Tuesday 21 July 2020

জন্মদিন কথন ২০২০

বন্ধু ভান্দানা বলে, “যখন দেখবি সব কিছুর প্রতি জিরো টলারেন্স মনোভাব এসে গেছে, বুঝবি বয়স হয়ে গেছে”।

আমার মনে হয়, যখন ছোট ছিলাম তখন ভবিষ্যতের ভাবনায় বিভোর থাকতাম, এখন বাঁচি স্মৃতিতে, পুরনো দিনের কথা বেশি ভাবা মানেই বয়স হয়ে গেছে। এই করোনা কালে প্রায় সবাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি, বাচ্চারা অনলাইন স্কুল, এই সুর্বন সুযোগে প্রচুর ভিডিও কল, আড্ডা, গান বাজনা হয়। এক ফাঁকে বাচ্চারা শুরু করে দুষ্টুমি। তাদের দুষ্টুমি নিয়ে কথা বলতে যেয়ে শুরু হয় নিজেদের কথা। আম্মি পাশ থেকে বলে, একদম তোদের ছোটবেলা, তোদের মত ঠিক এভাবে লেগে থাকে। বাচ্চারা তখন শুরু করে, দিদু বলেছে তুমি এরকম করতে, পাপা ওরকম করতো, বড়মা এটা বলতো, তুমি আর পাপা অনেক মারামারি করতে ইত্যাদি প্রভৃতি আরও কত কি। কপট ধমক দেই ওদের, দিদু আমাদের সম্বন্ধে কোন ভাল কথা বলে না? কিন্তু অন্তরে অন্তরে আমিও জানি, আমার মা’ও স্মৃতিতেই বাঁচে, আমরা কাছে নেই, স্মৃতিটুকু ছাড়া আর আছে কি মায়ের।

অসুবিধা হলো, মারামারি করেছি সেটা মনে আছে কিন্তু কি নিয়ে মারামারি করতাম, সেগুলো ওরা বললেও মনে করতে পারি না অতো। সকালে পেপার পড়া নিয়ে মাঝে মাঝে নাস্তার টেবলে একচোট হত। নিয়ম ছিলো আব্বু পড়ার পর যে আগে ধরবে সে আগে পড়বে। কিন্তু আমি আগে নিলেও ভাইয়া টান দিতো, ফলাফলে পেপার ছিড়তো। আর হতো ডাল ঘেটে দেয়া নিয়ে, মারামারিতে আমি অলোয়েজ হারতাম, প্রতিশোধ ছিলো, ভাইয়া শুধু ডালের ওপরের পানি খায়, আর কিছু খায় না, স্কুলে যাওয়ার আগে গরম গরম ডাল টেবলে রাখলে আমি তাড়াতাড়ি চামচ দিয়ে ডালের ওপর-নীচ ঘেটে দিতাম, ভাইয়ার ডাল খাওয়া বরবাদ, তখন আর একচোট মার খেতাম।

আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে সবকিছুর গ্রুপ আছে, স্কুল, কলেজ, ইউনি, পাড়া, আত্মীয়দের, কিসের গ্রুপ নেই। সারাদিন অফিসের কাজে যায়, প্রায় রোজই কিছু না কিছু ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তার মাঝেই রুটিন করে ফেবু স্ক্রল করি, সমস্যা হলো পুরনো কিছুই আর মনে করতে পারি না, চিনতেও পারি না। অন্য একটা জগত, অন্য কোন জনমের কথা মনে হয়। অনেকেরই চেহারা কিংবা নামও আর স্মৃতিতে নেই। কেউ যদি বলে ক্লাশমেট ছিলাম মেনে নেই, কোচিংমেট ছিলাম তাও সই, পাড়ামেট ছিলাম, তাও পসিবল, আমাকে চিনতো, বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেই। স্মৃতির ভান্ডার পুরোই শূন্য। দুই দশক অনেক সময়, মানুষ, শহর, জলবায়ু সব পরিবর্তন হয়ে যায়। খুঁজে পাওয়া কিংবা মেলানো আর সম্ভব না। আমি চিনতে না পারলেও আমাকে কেউ কেউ চিনতে পেরে 
বসুন্ধরা বা পিংক সিটিতে জিজ্ঞেস করে , ফেবুতে ম্যাসেজ দেয়, তুমি স্বাতী না? তাতেই আমি ধন্য অনুভব করি, ভাল লাগে, পুরোপুরি মুছে হয়ত যাই নি এখনো। দেশে থাকলে নিশ্চয়ই অনেকখানি মনে থাকতো, পরিযায়ী পাখিদের স্মৃতি কি তত তীক্ষ্ণ হয় না? অল্প কিছুদিনের ছুটিতে দেশে যাই, তার অর্ধেক যায় বিভিন্ন শপিং মলে, রেস্টুরেন্টে আর রাস্তায় জ্যামে। অনেকদিন থাকি না বলে আর হুট করে আশেপাশের সব বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠে না।

আগে ঢাকা পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে বাসায় ঢোকার এই সামান্যকটি মুহূর্তের মধ্যেই আশেপাশে বাসার দারোয়ানরা দেখতো, তারা জানতো কে এসেছে ফিরে, দু’দিন না যেতেই তাদের মারফত খবর আসতো, খালাম্মা আপনারে বাসায় আসতে বলছে। কালের গহীনে এখন অনেক খালাম্মাই মিলিয়ে গেছে, পরিচিত দারোয়ানরাও নেই, ছোট হয়ে এসেছে আমার চলাচলের পরিধিও।

কেয়ারন্টিন এতদিন খেলা খেলা লাগলেও এখন সাফোকেটিং। ইউ-এস, বাংলাদেশ সবদিকে ট্রাভেল বন্ধ। মন চাইলে কিংবা কোন কারণে কোথাও যেতে পারবো না এই অনুভূতিটা দমবন্ধ করা। যাই কিংবা না যাই সেটা অন্য জিনিস কিন্তু যেতে পারবে না সেটা অন্য অনুভূতি দেয়।


পরিযায়ী হওয়ার আর একটা বড় অসুবিধে হলো, চুল রুপালি হতে শুরু করলেও মন রয়ে গেছে, যেখানে ছেড়ে এসেছি সেখানেই। বায়োলজিক্যাল ঘড়ি হয়ত টিকটিক করছে কিন্তু মনের ঘড়ি রোজ আকাশ ছোঁয়। জীবনের হয়ত সবচেয়ে অন্যরকম বছরটা পার করলাম। জন্মদিন নিয়ে চিরদিনই আমি খুব উচ্ছসিত থাকি, এবছরও তার কিছু কমতি হয় নি। কিংবা জীবনের এই গোধূলি বেলায় এসেও সে উৎসাহ একটুও কমে নি। জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকেই মন কেমন কেমন করতে থাকে। জন্মদিন উপলক্ষ্যে ফ্রান্সবাসীকে তাদের ন্যাশনাল ডে’তে অভিনন্দন। যারা যারা আমাকে নিয়ে পোস্ট দিয়েছো, মেমোরি শেয়ার করেছো, অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে আবারো ধন্যবাদ।
ভাল থেকো পৃথিবী, ভাল আছি আমি, আমার সকল বন্ধুদের ভালবাসা আর সকল শত্রুদের সাধুবাদ।

যেদিন উড়ে যাবো সেদিনও এতটা মায়াই থাকবে এই পৃথিবীর জন্যে।

No comments:

Post a Comment