চন্দ্রনিবাস
প্রায়ই
আক্ষেপ শোনা যায় ফেসবুক জুড়ে, আকাশ খালি করে
নক্ষত্রেরা সব ঝরে পরছে, কেউই তো রইলো না, স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, কাকে অনুসরণ করবো। আচ্ছা, সবাই তো আমরা
যথেষ্ঠ বড় হয়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে
পারি না?
নিজের মন আর চিন্তা, অনুভূতি যা বলে সেটা অনুসরণ না করে একজন নির্দিষ্টি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, মতবাদকে কেন অনুসরণ করতে হবে?
যাদের লক্ষ
লক্ষ অনুসারী, সারা পৃথিবী জুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়
যারা,
যাদের দর্শন, কাজ,
ব্যক্তিত্ব এর মোহে আমরা ভুলি, চলুন তো তাদের জীবনটা একবার দেখি।
বাইবেল মতে দাউদ ৭০০ থেকে ৭০০০ মানুষ হত্যা করেছিলেন। তবু
তিনি মহান নবী। শুধু কি তাই? এই নবী তার প্রাণপ্রিয়
পুত্র আবাসালুমকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, কারণ- পুত্র বিদ্রোহ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে নিজেই নিজের
মন্দির গড়ে রেখে গিয়েছিলেন। যদিও দাউদের মন্দির একসময় শত্রুপক্ষ গুড়িয়ে দেয়, তার স্থাপত্যের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া দায়। দাউদের ছিল সাতজন স্ত্রী। সাতজন
স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি তার এক সেনার স্ত্রী বাতসেবাকে রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ
করেন। যদিও পরে তিনি বাতসেবাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন আর বাতসেবার পুত্র সলোমনই হন
দাউদ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।
দাউদপুত্র সলোমনের হারেমে ছিল ৭০০ রাণী আর তিনশ রক্ষিতা (সূত্র: জেরুজালেম ইতিহাস, সলোমন টেম্পল ) । বুও তারা নবী, তাদেরকেই অনুসরণ করে যাবে
মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে।
কলির অবতার বলে যিনি খ্যাত সেই কৃষ্ণের রাধা’র সাথে প্রেমের কথা কে না জানে? বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা রুক্মিনী’কে বিয়ে করার পরও তার ১৬০০০ অধিক পত্নী ছিলো। যাদের মধ্যে আটজন খুব উল্লেখ যোগ্য ছিলেন যাদের অষ্টভার্যা নামেও অভিহিত করা হয়। এঁরা হলেন রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দি, মিত্রবৃন্দা, নগ্নাজিতি, ভদ্রা এবং লক্ষণা।
কৃষ্ণ ছিলেন
প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ এবং মহাভারতের যুদ্ধ ও তার পরিণতিতে তাঁর প্রগাঢ়
প্রভাব ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন যখন উপলব্ধি করলেন
যে যাঁরা তাঁর প্রতিপক্ষ তাঁরা তাঁর আত্মীয়বর্গ এবং অত্যন্ত প্রিয়জন তখন তিনি
যুদ্ধের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি সমস্ত আশা ত্যাগ করে তাঁর ধনুক
গাণ্ডীব নামিয়ে রাখলেন। তখন অর্জুনের মোহ দূর করার জন্য কৃষ্ণ অর্জুনকে সেই
ধর্মযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উপদেশ দেন যা ভগবদ্গীতা নামে খ্যাত। এছাড়াও কৃষ্ণ
ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা জয়দ্রথকে বধ করতে অর্জুনকে সহায়তা করেন। কৃষ্ণ কৌরবদের
