Thursday 9 April 2020

দ্যা করোনা ডায়রী অফ তাতা ফ্র্যাঙ্ক ১-৩ (মার্চ)

ফার্স্ট কোয়ার্টার ক্লোজিং শেষ, হাতে এখন অখন্ড অবসর ফেবুকিং করার। না আছে টার্গেট আর না আছে এচিভের কোন তাগাদা। যদিও রেজাল্ট এখনো পাব্লিশ করে নাই, ম্যানেজম্যান্ট কি ম্যানিপুলেট করতেছে, আল্লাহই জানে। রেজাল্টের অবস্থা হলো ঐ কৌতুকের মত, এক বিষয়ে ফেল করলে দুইটা ঘন্টা বাজবে, দুই বিষয়ে ফেইল করলে চারটা ঘন্টা কিন্তু এখন সারা বাড়ি চব্বিশ ঘন্টাই ঘন্টা বাজে। এটা হলো সাধারণ সেক্টরে। ঐদিকে ডেটল, স্যাভলন, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, প্যারাসিটামল, টয়লেট পেপার ইত্যাদি কোম্পানীর সারা বছরের টার্গেট এই প্রথম কোয়ার্টারেই এচিভড। তিন শিফটের জায়গায় হয়ত পাঁচ শিফটে প্রোডাকশন চলছে। ডেটল, স্যাভলন এগুলো ল্যাবে নিয়ে চেক করা দরকার, আমাদের দেশের দুধে পানি মেশানোর মত, তাড়াতাড়ি করার জন্যে এরাও পানি মিশিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে কিনা কে জানে। এদের একাউন্ট ম্যানেজাররা মোটা বোনাস পাবে ফো শিওর। রিসিশনে সবার আগে রিয়েল এস্টেটের দাম পরে, বাড়ির দাম পরবে, পার্টনার নিয়ে এরা হয়ত অলরেডি বাড়ি দেখা শুরু করছে, স্ট্যান্ড ফ্রী বাংলো কিনে ফেলবে এই চান্সে। এদের এখন ঠিক টাইমে প্রোডাক্ট ডেলিভারী হবে কিনা সেই টেমশন।

ঐদিকে নিউজে এসেছে, কনস্ট্রাকশান ম্যাটেরিয়ালের দোকানে যাচ্ছে রমরমা। প্রথম কোয়ার্টারের যা ফোরকাস্ট ছিলো তারচেয়ে আরও পঞ্চাশ ভাগ বেশি এচিভ হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, বাড়ি বসে মানুষ বোরডোম কাটাতে, ফার্নিচারপত্র নতুন রঙ করা, বাড়িঘর মেরামত, সারাই, সাজানো, নতুন কাজ যা যা সামার প্ল্যানিং এ ছিলো কিংবা ছিলো না সব করে নিচ্ছে। প্রিমে রুতে বলেছে, ভ্যাকেশানে যেনো কেউ বাড়ির বাইরে না যায়। তাই ইন্ট্রাটাউন নতুন আইডিয়া এনেছে “স্টেকেশান”, হয়ত অন্য দোকানও এনেছে, সব দেখা হয়নি। নিজের বাগানকে ভ্যাকেশানের জন্যে সাজিয়ে নিয়ে, বাড়িতেই ভ্যাকেশান করার নতুন টার্ম “স্টেকেশান”। করোনা নতুন নতুন অনেক শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। নতুন বিজনেস, নতুন আইডিয়া, নতুন লিভিং স্টাইল ইভলভ করছে।

