Thursday 7 July 2022

কিসমাত আপনা আপনা

পকেটে টাকা নাই? গড়ের মাঠ? ফি মাসেই ম্যালা এদিক ওদিকের খরচা থাকে? ঐদিকে আবার বউ বাইরে খেতে যেতে বায়না করে? ঘুরতে যেতে চায়? জাস্ট বলবেন, ভাল মেয়েরা এত ঘুরতে বেড়াতে যায় না। বাইরের খাবার খায় না। এরকম মেয়েদের মানুষ মন্দ বলে। ভাল বংশের মেয়েরা, নিজেরা রেঁধে বেড়ে স্বামী- সন্তানকে খাওয়ায়। ব্যস, জোঁকের মাথায় নুন পরে যাবে। বউ নিজেকে ভাল মেয়ে প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে যাবে। কড়কড়া গরমে যতই তার ঠান্ডা ব্যানানা স্প্লিট কিংবা ডামে ব্ল্যাঙ্কের ওপরের আঠালো চকলেট সসের জন্যে জিহবা তড়ে যাক, সে নিজের চোখে দেবে ধূলো আর জিভে দেবে তুলো। বুক ফেটে গেলেও মুখ খুলবে না। ঘর সাজানোর জন্য মুরানো শোপিস, কিংবা শৌখিন বারবেরি কানের দুল, ক্রিস্টালের গ্লাস এসবের বায়না করে? ভদ্র বাড়ির বউরা কি মার্কেটে মার্কেটে ঘোরে? বাউন্ডুলে মেয়েরা এসব নাটক সিনেমা দেখে বেড়ায়, মার্কেটে ঘোরে, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়। সংসারি মেয়েরা না। আজন্মের শখ ছিলো একটা মিষ্টি, আদুরে, সংসারি মেয়ে আমার বউ হবে। বাড়িতে টুকটুক ঘুরবে, কারণে অকারণে চা-নাস্তা বানিয়ে আনবে। দেখবেন, বউ নিজেকে সংসারি প্রমাণ করার জন্যে, স্বামীর পরীক্ষার খাতায় মেধা তালিকায় থাকার জন্যে, মার্কেট, বান্ধবী, নাটক, গল্পের বই পড়া সব বাদ দিয়ে দেবে। শুধু জানবে না, সীতারা পরীক্ষা দিয়েই যায় আজীবন কিন্তু পাশ আর হয় না, কিছু না কিছু খুঁত থেকেই যায়। গৃহকর্মে সাহায্য করার জন্যে পাখি আপা ছিলো আমাদের বাসায় অনেক অনেক বছর। একদিন পাখি আপা বড় হলে সবাই ঠিক করে পাখি আপাকে বিয়ে দেয়া দরকার। পাখি আপার পুরো পরিবার আমাদের কারো না কারো বাড়িতে সাহায্য করে, এদের পুরো পরিবারের দাবী আছে আমাদের পুরো পরিবারের প্রতি। বেশ আয়োজন করেই পাখি আপার বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। পাখি আপার বরকে জাহাজে চাকুরি দিয়ে দেয়া হলো। এটা বেশ সুবিধাজনক সমাধান ছিলো। পাখি আপার বর জাহাজে চলে গেলে পাখি আপা বাসার কাজ করে, জাহাজ থেকে মাসে-দেড় মাসে বর পাঁচ-সাত দিনের জন্যে এসে ঘুরে যায়। তখন পাখি আপা বরের সাথে একটু সিনেমা টিনেমা দেখতে যায়। নতুন বিয়ের আনন্দে পাখি আপা তার বর চলে গেলেই বরের গল্প করতে চায়। বাসার সবাই এটা নিয়ে বেশ বিরক্ত, কেউ তার বরের গল্প শুনতে আগ্রহী নয়। একদিন আম্মি আমার সামনে বললো, স্বামীর নাম নিয়ে কথা বলতে হয় না তাহলে স্বামীর হায়াত কমে যায়। পাখি আপা নিদারুণ দুঃখের মুখ করে ফেললো, এই কয় মাসে কয়েক লক্ষ বার স্বামীর নাম তিনি মুখে উচ্চারণ করে ফেলেছে। বারবার জিজ্ঞেস করে, কে কইছে খালাম্মা, কে কইছে? আম্মি বললো, হুজুরের কাছে শুনেছে। আর আমার খটকা লাগলো, এই যে কাজিনদের বিয়ে হয়েছে, তারাও স্বামীর নাম হাজার বার মুখে আনে, আম্মি তাদেরকে সর্তক না করে, পাখি আপাকে কেন করতে গেলো!!! আমি আম্মির ঘরে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোন হুজুর কোনদিন এটা বললো? আম্মি বিরক্তির গলায় বললো, কে জানে, কিসের! সারাদিন দেখোস না, পটর পটর জামাইর গল্প, বিরক্ত লাগে, এখন মুখটা একটু বন্ধ থাকবে। তারপর আবার আমাকে শাসানি দিলো, তুই কাউকে এটা নিয়ে কিছু বলতে যাবি না, চুপ থাকবি। আম্মির পছন্দের তালিকায় আসার নিদারুণ চেষ্টা থেকে আমি চুপই ছিলাম। শুধু জীবনের এই প্রান্তে এসে অনুভব করেছি, ধর্ম আর প্রথা তৈরিই হয়েছে শাসন আর শোষণ করার জন্যে। কাউকে "চুপ রাখার" জন্যে এর চেয়ে ভাল হাতিয়ার আর হয়ই না। যেখানে পাখি আপাকে পাকড়াও করা যায় সেখানে পাখি আপা আর যেখানে স্বাতী আপাকে পাকড়াও করা যাবে সেখানে স্বাতী আপা। কিসমাত আপনা আপনা।

No comments:

Post a Comment