Monday 27 July 2015

লিখেছি কাজল চোখে

কাল শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করলাম, কিন্তু ঘুম আর এলো না কিছুতেই। উঠে এক কাপ চা বানালাম খুব নিঃশব্দে, বাড়ির আর কারো যাতে ঘুম ভেঙে না যায় চায়ের মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম, ওমা!!! দেখি কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! কিন্তু কী জানো? এতো সুন্দর চাঁদকে ঠিক আমার মতোই নিঃসঙ্গ লাগলো এতো তারার ভিড়ে।

মাথায় হঠাৎ ভাবনা কিলবিল করে ওঠা আমার পুরনো রোগ, তুমিতো জানো। সবাই চাঁদকে নিয়ে কী কাড়াকাড়ি করে, প্রেমিকাকে চাঁদের সাথে তুলনা করে, কবিতা লিখে, গান করে কিন্তু কেউ কি কখনো চাঁদের নিঃসঙ্গতা নিয়ে ভাবে? ভাবে সে কতোটা একলা? কতোটা কষ্ট হয় তার একা একা এভাবে বছরের পর বছর মিথ্যে হাসি মুখে নিয়ে প্রহরগুলো কাটাতে? ভাবতে ভাবতে আবার চাঁদের দিকে তাকাতে চাঁদটাকে ভীষ বিষণ্ন লাগলো। মনে হলো চাঁদ কী ভীষ মন খারাপিয়া দৃষ্টি নিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে

চাঁদের দৃষ্টি অনুসর করে নিচে তাকিয়ে আরো অবাক হবার পালা আমার। পুরো শহরটা অদ্ভত মায়াময় একটা বিষণ্নতার চাদর গায়ে পরে আছে যেনো। চাঁদের বিষণ্নতা পুরো শহরকে গ্রাস করে নিয়ে সমস্ত আবহকেই গাঢ় নীল করে তুলেছে।

আচ্ছা, বিষণ্নতার রঙ কি গাঢ় নীল? নইলে পুরো শহরটাকে এতো নীল দেখাচ্ছে কেনো বলতো? কোন কারণ ছাড়াই আমার চোখ ভিজতে আরম্ভ করে দিলো। আচ্ছা এমন নয়তো, নিজে বিষণ্ন বলেই এরকম মনে হচ্ছে? যাহ, তা কী করে হবে!

আজকাল এই নিঃসঙ্গতা খুব উপভোগ করতে শিখে গেছি আমি, বড় হয়েছিতো। ভিড়ই বরং আমার অসহ্য লাগে। কেনো যেনো চাঁদের বিষণ্নতাটা কাউকে জানানো জরুরি মনে হয়েছিলো, লিখতে গিয়েই মনে পড়লো, কোথাও কেউ নেই।

টানা তিনদিনের হরতাল পড়লো আবার। এটা শেষ হতে না হতে আবার কয়দিনের জন্যে দেয় কে জানে? পুরো সপ্তাহটাই ধরতে গেলে মাটি, এভাবে বন্দি হয়ে দিনের পর দিন বাঁচা যায়? কী করবো ভেবে ভেবে ঠিক করলাম গ্রামে চলে যাই, যেখানে নেই হরতাল, নেই যানজট। আমি জানি তুমি বলবে, বিদ্যুৎ কিংবা এয়ারকুলারও হয়তো নেই, ওভাবে থাকা যায়? তাও আবার এই প্যাচপ্যাচে গরমে। কিন্তু গ্রামে আমি চলেলাম শেষ পর্যন্ত। আমারতো উঠলো বাই তো কটক যাই স্বভাব চিরকালের।

বিশ্বাস করো, এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, এসে অব্ধি তোমার জন্যে এতো খারাপ লাগছে আমার। এতো শান্ত কোলাহলহীন পরিবেশ যে আসা মাত্র তুমি মুগ্ধ হয়ে যেতে। সন্ধ্যেয় বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি আর আকাশের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো ভেবে যাচ্ছি। যথারীতি বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু আমার কী মনে হচ্ছে জানো, ভাগ্যিস বিদ্যুৎ নেই। নইলে আকাশের এই রপ, সন্ধ্যের এই চেহারা আমার চোখে ধরা পড়তো কী করে বলো? সন্ধ্যা এতো সুন্দর হয় নাকি, কই শহরে বসেতো বুঝতে পারি না?

