্মানি যাইয়া বাকি টাকা পরিশোধ করিবেন এই অঙ্গীকারে। এইভাবে মনের সুখে, বড়লোকি আয়েসে কাটিয়া গেলো তিন চার মাস। এইবার আবার ফিরিয়া যাইবার পালা।

ফিরিয়া গিয়া আবার সেই পরিশ্রম, দোকান, ব্যবসা। যদিও এখন মানসিকভাবে অনেক সুখী। যাহাই হোক জীবনে কিছু অর্জন করিয়াছেন তিনি, কঠোর পরিশ্রম কাজে লাগিয়াছে। জমিজামার বিস্তর ছবি উঠাইয়া সাথে লইয়া গেছেন, সুযোগ পাইলেই গুনগুন করিয়া একা একা গান করেন আর ছবি দেখেন, নিজে দেখেন, পরিচিত কেউ দোকানে আসিলে তাহাদিগকেও দেখান। কারো বাড়িতে অনুষ্ঠানাদিতে নিমন্ত্রিত হইলে সেখানেও লাজুক মুখে ছবির এ্যালবামখানি সাথে লইয়া যান। তিনি এখন আর একজন অগাবগা কেউ নন, এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি বলিয়া কথা। কঠিনভাবে কৃচ্ছ সাধন করিয়া পয়সা জমাইতে লাগিলেন আর দেশে পাঠাইয়া ঢাকার জমির দাম পরিশোধ করিতেছিলেন। কিন্তু সবকিছু সবসময় নিজের ইচ্ছামাফিকতো হয় না, বিধির বিধানও থাকে। হঠাৎ করিয়া বিরাট কোন রোগ শোক ছাড়াই চৌধুরী আলমের শ্বশুর ইন্তেকাল করিলেন। জমির মালিকের দিলে রহম কম, তিনি এখন আর অপেক্ষা করিতে চাহিলেন না, বাকি টাকা এককালীন পরিশোধ করিতে তাগাদা দিলেন, নইলে তিনি জমি অন্য জায়গায় বিক্রয় করিয়া দিবেন বলিয়া জানাইলেন। তিনিতো আর তাহাকে জমি বিক্রি করেন নাই, তিনি চিনিতেন তাহার শ্বশুরকে। ভীষণ বিপদে আবার চৌধুরী আলম। শ্বশুরবাড়িতে তাহার মানসম্মানের ফালুদা বাহির হয় হয় অবস্থা। স্ত্রী কান্নার হেঁচকির জন্যে ফোনে কথা কহিতে পারেন না। ভাইয়ের বউদের সামনে তাহার এমন লজ্জা অপমান। উপায়ন্তর না পাইয়া স্থানীয়ভাবে ঋণ করিয়া ঢাকার জমির ধাক্কা সামলাইলেন চৌধুরী আলম।

জমির পর শুরু হইলো আর এক নয়া ঝামেলা। স্ত্রী বাপের বাড়িতে আর থাকিতে চাহেন না। বাবা না থাকিলে আবার কিসের বাবার বাড়ি। ভাইদের সংসারের গলগ্রহ হইয়া কি তিনি আর তার কন্যা জীবন পার করিয়া দিবেন? বিদেশের মুখ, সংসারের মুখ দেখিবার সাধ কি তাহাদের হয় না? চৌধুরী আলম বার বার বুঝানোর চেষ্টা করিলেন, বিদেশ বলিতে দেশ হইতে মানুষ যাহা বুঝে আসলে সেইরকম কিছু ব্যাপার নহে। প্রচুর খাটুনি ও খরচ। কিন্তু তাহার স্ত্রী নাছোরবান্দা। মাঝে মাঝে কন্যাও সেই গানে যোগ দিয়া পিতাকে আরো বিপদে ফেলে। উপায়ন্তর না দেখিয়া চৌধুরী আলম কহিতে বাধ্য হইলেন, ঢাকার জমির ঋণ শোধ না হইবা পর্যন্ত তাহাদের জার্মান আনিয়া বাসা করিয়া রাখার সামর্থ্য তাহার নাই। মনোমালিন্যের মধ্যে কয়েক বৎসর পার করিলেন। জমির ঋণ শোধ করিলেন। চৌধুরী আলমের কি ইচ্ছা করে না পরিবার সাথে রাখিতে? কিন্তু আবার নানান কথা ভাবিয়াও থাকেন তিনি। এখানে আনিলে কন্যা জার্মান ভাষা শিখিবে, ইহুদি নাসারাদের মতো পোশাক আশাক পরিধান করিবে, বাবা মাকে হয়তো মান্য করিবে না, দেখা যাইবে গোরার সহিত ভাগিয়া গিয়াছে, উহ আর কল্পনা করিতে পারেন না। স্ত্রীকে এইগুলা বুঝাইবার বহু চেষ্টা করিয়াছেন। আল্লাহপাক তাহাদেরকে ছেলে সন্তানতো দেন নাই, বংশের মর্যাদা ভাবিতে হইবে না? ঢাকাতেই বাপের বাড়ির কাছে আলাদা বাসা ভাড়া লইয়া দিবেন কহিয়াছেন, মেয়ের ইজ্জত তাহাদের ইজ্জত নিয়া কহিয়াছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হইলো না। স্ত্রীর এক কথা, আরো মানুষ কি থাকিতেছে না? শীঘ্রই লইয়া যাও।