করোনা উপলক্ষ্যে মানুষের স্টোর করার নেশায়, সুপারমার্কেট কিছু নিয়ম দিয়েছে। পার পার্সান একবারে কুড়িটার বেশি (দু প্যাকেট) ডিম কিনতে পারবে না। টয়লেট পেপার, আরও অন্যান্য জিনিসেও কি জানি এরকম রুলিং। একদিকে করোনার জন্যে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ আবার অন্যদিকে একবারে বেশি বাজার করতে পারবে না। তাজা সব্জি, ফল, দুধ, ডিম, রুটি নিয়ে বেশ সজাগ থাকতে হয়। আমরা রেকর্ড ভঙ্গ করে একখানা বিস্কুটও এক্সর্টা কিনি নাই। নাই। সবাই যেভাবে সারভাইভ করবে আমরাও সেভাবেই করবো। সময়ের সাথে চলবো, এই পন।করোনা উপলক্ষ্যে গেছিলাম প্যারাসিটামল আর হ্যান্ডস্যানিটাইজার কিনতে। দুইটাই সুপারমার্কেটে শেষ, ফার্মেসি থেকে দুইটাকার জিনিস চার টাকায় কিনতে হলো। একদিন সুপারমার্কেটে রুটি ছিলো না, পরের দিন যেয়ে আনতে হলো তবে ইন জেনারেল তাজা ফল আর সব্জির ভ্যারাটাইটিস কমে গেছে, একবার এটা পাওয়া গেলে আর একবার অন্যটা নেই। সাপ্লাই চেইন চাপে আছে, তবে দিন চলে যায়।

এদিকে এখানে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলছে সেই সাথে মৃত্যুর হার। অনেকদিন হলো স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, এখন এই পদ শূন্য। নেদারল্যান্ডস চায়না মেডিক্যাল ইকুইপম্যান্ট রিজেক্ট করেছে, নন কোয়ালিফায়েড বলে দিয়েছে। এনাদার টেমশাম। কারণ চায়না ছাড়া এত দ্রুত এত ভেজাল কোথায় উৎপন্ন হইবে। নেদারল্যান্ডস ইকুইপম্যান্ট কোথা থেকে কিনবে সেটা জানায় নি। কিন্তু ইকুইপম্যান্ট শর্ট আছে সেটা বলেছে। ইকুইপমেন্ট এন্ড মেডিকেশান এর বন্দোবস্ত ঠিক না হলে হয়ত স্টে এট হোম আরও লংগার করে দেবে। পার্কে যাই জগ করতে, মানুষের উপস্থিতি বেশ কম। জগিং, এক্সারসাইজ, কুকুরের অভিভাবক ছাড়া কাউকে তেমন সে সময় বাইরে দেখা যায় না। ঈর্ষনীয় রোদ উঠছে এবার মার্চের শুরু থেকেই, ঠান্ডা থাকলেও চোখের আরাম, মন ভাল থাকে। বছরের প্রথম ভ্যাকেশান পিরিওড শুরু হওয়ার কথা ছিলো, প্রিমে রুতে বলেছে, ইস্টার আর স্প্রিং কোন ভ্যাকেশানেই তিনি চান না, কেউ বাড়ি থেকে বের হোক। নর্থ হল্যান্ডের লোক সাউথ হল্যান্ডে আসুক কিংবা এর উল্টোটা কোনটাই তিনি চান না। রাজার জন্মদিনের অনুষ্ঠান, ইস্টারের অনুষ্ঠান সব বাতিল করা হয়েছে। এদিকে প্রায় সব ভ্যাকেশান এজেন্সিই বলেছে, বুক করা ভ্যাকেশনের টাকা ফেরত দেবে না তবে ছুটি বাতিল হলেও, পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ছুটিতে গেলেই হবে, টাকা তাদের কাছে জমা থাকবে। আমার অবশ্য এই পদ্ধতি ভালোই মনে হয়েছে, সমানে সব ব্যাঙ্ক-ক্রাফট হওয়া কোন কাজের কথা না, টিকে থাকার পলিসি বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

