Thursday 25 January 2024

আদিবা

আফগানিস্তানের মেয়ে আদিবা, মাত্র ডাক্তারি পাশ করে বেরিয়েছে। যুদ্ধের ডামাডোলে পরিবারশুদ্ধ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইরানের রিফিউজি ক্যাম্পে। সেখানে পাঁচ/ছয় মাস থাকার পর তার খালার সাহায্যে বিয়ে হয় এক ইরানি যুবকের সাথে। বিয়ের দশ বারোদিন পরেই এই নব দম্পত্তি নেদারল্যান্ডসে এসে পৌঁছায়। রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিভিন্ন ধাপ পার করে এবারের ধাপ, “ভাষা শেখা”। আমার সাথে আদিবার আলাপ “ভাষা শেখার” ক্লাশে। দুজনেই এশিয়ান হওয়াতে গল্প জমতে বেশি সময় লাগেনি। পাশাপাশি বসতাম, কফি ব্রেকে গল্প, ক্লাশ ছুটির পর গল্প। যে “আফগান যুদ্ধ” আমি টিভিতে দেখেছি, পেপারে পড়েছি, সে সাক্ষাত আমার চোখের সামনে। আমার অনুভূতি যাকে বলে “বিপন্ন বিস্ময়”। আমার প্রশ্নের শেষ নেই, কৌতুহলের শেষ নেই. বাবামায়ের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই, কবে আবার তাদের দেখতে পাবে জানে না। কিন্তু অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর আদিবা। আজকে হাতে মেহেদি লাগায়তো কালকে চুলে নানারকম বিনুনি করে। আর এদিকে সপ্তাহে চারদিন বাবামায়ের সাথে কথা বলা আমি বৃষ্টি দেখলে কাঁদি, রোদ দেখলেও কাঁদতে থাকি। খালার বাসায় কোন রকম করে হওয়া বিয়ের ছবি আমাকে দেখায় আদিবা, তার চোখে স্বপ্ন, তার বাবা বলেছে, যুদ্ধ শেষ হলে, সবাই আফগানিস্তানে ফেরৎ যাবে আর তখন অনেক বড় করে আদিবার বিয়ের অনুষ্ঠান করবে। আফগানিস্তানে বিয়ে হলে কি কি রিচুয়াল হয় সেসব নিয়ে গল্প করে। ক্লাশ শেষ হয়ে গেলে আমরা যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে যাই। হাজার প্রমিজ সত্ত্বেও নিয়মিত যোগাযোগ আর হয়ে ওঠে না। এন্ডহোভেন তখন অনেক নিরিবিলি ছিলো, মাঝে মাঝেই ডাউনটাউনে আদিবার সাথে দেখা হয়ে যেতো। সময় মিললে দুজনেই ম্যাকে বসতাম, সেই অফুরান গল্প নিয়ে। মিসক্যারেজ হয়েছে আদিবার, বাচ্চা হচ্ছে না সেই নিয়ে স্বামী আদিবাকে দোষ দিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বলেছে, আদিবার সমস্যা নেই, বরের সিমেন কাউন্ট করতে হবে, কিন্তু বর তাতে রাজি হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই আদিবার গায়ে হাত তুলে এসব নিয়ে। খুব মিষ্টি একটা চলন্ত পুতুলের মতো দেখতে আদিবা, মুক্তো ঝরা হাসি যাকে বলে। শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করতো আমার। খুব স্বাভাবিক গলায় এসব গল্প করতো, যেনো কিছুই না। এতো কিছু পেরিয়ে এসেও আদিবা কি হাসিখুশি ফুর্তিবাজ আর আমি সারাবেলা মনমরা। এর অনেকদিন পর, পাঁচ/ছয় বছর তো হবেই, আদিবাকে যখন প্রায় ভুলেই গেছি। ব্যস্ত আমি, দিনের বেলায় আর ডাউনটাউনে ঘোরার সময় নেই। এক বাঙালি বন্ধু নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেছে, বারবার দেখতে যাওয়ার জন্যে দাওয়াত করে তো এক সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত হলো, যেয়ে ঘুরেই আসি। দেখছি একটি মেয়ে দ্রুতগতিতে এই টেবল থেকে সেই টেবলে ছোটাছুটি করছে। ক্ষিপ্রহাতে সার্ভ করছে, ক্লিন করছে। চেনা চেনা লাগতেই সেই হাসি, “আদিবা”। ছোট একটা বাচ্চা আছে (ছেলে না মেয়ে ভুলে গেছি), সন্ধ্যেবেলায় নেইবারের কাছে রেখে সে রেস্টুরেন্টে জব করছে, ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের কারণে ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের সাথে এখন নিয়মিত যোগাযোগ হয়, পয়সা জমাচ্ছে যাবে দেখা করতে। সেই হাসিখুশি, সহজ আদিবা। মিথ্যে লজ্জায় লুকাচ্ছে না, প্রাণখুলে কথা বলছে। অনেকের মতো, আমিও আগে ভাবতাম, কি সাহসী মেয়ে আদিবা! কিন্তু আজ জানি, সাহসের কিছু ছিলো না এখানে, জীবন যখন যে অবস্থায় রেখেছে, আদিবা সেটাকেই মেনে নিয়েছে। পেছনে ফেরেনি, সামনে তাকিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের যুগে বন্ধুত্ব হয়নি তাই আবারো আদিবা হারিয়ে গিয়েছে।

No comments:

Post a Comment