চারদিক থেকে ঝিরঝির হাওয়া আসছে, এয়ারকুলারের মতো এতো ঠান্ডা নয়, কিন্তু পিঠ ছুঁয়ে, গলা ছুঁয়ে, ঘাড় ছুঁয়ে, চুল ছুঁয়ে, চিবুক ছুঁয়ে আমার ঠোঁট অব্ধি ছুঁয়ে যাচ্ছে। জানি জানি, আমার ঠোঁট কেউ ছুঁয়ে দিলে তোমার ভাল লাগে না। কিন্তু এই বাতাস আমার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে আমাকে শীতল করে দিচ্ছে। কেউ এভাবে নিঃশব্দে ভালবেসে ছুঁয়ে গেলে আমি কিভাবে ঠেকাই বলো?  বারান্দা ভর্তি জোনাকি পোকার আনাগোনা। হাজার হাজার তারাবাতি যেনো জ্বলছে আর নিভছে। তুমি পাশে থাকলে তোমার হাত মুঠো করে ধরে রাখতাম। জানি মুঠো ঘেমে উঠতো কিন্তু তবুও। তোমার গায়ের গন্ধ নিতাম। আর তুমি যেমন গুন গুন করো, তেমন গাইতে...। কোন গানটা গাইতে তুমি?

সকালে উঠে চটি ফেলে দিয়ে, খালি পায়ে কাদায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরলাম। তাজা মাছ কী অদ্ভু রুপালি হয়গো তুমি জানো? রুপার চেয়েও রুপালি আর কী এক সোঁদা গন্ধ মাছের গায়ে। আমার ইচ্ছে ছিলো সব মাছ আবার পানিতে ছেড়ে দেবো। মাছেদেরও নিশ্চয় পরিবার পরিজন আছে, মা মাছটি হয়তো তার মেয়ে মাছটিকে খুঁজতে থাকবেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে কোথায় হারালো তার আদরের বুকের ধন? মেয়েকে ফিরে না পেলে কাঁদবেন। কিন্তু সবতো আর আমার একার ইচ্ছেয় হবে না, সাথে যে অন্যেরাও আছেন। তাই বড় বড় কটা মাছ রেখে দিয়ে ছোট মাছগুলোকে আরো কিছুদিন জলে সাঁতার কাটার সুযোগ দেয়া হলো।

খালের ধারটা এতো সুন্দর জানো আমার ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। ধান কেটে একটা নৌকায় একজন ফিরছিলেন হয়তো জিরোবেন বলে, তাকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে আমি তার ছোট নৌকাতে চড়ে চলে গেলাম বিলের দিকে আরো ভিতরে। গহিন বিল আর তার চারদিকে এতো শাপলা না দেখলে তুমি কল্পনাই করতে পারবে না, ঠিক সুনীল যেমন বলেছিলেন, যেখানে সাপ আর ভ্রমর খেলা করে। আমি নৌকা বাইতে পারছিলাম না, এদিকে বৈঠা মারিতো ঐদিকে যায়। মাঝিদের কতো অবজ্ঞা করি আমরা কিন্তু আজ প্রথম উপলব্ধি করলাম ছোট সোনার তরীকে পারে নিতেও কতো কী জানতে হয়। অপক্ক হাতে বৈঠা মেরে মেরে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ছেড়ে দিলাম তারপর, এ যেনো যেখানে যাক যাক না কেনো, ডুবুক সবি ডুবুক তরী, তুমি হাসছো না, এই লাইনটা পড়ে?

বৈঠা রেখে আমি পাগলের মতো শাপলা তুলে তুলে ছোট নৌকাটাকে ভরিয়ে ফেলছিলাম। মাঝি অবাক হয়ে আমার কাণ্ড দেখে বলেই ফেললেন, এতো শাপলা দিয়ে কী করবেন আম্মা? মাঝির কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজের ছেলেমানুষি দেখে আমি হেসে ফেললাম, লাজুক গলায় বললাম, কিছু না। আপনি নিবেন? নিয়ে নেন না। মাঝি কোন জবাব দিলেন না শুধু আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

এরপর কথা নেই বার্তা নেই ঝুম ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। মাঝি ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি নৌকা বাড়ির দিকে বাইতে লাগলেন। নদীর ওপর কখনো বৃষ্টিতে ভিজেছো তুমি? কী অসাধারণ কী অসাধারণ অনুভূতি তুমি জানতেই পারলে না। মনে হচ্ছিলো মরণ হলে এই মুহূর্তেই হোক, আর কিছুই চাওয়ার নেই জীবনে। বৃষ্টির প্রতি ফোঁটা যখন আমার ছুঁয়ে যাচ্ছিলো, আমি কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। তোমার প্রথম স্পর্শ মনে পড়ে যাচ্ছিলো। আর সাথে সাথে হাসছিলামও আবারো তোমার বিনা অনুমতিতে কেউ আমায় ছুঁয়ে দিলো। বাড়ি এসে নেয়ে খেয়ে বিছানায় গড়াতে গিয়ে মনে হলো, আজকের এই অসাধারণ মুহূর্তগুলো লিখি...আর লিখতে গিয়েই মনে পড়লো, কোথাও কেউ নেই...