বাসায় থাকি সারাদিন, ঘোরাফেরা নেই। ভাইয়া টেমশমে আছে, আল্লাহ না করুক, তার বোনের হাতে না আবার টাকা জমে যায়। আমি অভয় দিয়ে বললাম, টেমশাম নিও না, এত প্রিমিটিভ চিন্তা করলে হবে? ঘরে বসেই তো টাকা খরচা করা যায়, বাইরে যাওয়ার কি দরকার! আমি সেদিকে ভালোই খেয়াল রাখছি। একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলাম, যে কয়টা ডাচ ওয়েবসাইটেই কিছু অর্ডার করতে গেছি, সবাই ডেলিভারি ডেট বলছে উনত্রিশে এপ্রিলের পর। সব ওয়েবসাইট দেখি নি তাই সবারটা বলতে পারছি না। প্রিমে আবার “স্টে এট হোম” ডেট এক্সটেন্ড করলে হয়ত ডেলিভারি ডেট ও চেঞ্জ হবে। চেক করে দেখতে হবে পরে। তবে এবার “স্টে এট হোম” ডেট এক্সটেন্ড করার পদ্ধতিতে হয়ত কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, দেখা যাক, অপেক্ষা।

দশই মার্চ শেষ অফিস করেছি, সেদিনই দুপুরে ডাচ সরকার ঘোষনা দেয়ার পর থেকে হোম অফিস। ত্রিশে মার্চ থেকে জগিং শুরু করেছি। এর মধ্যে বের হওয়া বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বলতে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে খবর পড়া, ফেবু আর হোয়াটসএপ। অবশ্য সেই অর্থে করোনা বাদ দিলেও অফিস ছাড়া বাইরের যোগাযোগ এটুকুই ছিলো অন্তত উইক ডে’তে। সযতনে সব জায়গায় করোনা বিষয়ক খবর বাদ দিতে চাই, তারপরও চোখে পরবেই। অফিস শেষ করে মুভি দেখি, মুভি থেকে আবার অফিস। এক এক সময় মনে হয়, স্ট্রেস ফ্রী আইডিয়াল লাইফ লীড করছি। স্থবির এই জীবনযাত্রায় খানিকটা বৈচিত্র্য আনতে ভার্চুয়াল জগতে অনেকেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরীতে, খেলতে ব্যস্ত। এক্টিভলি পার্টিসিপেট করি আর না করি, ট্যাগড হতে, সবার ক্রিয়েটিভিটি দেখতে, ছবি দেখতে দারুণ লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে যেটি, যত বড় বিপদই হোক, মানুষ বাঁচতে ভালবাসে, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত “সো মাচ কমিটেড টু লাইফ”।

ম্যানেজার বলছে, একটানা কাজ করছো, একদিন ছুটি নাও। নতুন টেমশাম, করোনা কালের এই "স্টে এট হোম" সিচুয়েশনে ছুটি দিয়া কি করিবো। “স্টে এট হোম” শুরু হলে হোম অফিস থাকলেও স্কুল তারপরও আরও দু’তিন দিন খোলা ছিলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ঠিকাছে, বিপদ কম হবে। কিন্তু স্কুল বন্ধ হওয়ায় রিয়েলি টেন্সড হয়েছিলাম, সবাই এক সাথে বাসায় দিনের পর দিন, প্যানডেমিক কোথায় না নিয়ে যায়। স্কুল, বন্ধু, আড্ডা ছাড়া, মেয়ে কি রকম রিয়াক্ট করে কে জানে। মেঘের সাথে কনভারসেশানে গেলাম, পজিটিভ সব সাইড দেখালাম, বললাম, এরকম তো সহসা হবে না, "ওয়ান্স ইন আ লাইফ টাইম চান্স, লেটস মেইক প্লেজেন্ট স্টে এট হোম, লেটস মেইক ভেরি বেস্ট অফ ইট”। সবসময় কথায় কাজ হয় না, আমার বিস্ময়ের এপার ওপার করে দিয়ে, এখনও এটি মোর অর লেস ওয়ার্ক করে যাচ্ছে। ছোটখাট দু একটা জিনিস বাদ দিলে। একটা কাগজে কালার পেন দিয়ে লিখে রেখেছি, ট্যাও ক্যাও করলে দেখাই, “প্লেজেন্ট স্টে এট হোম”, সামহাও মেনে যায়।

