Sunday 7 May 2023

বেহুলার ভাসান - ১

আমের রাজ্যের রাজকুমারী হীরাকুমারী, যিনি “হীরাবাই” নামেও পরিচিত, রাজস্থানের রাজপুত ঘরানার রাজা ভারমালের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এটি পড়লে কেউ তাকে চিনতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। যদি বলি মোগল সম্রাট আকবরের স্ত্রী “যোধাবাই” তাহলে অনেকেই চিনবেন কিন্তু সত্যিই তিনি “যোধাবাই” নামে পরিচিত ছিলেন কিনা তা নিয়ে খোদ ঐতিহাসিকদেরই সন্দেহ আছে। ষোলশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক সমঝোতার অঙ্গ হিসেবে হিন্দু রাজপুত রাজকন্যা যোধার সাথে মুসলমান মোঘল সম্রাট আকবরের বিয়ে হয়। বলা বাহুল্য, যোধার চরম আপত্তি ও অমতেই এই বিয়ে হয়। মহান সম্রাট আকবর সম্পর্কে ভিনসেন্ট স্মিথের মত আকবেরর উচ্চ প্রংশসাকারী যিনি “ Akbar- the great Mughal” রচনা করেছেন, তিনি কি লিখেছেন পড়ি, “ আকবর উচ্চতায় ছিলেন গড়পড়তা এবং বাম পায়ের কারনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তার মাথা ডান কাঁধের উপর ঝুঁকে থাকত। তার নাক ছিল ছোট ও সামনের হাড় ছিল মোটা। তার নাসিকা গহ্বর দেখলে মনে হত তিনি রেগে আছেন। অর্ধেক মটর দানার সাইজের সমান একটি আঁচিল ছিল যা ঠোঁট ও নাসিকা গহ্বরের সাথে যুক্ত। সে দেখতে কালো ছিল।” জাহাঙ্গীর লিখেছেন, “আকবর নেশাগ্রস্ত অথবা সর্তকাবস্থায় তাকে শেখ বলে ডাকতেন।“ এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে আঁকবর একজন নেশাগ্রস্থ ছিলেন। আকবরের সহচর ইয়াকুবা লিখেছেন, আকবর এতই মদ পান করতেন যে মাঝে মাঝে অভ্যাগত অতিথিদের সাথে কথা বলতে বলতে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। তিনি মাঝে মাঝে তাড়ি (তালের রস দিয়ে তৈরী নেশা জাতীয় পানিয়) পান করতেন। যখন তিনি অতিরিক্ত পান করতেন তখন তিনি উম্মাদের মত আচরণ করতেন। “মহান আকবরের শিক্ষাগত যোগ্যতা” জাহাঙ্গীর লিখেছেন আকবর মাঝে মাঝে বিদ্বানদের মত আচরণ করতেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন। আবুল ফজল আইন-ই- আকবরে লিখেছেনঃ ” শাহেন শাহ্ আকবরের ঘরের সামনেই একটা শুঁড়িখানা স্থাপন করা হয়। সেখানে অসংখ্য বণিতা জড়ো হত যা গণনা করা কঠিন হয়ে পড়ত। সভাসদগন মাঝে মাঝে নর্তকীদের বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু যদি কেউ কোন কুমারীকে তার বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইতেন তাহলে তাকে অবশ্যই আকবরে কাছ থেকে অনুমতি নিতে হত। কখনো কখনো যুবকদের মাঝে হাতাহাতি শুরু হয়ে যেত। একবার আকবর নিজেই কয়েকজন বনিতাকে ডাকলেন এবং তাদের জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের মধ্যে কে কুমারিত্ব ছেদন