Thursday 29 November 2018

BLOCKADE

টেলিফোনের ওপারে বাবার গলা শুনতে পেয়ে উদ্বিগ্ন সুলতানা আকুল গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাবা তোমরা কেমন আছো? ওদিকের কি খবর? সুলতানার প্রশ্ন শুনে বাবা আরও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ফোনটা দিলেন সুলতানা’র মায়ের হাতে। সুলতানা মা’কেও একই কথা জিজ্ঞেস করলো, মা ওদিকে কি খবর? মা’ও নিরুত্তর। সুলতানা টের পাচ্ছে, ফোন আবার হাত বদল হচ্ছে। চারবার ফোন হাত বদল হওয়া পর, সুলতানার মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, চুপ করো তুমি, এই নিয়ে কোন কথা নেই। সুলতানা মায়ের অসহায়ত্ব টের পেলো। পঁচিশে মার্চের ভয়াল খবর পেনিসিলভিনিয়াতে পৌঁছলো উনিত্রিশে মার্চ। এক সন্তানের জননী সুলতানা টিভিতে, অসহায় না খেতে পাওয়া, মৃত্যু ভয়ে ভীত বাচ্চাদের মুখ দেখতে দেখতে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলো, বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে এই অন্যায়ের কথা, এ হয় না, এ হতে দেয়া যায় না। বিভিন্ন জায়গায় তিনি রোজ “একশ”টি ফোন করবেন এই ছিলো তার প্রতিজ্ঞা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তার এই প্রতিজ্ঞা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা’র কাজে এলো।

পি।এইচ।ডি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষিকা সুলতানা আলম চেষ্টা করতে লাগলেন প্রবাসী বাঙালি, অবাঙালি বন্ধুদের মধ্যে খবর পৌঁছে দিতে, সচেতনতা তৈরী করতে, তাদের করনীয় ঠিক করতে। অবশেষে জনা পনের মানুষ এক সন্ধ্যায় পেনিসিলভিনিয়ার এক বাড়িতে একসাথে হয়ে শুরু করলেন তাদের যুদ্ধ। প্রথমে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে প্রটেষ্ট, মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা। দেখলেন ব্যানারে তেমন কাজ হচ্ছে না, তারা টিভিতে যেমন দেখেছিলেন, সেরকম জামা কাপড় পরে, সে সব অসহায় ভঙ্গীতে এই ঠান্ডায় রাস্তায়, ঘাসের ওপর শুয়ে থাকলেন। তাতে কিছুটা কাজ হলো। তারপর ঠিক করলেন, হোয়াইট হাউজের সামনে কাগজ দিয়ে সুয়ারেজ পাইপের আদলে বানিয়ে তাতে বসবাস করবেন। যেমন ভাবা ঠিক তেমনই কাজ। ঠান্ডার মধ্যে দুই দিন কয়েকটি পরিবার কাগজের সুয়ারেজ পাইপে থাকার পর হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র তাদের ডাকলেন। মিডিয়া’র অনেকের নজরে আসলো। নিক্সন সরকার, দুইবার করে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে বাধ্য হলেন। এপ্রিলে একবার তারা জানালেন, পঁচিশে মার্চের পর পাকিস্তানের কাছে তারা কোন অস্ত্র বিক্রি করে নি। জুনে আবার জানালেন, পঁচিশে মার্চের পর তারা পাকিস্তানকে কোন ধরনের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে নি। যদিও কিসিঞ্জার তখন চীন সফর করে চীনকে হাতে রাখতে ব্যস্ত ছিলেন, চীন বরাবরই পাকিস্তানের ভাল বন্ধু।

