Friday, 8 June 2012

আমার যত সিনেমা - ২


আমি সব কাজে লেট লতিফা। সিনেমাও তার ব্যতিক্রম কিছু না। আমি জানি যে সিনেমাগুলোর কথা আমি বলবো তার বেশিরভাগই ইতিমধ্যে সবার কয়েক দফা দেখা হয়ে গেছে, তবুও সিনেমাগুলো দেখে আমার কি অনুভূতি হয়েছে তাই লিখবো।
এক মুঠো ছবিঃ রুপা গাঙ্গুলী’র প্রোডাকশনের পরিবেশনা এটি। হিন্দি দশ কাহানীয়া ছবির মতো ছয়টি ছোট গল্প নিয়ে সিনেমাটি বানানো। জন্মদিন, পঙখীরাজ, তপন বাবু, রাগুনবাবুর গল্প, তারপর ভালবাসা আর প্রোগ্রেস রিপোর্ট। তারপর ভালবাসা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে। খ্যাতি কিংবা ব্যস্ত জীবনের কারণে আমরা কতোজনকে তুচ্ছ করি, কতো কিছুকে তুচ্ছ করি। কোন দুর্ঘটনা কিন্তু জীবনটাকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। সেরকম, একজন খ্যাতিমান ব্যস্ত অভিনেত্রী কি করে এক দুর্ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েন, তার অসাধারণ গল্পটি উঠে এসেছে। দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন রুপা এখানে। তার অতি অভিনয়ের যে একটা বদভ্যাস ছিলো, সেটা এখানে অন্তত আসেনি। নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কেউ কেউ এই সিনেমাটা দেখতে পারেন। পঙখীরাজ সিনেমাটার হৃদয়বিদারক পরিনতি, আজকালকার ঢাকাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়। বাস্তব হয়তো কিন্তু মন মানতে চায় না। একটি ছোট চায়ের দোকান চালায় মেয়েটি আর স্বপ্ন দেখে একদিন তার সব কষ্ট শেষ হবে আর সে হবে সোকলড ভদ্রলোক। তার চায়ের দোকানের সামনে দিয়েই তার স্বপ্নের রাজকন্যা রোজ অফিসে যায়। কিন্তু বাস্তবের আঘাতে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো। রাগুনবাবুর গল্পটিও অতি বাস্তব। সহ্য করলে যে সামনের লোকটির অন্যায় একসময় বেপোরোয়া হয়ে উঠতে পারে তারই বাস্তব ইতিহাস এটি। বাকিগুলো আপনারা দেখে নিবেন।
ইচ্ছেঃ সুচিত্রা ভটাচার্যের উপন্যাস থেকে করা এই সিনেমাটি। একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত উচ্চাকাংখী মায়ের গল্প। মায়ের হাতে নিষ্পেষিত হতে থাকা, শেষে কিছুটা জেদের বশে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলা ছেলের গল্প। সিনেমাটিতে কিছু কিছু দৃশ্য আছে যা আমাদের টিপিক্যাল বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজকে উপস্থাপন করে। যেমন দুই কাজিনের মধ্যে সাধারণ জ্ঞানের লড়াই আর সাথে মায়েদের আর বাবাদের মুখোভাব। সন্তানের ক্যারিয়ার, প্রেম সবকিছুতে মায়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ। অসহায় সন্তানের নিষ্ফল মনোবেদনা বার বার ফিরে এসেছে। একবার শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যাবে না।
রঞ্জনা আমি আর আসবো নাঃ ছোটবেলা থেকেই আমি দেখেছি কারো পরামর্শে কিংবা উপদেশে সিনেমা দেখলে সেটা আমার ঠিক হজম হয় না। তখন আমরা স্কুলে পড়ি, বলিউড মুভির পোকা। কোন একটা সিনেমা দেখে, তার গান শুনে আমরা হাওয়ায় ভাসছি। এমন এক দুপুরে আমি আর চাচাতো বোন গেলাম, ভিডিও ক্লাবে সিনেমা আনতে। লোকটাকে দুই বোনে ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, খুউউউব রোমান্টিক একটা হিন্দী ছবি দিতে। তিনি দিলেন সানি দেউলের “ডাকাইত”। আমরা দুই বোনে সারা দুপুর সেই সিনেমা দেখলাম আর খুঁজলাম এই বুঝি রোমান্স আসলো এই বুঝি রোমান্স আসলো। এ রকম ডাকাইত অনেকবার আমাদের ওপরে গছানো হয়েছে। রঞ্জনা আমি আর আসবো না ও আমার কাছে সেই ক্যাটাগরীরই লেগেছে। অসাধারণ গান কিংবা গল্প কোনটাই লাগেনি। আর অঞ্জন দত্তের গান শুনে মনে যে ছবি আঁকা ছিল, সিনেমা দেখে সেটা চিরতরে ধুয়ে গেছে। সেজন্যই হয়তো কবি বলেছিলেন, মোষ্ট বিউটিফুল থিংস কানট বী সীন অর ইভেন চাটড। কবি আগেই অভিজ্ঞ ছিলেন।