সেনাপতি দ্রোণাচার্যের পতনও সম্পন্ন করেছিলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে যুধিষ্ঠির
দ্রোণাচার্যকে গিয়ে চতুরতার সাথে বলেন যে অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন এবং তারপর খুব
মৃদুস্বরে বলেন যে সেটি একটি হাতি। কিন্তু যেহেতু যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যাচার করতেন
না তাই দ্রোণাচার্য তাঁর প্রথম কথাটি শুনেই মানসিক ভাবে অত্যন্ত আহত হন ও অস্ত্র
পরিত্যাগ করেন। এরপর কৃষ্ণের নির্দেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের শিরশ্ছেদ করেন।
কর্ণের সাথে
অর্জুনের যুদ্ধের সময় কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। তখন কর্ণ যুদ্ধে বিরত
থেকে সেই চাকা মাটি থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলে কৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দেন যে
কৌরবেরা অভিমন্যুকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাই
তিনি নিরস্ত্র কর্ণকে বধ করে অর্জুনকে সেই হত্যার প্রতিশোধ নিতে আদেশ করেন। এরপর
যুদ্ধের অন্তিম পর্বে কৌরবপ্রধান দুর্যোধন মাতা গান্ধারীর আশীর্বাদ গ্রহণ করতে যান
যাতে তার শরীরের যে অঙ্গসমূহের উপর গান্ধারীর দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হবে তাই ইস্পাতকঠিন
হয়ে উঠবে। তখন কৃষ্ণ ছলপূর্বক তার ঊরুদ্বয় কলাপাতা দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেন। এর
ফলে গান্ধারীর দৃষ্টি দুর্যোধনের সমস্ত অঙ্গের উপর পড়লেও ঊরুদ্বয় আবৃত থেকে
যায়। এরপর যখন দুর্যোধনের সাথে ভীম গদাযুদ্ধে লিপ্ত হন তখন ভীমের আঘাত দুর্যোধনকে
কোনভাবে আহত করতে ব্যর্থ হয়। তখন কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম ন্যায় গদাযুদ্ধের নিয়ম
লঙ্ঘন করে দুর্যোধনের ঊরুতে আঘাত করেন ও তাকে বধ করেন। এইভাবে কৃষ্ণের অতুলনীয় ও
অপ্রতিরোধ্য কৌশলের সাহায্যে পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয় করে।
নবী
মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথম পত্নী খাদিজার মৃত্যুর পর
আরও ১০ জন (মতান্তরে ১২ জন) স্ত্রী গ্রহণ করেন। অর্থাৎ তার স্ত্রীর সংখ্যা
সর্বমোট ১১ জন (মতান্তরে ১৩ জন)। এছাড়াও দাসী’রা ছিলো।
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, সাওদা বিনতে যামআ, আয়িশা বিনতে আবু বকর, হাফসা বিনতে উমর, যয়নাব বিনতে
খুযাইমা,
উম্মে সালামা হিন্দ বিনতে আবী উমাইয়্যা, রায়হানা বিনত যায়েদ, যয়নাব বিনতে জাহশ, জুওয়াইরিয়া বিনতে
হারিছ ইবনে আবি যারার, রামালাহ বিনতে
আবী-সুফিয়ান, সফিয়্যা বিনতে হুওয়াই, মাইমুনা বিনতে হারিছ ইবনে হাযন, মারিয়া আল-কিবতিয়া (ইবনে কায়িম আল-যাওজিয়া সহ আরও বহু
সূত্র দাবি করে যে, তিনি মুহাম্মাদের
একজন উপপত্নী ছিলেন, অর্থাৎ তিনি
মুহাম্মাদের কৃতদাসী ছিলেন কিন্তু স্ত্রী নয়। এর কারণ ইসলামী আইন মুসলিম
পুরুষদেরকে দেনমোহর প্রদানকৃত বিবাহিত নিজ স্ত্রী এবং নিজ অধিকৃত দাসীদের সাথে
বৈবাহিক সম্পর্ক করার অনুমতি দেয়ায় তিনি দাসী হয়েও মুহাম্মাদের স্ত্রীগণের
পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্য ছিলেন। ইবনে ইসহাক রচিত মুহাম্মাদের জীবনী হতে