মেঘের স্কুলে মাঝে মাঝেই এই বয়সী বাচ্চাদের হ্যান্ডেল করার ওপরে প্যারেন্টসদের জন্যে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ এরেঞ্জ করে। মানসিকভাবে বাচ্চারা ভাল না থাকলে ঠিক করে পড়াশোনা করতে পারে না, পারবে না তাই এই ব্যবস্থা। বিভিন্ন প্রফেশনাল সাইকোলজিক্যাল অগার্নাইজেশান থেকে স্পেশালিস্টদের নিয়ে আসে। সবচেয়ে ভাল লাগে অডিয়েন্স থেকে কোয়েশ্চেন এন্ড সিচুয়েশান নিয়ে তারা প্রফেশনাল ড্রামা কোম্পানীর এক্টর এন্ড এক্ট্রেসদের দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সেই সিচুয়েশানকে চার পাঁচ ভাবে এক্সপ্লেইন করে অভিনয়ের মাধ্যমে। কোন সিচুয়েশানে প্যারেন্টস কিভাবে রিয়াক্ট করলে বাচ্চা কিভাবে রিয়াক্ট করবে। সেখানে একসময় উঠে এসেছিলো, নেদারল্যান্ডসে কিশোর-কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতা কেন কমে গেছে, কেনো তাদের সংশোধানাগার বন্ধ করে দিয়েছে? তার কারণ তারা বললেন, “সোশ্যাল মিডিয়া”, বাচ্চারা এখন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, হোয়াটসএপ, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটে। তাই শপ লিফটিং, স্টকিং এসব এখন প্রায় নেই। হয়ত কিছু সাইবার ক্রাইম আছে কিন্তু সংখ্যায় নগন্য। আমারও তাই মনে হচ্ছে, অফিস, স্কুলের টাইম বাদ দিলে সবাই ব্যস্ত থাকে, নানা পদের খাবার বানানোতে আর যার যার ডিভাইসে, তাতে গৃহ শান্তি বজায় থাকে। পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন খাবারের অভাবে মানুষের মিছিল দেখছি মিডিয়াতে, ঠিক সেই সময় অন্য প্রান্তে আমরা, কিছু করার নেই তাই তিন বেলা নানা ধরনের নতুন নতুন আইটেম বানিয়ে খাচ্ছি। সত্যিই হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র আমাদের এই পৃথিবী আর কি প্যাথেটিক এই জীবন।

রাস্তায় লোক চলাচল বেশ স্বাভাবিক। সামনের জানালা দিয়ে শহরের একটা বড় রাস্তা চোখে পরে সেখানেও গাড়ির ব্যস্ততা আছে। উইক ডে’তে কমবেশি হলেও উইকএন্ডে বেশ ব্যস্তই। করোনা আর না-করোনা সময়ের পার্থক্য ঠিক আলাদা করতে পারলাম না। চমৎকার রোদ বলে বাড়ির পাশের পার্কেও সপ্তাহান্তের কিচিরমিচির টের পাওয়া যায়। আগের মতই আগন্তুকদের গাড়ি পার্কের ভীড় লেগে আছে। প্রতিদিন গড়ে এক লিটার তাজা দুধ খাওয়া, আপেল আর চীজের ওপর বেঁচে থাকা, সাইকেল আর জিম করা ডাচেরা ভেবেছিলো, পৃথিবীর মধ্যে তাদের ইম্যুন সিস্টেম সবচেয়ে ভাল, করোনা তাদের ইম্যুনের কাছে পরাজিত হবে। জরিপে উঠে এসেছে, নব্বই শতাংশ জনসংখ্যা চেয়েছিলো, তাদের করোনা হয়ে যাক, তারা ইম্যুন বিল্ড করে ফেলবে। এখন যে হারে করোনার কাছে ধরাশয়ী হচ্ছে তাতে তো ইম্যুন আইডিয়ার বারোটা। তারপরও ডাচেরা গা করছে না, বাইরে যাচ্ছে হরদম, সোশ্যাল ডিসটেন্স ক্ষেত্র বিশেষে মানছে। প্রিমে ও বলেছে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিই ভরসা। আর আছে বেঈমান ডাচ ওয়েদার, মে মাস পর্যন্ত যেখানে কদাচিত রোদের দেখা মেলে, প্যাঁচপ্যাচে বৃষ্টি আর ঠান্ডাই থাকে এখন মার্চের শুরু থেকে ফাল্গুনের হাওয়া আর রোদ। যেমন করোনা বাড়ছে তেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদ্দুর। ভাসিয়ে নিচ্ছে চারধার আর ডাচেরাও আছে “ডোন্ট কেয়ার করোনা” মুডে।