বেডরুমঃ আধুনিক কালের বেশ আলোচিত সিনেমা এটি। অনেকের কাছেই বেশ প্রশংসা শুনলাম সিনেমাটির। আমার কাছে বেশ গতানুগতিক লেগেছে। এর দুটো কারণ থাকতে পারে, সময়ের আধুনিকতার রেসে আমি পিছিয়ে পড়েছি কিংবা সময় এগিয়ে গেছে। এতো উচ্ছৃখংল জীবন, যা ইচ্ছে তা করা কিংবা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করা, এসবে এখনো চোখ মন অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শুধু বুঝিনি সিনেমার নাম কেন বেডরুম হলো। যেকোন টাইপ নাম হতেই পারতো দ্যান বেডরুম। বানিজ্যক চিন্তা থেকে নাকি কে জানে?
শ্বেত পাথরের থালাঃ অনেক আগে ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, বাবার সাথে বসে। পরিবেশের কারণেই হোক কিংবা গল্প বা সিনেমার কারণেই হোক, সিনেমাটি আমার মগজে আজো দাগ কেটে বসে আছে। অপর্না সেন আর সব্যসাচী চক্রবর্তী, ঋতুপর্না সেনগুপ্ত আর দীপঙ্কর রায় অভিনিত সিনেমাটি। নতুন প্রজন্ম যারা দেখেনি সিনেমাটি তারা দেখে নিতে পারে। ভাল লাগবেই, বিফলে মূল্য ফেরত। ১৯৯২ এর ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছে সিনেমাটি। বানী বসুর লেখা উপন্যাস থেকে এ সিনেমাটি বানিয়েছেন প্রভাত রায়। একটি আধুনিক শিক্ষিত মেয়ের একটি সনাতন পরিবারে বিয়ে হয়। বিয়ের পর ভালই চলছিল গোঁজামিল দিয়ে। হঠাৎ স্বামী মারা গেলে তার বৈধব্য জীবন আর আত্মসম্মানের মধ্যে শুরু হয় চিরদিনের সেই প্রভু – সামন্ত খেলা শ্বশুরবাড়ির সাথে। শেষে ছেলে নিয়ে বাধ্য হয়ে আলাদা হয়ে যান। অনেক কিছু সহ্য করে একা ছেলে মানুষ করলেও, ছেলেও পরে মায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটা হলো খুব ছোট করে দেয়া সিনেমার বিবরণ।
পাদটিকাঃ আজকাল মাঝে মাঝে বাসাটা একটু স্থিতিতে থাকে। সন্ধ্যাবেলা মা মেয়ে এক সাথে বসি আগের মতো। এটা আমাদের প্রিয় একটি জিনিস। একই কম্বলের নীচে দুজন জড়াজড়ি করে বসে ল্যাপটপে ফেসবুকিং করি, সিনেমা দেখি। কুংফু পান্ডা, স্নিউচে, স্পঞ্জ বব, লোলেক পোলেক কিংবা ভূতের ভবিষ্যত। আরো অনেক নাটক কিংবা সিনেমা। আজকাল লক্ষ্য করি আমার নয় বছরের মেঘ, দুষ্ট – মিষ্টি দৃশ্যে লজ্জা পায়। সে তখন কোক আনতে যায়, চিপস আনতে যায়, আইসক্রীম নিয়ে আসে। কিংবা চোখ বন্ধ করে, মুখ ফিরিয়ে রেখে হাসে। ছোটবেলায় মা – বাবাকে ফাঁকি দিতাম, ভাবতাম বুঝে না। আজ জানি জেনে শুনে হাসি মুখেই তারা এই ফাঁকি মেনে নিতেন। এখন এও উপলব্ধি করলাম, কখন মেয়েকে কোক আনতে পাঠাই আর চিপস আনতে পাঠাই তা মেয়েও বুঝে গেছে। আমি শুধু যে রামে ছিলাম সেই রামেই আছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রাসেল আশরাফ ছেলেটা আমার অফিস – বাসা, বাসা – অফিস মার্কা বৈচিত্রহীন প্রবাস জীবনে প্রায়ই একটু আনন্দের ছোঁয়া রেখে যায়। আপা, এই ফিল্ম কিংবা নাটকটা দেইখেন। কিংবা গানটা শুনেন। আর আমার সিনেমা, সফটওয়্যার, গান যেকোন দরকারে একটু নক করলেই হলো। দরকার হলে রাত জেগে কাজ করে দিবে। কোনদিন সামনে থেকে না দেখা এই ছেলেটা অন্য দেশে থেকেও আমার দৈন্দদিন জীবনে একজন পারিবারিক সদস্য। সুখ আমার কপালে সয় না। পুলাটা বিয়ে করতেছে। কোন ডাইনি আমার এই ভাইকে কেড়ে নিচ্ছে। বিয়ের পর জীবন বদলে যাবে। ব্যস্ততা বদলে যাবে। হয়তো এই টুক টুক করে দেয়া লিঙ্কগুলো আর ফেসবুকের ম্যসেজ বক্সের ওপরে লাল টিপ হয়ে জ্বলবে না। তবুও দুয়া করি পুলার জীবনটা সুখে কাটুক। দিল্লী কা লাড্ডু খেয়েই গান করুক, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
তানবীরা
০৬/০৯/২০১২