সম্পাদিত ইবনে হিশামের সংকলনে তাকে মুহাম্মাদের স্ত্রীগণের তালিকায় উল্লেখ করা
হয় নি।)
এ ছাড়াও
মুহাম্মদ আর যে সমস্ত নারীকে বিবাহ করেছিলেন, তাঁরা হলেন:
সানা (অথবা
সা'বা) বিনতে আসমা বিন আল-সালত; আল-শানবা বিনতে আমর
আল-গিফারিয়া; ঘাযিয়া বিনতে জাবির; আসমা বিনতে
আল-নুমান; রায়হানা বিনতে আমর
বিন খুনাফা, বানু কুরাইজা গোত্র আক্রমণকালে যাকে
তিনি হস্তগত করেছিলেন, শারাফ বিনতে খালিফা; আল-আলিয়া বিনতে যাবিয়ান; কুতায়েলা বিনতে কায়েস; ফাতিমা বিনতে
শুরাইয়া,
আমরা বিনতে ইয়াজিদ ও
লাইলা বিনতে খাতিম।
এ ছাড়াও
তাঁর ছিল আরও রক্ষিতা (Concubine):
মারিয়া
আল-কিবতিয়া ছাড়াও আরও তিন জন, তাঁরা হলেন:
রায়হানা বিনতে যায়েদবিন আল-কুরাইজা, বলা হয় তিনি ছিলেন বানু নাদির গোত্রের; যয়নাব বিনতে জাহাশ-এর দানকৃত এক দাসী ও অন্য একজন যুদ্ধবন্দিনী (যার নাম জানা
যায় না)।
হযরত
মুহাম্মদ (সাঃ) তার জীবদ্বশায় মোট ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আর সরাসরি মোট ৯টি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। যে সকল অভিযানে নবীজী স্বয়ং
অংশগ্রহণ করেন সেগুলোকে নবীজীবনী রচয়িতা ও জীবনীবিশারদদের পরিভাষায় বলা হয় গাযওয়া,
যেসব যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করেননি, কোন সাহাবীকে দলপতি নির্ধারণ করে অভিযানে পাঠিয়াছেন সেগুলোকে বলা হয়‘সারিয়্যা’ বা‘বা‘ছ’। ১.
গাযওয়ায়ে বদর ২. গাযওয়ায়ে উহুদ ৩. গাযওয়ায়ে আহযাব ৪. গাযওয়ায়ে বনী কুরাইয়া ৫. গাযওয়ারে
বনী মুস্তালিক ৬. গাযওয়ায়ে খাইবার ৭. গাযওয়ায়ে ফাতেহ মক্কা ৮. গাযওয়ায়ে হুনাইন ৯. গাযওয়ায়ে
তায়িফ। আর সারিয়্যা’র
সংখ্যা চেতাল্লিশ।
কবি কাজী
নজরুল ইসলামের সাথে সুস্পষ্ট সম্পর্ক ছিলো তিন জন নারীর, তারা হলেন, সৈয়দা খানম, প্রমীলা সেনগুপ্তা, ফজিলাতুন্নেসা জোহা। এছাড়া ঢাকার মেয়ে রানু সোম, ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র, বর্ষবানী পত্রিকার সম্পাদক কোলকাতার মেয়ে জাহানারা বেগম
চৌধুরী (মীরা) ও বিখ্যাত শিল্পী কানন বালা দেবী’র সাথেও তার প্রেমের গুঞ্জন শোনা গেছে।
কবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি কাদম্বরী দেবী’র সাথে
প্রেমের কথা সর্বজন বিদিত। শুধু তিনিই একমাত্র প্রেমিকা ছিলেন? না, দেশে বিদেশে ঠাকুর
মশাই এর প্রেম ছিলো। মুম্বাইতে প্রেমে পরেন মারাঠি কন্যা আন্না তড়খড়ের, আর্জেন্টিয়ান প্রেমিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমন্তবালা রায় চৌধুরীর সম্পর্কের কথাও
তুলে এনেছেন রবীন্দ্রজীবনী বিষয়ক গবেষকরা। স্ত্রী মৃণালিনীর সমবয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী
ইন্দিরার জন্যও রবীন্দ্রনাথের মন পুড়ত— এমনটা বলেন অনেকে। নিজের ভাতিজি’র সাথেও তার
অনুরাগ মিশ্রিত চিঠি আদান প্রদান হত। আরও ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত রাণু অধিকারী।
শামসুর
রহমান
প্রেম, নারী ও কবিতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ ও শামসুর রাহমানের কথপোকথন
:
হুমায়ুন আজাদ
: আপনি যে প্রেমের কবিতা লিখছেন এগুলো কি কোনো বাস্তব প্রেরণা থেকে উদ্ভুত হচ্ছে, না কল্পনা থেকে?
