Saturday 1 June 2013

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (চতুর্থ পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=f26126351f269a9a4f38d76bb2ffd7f9&nttl=160468

কিন্তু ঘর ভাসিয়া যাইতেছিল সুখ আর আনন্দে। চৌধুরী আলমের স্ত্রী ও কন্যা জার্মান দেশে যাহা দেখিতেজার্মানি আসিয়া প্রথম কিছুদিন কাটিয়া গেলো নিজেদেরকে একটু সুস্থির করিতে। বিভিন্ন অফিসে বিভিন্ন রকমের দৌড়াদৌড়ি, বীমা, সরকারের বিভিন্ন খাতায় স্ত্রী কন্যার নাম উঠানো ইত্যাদি প্রভৃতি ঝামেলা লইয়া। পাইতেছেন তাহাতেই মুগ্ধ হইয়া যাইতেছেন। আর সারাক্ষণ মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, কি পাষাণ লোক চৌধুরী আলম, এই সুখ স্বাচ্ছন্দ হইতে এতোদিন তিনি তাহাদেরকে বঞ্চিত করিয়াছেন। একটু ধূলা নাই বালি নাই, মেশিনখানা টিপিয়া ধরিলেই ঘর পরিষ্কার হইয়া যায়, কল টিপিলেই গরম পানি – ঠাণ্ডা পানি, মেশিন ঘুরালেই ঘর গরম হইয়া উঠে, সুইচ টিপিলেই আগুন বাহির হয়। আহা, বেহেস্তে কি ইহা হইতে বেশি আরাম? গাড়ি চড়িয়া এদিক সেদিক যাইতেছেন, ট্রলি ঠেলিয়া বাজার করিয়া আনিতেছেন, ঠিক যেমন সিনেমায় বড়লোকেরা করিয়া থাকেন। কোন আক্কেলে চৌধুরী তাহাদেরকে কহিতেছিল, বিদেশ মানে নানাবিধ যন্ত্রণা? তাহারা তো এইখানে যন্ত্রণার লেশমাত্রও পাইতেছেন না, বরং এতো সুখ দুনিয়ায় লুকাইয়া আছে তাহাই তাদের অজানা ছিল এতোদিন। মহানন্দে চৌধুরী গিন্নী সংসার সাজাইতে মন দিলেন এইবার। বিবাহ হইয়াছে সেই কবে, কিন্তু সংসার পাইলেন তিনি আজ। তাহার নিজের সংসার, যাহার তিনি একচ্ছত্রী কর্ত্রী। এতোদিন বাপের সংসার ভাইয়ের সংসারে ভাসিয়া বেড়াইতেছিলেন তিনি। এইবার খুঁটির নাগাল পাইলেন।

চৌধুরী আলমও তাহার নিজের কাজে কর্মে আস্তে আস্তে মনোনিবেশ করিলেন। ওপরে বাসা নীচে দোকান সমস্ত কিছুই তাহাদের হাতের মুঠোয়। দোকানে ভিড় হইলে স্ত্রীকে ওপর হইতে ডাকাইয়া পাঠান, স্ত্রী আসিয়া সব্জি ওজন করিয়া, মাছ কাটিয়া দিয়া তাহাকে সাহায্য করিয়া থাকেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চৌধুরী আলম দেখিলেন বউকে যাহা ভাবিয়াছিলেন অবলা অকর্মন্য তিনি মোটেই তাহা নহেন। বউ বেশ চটপটে, গুণী। সুন্দর করিয়া মানুষের সহিত গুছাইয়া কথা কওয়া, নিজে নিজে কাজ করিবার মতো বুদ্ধি সে ধরে। প্রথমে স্ত্রী কন্যা আসিলে খরচ বাড়িয়া যাইবে, ভাষা জানিবে না, পড়াশোনা জানে না, ইহাদেরকে কে দেখাশোনা করিবে, তিনি ইহাদের দেখাশোনা করিলে দোকানদারী কখন করিবেন ইত্যাদি ভাবিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছিলেন। এখন দেখিলেন বাস্তবে তাহার বহু ভাবনায় উলটো ফল হইয়াছে। রান্নাবান্না, কাপড় ইস্ত্রী, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, দোকানদারী বহু কিছুতেই স্ত্রী কন্যার সাহায্য পাওয়া যায়। তাহার আর আগের মতো কষ্ট নাই বরং বেশ খানিকটা আরাম করিতে পারেন। আগে দোকান ফেলিয়া অনেক সময় বাজার করিতে যাওয়াও কষ্টকর ছিল, কাহাকে বসাইবেন দোকানে নইলে দোকান বন্ধ করিয়া যাইতে হইতো। আর আজকাল তিনি মাঝে মধ্যে বেশ এদিকে ঐদিকে ঘোরাফেরা করিয়া আড্ডা দিয়া আসেন। পঞ্চব্যাঞ্জন সহকারে ভোজন করিয়া পরিপাটি বিছানায় সুখের নিদ্রা যান এই ভাবিতে ভাবিতে জীবনটা আসলে খারাপ নহে। সত্যি কহিতে কি তাহার সুখে পরিচিত অনেকে এখন ঈর্ষা করিতেছে তিনি বেশ অনুভব করিতে পারেন। আরো দশ বছর পূর্বে হইতে স্ত্রী নিয়া বসবাস করিতেছেন, এমন অনেকের স্ত্রীই এখনো মানুষের সহিত ঠিক করিয়া কথা কহিতে পারেন না, আর তাহার স্ত্রী দোকান সামলাইতেছেন ছয় মাসের মধ্যে, ঈর্ষার ব্যাপার বইকি তো নয়।