Tuesday, 29 May 2012

আপা একটু তাকান, প্লিইজ লাগে


৩০মে তারিখের বাংলাদেশনিউজ২৪ এর জাতীয় থ্রেড এর নীচে নিম্নোক্ত এই লিঙ্কগুলো পেলাম।
আবারো পুলিশের হাতে সাংবাদিক নির্যাতিত http://www.bangladeshnews24.com/2012/05/29/38679.htm
পুলিশের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী নারীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ, প্রতিবাদকারীকে লাঠিপেটা
বরিশালে গৃহবধূর শ্লীলতাহানির চেষ্টা, এএসাই বরখাস্ত
চরফ্যাশনে পুলিশ দস্যু বন্ধুক যুদ্ধে পাঁচ দস্যু নিহত
যেভাবে পুলিশ শুরু করেছে তাতে কি দেশে গুন্ডা বদমাইশের আদৌ আর প্রয়োজন আছে? গুন্ডা বদমাইশরা লজ্জা পাচ্ছে পুলিশের পারফর্মেন্স দেখে। তারাতো পুলিশের কাছে হেরে যাচ্ছে। মানুষতো পুলিশ শব্দের সাথে গুন্ডা বদমাইশ শব্দার্থ গুলিয়ে ফেলছে।
“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
এখন পালটে হবে,
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো পুলিশ এলো পাশে”
ক্ষমতার দাপট কি জনগন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আপা। প্লিইইজ লাগে আপনার উর্দি পরা পোষা গুন্ডার দলকে একটু থামান। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি কিছুই বুঝতে চাই না। কর দিচ্ছি জানে খাটা পয়সা থেকে তার বদলে নিরাপত্তা চাই শুধু নিরাপত্তা। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে গেলে সুস্থ শরীর বেঁচে ঘরে ফেরার নিরাপত্তা। যাকে ইচ্ছে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যাকে ইচ্ছে গুম। যাকে ইচ্ছে মেরে ফেলে দিচ্ছে। সাংবাদিক থেকে কূটনীতিক। কোন সভ্য সমাজের অঙ্গ কি আমরা? জঙ্গল হয়ে যাচ্ছে। একশ বছর আপনারাই ক্ষমতায় থাকেন। আপনারা কিংবা কোন দল ক্ষমতায় থাকে তা দিয়ে সাধারণ জনগনের জীবনের চার আনা লাভ কিংবা পরিবর্তন হয় না। শুধু কতোগুলো স্থাপনার নাম পরিবর্তন সূরা দোয়া কালামের মতো আমাদের মুখস্থ রাখতে হয়। তাও সই, গত চল্লিশ বছর তাই করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। শুধু আমাদেরকে প্রাণে মেরেন না। যা নেয়ার নেন আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দেন। আমাদের সম্মান ভিক্ষা দেন।


Friday, 11 May 2012

বইমেলা কড়চা – (চার) মালাইয়ের স্বাদ পনিরে


ঢাকায় বইমেলা চলার সময় খুব নষ্টালজিক অনুভব করছিলাম। সেই নষ্টালজিয়া কাটানোর জন্যে ফান করে স্যাটায়ার লেখায় হাত দিয়েছিলাম। আমার সমস্ত শখের কাজের মতো যথারীতি এটিও অসম্পূর্ণ আর আধ খ্যাচড়া রয়ে গেলো। এ বছরের মতো এ পর্বটিই আমার এই সিরিজের শেষ লেখা। নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরীন আমার এ পর্বের লেখিকা। তার প্রকাশিতব্য বই কেমন হতে পারে তা নিয়ে আমার আজকের কল্পনা। তসলিমা নাসরীনের উপন্যাস প্রায় প্রত্যেক বইমেলাতেই বের হয় এবং যথারীতি পালাক্রমে বাংলাদেশ ও কোলকাতায় নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। বই নিষিদ্ধ ঘোষনার এ রীতি এশিয়া ছাড়া আর কোথাও আছে কি না, আমার জানা নেই। আমার ব্যক্তিগত ধারনা তিনিও নির্বাসনে বসে একটি পাশবিক আনন্দ উপভোগ করেন, বই নিষিদ্ধের এই হুল্লোড় থেকে। বেছে বেছে কখনো কখনো অকারণে এমন জিনিসই লিখে পাঠান, যাতে বইটা যেকোন মূল্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অক্ষম মানুষের হতাশ প্রতিশোধ নেয়া। আমি তসলিমার নির্বাচিত কলাম, কবিতার একজন মুগ্ধ পাঠক। আমি জানি অসংখ্য ভক্ত তার আছে, তারা যেনো আমার এ লেখাটিকে একান্তই স্যাটায়ার হিসেবে নেন, এ প্রার্থনা থাকবে।