শামসুর
রাহমান : কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তব।
হুমায়ুন
আজাদ : আশা করি আপনার অনেক প্রেমিকা ছিল। এদের মধ্যে কে সবচে অনুপ্রেরণা দিতে
পেরেছে আপনাকে?
শামসুর
রাহমান : এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয়, আমি সবার কাছেই ঋণী।
হুমায়ুন
আজাদ : আপনার প্রেমের কবিতায় আপনি কোন ধরনের আবেগ প্রকাশ করেন? অর্থাৎ হৃদয়ের আবেগের ওপর আপনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, না শারীরিক আবেগের ওপর?
শামসুর
রাহমান : দুটোতেই।
হুমায়ুন
আজাদ : শরীর কতটা ভূমিকা পালন করে?
শামসুর
রাহমান : শরীর তো আছেই, কেননা প্রেম যেখানে
আছে,
সেখানে শরীর থাকবে, হৃদয়তো শরীরের বাইরের কিছু নয়, ভেতরেরই জিনিস – যেমন হীরে থেকে যে
দ্যুতি বেরোয় সেটাই হলো আমাদের হৃদয়ের ব্যাপার আর সেই প্রস্তরখণ্ডটি হলো আমাদের
শরীর। আমি দেহাতীত প্রেমে বিশ্বাস করি না। তবে শরীরটাই সব নয়। … প্রেম শুধু শরীর-নির্ভর নয় এবং শুধু হৃদয়নির্ভরও নয়। দুটির
মিশ্রণে প্রেমের জন্ম বলে আমি মনে করি। তবে আমার কবিতায় বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও
অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে।
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়
প্রিয়
লেখকের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকে আমার কিছু ভাল লাগা অংশ তুলে
ধরলাম,
“সুনীল ছিলো রমনীমোহন” মেয়েদের কাছে ভারী প্রিয়— এ কথা সবাই জানে। মেয়েরা ওর জীবনে এসেছে। আমি ছাড়াও অন্য নারীর প্রতি সে
অনুরক্ত হয়েছে, তা-ও আমি জানি। কিন্তু যদি অন্য কোনো
নারীকে ওর ভালো লাগলেও থাকে, ও আমাকে কখনো তার
সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। আমি রাগ করেছি, কারো নাম করে প্রশ্ন করেছি ওকে। কিন্তু ও কখনো আমাকে কারো নাম বলেনি। আমি
মানুষ,
আমারও অভিমান হতো। অনেকভাবে আমি রাগ দেখিয়েছি, ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। আবার এ-ও জেনেছি যে, আমার প্রতি সুনীলের যে ভালোবাসা আছে, বিশ্বাস আছে, আমাদের যে সম্পর্ক আছে, তা নষ্ট হওয়ার নয়।
সে ভালোবাসা অনেক কিছুর উপরে।”
কবি ও লেখক
হিসেবে নারীমহলে সুনীল ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তারপরও ভালবাসা নিয়ে এক ধরনের অতৃপ্ততা
ছিল তার মধ্যে। একবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোন থিমের কবিতা লিখতে পছন্দ করেন?
এর জবাবে তিনি
বলেন,
“ব্যর্থ প্রেম।”
আবার প্রশ্ন
করা হয়,
জীবন থেকে নেওয়া?