যেইরকম ভাবিয়াছিলেন কন্যাকে স্কুলে দিবেন না, বাসায় পড়াইবেন। সেইরকম কন্যা বাসায় থাকে। টিভিতে, ভিসিআরে সারাক্ষণ হিন্দী সিনেমা, সিরিয়াল দেখিতে থাকে। মাঝে মধ্যে অবশ্যই বাবা মায়ের তাড়া খাইয়া সে পুস্তক নাড়াচাড়া করিয়া থাকে, পাঠ করে না ধ্যান করে তাহা খুঁজিয়া তলাইয়া দেখিবার কেহ নাই। কন্যা বইপুস্তক সামনে রাখিয়া টেবিলে বসিয়া থাকিলেই পিতামাতা তাহারা তাহাদের কর্তব্য করিতেছেন ভাবিয়া অত্যন্ত খুশী। এইভাবেই দিন কাটিয়া যাইতে ছিল হাসিখুশী আর আনন্দে। কিন্তু এইখানে বাধ সাধিল ভিলেন জার্মান সরকার। ষোল বছর বয়স অব্ধি এইখানে স্কুলে যাওয়া প্রত্যেক বাচ্চার জন্য বাধ্যতামূলক। সেই অনুযায়ী সরকার স্কুলকে বাৎসরিক অর্থ প্রদান করিয়া থাকেন, কোন স্কুলে কতোজন বাচ্চা। বাচ্চার বাবা মা কতোদূর পড়াশোনা করিয়াছেন, তাহারা বাচ্চাকে বাসায় কি ধরনের সাহায্য দিতে পারিবেন, বাচ্চার অন্যকোন ধরনের শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যা আছে কিনা, সেই সমস্তের ওপর ভিত্তি করিয়া স্কুলের বাৎসরিক বাজেট নির্ধারণ করা হইয়া থাকে। সরকারের খাতায় শিশুর নাম উঠাইয়া দিয়া, সরকারের ঘর হইতে বাচ্চার ত্রৈমাসিক ভাতা উঠানো হইতেছে বটে কিন্তু সরকার এই শিশুকে কোন স্কুলে খুঁজিয়া পাইতেছেন না। বছর শেষে যখন শিশুভাতা আর বিদ্যালয়ের হিসাব মিলিতেছে না তখন সরকার ঘটনা কি খুঁজিতে পুলিশ লাগাইলো।