Quackers ধর্মে বিশ্বাসী রিচার্ড টেয়লার বলেন, যদি সত্যিকারের কোয়েকার হতে চাও, তাহলে তোমাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ফিলিস টেয়লার আর রিচার্ড টেয়লার দম্পত্তি করাচী বন্দর থেকে যেসব জাহাজ ছেড়েছে বাঙালি আর পাকিস্তানী নাবিকদের নিয়ে, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর জাহাজে অবস্থান করা বাঙালি নাবিকরা ভীত সন্ত্রস্ত দিন যাপন করছিলো। জাহাজ এমেরিকায় এসে নোঙর করার পর ভীত বাংলাদেশি নাবিকরা স্থানীয় মানুষদের কাছে সাহায্য প্রার্থণা করে। এক ব্যাঙ্ক থেকে তাদেরকে টেয়লার দম্পত্তির ফোন নম্বর দেয়া হয়। টেয়লার দম্পত্তি তাদের আরও বন্ধুদের সাথে নিয়ে এক একবার ছয় গাড়ি পযর্ন্ত মানুষদের উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, নিজের হাতে রুটি বানিয়ে, পরিবেশন করেছেন। অনেক নাবিকদের তারা এখান থেকে টিকেট কেটে দেশে পাঠিয়েছেন। নাবিকরা নিরাপদে দেশে ফিরে চিঠি লিখে জানিয়েছেন পরিবারের সাথে তাদের সেসব বেদনাবিধুর আর মধুর মিলন দৃশ্যের কথা। পরিবার ধরেই নিয়েছিলো তারা আর বেঁচে নেই, পাকিস্তানীরা জাহাজেই হয়ত তাদের হত্যা করেছে।

এরকম অমূল্য অনেক বাস্তব ঘটনার সমন্বয়ে আরিফ ইউসুফ তৈরী করেছেন, দু-হাজার সতেরো’র TWIFF এওয়ার্ড বিজয়ী ডকুমেন্টরী “BLOCKADE”. ডকুমেন্টারীর সবকিছু নিয়ে বিশদে লিখতে গেলে, আয়তন অনেক বড় হবে, ফেসবুক-টুইটারের এই অনু-পরমানু গল্পের যুগে কারই বা ধৈর্য্য আছে এত বড় একটা লেখা পড়ার। ধারনা দেয়ার মত করে খুব ছোট পরিসরে এই লেখার অবতারণা। যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি কিন্তু বিদেশে থাকা অনেক প্রবাসীদের অক্লান্ত চেষ্টায় ও অনেক বিদেশীদের মানবিক সাহায্যে রক্ষা পেয়েছে অন্তত আরও বিশ লক্ষ প্রাণ। বাংলাদেশ অবশ্য এসকল বন্ধুদের মনে রেখেছে এবং তাদেরকে অবদানকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দান করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

আরিফ ইউসুফ যিনি পেশায় একজন আই।টি স্পেশালিস্ট, নিউ জার্সিতে বাস করলেও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশে আই-টি সেক্টরের প্রসারেও কাজ করছেন। পেশাগত কাজের বাইরে তার সময় যায় সত্যের পেছনের সত্যকে খুঁজে বের করতে, তাকে তুলে ধরতে। এই ডকুমেন্টারীটি তৈরী করতে তাঁর সময় লেগেছে আট থেকে নয় বছর। এবং তিনি জানিয়েছেন, এটি তার কাজের শুরু, শেষ নয়। আরও এমন অনেক জানা -অজানা তথ্যের সমন্বয়ে তার নতুন নতুন কাজ দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা। অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো তার জন্যে।

নেদারল্যান্ডসে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রদূত শেখ মোহামম্মদ বেলালকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই তথ্যচিত্রটি আমাদের কাছে তুলে ধরার জন্যে। শীতের এই নিসস্তব্ধতা ভেঙে গরম চা-কফি’র সাথে ছোলা-পেঁয়াজু আর পায়েসের কোলাহল ও আড্ডামুখর একটি অপরাহ্ন উপহার দেয়ার জন্যে দূতাবাসের সকল কূটনীতিক কর্মকর্তাদের ও অশেষ ধন্যবাদ।

২৯/১১/২০১৮

No comments:

Post a Comment