চৌধুরী আলম বহুভাবে বলিবার চেষ্টা করিলেন, পরিবার সাথে থাকিলে এখন যেমন তরতর আগাইতেছেন, পয়সা জমাইতেছেন, সেই সুযোগ আর থাকিবেনা। পরিবার থাকা মানেই বহু খরচ। ইহাতে ফল হইলো উলটা। স্ত্রী কাঁদিয়া কাটিয়া সন্দেহের তীর ছুড়িয়া কহিলো, তিনি শুনিয়াছেন, বিদেশে অনেক পুরুষই একখানা করিয়া বিদেশী বউ রাখে আর দেশে রাখে একখানা। তাহার কি সেইরকম কেইস নাকি? তাহা হইলে যেনো তিনি জানাইয়া দেন, স্ত্রী আর তাহাকে কাঁদিয়া পেরেশান করিবে না। চৌধুরী আলম সুখে যেনো বিদেশী বউ লইয়া ঘরকন্না করেন, তিনি আর পথের কাঁটা হইবেন না। চৌধুরী আলমের চরম অনিচ্ছা থাকা সত্বেও দাম্পত্য কলহের কারণে তাহাকে পরিবার আনতে রাজি হইতে হইলো। স্ত্রীর কান্নায় পরাস্ত হইয়া তাহাদেরকে আনিবার কাগজপত্র ঠিক করায় মনোনিবেশ করিলেন। তাহাকে এখন সরকারের ঘরে বহু টাকার কর গুনিতে হইবে, মূর্খ মেয়েছেলে তাহার কি বুঝিবে? এতোদিন তিনি ব্যবসায় লোকসান দেখাইয়া আয়কর থেকে স্বাস্থ্যবীমা, বাড়িভাড়া, তাহার জ্ঞানের মধ্যে যাহা আছে সবকিছু ফাঁকি দিয়াছেন। এখন প্রথমে তাহাকে পরিবার আনিবার অনুমতি করানোর জন্য সরকারকে দেখাইতে হইবে তিনি স্বচ্ছল। একমাসের আয় দেখাইয়া এই অনুমতি মিলিবে না। কমপক্ষে তিন থেকে ছয়মাসের কাগজপত্র চাহিবেন তাহারা। সন্দেহ করিলে আরো বেশিদিনেরও চাহিতে পারেন। একমাসে আয় যেমন অনেক বাড়াইয়া দেখাইতে পারিবেন না, পরের মাসে আবার আয় অনেক কমও দেখাইতে পারিবেন না। পরিবার পালন করিবার মতো যথেষ্ট আয় না থাকিলে পরিবার আনার অনুমতি মিলিবে না। আর এই যথেষ্ট আয়কে সেট করিতে বহুটাকার আয়কর গুনিয়া তাহাকে আপাতত ফতুর হইতে হইবে। এতোদিন জার্মান সরকারের সহিত ইঁদুর বিড়াল খেলিয়া চলিয়া গিয়াছে। সেইদিন এখনকার মতো ফুরাইলো। এইসব ভাবিলেই তাহার মুখ তিতা হইয়া বুকে বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু হইয়া যায়।

