Thursday 16 April 2015

মনে পড়ে ঃ ফেরদৌসী মজুমদার






পড়লাম ফেরদৌসী মজুমদারের লেখা আত্মজীবনী ‘মনে পড়ে’। বনেদি, ধনী মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিলো তাঁর ১৯৪৩ সালে। চৌদ্দ ভাইবোনের সংসার ছিলো তাদের, তিনি ছিলেন এগারো নম্বর। বেশ কড়া শাসন আর আধুনিকতার মিশ্রণে ছিলো তার পারিবারিক জীবন। কবীর চৌধুরী, শহীদ মুনীর চৌধুরীর বোন তিনি, বাকি ভাই বোনেরাও সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত, রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান তারা। আত্মজীবনীতে তিনি তার পারিবারিক ঘটনা বেশ অকপটেই বলেছেন, সে-জিনিসটা আমার ভাল লেগেছে। আমার নিজের ছোটবেলাও কেটেছে মুসলিম রক্ষশীল পরিবারে। আমি তার পরিবার দিয়ে কিছুটা যেনো নিজের পরিবারটাই দেখতে পেলাম। মাথায় কাপড় দেয়ার জন্যে, পর্দায় থাকার জন্যে মেয়েদেরকে শাসন, সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরতে দেরি করা নিয়ে ছেলেদেরকে শাসন, পড়াশোনা নিয়ে মারধোর, অশান্তি, হয়তো তখন ঢাকার ঘরে ঘরে এরকমই গল্প ছিলো...


তখনো এতো লোক ঢাকায় বাস করতো না। গ্রামের দু একটি সচ্ছল পরিবারের দুএকজন ঢাকায় থাকে। প্রায়ই দেখা যেতো গ্রাম থেকে কেউ না কেউ, কোন না কোন প্রয়োজনে কিংবা কখনো স্রেফ শহর দেখার জন্যে ঢাকা চলে আসত এবং যারা ঢাকায় থাকে তাদের বাসায় উঠে যেতো। অনেকটাই “মান ইয়া না মান, ম্যায় তেরা মেহমান” টাইপ অবস্থা। ফেরদৌসীদের বাড়িও তার ব্যতিক্রম ছিলো না, তা নিয়ে ফেরদৌসী লিখেছেন, “বাবার দিকের লোকজন এলেই আম্মা সচেতনভাবে ওদের একটু সেবা-যত্ন করতেন। ওরা এলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের থাকা খাওয়ার একটু অসুবিধে হতো। বাড়িতে এলে বিছানায় উঠে যেত ওরা, মাটিতে নেমে যেতাম আমরা।............. কিন্তু এসব ঘটনা থেকে আমার মনে যেটা দাগ কেটেছে এবং যে উপসংহারে উপনীত হতে আমি বাধ্য হয়েছি-সেটা হচ্ছে দেশের বাড়ির প্রায় অশিক্ষিত লোকগুলো বড় সঙ্কীর্ণমনা হয়। এদেরকে সন্তুষ্ট করা বড় কঠিন। এদের ভিলেজ পলিটিক্সটা বড় মারাত্ক। বিচিত্র স্বভাব, বিচিত্র মনমানসিকতা। তাই গ্রামীণ সরলতার পাশাপাশি গ্রাম্য সঙ্কীর্ণতার কথাটিও ভুললে চলবে না।”


