Sunday 26 February 2023

“পদ্ম পদ্য” – আফসানা কিশোয়ারের সাথে একটি অক্ষিপথ ভ্রমণ

আজকাল কবি হওয়া যত সোজা, মানুষ হওয়া ততো কঠিন। ধৈর্য্য, সহ্য, অধ্যবসায় দিয়ে এই কঠিন পরীক্ষা পার হওয়া প্রানীর সংখ্যা নিতান্ত কম। অবশ্য সেটা সবকালেই কম ছিলো। এই কমের একজন আফসানা কিশোয়ার লোচন, এত সেলফলেস মানুষ অন্তর্জালে অন্তত বিচরণ করে না। নিঃস্বার্থ, পরোপকারী এবং পরিশ্রমী “মানুষ লোচনের” কাছে “কবি লোচন” পরিচয় নিন্তাতই গৌন। গরম গরম ভাজা জিলাপীর গা বেয়ে টসকে পরা রসের মত উপাদেয় সব লেখা, ভিডিও, মীম ইত্যাদির সাথে ভুবনমোহিনী হাসি মাখানো ছবি দিয়ে টাইমলাইন তার মাখামাখি। কোনদিন কোন লেখা টাইমলাইনে আসবে সেটা নির্ভর করে নিতান্তই কবির খেয়ালের ওপর। মন মেজাজ ঢাসু থাকলে আসবে কাঁচামিঠা আমড়া লেখা, যেদিন কবি প্রেমে বুঁদ সেদিন পাঠক পাবে অপু-বুবলি লেখা আর মাঝে মাঝে হৃদয় নিংড়ানো সেরকম পদ্মা নদীর মাঝি জীবনধর্মী লেখা। কবিতা পড়ি, দুষ্টুমি করি, খোঁচাই সব কিন্তু আদতে অপেক্ষা করি সেই জীবনধর্মী লেখাগুলোর। যেগুলো পড়ার পর আমার বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানেতে শিরশির করে। বারবার পড়ি আর ভাবি এরকম অনুভূতি বা ভাবনার মধ্যে দিয়ে তো আমি অহরহ যাই কিন্তু আমি কেনো আমার ভাবনাটা ঠিক এরকম গুছিয়ে লিখতে পারি না? সেই সাত সকালে মোম গলার মত মাঝে মাঝে চোখও গলে আমার। কথা অনেক হলো এখন কিছু কবিতার শুরুর অংশ পড়ে ফেলা যাক, আমার পছন্দের। শুরু করা যাক, কবির পছন্দের প্রেমের কবিতা দিয়ে, যে কথার মানে নেই সই, আমার জন্য যে শাড়িটা ড্রাইওয়াশ করে তুলে রেখেছো তা পাট ভেঙে তুমি এবার পরে ফেলো দ্বিধা ছাড়া। যে রিসোর্টে আমার জন্য গ্লাস সাজানো সেগুলোও অন্য কারও জন্যে ব্যবহার করতে পারো অনায়াসে। তুমি যে পথে হাঁটো সে পথে আমার হাঁটা নিয়তি তা আমি জানি। এ হাঁটাটা হবে একার। তুমি আমাকে প্রার্থনায় রাখো-সে শব্দ আমার কানে মৃতের শোকগাঁথা হয়ে ধরা দেয়। তোমার গ্রহে আমি থাকব, আমার সবটা জুড়ে তুমি-তবু স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা কখনো মুখোমুখি হবে না, তারা পালাবে ভিন্নপথে। তোমার আমার জন্যে কোন অপেক্ষা নেই, আমার আছে অভিমানের বিরহ। সব অনুভব একদিন সকাতরে কেঁদে ডুবে যাবে সাতশ পাঁচ নদীর জলে। আমার ফেরা হবে না তুমি ডাকলে না বলে। অর্থহীন এই অভিমান করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার কিন্তু সবাই শুধু এত গুছিয়ে লিখতে পারে না। কবিকে যারা ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন তাদের কাছে নীচের কবিতা নিতান্তই পরিচিত লাগবে। কবি এমনই, ভাণ-ভনিতা ছাড়া তুমি একটা যাতা আমি তোমারে হ্যাংলা হইয়া কলম কইরা বুক পকেটে রাখি নাই। পোলাপাইন্যা ঢঙে মোবাইলের স্ক্রিনসেভারেও থুই নাই। মানুষ ভালবাসলে শিমুলের তুলা উড়ার ছবিতে তার ফুল এদিক ওদিক ঘ্রাণ ছড়ায় এই আলামত পাইলেই কেউ ভীরু হরিণ হইয়া আমাজনের জঙ্গলে পা বাড়ায়? আমার নাম কি কলঙ্ক যে পাশে বইলেই কালি লাইগা যাইব? আমারে যারা নিন্দা করে তারা তোমারে এমন কইরা মায়া দিব? তারপর সাধারণ মানুষের একটি অসাধারণ দীর্ঘশ্বাস। এক নাম না জানা অচেনা কারো জন্যে ভর সন্ধ্যায় কার না বুক এমন হুহু করে অপেক্ষা কত কত মানুষ আত্মজীবনী লেখে, আমার তেমন কোনো ইচ্ছা জাগে না। ভালোবেসে ভালো না থাকার এক অফুরান আখ্যান আমার লেখার জন্য মন উথাল-পাথাল করে। তারপর ভাবি, আমার কথা লিখে কি হবে? আমি কে যে আমার গল্প সাতকান্ড করে বয়ান করতে হবে? তার চেয়ে তোমার শৈশবের পা যে পথে পড়েছে গুটিগুটি সে ধুলা, তোমার ভেঙে যাওয়া পেন্সিলের গুঁড়া, কাজলদানিতে সর্ষের তেল মেখে প্রদীপের উপর ধরে কাজল বানিয়ে টানা চোখে বসানো সন্ধ্যার অন্ধকার এ যদি অক্ষরে নামাতে পারতাম। আমাদের সবার প্রতিদিন কত শত গল্প জমা হয় কিন্তু লেখা হয়ে ওঠে না। হারিয়ে যাওয়ার গল্প এ গল্প বহুবার বলেছি-যে ড্রেসটা খুব পছন্দের তার কোণা অবশ্যই রিকশা থেকে নামার সময় রিফুর অযোগ্য হয়ে ছিঁড়ে যাবে। যে কানের দুল খুব মানায় তার পুশ খুলে দুলটা হারিয়ে যাবে জনারণ্যে। যে মানুষকে একদিন না দেখলে, কথা না বললে মন প্রাণ দেহ সব সাহারা মরুভূমি মনে হবে-সে দৈনন্দিন থেকে তো বটেই, এমন কি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ব্লক করে দেবে। এবার পড়বো কয়েকটা হৃদয় নিংড়ানো নির্যাসঃ অগুনিত দিন তোমাকে দেখি না। স্ক্রিনে ক্বচিৎ এই দেখায় হয়তো কখনো দূরত্ব সামান্য কম মনে হয়। প্রতিদিন নানা শব্দে তোমার সাথে ভাব বিনিময় করি নিজের মাথার ভেতর। আমি যা ভাবি তার তিন ভাগের এক ভাগও প্রকাশ করতে পারি না। নিজেকে নিয়ে এক লবণ সমুদ্রে ডুবে থাকার ইচ্ছা হয়, যেন আমার ক্ষতেরা কোনোদিন বেঁচে থাকার এই জ্বলুনি না ভোলে। তুমি জানো প্রিয় মানুষের গন্ধ স্পর্শ কেমন হয়? নিশ্চয়ই