করোনায় যখন ইউরোপের প্রায় সব দেশ স্টে এট হোম থেকে, লকডাউন টু কার্ফিউতে গেছে, সে সময় সুইডেন আছে বিন্দাস। তারা নিয়েছে “Herd Immunity” পলিসি। খানিকটা ডারউইনের ইভালুশেয়ান থিয়োরীর মত না, "Survival of the fittest"? সবাই যখন আমরা বাড়িতে ভয়ে অর্ধেক মরে আছি, তখন বন্ধুদের পোস্ট করা ছবিতে দেখছি, এরা বাইরে টেরাসে বসে ড্রিঙ্ক এঞ্জয় করছে!

করোনায় প্রিমে সব ধরনের বিউটি, নেইল, হেয়ার সেলুন বন্ধ রাখতে বলেছেন। চুল বেশ লম্বা হয়েছে। ভেবেছি, যতদিন অফিশিয়াল না হেয়ার সেলুন ওপেন হয়, চুল কাটবো না, বেশ একটা করোনা স্মৃতিচিহ্ন থাকুক। অফকোর্স যদি বেঁচে থাকি আর কি
  
আজ প্রায় ছাব্বিশ দিন পর প্রথম সুপারমার্কেটে গেলাম। সুপারমার্কেটে যেয়ে নিজেকে প্রায় এলিয়েন মনে হচ্ছিলো। কোনদিকে যাবো, কি ধরবো আর ধরবো না বুঝতেই পারছি না। ঢোকার মুখে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। ক’জন ভেতরে আছে আর ক’জন ঢুকতে পারবে রীতিমত চেক হচ্ছে, মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টে চেক-ইন করছি। সবাইকে বাধ্যতামূলক ট্রলি নিয়ে ঢুকতেই হবে। আগের মত কয়েন দিয়ে ট্রলি নিতে হয় না, কয়েন ছাড়াই ট্রলি দিচ্ছে। দুজন দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ সব ট্রলি স্যানিটাইজার দিয়ে ক্লিন করছে। এই কিপ্টের দেশে যেখানে সব “ডু ইট ইয়োসেলফ” দিয়েছে, ক্যাশিয়ার তুলে দিয়েছে, নিজের শপিং নিজেকে স্ক্যান করে নিজেকে পে করতে হয় সেখানে দুজন মানুষ আলাদা রেখেছে ট্রলি স্যানিটাইজড রাখার জন্যে, খুব অবাক ব্যাপার। সরকার কোন নির্দেশনা দিয়েছে কি না এ নিয়ে সেটা চেক করে দেখা হয় নি। বাজারের ব্যাগ সব তুলে নিয়েছে ক্যাশ থেকে। ছোঁয়াছুঁয়ি এড়ানোর যত রকম ব্যবস্থা নেয়া যায়। সবদিক লাইন এঁকে, ফিতে দিয়ে ডিভাইড করে দিয়েছে। কোনদিক দিয়ে যেতে হবে, কোথা দিয়ে বের হতে হবে, দেড় মিটার ডিসটেন্স রাখতে হবে তার কথাও বারবার বোর্ডে লেখা আছে লাল কালি দিয়ে। চীজ, বিস্কিট, রুটি কিংবা নতুন খাবার যেখানে দেয়া থাকতো টেস্ট করার জন্যে সেসব সব বাসন শুদ্ধ উধাও। আগে বোনাস কার্ড, আলবার্টাইন কার্ড ইত্যাদি ক্যাশিয়াররা পাঞ্চ করতো, এখন মেশিন বাইরে দিয়েছে, নিজে পাঞ্চ করো, ক্যাশিয়াররা ছোঁবে না। ঠিকাছে, ক্যাশিয়ারদের সেইফটি। ক্যাশমেমোও বাইরে বের হবে, যার ইচ্ছে নিজেরটা নিজের হাত দিয়ে নাও, না নিলে না নাও, ক্যাশিয়ারের সাথে হাত ছোঁয়ার কোন ব্যাপার নেই। জামা কাপড়ের দোকানে গেলে দেখা যেতো তারা কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। ইন্ট্রাটাউনে দেখলাম ঢোকার মুখে তারা হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর টিস্যু রেখেছে, হাত ক্লীন করে ঢোকো আবার বের হয়েও আর একবার হাত ক্লীন করো। সাথে দেয়া আছে, শপিং রুলস, ডিসন্টেন্স, ক্লীনিং, পেয়িং সবকিছুর জন্যে সোশ্যাল সেইফটি রুলস।