সুনীল বলেন, “হ্যাঁ, সব সময় মনে হচ্ছে
ব্যর্থ,
সবকিছু ব্যর্থ। একটু ভালবাসা চেয়েছিলুম কেউ দিল না।”
লন্ডনের সেই
কথার আরও কয়েক বছর পর সানন্দা’র সঙ্গে এক
সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যক্তি জীবনের প্রেম ও ভালবাসা নিয়ে সুনীল বলেন, “ওটা (ভালবাসা) পুরোপুরি পাওয়া যায় না। এ কষ্টটা থেকে যাবে।
এ ছাড়া আর কী? আর সবই তো পেয়েছি।”
শুধু নীরা’র জন্য : সুনীল লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। তরুণ
বয়সে পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে ভালবেসে ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে কিছুতেই তার ভালবাসার
কথা বলতে পারছিলেন না। অতঃপর সেই মেয়েটিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেন তিনি। মেয়েটিদের
বাসায় ‘দেশ’ পত্রিকা রাখা হতো।
সুনীল তার কবিতাটি ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন এবং একদিন সেটা ছাপাও হয়। কিন্তু কবিতা
ছাপা হলে কী হবে? মেয়েটি তখন কিছুতেই
বিশ্বাস করেনি যে, এটি সুনীলের লেখা
কবিতা। সে বলত, এ নামের অন্য কেউ কবিতাটি লিখেছে।
নিজের লেখক
হওয়ার বিষয়ে সুনীল তার একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি লেখক কিংবা কবি হওয়ার পেছনে ওই মেয়েটির কাছে ঋণী। সে কবিতা পছন্দ করত বলেই
আমি কবিতা লিখেছিলাম। সে যদি খেলাধূলা বা অন্যকিছু পছন্দ করত তাহলে আমি হয়ত তা-ই
হতে চাইতাম।”
তবে এ
মেয়েটি-ই ‘নীরা’ কিনা—
এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কখনো কিছু বলেননি তিনি। তার কবিতার
নীরাকে তিনি আড়ালেই রেখেছেন সারাজীবন। নীরা প্রসঙ্গে যতবারই জানতে চাওয়া হয়েছে
সুনীল বলেছেন, “কবিতায় যা বলেছি এর বেশী বলতে চাই
না। কবিতার মধ্যে যেমন সে আছে, সেভাবেই সে থাক।
প্রত্যেক পাঠকেরও নিশ্চই একজন নীরা আছে। কোনো পাঠকের কল্পনায় যদি কোনো নীরা থাকে, তাহলে সে তাকে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে।”
কারো কারো
ধারণা,
সুনীলের স্ত্রী স্বাতী-ই হয়ত সে-ই নীরা। কিন্তু তিনি নীরা
নন। এ প্রসঙ্গে স্বাতী লিখেছেন, “আমি কিন্তু মোটেই ‘নীরা’ নই। সুনীল যে ‘নীললোহিত’, তা যেমন বলা যায়, আমাকে কথনোই ‘নীরা’ বলা যায় না। নীরা থাক ‘নীরা’ হয়েই। থাক রহস্যে ঢাকা, থাক সকলের অচেনা।”
ঢাকায় একবার
সুনীলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, ‘এই যে নীরার
প্রতি তার অসীম দুর্বলতা ও নীরাকে নিয়ে তিনি এত কবিতা লিখেছেন, এতে করে নীরার প্রতি তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় কখনো
ঈর্ষা বোধ করেন কি না?’
হঠাৎ এ
প্রশ্নের জন্য সুনীল আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। একটু থমকে গিয়ে তিনি বলেন, “আরে স্বাতীতো তাকে কখনো দেখেইনি, দেখলে নিশ্চয়ই আপত্তি করত।”— কথাটা বলেই হাসতে লাগলেন সুনীল।
সুনীলের ‘নীরা’ বিষয়ক সব কবিতা যে
শুধু নীরাকে নিয়েই লেখা হয়েছে; ঠিক তা নয়। প্রথম
দিকের প্রায় সব কবিতায় হয়ত নীরাই ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে নীরার আদলে আরও অনেকেই
তার কবিতায় এসেছেন। এ অভিমত সুনীলের ঘনিষ্ঠজনদের। সুনীল নিজেও এ কথা স্বীকার
করেছেন।
সুনীলের
স্ত্রী স্বাতীর মতে, “আমার মনে হয়, নীরা’র মধ্যে অনেক মেয়ে
