Thursday 18 May 2023

বেহুলার ভাসান - ২

মনির আর রীমা ১৯৮৯ সাল, আমাদের পড়ন্ত কৈশোরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো, “শারমিন রীমা” হত্যাকান্ড। ৯ই এপ্রিল খুন হয় রীমা। সেসময়ের ঢাকা শহরে বিখ্যাত যেকজন গাইনী ডাক্তার ছিলেন তার মধ্যে ডাঃ মেহেরুন্নিসা ছিলেন অন্যতম আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ আবুল কাশেমের একমাত্র ছেলে মনির হোসেন। সর্বদিক থেকে হাই প্রোফাইল কেইস ছিলো, কি নেই এতে? পারিবারিক পরিচয়, বেশুমার টাকা, গ্ল্যামারাস নারী, প্রায় বলিউড মুভির ঘটনার মতোই। রোজ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তিন কলাম জুড়ে নানা ছবি সহ সংবাদ। সাধারণ পরিবারের মেয়ে বা বউ হলে হয়তো বড় জোর ভেতরের পাতায় ছবি ছাড়া একদিনের এক কলামের সংবাদ হতো “রাজধানীতে গৃহবধূ খুন”। তবে অনেক টাকা আর ক্ষমতা সত্বেও ছেলের মা পাবলিক অপিনিয়নের কাছে পরাজিত হয়ে বলেছিলেন, “আমার ছেলে যদি দোষী হয়, তবে তার ফাঁসি হোক”। বিচারে অবশ্য মনিরের ফাঁসিই হয়েছিলো। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সমাজ, সংসার, আদালতে শুধু একপক্ষকে টানা হ্যাঁচড়া করা হয় অন্যপক্ষকে ছেড়ে দেয়া হয় সিনেমার শেষ দৃশ্যর মত “কান্নাকাটি” করার জন্যে। বাস্তবতা হলো, সব ঘটনায় দুইটা পক্ষ থাকে, শুধু যে ছুরি মারে সেই দায়ী? ছুরি মারার ক্ষেত্র যারা প্রস্তুত করে তাদের কেন কোন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে না? রীমার পরিবারের কাছে সমাজের প্রশ্নঃ ১। মেয়েপক্ষ ছেলের পড়াশোনা যাচাই বাছাই করার কোন চেষ্টা করেনি। “এমেরিকা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এসেছে” ছেলে পক্ষের এই কথায় ঈমান রেখেছে। সার্টিফিকেট কিংবা ইউনিভার্সিটি কোনটাই নেড়েচেড়ে দেখতে যায় নি। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দিয়েছে নন ম্যাট্রিক ছেলের সাথে। ২। মনিরের বন্ধু সার্কেল, লাইফ স্টাইল সম্পর্কে কোন খোঁজ নেয়নি। সেটা করলেও পড়াশোনা কিংবা স্বভাবচরিত্রের ব্যাপারটা উঠে আসতো। ৩। ছেলের নিজের ক্যারিয়ার চাকুরী-ব্যবসা নিয়েও তারা মাথা ঘামায় নি। সম্ভবতঃ ছেলের মা-বাবার ক্যারিয়ারই মেয়েপক্ষের জন্যে যথেষ্ট ছিলো। ৪। ছেলের অন্য সম্পর্ক, প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি নিয়েও খোঁজ নেয়া বাহুল্য মনে করেছে। ৫। বিয়ের তিন মাসের মাথায় ছেলেমেয়ের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে, তাও যে সে ঝগড়া না, ছেলে, মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে তারপরও, ছেলে আর “করবে না” বলাতে তারা ছেলেকে বিশ্বাস করে মেয়েকে ছেলের সাথে দিয়ে দিয়েছে। ৬। মেয়েকে ছেলের গার্জেনের সাথে ছেলের বাড়িতে দেয় নি, এই ঝগড়াঝাটির উত্তাল মুহূর্তে একা বেড়াতে নিয়ে যেতে দিয়ে দিয়েছে। মনির বুদ্ধিমান হলে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েই “রীমা”কে শেষ করতে পারতো। আলাদা খুনের প্রয়োজন ছিলো না। ৭। যে ছেলে এতো ছোট বয়স থেকে বিভিন্ন নারীতে আসক্ত, বিয়ের তিন মাসের মধ্যে নতুন বউ রেখে পুরান বান্ধবী/বান্ধবীদের কাছে ছোটে, সে “আর যাবে না” বলাতে রীমার পরিবার সেটাও বিশ্বাস করেছে। কি করে এটা সম্ভব? তিন মাস যে এক বউতে কাটাতে পারে নাই, সে সারা জীবন কাটাবে কি করে? এই ঘটনার সবচেয়ে ট্র্যাজিক পয়েন্ট আমার কাছে যেটা লাগে, “রীমাকে তার মায়ের বাড়ি থেকে, মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে দুই দিনের মধ্যে মেরে ফেলেছে”। শারমিন রীমার বাবা ছিলেন সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ যিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। যে ভদ্রলোক একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন জাতি সত্ত্বার স্বপ্ন দেখার মত দূরদৃষ্টি রাখতেন তাঁর পরিবার এতোটা অদূরদর্শী হয় কি করে! মেয়েকে মরার জন্যে ঠেলে দিয়ে, মারা যাওয়ার পর পুরো পরিবার নিয়ে সবাই কাঁদতে বসে আর আইনের কাছে সুষ্ঠু বিচার দাবী করে যেনো আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়। কেমনে? সব মায়েরা একই কাজ করে ভিন্ন ফলাফল আশা করে কোন মিরাকলের ভরসায়? মনিরের থেকে প্রায় দেড় গুন বয়সী বড় তিন সন্তানের জননী খুকুকে বিয়ে করে মনির যদি ডাঃ মেহেরুন্নিসার সম্মানের হানি করে ফেলে তাই তিনি তার “সোশ্যাল অনার” বাঁচাতে “মধ্যবিত্তের মেয়ে রীমা”কে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন। “সোশ্যাল অনারে”র স্বীকার এখানে মনির আর রীমা’র দুটো জীবন। ***প্রায় পুরো লেখাটা স্মৃতি থেকে লিখছি, কিছু তথ্যের ভুল ভ্রান্তি হয়তো থাকতে পারে।***

No comments:

Post a Comment