এক প্রাতে পুলিশ বেল টিপিয়া দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলো। দুয়ারে পুলিশ দেখিয়া হৃদকম্পন শুরু হইয়া গেলো চৌধুরী আলমের। কি কারণে কি অপরাধ কিছুইতো বুঝিতে পারিতেছেন না। আজকালতো মোটামুটি সামান্য হলেও নিয়মিত আয়কর তিনি পরিশোধ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঘটনা কি? কন্যা লইয়া পুলিশের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নাস্তানাবুদ হইয়া গেলেন, কন্যা ভাষা জানে না, দেশের কায়দা কানুন রীতিনীতি জানে না, সেজন্য তাহাকে এখনো স্কুলে দেন নাই, দিবার কথা ভাবিতেছিলেন, ইত্যাদি ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা কহিলেন বিপদ সামলানোর জন্যে। সামনের সেশন হইতে কন্যাকে স্কুলে দিবেন স্বীকার আসিয়া তিনি মুচালেকা দিলেন। আর জার্মান নাগরিক হইয়া কন্যাকে স্কুলে না পাঠাইয়া রাষ্ট্রের যেই আইন তিনি ভঙ্গ করিয়াছেন তাহার জন্য তাহার বিস্তর জরিমানা হইবে সেইটা কোর্টে তাহাকে বুঝিতে হইবে বলিয়া রিপোর্ট করিয়া পুলিশ বিদায় হইলো। জরিমানা আর মামলার ভয়ে চৌধুরী আলমের বক্ষ ভাঙ্গিয়া পড়িলেও তাহার কন্যা মনে মনে খুবই পুলকিত হইলো। আসিয়া অবধি সে কোথাও যাইতে পারিতেছে না। এক এই ঘর আর দোকান আর দোকান আর ঘর। একা কোথাও ঘুরিয়া দেখিবার অবকাশ নাই, কাহারো বাটিতে যাইবার অনুমতি নাই, কি এক বন্দী জীবন। এইবার হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। হোক বিদেশী, রঙ অন্য, ভাষা জানে না তাহাতে কি, শিখিয়া লইবে। তবুওতো সমবয়সী, একসাথে পড়াশোনা করিলে নিশ্চয় কেহ কেহ তাহার বন্ধু হইবে, তাহাদের সহিত গলাগলি করিয়া মনের ভাব আদান প্রদান করিবে। তের বছর বয়সে সারাক্ষণ মা-বাবা আর বাবা-মা কাহার ভালো লাগে? প্রথমে জার্মান আসিয়া চকচকে গাড়ি, পরিপাটি সাজানো বাড়ি, ঝলমলে শপিং মল ইত্যাদি দেখিয়া যতো ভালো লাগিয়াছিল, দিনের পর দিন একা থাকিয়া সেই মুগ্ধতা এখন অনেকটাই হ্রাস পাইয়া গিয়াছে।

ইহার মধ্যে একদিন চৌধুরী আলম প্রত্যুষে বাড়ি হইতে টেলিফোন পাইয়া খুবই অবাক হইলেন। টেলিফোন সাধারনতঃ একতরফা উনি বা উনারাই করিয়া থাকেন আত্মীয় পরিজনদের। ঐদিক হইতে টেলিফোন আসে না কহিলেই চলে। প্রথমে তিনি খুবই ঘাবড়াইয়া গেলেন, বাবা মাকে লইয়া কোন অশুভ সংবাদ নহে তো আবার।

অপরপ্রান্তে খুশীর আওয়াজ পাইয়া কিঞ্চিত শান্ত হইয়া ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসিলেন, কি সংবাদ। অপরপ্রান্তে তাহার বড় ভ্রাতা ছিলেন। তিনি কহিলেন, তাহার বড় কন্যার বিবাহ ঠিক হইয়াছে। পাত্র জেলা সদরে থাকে, ওখানকার বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক, মানী বংশের গুণী ছেলে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনিয়া চৌধুরী আলম খানিক দমিয়া গেলেন, ইহা কি আর এমন ভালো পাত্র। মাস্টার মানেই ভাতে পানিতে মরা। বেতন পায় কি পায় না, ইহার কি কিছু ঠিক আছে?

বড় ভ্রাতা আশ্বস্ত করিলেন, সেই সমস্ত দিন আর নাই। এখনকার শিক্ষকরা বড়ই সুপাত্র, কোচিং প্রাইভেট করাইয়া অনেক রোজগার করিয়া থাকেন। কন্যা ইষৎ বেটে তাহার ওপর নকলের ঝাঁজে ম্যাট্রিকের দুয়ার পাড়ি দিলেও সামনে আর আশা নাই। এই কন্যার জন্য এই পাত্র মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।

এমন মানী পাত্রকে মানসম্মানমতো কিভাবে সম্মান করিবেন সেই বুদ্ধি করিতে তিনি ফোন করিয়াছেন। তাহারা নিজেরা এতো উচ্চবংশ, এলাকার বিশিষ্টজন, তাহাদের বড় কন্যার শুভবিবাহ, এভাবেতো ছাড়িয়া দেওয়া যায় না। কাহার ভাতিজি তাহাতো সকলেই জানে নাকি?