আমরা অনেকেই হয়ত ভাবছি, করোনা ওভার হয়ে গেলে আমরা আবার করোনা পূর্ববর্তী জীবন ধারায় ফিরে যাবো। না, সেটা কখনোই আর হবে না। প্যান্ডেমিক করোনা ইউরোপের সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনে যে ধাক্কা রেখেছে সেটার দাগ আর কখনোই মুছবে না। যা একবার পেছনে চলে যায় সেটা স্মৃতিতে থাকে কিন্তু ফিরে আসে না। আমরা আস্তে আস্তে করোনা এফেক্টের সাথে কিংবা তার আফটার এফেক্টের সাথে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলবো। সেটাই তখন আমাদের স্বাভাবিক জীবন হবে। যদি বেঁচে থাকি, “আমরা গল্প করবো, ইউ নো উই ইউজ টু ডু থিংগস লাইক দ্যাট বিফো করোনা, অর উই ইউজড টু লিভ লাইক দ্যাট বিফো করোনা।“ এই যে কেউ হাঁচি দিলে, কিংবা কাশি দিলে তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাই, পার্কে জগ করার সময় খুব পাশ দিয়ে কেউ দৌড়ে গেলে ভয়ে গা শিরশির করে, করোনা নেই তো আবার, ইনফেক্ট করে দিয়ে যায় নি তো, এই সন্দেহ মন থেকে সহসা আমাদের কারোই যাবে না। এই হাত ধোয়া, এই স্যানিটাইজ, এই সুপারমার্কেটের কিংবা দোকানের বদলানো পরিস্থিতি সহসা সব আবার আগের জায়গায় চলে আসবে না। এখান থেকে যাত্রা শুধু সামনের দিকেই যাবে, পেছনে আর ফিরবে না। দেখা যাবে, ম্যালেরিয়া, যক্ষা, প্লেগ রোগের টিকার মত করোনা টিকাও হয়ত একটা সাধারণ জিনিস হয়ে যাবে, বাচ্চা জন্মের পর আর সব টিকার সাথে করোনা টিকাও দেয়া হচ্ছে।


ধার্মিকরা বলছেন, ইশ্বরের শাস্তি, ইশ্বর তার ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ প্রকৃতিকে দিনের পর দিন অনেক মিসইউজ করেছে, প্রকৃতির প্রতিশোধ। খানিকটা সত্যি তো বটেই, যে হারে এবং যে দ্রুত প্রকৃতি তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনছে, নিজেকে হীল করছে, অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষ অন্যান্য জিনিসের সাথে প্রকৃতিরও বড় শত্রু। নিজের আনন্দের জন্যে আমরা ডলফিন, কাকড়া, কচ্ছপের বিচরণ ক্ষেত্র পর্যন্ত দখলে নিয়ে নিয়েছি।  ইউ এস এক্সপার্টদের মতে, দুহাজার একুশের শেষ অব্ধি এই তান্ডব হয়ত চলবে। চলুক, মানুষই পেছনে নামুক, প্রকৃতি রাজত্ব করুক তার আপন রাজ্যে। 










#journey_twentytwenty
০৪/০২/২০২০


No comments:

Post a Comment