দোকানের ওপরের ফ্ল্যাটখানার জন্যে বহুদিন ধরিয়া বাড়িওয়ালার নিকট ধর্ণা দিয়াছিলেন তিনি। এতোবছর বাদে আল্লাহ মুখ তুলিয়া চাহিলেন। ভাড়াটিয়া বিদায় হইলে বাড়িওয়ালা তাহার আবদার পূরণ করিলেন। এইবার প্রায় পাঁচ বছর বাদে দেশে আসিয়াছেন তিনি। স্ত্রী কন্যাকে সাথে লইয়া যাইবেন, পাসপোর্ট ভিসার হাঙ্গামা লইয়া ব্যস্ত তিনি। কন্যার বয়স এখন বারো, ক্লাশ ফাইভে পড়ে। বারো বছরে কন্যার সহিত তাহার এই লইয়া দুইবার দেখা। কন্যাকে দেখিলে তাহার বুক ধড়ফড় করে। বাড়ন্ত গড়ন, বয়স বারো কিন্তু দেখায় চৌদ্দ পনের। কি করিবেন, কি বিপদে পড়িবেন এই সমস্ত দুঃশ্চিন্তায় তাহার ঘুম হারাম। ঐদিকে স্ত্রী কন্যা মনের সুখে বাজার করিতেছেন বিদেশ যাওয়াকে উপলক্ষ্য করিয়া। স্ত্রী’র সহিত আলোচনা করার চেষ্টা করিয়াও তিনি ক্ষান্ত দিয়াছেন, তাহার এই সমস্ত সম্পর্কে কোন ধারণাই নাই বলিয়া আলোচনা আগাইতে পারে না। এমনিতে ইহুদি নাসারাদের ওপরে তাহার সেইরকম ঘৃণা নাই, সবাই আল্লাহর তৈরি। শুধু আখিরাতে কেউ যাইবে বেহেস্তে আর কেউ যাইবে দোজখে, এটাই কথা। কিন্তু তিনি তাহার পরিবার নিয়া সর্বাবস্থায় ঈমানের রাস্তায় থাকিতে চান। তারচেয়েও বড় কথা, কন্যাসন্তান হইলো পরিবারের মর্যাদা। তাহা নষ্ট হইলে কিভাবে সমাজে মুখ দেখাইবেন? এতো বড় চৌধুরী বংশের সম্মানের কথা তিনি ভাবিবেন নাতো কে ভাবিবে?

শুয়োর খাওয়া ছেলেমেয়ের সহিত একসাথে পড়িয়া তাহার কন্যার মতিগতি কোন দিকে যাইবে কে জানে? ইসলামিক মনোভাব কায়েম থাকিবেতো? কিছু কিছু দেশী পরিবারের এই অশান্তিতো তিনি নিজ চোখে দেখিতেছেন। আর এই নাছারা স্কুলে নিজের অধিকার, মর্যাদা, কোথায় গেলে কি সাহায্য পাওয়া যাইবে, বিপদে পড়িলে কোথায় যাইতে বা ফোন করিতে হইবে সব শিখাইয়া পড়াইয়া দেয়। ছেলেমেয়েকে ঠিকমতো শাসনও করা যায়না ইহাদের জ্বালায়। বাবামায়ের সাথে মনোমালিন্য হইলেই ছেলেমেয়েরা আঠারোতে পা দিয়াই বাটির বাহিরে থাকিতে শুরু করে। বাধা দিবার কোন উপায় নাই, তাহারা পুলিশের সাহায্য নিবে দরকার হইলে। বাবামায়ের কোন শাসন বারণই শোনে না। এইসব ভাবিয়া ভাবিয়া তিনি ঠিক করিলেন, স্কুলই যেহেতু সকল নষ্টের গোড়া, তিনি কন্যাকে স্কুলে পড়াইবেন না। বাটিতে বসিয়া সে নিজে পড়াশোনা করিবে, তাহার পর দেশে আসিয়া ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়া যাইবে। যাহা ভাবা তাহাই কাজ। দেশ হইতে এস.এস.সি পরীক্ষা পর্যন্ত যতো বই, নোটবই আছে সব কিনিয়া সাথে লইলেন। তাহার পর এক প্রত্যুষে তাহারা পুরো পরিবার জার্মান দেশের উদ্দেশ্য প্লেনে উড়িলেন।

No comments:

Post a Comment