তসলিমা প্রসংগে লিখতে যেয়ে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত একটি মতামত এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি যথেষ্ট একজন শক্ত মানুষ, অন্যদের প্রেরণা দেন, পথ দেখান। কিন্তু সব ব্যক্তিগত ঘটনাকে জনসম্মুখে (পাবলিক) তুলে ধরেন। ব্যাপারটা কতোটা নৈতিক? যৌনজীবনকে প্রত্যক সমাজেই ব্যক্তির একান্ত ব্যাপার বলে ধরা হয়। তিনি নিজের সম্মতিতে, স্বইচ্ছায় কারো সাথে ব্যক্তিগত সময় উপভোগ করার পর, লাঞ্চিত নন, উপভোগ করার পর তিনি তা নিয়ে বই লিখে সারা পৃথিবীর মানুষকে সেটা ঢোল পিটিয়ে জানাবেন, কেনো? তিনি কি তার সঙ্গীকে এজন্য সংগ দেন যে এরপর মতের অমিল হতে পারবে না? মতের অমিল হলেই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার লিখে তাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় প্রচন্ড হতাশায় তিনি যা করে চলেছেন, প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তা আসলে এক ধরনের অসুস্থতা। যাক এ আলোচনা। আসুন আমরা প্রকাশিতব্য বইয়ের কল্পনায় যাই। ধরা যাক তসলিমার এই বইটির নার ঙ।

আমার ভীষন মন খারাপ ক্লান্ত লাগছে। রিকশা করে যাচ্ছি। হঠাৎ বসুন্ধরার কাছে গিয়ে মনে হলো, কিছু টুকিটাকি জিনিস নেয়া দরকার বাসার জন্যে। আমি কিছু বাসন কোসন, ঘর সাজানোর টুকিটাকি কিনে হাটছি এখন কিছু সিডি কিনবো। হঠাৎ “এ” র সাথে দেখা। আমি দেখতে পাইনি, সেই আমাকে দেখেছে। দেখে হাত নেড়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আমি কেমন আছি। আমি বল্লাম ভালোই। এর আগে “এ”র সাথে আমার বার কয়েক পত্রিকা অফিসের সাহিত্য আড্ডায় দেখা হয়েছিল। সুঠাম দেহের এ ছেলেটির কথাবার্তা বেশ আধুনিক আর মননসম্পন্ন মনে হয়েছে। আমাকে বললো, চলুন কোথাও বসে একটু চা খাই। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। এমন টেনশনের মূহুর্তে একটু সুন্দর সংগ পাওয়ার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না। কথায় কথায় জীবনানন্দ দাশের কবিতার আলোচনা উঠল। জানলাম তার কাছে কিছু দুস্প্রাপ্য পেপারকাটিং আছে জীবনানন্দ দাশের কবিতার ওপরে। কবিতা আমার সারা জীবনের ভালবাসা। সে যখন আমাকে তার বাসায় পরদিন দুপুরে নিমন্ত্রন করলো, আমি না করার কথা ভাবলামই না। সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। আমার মাথায় তখন শুধু পেপার কাটিং ভাসছে। অন্যকোন সম্ভাবনার কথাই মনে আসলো না।

পরদিন দুপুরে আমি গেলাম তার বাসায় জীবনানন্দের কবিতার ওপরের আলোচনা দেখতে। “এ” আমাকে তেহারি আর কোক খেতে দিল। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে আর আমরা দুজন মুখোমুখি বসে কবিতা নিয়ে আলোচনা করছি। বাসায় আর কেউ নেই। হঠাৎ “এ” তার সোফা থেকে উঠে আমার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। আমি ব্যাপারটা না বোঝার ভান করে এড়িয়ে আর একটু সরে বসার চেষ্টা করলাম। “এ” সেটাকে তুচ্ছ করে আমার কোমড় জড়িয়ে আমাকে ওর দিকে ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আমি সরার জন্যে জায়গা খুঁজছি। কিন্তু এর মধ্যেই “এ” এর তার ঠোঁট দিয়ে আমার ঠোঁট চেপে আমাকে চুমু খেতে শুরু করে দিলো। আমি প্রানপনে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম তার হাত আমার প্যান্টের বেল্টের ওপর। শক্তিতে আমি তার সাথে পেড়ে উঠছি না। সে আমাকে মেঝেতে ফেলে দিল, আর একহাতে টেনে আমার শার্ট খুলে ফেলল। আমি প্রায় জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে রইলাম। আধ ঘন্টা কিংবা তারো কিছু সময় পড়ে যখন আমার চেতনা ফিরল তখন দেখি আমরা পাশাপাশি শুয়ে আছি, দুজনেই বিবস্ত্র।