চৌধুরী আলম এই কথা শুনিয়া আমতা আমতা করিয়া কহিলো, তাহাকে কি করিতে হইবে?
বড় ভ্রাতা উৎফুল্ল কণ্ঠে কহিলেন, তাহাকে বিশেষ তেমন কিছুই করিতে হইবে না। এখানে সকলেই আছেন, তাহারা সবাই মিলিয়া যোগাড়যন্ত্র যা হয় করিয়া ফেলিবেন। তিনি যদি লাখ তিনেক টাকা অতিসত্বর পাঠাইয়া দেন তাহা হইলে বড় উপকার হইতো। বিবাহ মানে শত কাজ আর পয়সা ছাড়াতো কেহ নড়িবে না।

এককথায় এতো টাকা অতিসত্বর তিনি কোথায় পাইবেন? তিনি এখন পরিবার লইয়া থাকেন, রোজগারতো একই আছে কিন্তু খরচ বাড়িয়া গিয়াছে তিনগুণ। মন চাইলেও এতোটাকা এতো কম সময়ে পাঠানো তাহার পক্ষে সম্ভব নহে, আকুল কণ্ঠে কথাগুলো কহিলেন চৌধুরী আলম।
বড় ভ্রাতা, তাহাকে ভুল বুঝিলেন। সংসারের এই সময়ে তাহার কাছে এইরকম ব্যবহার তিনি প্রত্যাশা করেন নাই। এতো বছর চৌধুরী আলম বিদেশে থাকেন, সংসারের কতোজনের জন্য তিনি কতো কি করিয়াছেন, বড়ভাই হিসাবে কি মুখ ফুটিয়া তিনি কোনদিন কিছু তাহার কাছে চাহিয়াছেন? আজ যখন পরিবারের সম্মানের জন্য তাহার কাছে মুখ খুলিলেন তাহার এই ব্যবহার? ঠিক আছে, চাই না তাহার টাকা, পারিবারিক জমিতে তো তাহারও অধিকার আছে, সেই অধিকার এইদিনে কাজ আসিবে নাতো কোনদিন আসিবে? সম্মান বাঁচিলে বাকি সব দেখিয়া লইবেন তিনি। রাগত ও আহত হইয়া ফোন ছাড়িয়া দিলেন।

চৌধুরী আলম ফোন ছাড়িয়া দুঃখে স্তব্ধ হইয়া লক্ষ্য করিলেন, বড়ভাই তাহাকে একবারের জন্যও দেশে আসিতে, বিবাহে উপস্থিত থাকিতে কহিলেন না, ডাকিলেন না। অথচ সবার বড় ভাতিজি, কতো না আদরের সহিত তাহাকে লইয়া চৌধুরী আলম হাটে গঞ্জে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ঘাড়ে লইয়া ছড়া কাটিতেন। বুকের সহিত মিশাইয়া কলিজায় করিয়া আপন কন্যা জ্ঞানে স্নেহ করিয়াছেন তাহাকে। সবাই শুধু টাকার দরকারে তাহাকে স্মরণ করে, উৎসবে তাহার উপস্থিতি অনাবশ্যক? তাহার কি মন চাইতে পারে না অন্যান্য ভাইদের সহিত মিলিয়া কন্যাকে বধূ সাজাইয়া বিদায় করেন?

বিশাল মনোকষ্টে তাহার বক্ষ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু মুখ খুলিবার উপায় নাই। মুখ খুলিবেনতো কোথায় খুলিবেন? এমনিতেই খরচাপাতি লইয়া সংসারে নানান খিটিমিটি চলিতে থাকে। স্ত্রী যদিও বা কিছুটা বুঝেন কিংবা বুঝের ভাব দেখান, কন্যার সাথেতো কথাই কওয়া যায় না, ফসফস জ্বলিয়া ওঠে। সারাক্ষণ ঘরে হিটিং জ্বালাইলে কতো বিল আসিবে তাহা সম্পর্কে কোন ধারণা তো নাই উলটা বলিয়া ওঠে, আমাদের খরচের এতো গা জ্বালা হইলে আনিলা কেনো জার্মান, এতো জনম যেইভাবে ফেলাইয়া ছিলা, সেইভাবেই রাখিয়া দিতা। তোমার কাছেতো টাকাই সব, স্ত্রী কন্যা কি? চৌধুরী আলম দিনে রাতে অনুভব করিতে লাগিলেন, হঠাৎ করিয়া তের বছরের কন্যার পিতা হইয়া যাওয়া কোন সহজ কর্ম নহে। তাহার কোন ধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিল না এই সম্বন্ধে। টেলিফোনে কন্যার খোঁজখবর রাখিয়া আর্দশ পিতা হওয়া আর একসাথে বাস করিয়া কন্যাকে মানুষ করা পুরাই ভিন্ন ব্যাপার। তিনি আর নির্দয়ের মতো কহিতে পারেন না, আনিতে তো চাহি নাই, তোমাদের পীড়াপিড়িতে রাজি হইতে হইলো। এতো যে চৌধুরী আলম খরচের ব্যাপারে কহেন, কন্যার ভ্রূক্ষেপও নাই। সমানে বাথটাবে পানি খরচ, বিভিন্ন কারণে বিদ্যুৎ খরচ চালাইয়া যাইতেছে। কথায় কথায় বাক্যবান এড়ানোর জন্য বরং তিনি কিছুটা চুপ থাকার চেষ্টা করেন। কিছু না হইতেই কন্যার ভালো লাগে না, পরদেশে তাহার মন বসে না। মাঝে মাঝে চৌধুরী আলমের সন্দেহ হয়, এরমধ্যে স্ত্রীও হয়তো কিছুটা জড়িত আছেন। কি করিলে ভালো লাগিবে?

তাহারা সাজিয়া গুজিয়া বাহির হইবেন বাজারে। ভালো লাগার ইহাই প্রধান স্থান। প্রথমে কহিবেন, কেনাকাটা কিছুই করিবেন না। দোকানে ঘুরিবেন আর ঘুরিবেন, দেখিবেন। কিন্তু পরে দেখা যাইবে বহুবিধ জিনিস তাহাদের সত্যিই দরকার, যাহা ছাড়া চলা যাইতেছে না কিংবা চলা ভীষণই মুশকিল। ইহার পর দেখা যাইবে দুইজনে দুই দুই চার ব্যাগ বাজার লইয়া দোকান হইতে বাহির হইতেছেন। তাহার পর তাহাদের আইসক্রিম কিংবা ম্যাকডোনাল্ডস কিংবা ডোনার কাবাব জাতীয় কিছুর ক্ষিদা পাইয়াছে। আর ইহার মধ্যে সারাক্ষণই ছবি তোলার হিড়িক লাগিয়া রহিয়াছে। দোকানের রংবেরং এর ডেকোরেশনের সামনে, এলিভেটরের ওপর দাঁড়াইয়া, কফির কাপ সামনে লইয়া, সিটি সেন্টারের ভিতরে–বাইরে কোথায় না ছবি না তুলিলেন তাহারা। নতুন সাজ পোশাক ক্রয় করা আর উহা পরিধান করিয়া ছবি তোলা প্রায় রেওয়াজে দাড়াইয়া গেলো। তিনি অবাক হইয়া প্রথম প্রথম জিজ্ঞাসিতেন, এতো ছবি কি হইবে? স্ত্রী কন্যা গম্ভীর মুখে উত্তর দিতেন, দেশে পাঠাইবেন। তাহারা যে বিদেশে সুখে শান্তিতে আছেন, এই ছবিগুলো হইলো তাহারই প্রতিচ্ছবি। সবাইকে সেই সুখ দেখাইতে হবে না? এই সমস্ত খরচাপাতি যে সব নগদ পয়সায় করিতে হয়, আর সপ্তায় সপ্তায় এতো নগদ খরচ করিবার মতো আয় যে তাহার দোকানে হয় না ইহা বুঝিবার মতো মানসিকতা তাহাদের কিছুতেই হয় না যার ফলশ্রুতি অশান্তি, মনোমালিন্য আর চোখের পানি। এইদিকে কন্যা সারাক্ষণ মুচরাইতে থাকে, তাহাকে এখনো জার্মান দেশখানা ঘুরাইয়া দেখানো হইলো না। বান্ধবীগণদের নিকট কতো গল্প শুনিয়াছে, বইতে – টিভিতে কতো ছবি দেখিয়াছে আর এইখানে আসিয়া আজ এতো দিন হইতে চলিল কোন দর্শনীয় স্থানের মুখ দেখিতে পারিল না।

একদিকে স্ত্রী কন্যা অন্যদিকে পরিবারের চাপ। কিছুটা লুকাইয়া কিছুটা গোপন সঞ্চয় ভাঙ্গিয়া আর কিছুটা ধার করিয়া দুই লক্ষ টাকা পাঠাইয়া বড় ভাইয়ের বাড়িতে ফোন করিলেন, ক্রুদ্ধ বড়ভাই ফোন ধরিলেন না। ক্রন্দন বুকে চাপিয়া রাখিয়া চৌধুরী আলম বড় ভাবির সহিত কুশলাদি বিনিময় করিলেন ও দুই লক্ষ টাকা পাঠানোর সংবাদখানা পৌঁছাইলেন। কিরূপে কি কার্য সমাধা হইতেছে, সব ঠিক করিয়া হইতেছে কিনা খুটাইয়া খুটাইয়া সেই সংবাদগুলানোও সংগ্রহ করিলেন। আর অবাক বিস্ময়ে আবারো লক্ষ্য করিলেন, না ভাবি না ভাতিজি একবারের তরে কহিলেন, “তিনি আসিলে কতো না ভালো লাগিত। কিংবা তিনি কি আসিতে পারেন না জাতীয় কিছু? টাকা পয়সা ব্যাতিরেকে কি সকল সর্ম্পকই ফুরাইল তাহার পরিবারের সহিত? মায়ের জন্যে এতো মন পুড়িয়া যায়। মাকে টেলিফোন করিয়া স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, মা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বাতের বেদনা, পিত্ত দাহ, ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসা ব্যয়, গ্রামে চিকিৎসা আর চিকিৎসকের অপ্রতুলতা নিয়া কতো শত কথা কহিয়া যান। কিন্তু তাহার কান দুইখানি অপেক্ষা করিয়া থাকে, তিনি কেমন আছেন এইকথা মা কখন জিজ্ঞাসিবেন সেই আশায়। কিন্তু মা নিজের কথা কহিতেই ব্যাকুল তাহাকে শুধান না তেমন কিছুই। হয়তো ধরিয়াই নিয়াছেন বিদেশ মাত্রই সর্বসুখ, পুত্র ভালোই আছে।

কয়দিন ধরিয়াই চৌধুরী আলমের স্ত্রীর শরীরখানা তেমন ভালো যাইতেছে না। খাওয়া দাওয়ার রুচি কমিয়া গিয়াছে, গা ম্যাজ ম্যাজ ভাব, কিছু না হইতেই মেজাজ করিয়া ওঠেন, এমনিতে তিনি যথেষ্ট নম্র স্বভাবের। কয়েকদিন অপেক্ষা করিলেন, ভাবিলেন আপনি সারিয়া যাইবে। একদিন দুর্বলতার কারণে মাথা ঘুরিয়া যাইতে চৌধুরী আলম ভাবিলেন অপেক্ষা করিয়া কাজ নাই, ডাক্তারের নিকট যাওয়াই ভালো হইবে। বলাতো যায় না কিসের মধ্যে কি হইয়া যায় আবার। ডাক্তার এর নিকটতো গেলেন কিন্তু স্ত্রী ঠিক করিয়া তাহার সমস্যা ডাক্তারকে বুঝাইয়া কহিতে পারিতেছেন না। স্ত্রী না কহিতে পারেন জার্মান ভাষা আর না কহিতে পারেন ইংরেজি। তারপর তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ও জার্মান মিলাইয়া ডাক্তারকে বুঝাইয়া কহিলেন। ডাক্তার সব শুনিয়া প্রস্রাব, রক্তচাপ পরীক্ষা করিয়া, নিশ্চিত হইলেন যে তাহার স্ত্রী আবার মা হইতে চলিয়াছেন। এই সংবাদের চৌধুরী আলম যারপর নাই আনন্দিত হইলেন। অনেকদিন ধরিয়া একখানা পুত্রের আশা তাহার। মেয়ে পরের জিনিস, পরের ঘরে চলিয়া যাইবে, মেয়েতে তাহার আর কি উপকার হইবে? পুত্র পাশে থাকিয়া কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া তাহাকে ব্যবসা বানিজ্যে সাহায্য করিবে। তবেই না সন্তান। আশেপাশের ভাবিদেরকে সুসংবাদ জানাইয়া, অন্য দোকান হইতে মিষ্টি ক্রয় করিয়া সবাইকে বিতরণ করিলেন। এইবার তাহাদের দুইজনেরই একখানা পুত্রের আশা। সেইজন্য নিয়ম করিয়া দুইজনেই পাঁচবেলা নামাজ পড়িতে লাগিলেন, খোদার কাছে কাকুতি মিনতি করিতে লাগিলেন, একখানা সুপুত্র আমাদেরকে দাও রাহমানুর রাহিম। বলা তো যায় না কাহার ডাক তিনি কবুল করিবেন। আশায় বুক বাঁধিয়া অপেক্ষায় দিন গুনিতেছেন চৌধুরী পরিবার।

No comments:

Post a Comment