আজকাল খুব ছোট ছোট কারণে মন খারাপ হয় জানো? সাধারণ মন খারাপ না, তীব্র হৃদয় ভেঙ্গে-যাওয়া কষ্ট হতে থাকে। শ্বাস নিতে পারি না চোখ ভিজে ওঠে শুধু। তুমি বলবে এ আর আমার নতুন কী? সামান্যতেই ভেঙে-পড়া চিরদিনের ছেলেমানুষ আমি। হয়তো তাই, কিন্তু কষ্টটাতো সত্যি। ভীরুদের কি কষ্ট কম হয় বলো?

আজ দুপুরে গোসল সেরে অনেকদিন পর একটা শাড়ি পড়লাম, হালকা আকাশি রঙের, হ্যাঁ স্যার তাই, কী করবো বলো? আমার যে শুধু হালকা রঙই ভাল লাগে। গাঢ় রঙে আমায় কি মানায়? আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হলো করি না একটু সাজ, কি আর হবে তাতে? ছোট একটা টিপ পড়লাম আর চোখে কাজল আঁকলাম, সেই আমার চিরচেনা সাজ। কিন্তু মন ভরলো না।

হঠাৎ মনে হলো মুক্তোর দুলটা পরলে কেমন হয়? দুল দুটো কিছুতেই খুঁজে পেলাম না, গয়নার বাক্স, ড্রয়ার, আলমিরা, কাবার্ড কোথাও না। কোন দুলগুলো বুঝতে পেরেছো? সেইযে কক্সবাজার থেকে আনা, পিঙ্ক পার্ল? আমার খুব পছন্দের দুলগুলো। অনেক খুঁজলাম এঘর ওঘর কিছুতেই পেলাম না। এতো কষ্ট হতে থাকলো, টিপ খুলে ফেললাম, কাজল মুছে দিলাম। অসহায়ের মতো কান্না পাচ্ছিলো।

একবার ছোটবেলায় আমি দাদুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম বাবা মায়ের সাথে। সেখান থেকে নিজের বাড়িতে যখন ফিরছিলাম অনেক রাত হয়ে গেলো, ট্যাক্সিতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার হাতে ছিলো আমার ময়না পুতুলটা যেটা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলো। খেতে ঘুমাতে এমনকি গোসলেও আমি আমার ময়নাকে হাত ছাড়া করতাম না। বাবা আমাকে ট্যাক্সি থেকে কোলে করে বিছানায় এনে শুইয়ে দিলেন। ময়নাটা হয়তো ট্যাক্সিতে আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিলো, অন্ধকারে বাবা আর সেটা খেয়াল করেন নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে কী কান্না আমার! আমি সারা বাড়ি হেঁটে হেঁটে ‘আমার ময়না, আমার ময়না’ করে কেঁদেছি। এখন বড় হয়ে গেছিতো তাই চাইলেও আগের মতো হাপুস নয়নে কেঁদে বুক হালকা করতে পারি না। বুকে জমে থাকে চাপ চাপ ব্যথা।

সেই বয়সে একটা ময়নার জন্যে কাঁদলেও লোকে সেটা স্বাভাবিকভাবে নেয় আর আজ মুক্তোর দুলের জন্যে কাঁদলেও লোকের প্রশ্নবিদ্ধ চোখের কারণে ঝাঁজরা হয়ে যাবো। অদ্ভুত না এই বড় হয়ে-যাওয়া! জীবনের এই মৌলিক আবেগগুলোকেও কম্প্রোমাইজ করে দিতে হয়। ইচ্ছেমতো হাসি কান্নার অধিকারও হারিয়ে ফেলি।

এই বিষণ্নতা, এই মন খারাপ বাগে আনতে ভাবি গান শুনি। প্রথমে চন্দ্রবিন্দুর “মনরে হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম” গানটা আশ্রয় করলাম তারপর ফাহমিদার “মন খারাপের একেকটা দিন নিকষ কালো মেঘলা লাগে”। কিন্তু মন খারাপতো কমলোই না বরং গানের সাথে সাথে আমি আরো বিষণ্নতায় তলিয়ে যেতে থাকলাম। আমার খাবার মুখে রুচে না, রাতে বার বার ঘুম ভেঙে যায় আর ঘুম আসে না। মাঝরাত থেকে সকাল পর্যন্ত জেগে থাকি, চোখের কোণায় কালি, কোন কাজে উৎসাহ নেই, লেথার্জিক লাগে সব কাজে।

কেনো এমন হয় আমার?

কী এমন আমি খুঁজে ফিরি তবে!

সবইতো আছে আমার, এই মন খারাপের মুহূর্তগুলোয় ভাবি কাউকে লিখি আর লিখতে গিয়েই মনে পড়ে সেই ধ্রুবপদ, সমে ফিরে আসি বারবার, বারবার...কোথাও কেউ নেই...

তানবীরা

১৩/৮/২০১৩

http://issuu.com/banglatribunenews/docs/emag/17?e=13804967%2F14312683



1 comment: