Monday 4 March 2019

রফিক আজাদ নবরূপের প্রবর্তক

http://www.bhorerkagoj.com/print-edition/2019/02/08/235645.php?fbclid=IwAR0Nv41yBEpFGMb8d91CQVOSg9Jp-3pn9hfmkI2Jd0ciedzXLPbpS_XwaVg

তুমি সেই লোকশ্রæত পুরাতন অবাস্তব পাখি,

সোনালি নিবিড় ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে যার

চতুর্দিকে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ!

রোমশ বালুকা-বেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে

অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে

কেবল তোমার জন্য বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে

সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে ‘যাই’। (মাধবী এসে বলে : অসম্ভবের পায়ে)
বহুল জনপ্রিয় কবিতাগুলোর কাতারে হয়তো এই কবিতাটা আসে না কিন্তু কবি রফিক আজাদের নাম এলেই আমার এই কবিতাটির কথাই প্রথম মনে হয়। কালজয়ী সৃষ্টির জন্য নিঃসঙ্গতা, বিষণœতা, অপূর্ণতা যেন অবশ্যম্ভাবী। অনেক পেয়েও অসম্পূর্ণ অনুভব হতে পারে, বাড়ি ভর্তি মানুষের মাঝেও নিজেকে খুঁজে না পেয়ে একাকিত্ব ঘিরে থাকতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র কবি রফিক আজাদ যাকে অনেকে জীবন নামেই জানতেন চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি উনিশ একচল্লিশে জন্মেছিলেন টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে। তিনি কবিতা লিখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামিয়ে দেখার স্বপ্ন দেখতেন।
ষাটের দশকে বাংলা কবিতা যখন নিজের ধারা পরিবর্তন করতে ব্যস্ত ছিল, রফিক আজাদ ছিলেন তার দিক নির্দেশনাকারী, পথ প্রদর্শক। নতুন আঙ্গিকে লেখা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা নিয়ে রীতিমতো তিনি নিরীক্ষা করে গেছেন। শুধু ক?বিতায় তি?নি নতুন দ্যোতনা আনেননি, ভে?ঙে ফে?লে?ছি?লেন ক?বি?দের স্টি?রিও?টি?পিক্যাল রূপ। প্রকৃতির সৌন্দর্য, নারী পুরুষের চিরন্তন চাওয়া, প্রেম, বিষণœতা, একাকিত্ব, হাহাকার, মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের ভঙ্গুর পরিস্থিতি, স্বৈরাচার, দেশের বিরূপ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সবই তার কবিতায় উঠে এসেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কবি উনিশ একাত্তরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাতৃভূমির দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, দেশের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা তার মনোবল নষ্ট করে দেয়। বিপন্ন ও বিদ্রোহ এই মনোভাব তার লেখায় উঠে এসেছে বারবার। দেশপ্রেমিক এই লড়াকু যোদ্ধা মানুষের লোভ, হিংসা ও ক্ষমতার দম্ভের প্রতিবাদে ক্ষোভে-বিক্ষোভে জ্বলে উঠেন। সেই আগুনের লাভা ছড়িয়ে আছে তার লেখার ছত্রে ছত্রে। তার বিক্ষুব্ধ সেই মনোভাবেরই জ্বলন্ত প্রকাশ।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,

তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যাবে;

ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন-

সমুখে যা পাবো খেয়ে নেবো অবলীলাক্রমে;

যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধর, পেয়ে যাই-

রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।

সর্বপরিবেশগ্রাসী হলে সামান্য ভাতের ক্ষুধা

ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে! (‘ভাত দে হারামজাদা’)
স্বাধীনতা-উত্তরকালে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর ওপর অভিমান থেকে যেমন তিনি ওপরের কবিতাটা লিখেছিলেন ঠিক তেমনি সেই সাহসী উচ্চারণে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, সামরিক জান্তাদের দখলের নিচে যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি প্রকাশ্যে বলা বাংলাদেশে এক রকম ‘অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ’ ছিল, তখন রফিক আজাদ ১৫ আগস্টের অন্যায় ঘটনা নিয়ে নির্ভীক চিত্তে প্রতিবাদ করতে গিয়ে লেখেন :
এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,

সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-

বত্রিশ নম্বর থেকে

সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে

অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে। (‘সিঁড়ি’)
অকুতোভয় দেশপ্রেমিক এই কবির কবিতায় দেশের সমসাময়িক রাজনীতি, পট পরিবর্তন, মানুষের ক্ষুদ্র মানসিকতার নির্ভেজাল প্রকাশ বারবার উঠে এসেছে। বাস্তবতাকে এড়িয়ে সাহিত্য চর্চার চেষ্টা তিনি করেননি। তার কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের কথা এসে পড়ে, জাগতিক সব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে আছে তার তীব্র ক্ষোভ। যুদ্ধ, মহামারী, নৈরাশ্য, নগর সভ্যতা দ্বারা ক্ষয়ে যাওয়ার মানুষের শিকড়ের রূপ দেখে একজন সংবেদনশীল সচেতেন মানুষ হিসেবে কবিও হয়ে পড়েন বেদনাসিক্ত। আমেরিকার ‘বীট জেনারেশন’ ও ইংল্যান্ডের ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ মুভমেন্ট দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কবি। নগর সভ্যতার বিরুদ্ধে তার রোমান্টিক কবিমন যেমন প্রতিবাদ মুখর হয়েছে ঠিক তেমনি আবার স্বপ্ন ভেঙে বাস্তবে ফিরে আসার চেষ্টাও আসছে তার লেখায়।
বালক জানে না সে বানানে ভুল করে

উল্টাসিধা বোঝে : সঠিক পথজুড়ে

পথের সবখানে কাঁটার ব্যাপকতা!

বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই,

পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই!

বালক জানে না তো সময় প্রতিক‚ল,

সাঁতার না শিখে সে সাগরে ঝাঁপ দ্যায়,

জলের চোরাস্রোত গোপনে বয়ে যায়,

বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে! (‘বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে’)
রফিক আজাদকে তার লেখা প্রিয় কবিতার কথা জিজ্ঞেস করলে, তিনি বারবার এই কবিতার কথাটিই বলতেন। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’ বইয়ের কবিতা এটি। তার দৃষ্টিতে তিনি যেই বোধটি এক কবিতায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, সেই বোধটি পরিপূর্ণভাবে মূর্ত হয়ে এসেছে এই কবিতায়।
তিনি যে শুধু কবিতার রূপ আর ধারা কিংবা গতানুগতিক কায়দার রোমান্টিক ধাঁচের শব্দ পরিবর্তনে মনোযোগী ছিলেন তাই নয়। মানুষ হিসেবে খুবই বেপরোয়া ও লাগামহীন ধরনের ছিলেন। কবিতা জুড়ে বিষাদ ভর করলেও জীবনের প্রতি ছিল তার সীমাহীন লিপ্সা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অত্যন্ত আধুনিক ও উদারমনা রফিক আজাদ কবিতার সাথে কবিদের রূপ পরিবর্তনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হাতকাটা গেঞ্জি পরতেন, গলায় চেন, হাতে বালা। নাকের তলায় ইয়া গোঁফ, হাতে সারাক্ষণই সিগ্রেট। ড্রাগ খেয়ে মোটরসাইকেল চালাতেন ঢাকার রাস্তায়। তরুণদের ওপর তার ইমেজ এতটাই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল যে, সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের সাথে তাল মিলিয়ে ‘বিচিত্রা’ তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল।
রফিক আজাদ মানে স্বাভাবিক চিরন্তন কবি চিন্তাভাবনার বাইরে কিছু একটা। নিজের সময়ের কথা বলতে গিয়ে কবি রফিক আজাদ সাহসের সঙ্গে সেই সময়ের কথা বলেছেন অকপটে। শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে ‘মিলনকে নিয়ে দুচার কথা’ এক লেখায় তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের পাঠকদের মধ্যে ঐ সময়ে শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি, ঢিলেঢালা পাজামা, পাজামাটা ঝাড়ুর কাজও করবে, পাঞ্জাবির নিচের দিকে অনেক ময়লা থাকবে, তারপর একটু রোগাটে-লম্বাটে, একটু উসকো খুসকো, একটু উদাসীন, কাঁধে আবার ঝোলা, হাতে বেলি ফুলের মালা-টালা হলে আরো ভালো- এই রকম আর কি। ষাটের দিকে আমি অধিকাংশ বাংলা ছাত্রছাত্রীকে দেখতাম ঐরকম। আমরাই প্রথম স্কিন টাইট জিন্স পরা শুরু করি। বাংলা পড়লেই যে পোশাকে-আশাকে, আচার-আচরণে ওরকম হতে হবে, ‘সখি আমায় ধরো গো, ধরো গো’ বলে শান্তিনিকেতনী হতে হবে, মেয়েলি স্বভাবের হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। শিল্পী তার লেখার সময় শিল্পী। অন্য সময় সে মানুষ। জীবনবাদী মানুষ। জীবনের সব কিছু সে উপভোগ করবে। তো সেই প্রচলিত ধারাকে আমরা একটু পাল্টে দিতে পেরেছিলাম। পরে এর সঙ্গে এসে যোগ দিল মিলন। তাতে করে বেশ জমেছিল। একবার যশোর প্রেসক্লাবে ঢাকা থেকে আমরা কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিক গিয়েছি। যখন আলাপ হচ্ছিল সবার সঙ্গে, পেছন থেকে বুড়ো ধরনের কে একজন মুখ ফসকে বলে ফেললো, শালারা লেখক, একজন কবিও আবার, দেখে মনে হয় জলদস্যু।