আমি অপমানের জ্বালা মনে নিয়ে, কাপড় গুছিয়ে, একরাশ ঘৃনা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি ফিরলাম। মানুষকে কিভাবে বিশ্বাস করবো। সামনে দেখা হলে যে শ্রদ্ধা বিণয়ে গলে পড়তো, একা পেয়ে সেই কিনা এ চেহারা? পুরুষ জাতটাই বিশ্বাসঘাতক। মন থেকে আস্তে আস্তে সমস্ত পুরুষদের প্রতিই শ্রদ্ধা চলে যেতে লাগলো। সারা সন্ধ্যে বসে একটা সাপ্তাহিকের জন্যে কলাম লিখার চেষ্টা করলাম। কাটলাম লিখলাম আবার কাটলাম। কাটাকুটি করতে করতে মনে যা আসে তাই লিখে রেডি করলাম, সকালেই আসবে নিতে তাদের পিয়নটা। পরের দিন আবার রাঙামাটি যেতে হবে, কবিতা পড়ার উৎসব আছে, সেজন্যও কিছু প্রস্তূতির প্রয়োজন। ভোর চারটার দিকে ঘুমোলাম। দুপুর বারোটায় উঠে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে পত্রিকা আর খাবার নিয়ে বসেছি। বিকেলে একটা মাইক্রোবাসে রওয়ানা হবো আমরা কিছু কবি একসাথে। চারজনকে আগে থেকেই চিনি। দুজনের কবিতা পড়েছি আলাপ হয়নি এখনো। পুরো গ্রুপে আমি একাই মেয়ে। এখনো কিছু গোছগাছ হয়নি। খেয়ে যাবো কাপড় গোছাতে। শাড়ি নিবো কিনা জানি না। আজকাল শাড়ির চেয়ে বেশি প্যান্টেই স্বচ্ছন্দবোধ করি। কিন্তু কবিতা পড়তে গেলে শাড়ির একটা আবেদেন বাঙ্গালী সমাজে কাজ করে ভেবে ঠিক করলাম শুধু সে সময়টুকুর জন্যে একটা শাড়ি নিয়ে যাবো।

সন্ধ্যায় মাইক্রোবাসে চড়ে রওয়ানা হলাম আমরা সবাই। সবাই বেশ ছুটির মুডে আছেন। গাড়িতে বেশ হাই ভলিউমে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে চিন্ময়ের গলায়। মাঝে দু একবার থেকে আমরা সবাই ধূমপান করলাম, চা খেলাম। চা খেতে খেতে অপরিচিত কবিদের সাথে পরিচয় আর আলাপ হলো। একজন আমার কবিতা নিয়ে খুব গদগদ। একটু রুক্ষ চুলের, গাল ভাঙ্গা চেহারার হলেও চোখ দুটো তার বেশ মায়া মায়া। আমার লেখা বেশ পড়ে বোঝা যায়। আমার লেখার ভঙ্গী আর পাঠকের পতিক্রিয়া নিয়ে আমরা গাড়িতেও অনেক আলোচনা করতে করতে আমরা সকাল আটটার দিকে রাঙামাটি গিয়ে পৌঁছালাম। নাস্তা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা একটু মেঠো পথে হাটতে বেড়োলাম। আবৃত্তি উৎসবের আয়োজকরা ভীষন ভালো করে সবকিছুর বন্দোবস্ত করে রেখেছিল যাতে আমাদের শহুরে লোকদের কোন সমস্যাই না হয়। ইট পাথর বাদ দিয়ে প্রকৃতির কাছে আসলে মনটা হু হু করতে থাকে। কি যেনো নাই এমন একটা একাকীত্ববোধ তাড়া করে ফিরে। হারানো দিনে ফিরে যাই। কাউকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিলো তখন। এমন সুন্দর মেঠো পথে হাটতে হয় কারো কোমড় জড়িয়ে নিদেন পক্ষে হাতে হাত রেখে। কিন্তু আমার এমন কে আছে? যেই কাছে এসে কোন না কোন উদ্দেশ্য এসেছে। শুধু আমাকে ভালোবাসে কেউতো আসেনি।

সন্ধ্যায় আবৃত্তির উৎসব চমৎকার হলো। আমি পাহাড়ি ফুল খোঁপায় গুঁজে অন্যদের সাথে আড্ডায় মজে আছি। তারপর একে একে সবাই বিদায় নিতে আরম্ভ করলো। সেই রুক্ষ চুলের গাল ভাঙ্গা আমার পাশে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো খাবেন না? আমি বল্লাম, হ্যা, এইতো যাই। সে বলল চলুন একসাথেই যাই। আমিও রাজি হলাম। টুকটাক গল্প হতে হতে খাওয়া দাওয়া হতে লাগলো। আমি হঠাৎ বললাম একটু ড্রিঙ্কস থাকলে মন্দ হতো না। গাল ভাঙ্গা লাজুক হেসে আস্তে বললো, আমার কাছে আছে খানিকটা। এখানে আনলেতো সবাই এক নিমিষে উড়িয়ে দিবে। আপনি রুমে যান আমি ওখানে নিয়ে আসছি। বোতল নিয়ে একটু পর সে রুমে এলে, আমরা অনেকক্ষণ নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলাম। হালকা হালকা নেশা হচ্ছিল। গাল ভাঙ্গা তার ব্যর্থ প্রেমের গল্প বলছিলো। কি করে তার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়ে তার বাল্যকালের সখী তারই ধনী এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে বিয়ে করে সুখে ঘরকন্না করছে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। এ প্রথম আমি কোন ছেলেকে তার হারানোসঙ্গীর জন্যে কাঁদতে দেখলাম। আমার মনটা করুণায় ভরে গেলো তার জন্যে। আলতো করে তার গালে হাত দিতেই সে আমার পায়ের পাতায় চুমু খেতে লাগলো। হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমিতে, আমাকে জড়িয়ে বলতে লাগলো, আমি তোমার মধ্যে অনেককিছু খুঁজে পেয়েছি। তুমিই আমার আসল প্রিয়া।