করতে চাও।” এখন কথা হচ্ছে, কীভাবে এতগুলো বণিতা একই সময়ে জড়ো হবে? অবশ্যই সেসকল ভাগ্যহীন নারীরা ছিল হিন্দু পরিবারের যারা যুদ্ধাবন্দী অথবা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করে সহায় সম্পত্তি লুট করা হয়েছে এবং আশ্র্য়হীন তাদের বন্দী করা হয়েছে। কারন ধারণা করা হয় মুসলিম রমণীদের পর্দার আড়ালে রাখা হতো এবং আকবর তার গৌরবজ্বল শাসনামলে সারাজীবন অসংখ্য হত্যা ও নারী অপহরণ করে ছিলেন। আকবরের শাসনামলে মিনা বাজার খুবই জনপ্রিয় ছিল যেখানে প্রতি নববর্ষ রাতে বিভিন্ন পরিবারের নারীদের হয় ফুসলিয়ে, প্রতারনা করে অথবা জোরপূর্বক জাঁহাপনার সম্মুখে হাজির করা হতো বেছে বেছে নেওয়ার জন্য। এ সমস্ত রেফারেন্স তুলে ধরা হয়েছে, আকবরের পয়সা খাওয়া তার পছন্দের পরগাছা ইতিহাসবিদের লেখা থেকে, কোন নিন্দুকের লেখা মিথ্যা অপবাদ নয় এগুলো। আবুল ফজল আকবরের হেরেম সম্পর্কে বর্ননা করেছেন, “সেখানে ৫০০০ নারী ছিল এবং প্রতিটি নারীর আলাদা থাকার ঘর ছিল” এছাড়াও আকবরের ৩৬ জনেরও বেশী স্ত্রী ছিল। তবে তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচাইতে আলোচিত হলেন যোধাবাঈ। সম্রাট আকবরকে নিয়ে অনেক লেখাজোকা থাকলেও রাজকন্যা এবং মুঘল সম্রাজ্ঞী হীরাবাঈ মতান্তরে যোধাবাঈকে নিয়ে তথ্য পাবেন খুব সামান্য। তবে জানা যায়, নয়নকাড়া সুশ্রী হীরাবাঈ নিরামিষভোজী ছিলেন, রাজবাড়ির রাজ রঁসুই ঘরের খাবার তিনি খেতেন না, তাঁর রসুইঘর ছিলো আলাদা। রাজপ্রাসাদেই তাঁর আলাদা পূজা ঘর ছিলো। তিনি পড়াশোনা জানতেন, গানের তালিম ছিলো, নিখুঁতভাবে তলোয়ার চালানো, ঘোড়া চালানো জানতেন। মানসিকভাবে দু’জন প্রায় ভিনগ্রহের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও মদ্যপ, লুটেরা, চরিত্রহীন আকবর বাদশাহের কাছে রাজা ভাগলব তার মেয়ের বিয়ে দিতে কুন্ঠা করেননি। এটাকে কি বলা যায়? সতীদাহ না অনার কিলিং? লর্ড কর্নওয়ালিস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় লর্ড বেন্টিকের সাথে মিলে সরাসরি আগুনে “পুড়িয়ে মারা” বন্ধ করতে পেরেছেন কিন্তু “বাঁচিয়ে রেখে মেরে ফেলা”র প্রতিকার কে করতে পেরেছে? খুব নির্মোহ চোখে দেখলে “যোধা”র কি জীবনের ঝুঁকি ছিলো না এই বিয়েতে? বাবা কি মেয়েকে জীবনের ঝুঁকিতে ফেলে দেননি? ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জীবনাচার, ভিন্ন খাদ্যভাসে মানিয়ে নেয়া এতোই সহজ? রাজনীতির কূটকৌশল না থাকলে প্রাণে বাঁচতেন যোধাবাঈ? যুগ যুগ ধরে পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে ঘটে চলা এই “অনার কিলিং” এর কাহিনী লিখতে শুরু করলে, কত সহস্র আরব্য রজনী লেখা যাবে? তানবীরা হোসেন ০৪/০৩/২০২৩

No comments:

Post a Comment