শুনে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, আমরা জলদস্যুবেশী বটে কিন্তু আমরা লেখক। এখন থেকে এ ধরনের লেখকই দেখবেন। কোণাপাঞ্জাবি আর দেখবেন না এই দেশে।’
অন্য সব কবিদের মতোই প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, বিরহ, পাওয়া না পাওয়া, অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা তার কলমে উঠে এসেছে বারবার। গতানুগতিক সব শব্দ হয়তো তিনি তুলে আনেননি, লেখেননি চিরন্তন প্রথা অনুসরণ করে কিন্তু যা লিখেছেন তা আজো কবিতাপ্রেমী কিংবা অপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। ‘যদি ভালোবাসা পাই’ কবিতাটি তার অনবদ্য সৃষ্টি। আজো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণ-তরুণীরা পরস্পরকে কাছে টানার জন্য অনেক সময়ই এই কবিতাটির আশ্রয় নিয়ে থাকে। ‘তুমি : বিশ বছর আগে ও পরে’ কবিতাটি যদিও তার স্বভাবমতো নতুন ধারার আঙ্গিকে লেখা নয় কিন্তু এর আবেদন চিরন্তন। বুকের গভীর গহনে বিশ বছর ধরে লালন করা গোপন অনুভূতির এক দুর্দান্ত প্রকাশ। ওপরে উল্লেখিত দুটো কবিতাই তরুণদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও অজস্র আবৃত্তিতে অনুরণিত। ‘চুনিয়া আমার অর্কেডিয়া’ কবিতায় ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছেন তিনি। তার কথানুসারে, কবিতাটি ১৯৭৬ সালের মে মাসে লেখা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে শহীদ হওয়ার পর অভিঘাতের ফলে দীর্ঘদিন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া টুকরো টুকরো কথা ও চিত্রের লিখিত রূপ। কবিতাটি বর্তমান দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্যের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূলত চুনিয়া নামক একটি গ্রামের বর্ণনা। ‘চুনিয়া’ গ্রামটিকে কবি গ্রিক আদর্শিক ও রোমান্টিক উপত্যকা আর্কেডিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং কাব্যিকভাবে দাবি করেছেন যে, এই আদর্শিক গ্রামটি দাঁড়াবে বর্তমান সভ্যতার সব হানাহানি আর রাহাজানির বিরুদ্ধে। কবিতার ব্যাকরণে ‘চুনিয়া আমার অর্কেডিয়া’ ঠিক কতখানি কবিতা হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে সুধীজনদের মাঝে ব্যাপক আলোচনা, মতপার্থক্য আছে কিন্তু কবিতার বক্তব্যের প্রতি প্রায় প্রত্যেকেরই আছে নিরঙ্কুশ সমর্থন।
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে

খুব শক্তিশালী

মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।

চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,

চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;

চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।

চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।

চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি?

প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না করে ওঠে?

চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে। (‘চুনিয়া আমার অর্কেডিয়া’)
নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা খাপছাড়া তলোয়ার লেখাও ছিল তার প্রথা ভাঙা লেখালেখির আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। সেই সময় কোনো ধরনের ভণিতা না করে সরাসরি এরকম সুস্পষ্ট উচ্চারণ বিরল ছিল। আড়াল রেখে কিংবা উপমা বা রূপকের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করার যে প্রচলিত ধরন ছিল সেগুলো সমূলে উৎপাটন করে দিয়েছিলেন তিনি। নারীর শরীর, পুরুষের কামনা, প্রকৃতির স্বাভাবিক এই খেলা, কাছাকাছি আসার এই অমোঘ আকুলতা, নর-নারীর চিরন্তন মিলন বা ভালোবাসার রূপের শাশ্বত চিত্রটি উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে। বাস্তবকে কিংবা সত্যকে পাশ কাটিয়ে কবি হতে চাননি তিনি। জীবনের দাবি তাই বারবার ধরা দিয়েছে তার লেখায়।
‘আমার তারুণ্যময় সুঠাম শরীর তোমাকে পাপের পথে নামাতে পারে না?-

সামান্য পাপের ভয়ে আকণ্ঠ তৃষ্ণার্ত তুমি সুপেয় জলের জন্য,

প্রিয়তমা, এইটুকু পথ পেরুবে না? (সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে)

কিংবা

বেলাভূমি দীর্ঘ হলে শুধু ধূধূ বালি

বালি ছাড়া আর কিছু নাই, তাই বলে

কে কবে করেছে বন্ধ নোনাজলে স্নান?

ঘুরেফিরে সেই পুরনো জোয়ারে তুমি

সমর্পিত হলে? যে জলে দুর্নাম প্রায়

প্রান্তবাসী নারীর সমান?’ (পয়ারেই করো ধারাস্নান)
কবি হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি রয়েছে অনেক সম্মাননায় ও পুরস্কারে। বেসরকারি ‘আলাওল পুরস্কার’, লেখক শিবির প্রবর্তিত ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’, কবি ‘আহসান হাবীব পুরস্কার’। তিনি সেই একজন বিরল সৌভাগ্যকারীদের একজন যিনি জীবিত থাকতেই জাতীয় সম্মাননার দুই বিশেষ নাম বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক দুই-ই তিনি লাভ করেছেন। ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি আর ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তাকে একুশে পদক দেয়া হয়। সামরিক শাসকদের রোষানলে ছিলেন বরাবর আর তাই একবার তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’ তখন বাজেয়াপ্তও করা হয়েছিল।
তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করে কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতায়। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’র নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর কাজ করেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে। বিভিন্ন ধরনের পেশা, বিভিন্ন জায়গায় বসবাস, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা তার লেখার ভাণ্ডারকে দিনের পর দিন পরিপূর্ণ আর সমৃদ্ধ করেছে। কথিত আছে, অবসর গ্রহণের কয়েক মাস আগে এক আমলার বিরূপ আচরণে প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাজ্ঞান সম্পন্ন এই কবি বাংলা একাডেমির চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা মৌলবাদিতা, ধর্মের আড়াল নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, দুঃশাসনের সাথে আপসহীন এক কবির বিরাগের প্রবল ছাপ তার লেখায়ও পড়েছিল। সেসবের প্রতিবাদ হয়ে তার কবিতায় উঠে এসেছে, শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা, বেশ্যার বিড়ালের মতো শব্দ। মানুষের আদর্শচ্যুত হওয়া, নৈতিকতা বিমুখতা তাকে বারবার ব্যথিত করেছে।
মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সুচতুর ধর্মব্যবসায়ী