নিজের একাকীত্বের সাথে ছিল সেদিনের সে অপমানের জ্বালা। আমিও সে পরিবেশে নিজে উন্মাদ হয়ে উঠলাম। মাতালের মতো তার সাথে শরীরের খেলায় আমিও মেতে উঠলাম। কোন প্রতিশোধের নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল কে জানে। নিজের ইচ্ছেমতো তার দেহটাকে আমি ব্যবহার করলাম। কথা ছিল আমি তার পরদিনই ঢাকা চলে আসবো। কিন্তু সবাই চলে আসলেও আমি আর গাল ভাঙ্গা রয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে অনেক কথা, ভালবাসা, ওয়াদা আদান প্রদান হলো। কোনভাবে আরো তিনদিনের ছুটি ম্যানেজ করে আমরা যেনো সেখানে মধুচন্দ্রিমা যাপন করলাম। সে আমাকে কথা দিলো, সবসময় আমার পাশে থাকবে, কোন বিপদে কোন কারণেই আমাকে ছেড়ে সে যাবে না। দুজন দুজনের সাথে ভালবাসার চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমরা অবশেষে বাসে করে ঢাকা ফিরলাম। আমি খুবই আনন্দিত, কাণায় কানায় পূর্ণ। এতোদিনে কাউকে আমার নিজের করে পেয়েছি। সন্ধ্যা হয়ে গেলো এখনো গাল ভাঙ্গার ফোন না পেয়ে আমি অবাক। এতোক্ষণ ফোন না করাটা কেমন যেনো একটু দৃষ্টিকটু লাগলো আমার কাছে। সকালে আমরা দুজন বাস থেকে নেমে যার যার বাসায় গেলাম আর সন্ধ্যে পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কথা হবে না। পরে ভাবলাম, হয়তো ক্লান্ত এখনো ঘুমিয়ে আছে, আমিই ফোন করে খোঁজ নেই। ফোন ধরলো এক অল্প বয়সী মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম তিনি কোথায়? মেয়ে বললো সে তার মেয়েকে নিয়ে ছাঁদে খেলছে। আমার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। নিজেকে অতি কষ্টে সামলে নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর আপনি? মেয়েটি বললো, তিনি আমার স্বামী। মাথা ঘুরে গেলো আমার আমি টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেলাম।

রাঙামাটির পর থেকে নিজেকে আমি কাজে ডুবিয়ে দিলাম। সকাল থেকে সন্ধ্যে হাসপাতাল তারপর বাকি সময়টুকু লেখালেখি। গাল ভাঙ্গাও কোন অদৃশ্যকারণে আমার সাথে আর যোগাযোগ করেনি। আমিও করিনি তার সাথে। হঠাৎ একদিন আবার “এ” এর সাথে দেখা। আমার বাসায় এলো সন্ধ্যেবেলা আমার খোঁজ নিতে। প্রথমে বিরক্ত তারপর অবাক আমার খোঁজ নেয়া মানে? সে বললো, বেশ অনেকদিন কোথাও আমি যাই না, কেমন আছি, কি হয়েছে, জানার জন্যে সে উৎসুক তাই বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে বাড়িতে চলে এসেছে। প্রথমটায় রেগে গেলেও পরের দিকে আমার ভালোই লাগছিল। চা খেতে খেতে আমরা আবার সাহিত্য আলোচনায় ডুবে গেলাম। এরপর থেকে মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা “এ” আমার বাড়িতে আসতে লাগলো। দুজন চা খাই, সাহিত্য নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, অন্যান্য লেখক বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা করি। একদিন বারান্দায় দুজন বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছি। হঠাৎ “এ” আমার হাত ধরে তারদিকে আকর্ষন করে কাতর গলায় মিনতি করে বললো, কাল দুপুরে আমার বাড়ি আসবে একবার? আমার অনেকদিনের উপোষী শরীর এ কাতর আবেদন উপেক্ষা করতে পারলো না। এরপর থেকে আমি মাঝে সাঝেই “এ” এর বাড়ি যাই। দুজনে একসাথে অনেক আনন্দ করি। শুধু আনন্দ দেই না, আমিও নেই। আমার ভাল লাগে “এ” এর সংগ।