যতোটা আগ্রহ নিয়ে বইটি শুরু করেছিলাম বইটা ঠিক ততোটা আশা পূর করতে পারে নি। সত্তরের শুরুতে রামেন্দু-ফেরদৌসীর বিয়ে হয়। সেসময়ে দুজন ভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষ পারিবারিক সম্মতি নিয়ে সংসার পাতছেন, সে খুব বিরল একটা ঘটনা। তাঁর ভাষাতেই, “মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে কদাচিৎ শোনা যেতো, কিন্তু মুসলমান মেয়ে হিন্দু ছেলে বিয়ে করেছে শোনা যেতো না”। কিন্তু এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু লিখেন নি তিনি। আমার দৃষ্টিতে, এটি খুব উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা যা বাংলাদেশের মানুষের জানার দরকার ছিলো। এই অন্ধ, বধির সমাজে, মৌলবাদী জনগোষ্ঠীর মত পরিবর্তন করতে এ ধরনের ঘটনার বিশদ প্রচারের প্রয়োজন আছে। প্রথমে পরিবার রাজি ছিলো না, পরে রাজি হয়েছে তার দৃঢ়তা দেখে শুধু এটুকুই লিখেছেন তিনি। সামাজিকভাবে কী ধরনের বাধাবিঘ্ন এসেছে বা আত্মীয় স্বজনদের কিভাবে মানালেন তা নিয়ে কিছুই লিখেন নি। তাঁর নিজের পরিবার ছাড়াও রামেন্দুর পরিবার ছিলো, রামেন্দুর সমাজ ছিলো, তাদের আচর তাঁর প্রতি কেমন ছিলো, তারা তাকে কিভাবে গ্রহ করেছিল সে-সম্পর্কেও একটি কথা নয়! তাঁর সুখ-শান্তির সংসারের কিছু বিবর সমাজকে জানানো তাঁর দায়িত্ব ছিলো বলে অন্তত আমি ভাবি।


রামেন্দু মজুমদারকে অনেকবার আমি পত্রিকায়, টিভিতে অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে দেখেছি। ফেরদৌসীকেও আমি বিভিন্ন প্রগতিশীল, বক্তব্যধর্মী নাটকে মঞ্চে ও টিভিতে অভিনয় করতে দেখেছি। এই পরিবারটি সম্পর্কে আমার ধারনা খুব অন্যরকম ছিলো। কিন্তু ফেরদৌসীর বইটি আমাকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে। আমি কিছুটা অংশ বই থেকে হুবহু তার ভাষাতেই তুলে দিলাম,

“ধর্ম নিয়ে জহুর ভাই অনেক পড়াশোনা করেছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলাম সব ধর্ম বিষয়ে মোটামুটি পড়েছেন। শুনেছি বৌদ্ধধর্ম তাঁর ভাল লেগেছিল। এমনকি গৌতম বুদ্ধের মতো গাছের নিচে ধ্যানে বসতে চেয়েছেন। প্যাগোডা না পেয়ে ২-১ দিন নাকি ধ্যানের উদ্দেশ্যে গাছের নিচেও বসেছিলেন। ১৩ – ১৪ বছর বয়সে বোধহয় বৌদ্ধধর্মের বিশ্বাসটা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। পরে গৌতম বুদ্ধের জীবনবিমুখতা তাঁর কাছে ভালো লাগলো না। জীবনের ঝঞ্ঝাট থেকে পালিয়ে বেড়ানো তিনি সমর্থন করেন না। কিন্তু এটা সত্য তিনিই বলেছেন, একসময় তাঁকে Buddist Qayyum ও বলা হতো। খ্রিষ্টান ধর্ম তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ১৪ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রোমান ক্যাথলিক হয়েছিলেন। তিনি ত্রিপিটকও পড়েছেন। কোনো ধর্মেই যখন শান্তি পাচ্ছিলেন না তখন তিনি কমিউনিস্ট হয়ে গেলেন। সেসময় তাকে Qayyum the Communist  বলা হতো। বেশ কয়েক বছর তিনি ও নামেই সুপিরিচিত ছিলেন, কিন্তু ওতেও শান্তি পেলেন না তিনি। অবশেষে নিজের সেই ধর্মে ইসলামের দিকে ঝুঁকলেন। সেটা হয়েছে আব্বা তাঁকে ইসলামের মর্ম বুঝিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলেন এবং সেটা পড়েই তিনি কোরান শরিফ পড়া শিখেছিলেন। আব্বা তাঁর জন্যে মৌলবী রেখে দিয়েছিলেন – নিজেও পড়াতেন; কিন্তু জহুর ভাই মৌলবীকে ফাঁকি দিয়ে প্রজাপতি ধরতেন। ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে মৌলবীর চাকরি নট। সম্পূর্ণভাবে আব্বা নিজে পড়াতে শুরু করলেন। সেই যে কোরানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জন্মালো তা আর কোনদিন কমে নি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। জহুর ভাই ইসলাম ধর্মের আর কোরানের বাণীর এমন আধুনিক ব্যাখা দেন যা অনেকেরই অজানা। কোরানের গূঢ় তত্ত্ব এবং কোরানের বাণীর নির্যাসটা তিনি আহরণ করেছেন এবং জীবনে তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন।