মিশে রয়েছে। আমার কোনো অংশ আছে কি তার মধ্যে? তা-ও জানি না ঠিক করে। আমি কখনো নিজেকে ‘নীরা’র সঙ্গে মেলাতে চাইনি। তবে বিশ্বাস করতে ভাল লাগত যে, সুনীলের সব প্রেমের কবিতাই আমাকে নিয়ে লেখা। তা অবশ্য মোটেই
নয়।”
মার্গারিট—— হঠাৎ আলোর ঝলকানি : কিশোর বয়সে অপরিপক্ক প্রেমের অভিজ্ঞতার
পর পরিণত বয়সে সুনীল যাকে ভালবেসে ছিলেন তিনি ছিলেন একজন ফরাসী তরুণী। নাম
মার্গারিট ম্যাথিউ।মার্গারিটের আগ্রহ ছিল ভারতীয় পুরাণ ও সংস্কৃতিতে। অন্যদিকে
সুনীলের গভীর অনুরাগ ছিল ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যে। দু’জনে ছিলেন দু’জনার পরিপূরক।
সুতরাং খুব দ্রুত তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কথনো বা সারাদিন দু’জন একই ঘরে
গল্প করেছেন, ড্রিঙ্ক করেছেন, খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছেন, এমন কী মাসিক খরচও শেয়ার করেছেন। দু’জন এতটাই
অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন যে, কেউ কাউকে ছাড়া
দীর্ঘ সময় থাকতে পারতেন না।
এই সহজ
মেলা-মেশার মধ্যে একটা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটল। একদিন সুনীলের বাসায় ড্রিঙ্ক ও কবিতা
পাঠের পর এক আবেগীয় মুহূর্তে সুনীল মার্গারিটকে বললেন, “তোমাকে একটা চুমু খাব?”
না, এ ঘটনায় সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়নি। মার্গারিটও বুঝতে পেরেছিলেন
সুনীলের মনোভাব। এ ঘটনার কয়েকদিন পর মার্গারিট সুনীলকে বলেন, “আমি আজ গীর্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার সময় অনুমতি চাইব। যদি
কোনো সাড়া পাই…”
মার্গারিটের
এ কথায় সুনীল জানতে চাইলেন, “কীসের জন্য
প্রার্থনা করবে বললে?”
লাজুক কণ্ঠে
মার্গারিট তখন বললেন, “তুমি যা চেয়েছিলে…”
পরবর্তীকালে
সুনীল মার্গারিটকে চুমু খেয়েছিলেন কি-না সে কথা না লিখলেও এ কথা জানিয়েছেন যে, “মার্গারিটের ভগবান আমার প্রতি সদয় হয়েছেন, যদিও সবটা নয়, একটুখানি।”
রুদ্র
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
লাখো লাখো
ভক্তের অংশ গ্রহনে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় রুদ্র মেলা। সেই রুদ্রকে লেখা তসলিমা’র খোলা চিঠি, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘবছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলীখালার সঙ্গে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি
কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি যেদিন বললে তোমার নেলীখালার সঙ্গে তুমি শুয়েওছিলে, আমার ইচ্ছে হয়েছিল আত্মহত্যা করি। আমি কারও সঙ্গে মিশেছি
জানলে যদি তোমার কষ্ট হয় তবে তুমি কেন বুঝতে চাইবে না যে আমারও কষ্ট হয় তুমি যখন
আমাকে একা রেখে লালবাগ যাও, বাণিয়াশান্তা যাও!
শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিল। তুমি শিমুলকে
নিয়ে কী কী কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে, আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে- কেমন হয়েছে? তোমাকে ছাড়া আর দুটো পুরুষ ছুঁয়েছি বলে লোকে আমাকে চরিত্রহীন বলে। তুমি যে
মালিটোলায়, লালবাগে, টানবাজারে, বাণিশান্তায় এত
নারী ছুঁয়েছ তোমাকে কিন্তু কেউ চরিত্রহীন বলে না। মেয়েদের বেলায় যত ছোঁয়াছুঁয়ির
বিচার।
তাই বলছিলাম কি, যাদেরকে
আদর্শ মেনে পথ চলার জন্যে সকলে ব্যস্ত, তারা বাস্তবে আপনার চিন্তা আর মূল্যবোধের কতটুকু
কাছে, সেটা কখনো ভেবে দেখেছেন কি?
তানবীরা
০৮/০২/২০১৮
No comments:
Post a Comment