এদিকে আমাকে নিয়ে সমালোচনা বাড়তেই থাকলো কিছু কিছু পত্রিকায়। আমিও রক্ত মাংসের মানুষ। বিরক্ত আমারো লাগে। আমি “এ”কে প্রায়ই বলি সে এবং তার অন্য কবি বন্ধুরা কেন কোন প্রতিবাদ লিখে পাঠায় না। “এ” এড়িয়ে যায়। বলে কি দরকার এতো ঝুট ঝামেলা বাড়িয়ে। তুমি কেনো আরো একটু মোলায়েম করে লিখো না। এতো তর্কে যাওয়ার দরকারই বা কি তোমার? সত্যি যখন একদিন আমি ঝামেলায় পড়লাম, “এ”কে ফোন করি, সে ফোন তুলে না। একবার, দুবার, দশবার। ফোন বেজে যায় কেউ তুলে না। মেইল করি নো রিপ্লাই। আমিও নাছোড়বান্দা, ফোন করেই যাচ্ছি। একদিন ফোনে পেয়ে গেলাম। বললাম, কিরে আসিস না কেনোরে তুই? সে আমাকে উলটো বললো, আমি যেনো ক্ষমা চেয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দেই। আপোষ করে নেই। সবকিছু নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। আমি হতভম্ব। এই তাহলে পাশে থাকা। নির্বাক আমি আস্তে আস্তে ফোন ছেড়ে দিলাম।

তানবীরা
১২/০৫/২০১২


Thursday, 3 May 2012

জীবন থেকে নেয়া (টুকরো টাকরা সুখের গল্প )