জানো। কিন্তু এর অভাববোধ তীব্র হলে কেমন লাগে টের পেয়েছো কখনো? আমি যখন মাতৃহারা হলাম, তখন মায়ের পুরনো শাড়ির তৈরি একটা কাঁথায় তাকে স্বপ্নের ভেতর স্পর্শ করতাম, আমার মস্তিস্ক বুঝাতো এর ভেতর আমি মায়ের গন্ধও পাচ্ছি। প্রিয়, আপনে যখন “শুভ সকাল” বলেন তখন আমার এই বৈদেশে রাত ঢলানি দিলেও দিব্য চোখে রোদ দেখতে পাই। ওয়েদার এপে গিয়া আমি ঢাকার হালচাল দেখি-আজ দেখলাম আপনার ঐখানে বৃষ্টি, আকাশ অন্ধকার। আপনে তো বর্ষা প্রিয় মানুষ-এমন দিনে একটু দেরিতে না হয় ব্যবসার চকে যান। বারান্দা দিয়ে হাত বাড়াইয়া জল ছুঁইয়া গরম চায়ের মগে টোস্ট ডুবায়ে আয়েশ করেন একদিন। আপনার তো খালি রাগ আর রাগ-যা অবস্থা তাতে আপনের মিনিমাম এক সপ্তাহ আমার চোখের সামনে শুইয়া বইসা থাকা উচিত। আমি রান্ধুম বাড়ুম আপনে উদাস চোখে আমার দিকে তাকায়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাওন মুখে তুলবেন। প্রতি অক্তে স্নানের আগে আমি আপনের গায়ে প্রাচীন কায়দায় ওলিভ অয়েল মাসাজ কইরা দিব, আপনার ব্যথা বেদনা কিঞ্চিত হইলেও হ্রাস পাইবো। কি চাই? বেঁচে থেকে সুস্থভাবে মরে যেতে চাই। কি অদ্ভূত মানুষের চাওয়া তাই না! এককালে চাইতাম অংক পরীক্ষায় অংকটা ঠিক হোক, তারপর চেয়েছি পাশে থাকা মানুষটা শব্দ করা ছাড়াই মনের কথা বুঝুক। মা হতে হতে মনে হয়েছে কন্যা আমাকে আকন্ঠ ভালবাসুক। এখন নিজের মাথার ভেতর নিজের সাথে বাস করতে করতে মনে হয় রঙবাজির দুনিয়া ধীরে সাদা কালো হয়ে যাওয়া ঠেকাতে চাই। গাছের মগডালে বসে নিচের যে দুনিয়া দেখি তার মিনিয়েচার চোখের মণিতে ভার্স্কয হয়ে বসে যাওয়া চাই না। চাই না মানুষ নামক বিচিত্র প্রাণীর মনের ভেতরটা পড়তে। মানুষকে বুঝতে পারার মতো কষ্ট মনে হয় আর কিছুতে নেই। আমি কি হাত তুলে প্রার্থনা করব কোনো নিদানের আশায়। না কি কবিতার হাত ধরে নিশিগন্ধা রাত পার হব বিড়াল পায়ে! “পদ্ম পদ্য” নামটা আমার কাছে পরীমনির ছেলের গালের মত তুলতুলে নরম নরম লাগে। গাল টেপার মত করে বার বার অকারণেই বলি, বলতে ভাল লাগে তাই বলি। বইটি জুড়ে আছে অসংখ্য “লিমেরিক”। প্রেমিক-প্রেমিকা বইটি অবশ্যই সংগ্রহ করবেন। যেকোন আবহাওয়ায় বা পরিস্থিতে পার্টনারকে মুগ্ধ করতে আপনাকে নিজেকে বেশি ভাবতে বা খাঁটতে হবে না। আপনাদের জন্যে খানিকটা “মুশকিল আসান” হচ্ছে এই “পদ্ম পদ্য”। তানবীরা হোসেন ০২/১৯/২০২৩

No comments:

Post a Comment