যখনই কোথাও কোনো ভাষণ দিয়েছেন ঠিক জায়গাতে কোরান থেকে ঠিক আয়াতটি বা শব্দটি বেছে নিয়েছেন। কোয়েটাতে একবার এক লেকচারের আগে তিনি কোরানের কিছু অংশ আবৃত্তি করেছিলেন। কোয়েটা কলেজের তৎকালীন Chief instructor এফএসকে লোদি এটার বিরুদ্ধে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলেন। তারে জহুর ভাই ভ্রুক্ষেপ হয় নি, তিনি তাঁর চেতনায়, তাঁর বিশ্বাসে অনড় ছিলেন এবং অনেক পাঞ্জাবিও তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাঙালির বুদ্ধিমত্তা, বাঙালির মনমানসিকতারই জয় হয়েছিল সেদিন।“ 
  

এতোটা গোঁড়া চিন্তাভাবনা আর মানসিকতা যার তিনি সেই যুগে কী করে একজন ভিন্নধর্মীর গলায় মালা দিলেন! যার মনে নিজ ধর্ম নিয়ে এতোটা শ্রেষ্ঠত্ব আর গরিমা কাজ করে তিনি অন্য ধর্মের কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, ভাবতেও কষ্ট হয় আমার। যে সময়ে মেয়েদের স্কুলে থাকতেই বিয়ে হয়ে যেতো, সে সময়ে তিনি ডবল এম।এ করে টিভিতে নাটক করতেন, এ বইটি পড়ে আমার সেটা ভাবতেও কষ্ট হয়। ধর্মের কাছে কী সত্যি তাহলে শিল্প-সাহিত্য, প্রগতিশীলতা অসহায়? এতো আধুনিক জীবন যাপন করে এমন রক্ষনশীল চিন্তা ভাবনা মনে রাখা কতোটা পরস্পরবিরোধী।


তবে পুরো বইয়ের কোথাও ফেরদৌসী তার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খুব বিশদে লিখেন নি যেটা আত্মজীবনী লেখার অনেকটা মূলধারা বলে ভাবা হয়। তিনি তাদের পারিবারিক ঘটনাবলীই লিখে গেছেন। অনেকটা খাপছাড়া, ধারাবাহিকতা নেই। এক এক সময়, এক এক ঘটনা। পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক, সত্তরের দশকের পর্যায়ক্রম অনুপস্থিত। সাংস্কৃতিমনা, শিক্ষিত পরিবারের ঘটনাবলী থেকে সমাজ পরিবর্তনের, রাজনৈতিক আন্দোলনের, মুক্তিযুদ্ধের যে-ধারাবাহিকতা আসার কথা ছিলো তাও নেই। যার কারণে ছোট থেকে বড় হয়ে-ওঠা ফেরদৌসীর বিশদ কিছু চিত্র এখানে পাওয়া যায় না। শেষের দিকে তাদের চৌদ্দ ভাইবোনের জীবনের সারমর্ম লিখেছেন, সবার প্রেম-বিয়ে-সংসার নিয়ে লিখেছেন। তারমধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত তার নিজের কাহিনি, যার মধ্যে প্রেম-বিয়ের কিছু নেই, শুধু আছে রান্না করতে জানতেন না, সেটা শিখেছেন আর তাঁর মেয়ের কথা! হয়তো এ-কারণে, বইটি ঠিক যতোটা আলোচনায় আসার কথা ছিলো, ঠিক ততোটা আলোচনায় হয়তো আসে নি। কিন্তু বইটিতে অনেক তথ্য আসার সুযোগ ছিলো। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনকে তুলে ধরার একটি দলিল হতে পারতো এই বইটি। সে-হিসেবে বইটা আশা জাগিয়েও ব্যর্থতার ছায়ামাখা একটা সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটিয়ে গেলো।

গত গ্রীষ্মের ছুটিতে বইটি যথারীতি উপহার পেয়েছিলাম ছোটভাই আরাফাত শান্ত থেকে।

তানবীরা
১৫/০৪/২০১৫




No comments:

Post a Comment