প্রতিদিন ফুলে-ফেঁপে ওঠে পীরের আস্তানা

শ্যামল বাংলায় চলে পাকিস্তানি উটের বহর

মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারের কেচ্ছা প্রতিদিন

পেট্রোডলারের কাছে পরাজিত চার মূলনীতি

এই তো আমার প্রিয় স্বাধীন স্বভূমি। [যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ]
সদ্য স্বাধীন দেশে কবি রফিক আজাদ তাঁর কবিতা দিয়ে, তারুণ্য দিয়ে, উন্মাদনা দিয়ে, টগবগে ক্রেজ দিয়ে সত্যি সত্যি জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, কবিকে খেয়েই কবিতার জন্ম হয়’- এই প্রবাদতুল্য কথাটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, কবিতা লেখা খুব কঠিন ব্যাপার। খেলোয়াড়দের মতো দুই দিন প্র্যাকটিস করলাম আর লিখে ফেললাম সেটা কবির ক্ষেত্রে হয় না। জীবন বিসর্জন দিয়েই কবিতা লিখতে হয়। নিজেও তো একটা জীবন বিসর্জন দিয়ে দিলাম। সারা জীবনের জন্য পণ করেই কবিতা লিখতে আসতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। লেগে থাকতে হবে আজীবন। নিজের সুখময় জীবনের মায়া ত্যাগ করেই কবিতা লিখতে আসতে হবে। কারণ যারা কবিতা লেখেন তাদের বেশিরভাগই কিন্তু কষ্ট করে গেছেন। আমি ব্যক্তিগত জীবনেও প্রচুর কষ্ট পেয়েছি শুধু কবিতা লেখার জন্য। সেসব বলে শেষ করা যাবে না।
অন্যায়, অবিচার, বিষণœতা, বিদ্রোহ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ নিয়ে নৈরাশ্য আর হতাশাই কি কবির জীবন ছিল? না, একদমই না, যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তারা বলেছেন, জীবনের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তার। প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসতেন তিনি, উপভোগ করতে চাইতেন। জীবন নিয়ে তার নিরীক্ষা ছিল, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপভোগের আকাক্সক্ষা ছিল তার মধ্যে। সত্য আর সুন্দরের একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন তিনি। সৌন্দর্যের প্রতি তার পিপাসা আকণ্ঠ। কবিতার অমরাবতীকে তা বারবার ছুঁয়ে গেছে। পরিপূর্ণ রোমান্টিক এক সত্তার অধিকারী ছিলেন তিনি। আকণ্ঠ প্রেমে নিমজ্জিত এক কবি। জীবনে আর যে কোনো হাতছানিই ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কোনো সৃষ্টিরই প্রেরণা হচ্ছে প্রেম।
‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে সত্যের সামান্য অংশ

খুঁজে পেতে অনেকেই লাঙলের ফলা আঁকড়ে ধরে-

সত্যের বদলে কিছু উঠে আসে সুন্দরের সীতা!

সত্যে ও সুন্দরে কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ বাঁধে না!’ (সত্য ও সুন্দর)
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে সকল অভিমান, অভিযোগ, পাওয়া না পাওয়া বুকে নিয়ে ২০১৬ সালের ১২ মার্চ এই প্রথা ভেঙে প্রথা তৈরি করা কলমের জাদুকর কবি রফিক আজাদ এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন. 

No comments:

Post a Comment