ঢাকা গেলে যা দেখি তাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে নিউমার্কেট আর গাওছিয়া যাই শুধু খাওয়ার জন্যে। কিছুই কিনি না, এ দোকান ও দোকান ঘুরি তারপর খাই, আবার খাই। হালিম, মোরগ পোলাও, শিক কাবাব, জিলাপি যা পাই তাই। একদিন কি কি অনেককিছু খেয়ে শপিং শেষ করে বেড়োতে যাবো আজিমপুরের সাইডের গেট দিয়ে, দেখি ওমা ঐখানের গেটের পাশের ছোট দোকানটায় কোণ আইসক্রীম বিক্রি হচ্ছে, সেটা খাওয়া হয়নি। বল্লাম পাশের লোককে। তিনি মহা বিরক্ত হলেন। প্রবাসীরা আমরা দেশে এলে অতিরিক্ত সচেতন থাকি। কোথায় কে আমাদের টাকা ছিনিয়ে নিয়ে উড়ে যায় সেই দুশ্চিন্তায়। আর এ ভদ্রলোকের সাথে এ ঘটনা বেশ কয়েকবার হওয়াতে তিনি মহাসতর্ক। তিনি তিক্ত গলায় বললেন, রাত বাজে নয়টা, এখন সব টাকা আমি গুছিয়ে ফেলেছি, কে কোথায় কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনদিক থেকে দেখবে, গুঁতা দিবে, আইসক্রীম খেতে হবে না, চলো বাসায়। আমি বল্লাম অসম্ভব আইসক্রীম না খেলে আমি আজ রাতেই মারা যাবো। আইসক্রীম আমাকে এখন খেতেই হবে। তিনি বুঝলেন আমি আজ রাতে আইসক্রীম না খেয়ে যাবো না। দোকানে যেয়ে বললাম, আইসক্রীম দেন। আর উনি দুই পকেট সাফ সুতরো করে ঝেড়ে যা খুচরো ছিল দোকানদারের তাকের ওপর রাখলেন। দোকানদার অসীম ধৈর্য্য সহকারে সেগুলো গুনে দেখলেন মাত্র সাতাশ টাকা। বিরক্ত গলায় বললেন, আইসক্রীম পঁয়ত্রিশ টেকা। আপনেতো মাত্র সাতাইশ টেকা দিলেন। তিনি বললেন ভাই, আপনাকে পঁয়ত্রিশ টাকার কোণ দিতে হবে না। আপনি সাতাশ টাকার কোণই দেন। আপনার মেশিন, আপনার স্বাধীনতা। আপনি জোরে চাপ দিয়েন না। অল্পচাপে যতোটুকু পড়বে, ততোটুকুই চলবে। চাইলে আপনে আরো কম দেন, পঁচিশ টাকার দেন। রাত নয়টায় দোকান বন্ধের সময় কোন উটকো চাপে পড়লো ভেবে দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর মেশিন চেপে কোণ দিয়েই দিলেন। আজ প্রায় সাত আট বছর আগের কথা। কিন্তু এখনো সেই রাতের কথা ভাবলে, দোকানদার ভদ্রলোকের প্রথমে হতভম্ব তারপর গম্ভীর মুখখানা মনে পড়লে অজান্তেই হেসে ফেলি। কি বিপদে না ফেলেছিলাম তাকে।
আমি রান্না করতে থাকলে, কাজ করতে থাকলে মেঘ খুবই নিঃসংগবোধ থাকে। ঘুরে ঘুরে বলে মা, আমি কি করবো? আমার খুব একা লাগছে। আমি মাঝে মাঝে আমার সাথে কাজ করতে ডাকি। আলু খুলে দেয়া তার প্রিয় কাজ, পেঁয়াজ খুলতে বেশি পছন্দ করে না। সালাদ বানায়। টেবল থেকে প্লেট গ্লাস এনে রিঞ্জ করে ডিশ ওয়াসারে ঢুকায়। একদিন নিজে নিজে ডিম ভাজতে চাইলো। সব নিজে করবে, আমি যেনো না ধরি। করলো একা একা সব। গরম প্যানে তেল দেয়া থেকে শুরু করে সব। এখন এক যন্ত্রনা হয়েছে, রোজ ডে কেয়ার থেকে ফিরেই বলবে, আমি আজকে ডিম ভাজা আর ভাত খাবো। আমি একা একা ডিম ভাজি মামা? এখানে ডাক্তার সপ্তাহে তিনটের বেশি ডিম খেতে না করে। ডিম ভাজা শিখে এখন নিত্য অশান্তি।
P1070365
মেঘ সপ্তাহে একদিন ক্ল্যাসিক্যাল ব্যালেট শিখতে যায়। ব্যালেট আমাদের দেশের নাচের কায়দা থেকে পুরোই আলাদা। তারপরও এখানে বৈশাখী কিংবা বিজয়া, স্বরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে নাচের ডাক আসলে বাংলা কিংবা কখনো কখনো হোলি দিওয়ালিতে হিন্দী নাচ শেখানোর চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে চেষ্টা কিছুটা উতরায়। এবার মনে হলো কিছুটা উতরেছে। মেঘের নৃত্যকান্ড
399022_210082155768338_209920182451202_325958_292986166_n
ডাচ বাচ্চাদের জন্য সাঁতার জানা বাধ্যতামূলক। সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচের দেশের লোকদের প্রতিনিয়ত পানির সাথে লড়াই করে এক সময় বেঁচে থাকতে হতো। এতোদিন সরকার অনুদান দিতেন স্কুল থেকে বাচ্চাদের সাঁতারে নিয়ে যাওয়া হতো। এখন সরকার অর্থনৈতিক মন্দার ভাব ধরে ক-স-ট কাটিং করছেন সবকিছুতে। সাঁতার শিখতে হবে তবে স্কুল আওয়ারে আর নয়, অবশ্যই সরকারি পয়সায় নয়। বাবা – মাকে নিজের পয়সায় স্কুলে টাইমের বাইরে করাতে হবে। মেঘ বেসিক সাতার আগেই শিখেছিলো। চৌদ্দ তারিখে নৃত্য দিয়ে পনেরো তারিখে বেসিক প্লাস সাঁতারের পরীক্ষা দিয়ে ডিপ্লোমা নিয়ে আসলো। এখন রেস ক্যু টিমের সাঁতারে যাচ্ছে। কাপড় টাপড় পড়ে সাঁতার করে, কেউ ডুবে গেলে কি করে টেনে আনবে, ঝড় বৃষ্টিতে কি করে সাহায্য করবে অন্যদেরকে, সে ক্লাশ করছে। ভাবি ঘরে বসে বসে টিভি দেখবে, নড়বে না চড়বে না, থাক। সাঁতারের উছিলায় নড়ুক চড়ুক।
P1070446
P1070402
নেদারল্যান্ডস মানেই সাইকেল। দেড় কোটি জনগনের এক কোটি সত্তর লক্ষ সাইকেল। বাচ্চারা একটু বড় হলে সাইকেল নিয়ে বের হয়। ট্রাফিক আইন জানা থাকা নিতান্ত জরুরী। স্কুলে প্রথমে থিওরি শিখায় ক্লাশ টুতে। তারপর টিচাররা সাথে নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে হেঁটে প্র্যাক্টিকাল করায়। হাটার বেসিক রুল জানার পর সাইকেল। এরপর ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্র্যাক্টিস করানোর পর আসে পরীক্ষা। স্কুলে সাইকেল নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ডিপ্লোমা নিতে হয়। ষোল তারিখে ময়না পাখি সাইকেল ডিপ্লোমা পেলো। এক নৃত্য ছাড়া কোনটাতেই মা-বাবা সাহায্য করিনি। তারপরো সে নিজে নিজে সব করে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি তোমাকে একটু প্রাউড করেছি মামা?
P1070458
অনেক কষ্টাকষ্টির দিনের মধ্যে এগুলো হলো এক টুকরো সুখের ছায়া, বন্ধুদের ছাড়া আর কার সাথে ভাগ করবো এগুলো?
তানবীরা
০২/০৫/২০১২

Friday, 27 April 2012

বদলে যাওয়া জীবনের গল্প


কিছুদিন আগে বিপুল উন্মাদনার মধ্যে দিয়ে এশিয়া কাপ ক্রিকেট খেলা হয়ে গেলো দেশে। আমি কোন কারণে তখন একজন ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলাম। সে ভীষন উত্তেজিত। ক্রিকেটে ইনফো ডট কমে খেলার স্কোর দেখেই তার এতো উত্তেজনা। মুহুর মুহুর ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করছে। আমার নিরুত্তাপ গলার জাগতিক ব্যাপার নিয়ে আলোচনা তাকে এতোটাই হতবাক করলো যে সে বলেই ফেললো, আপু খেলা দেখছেন না? আমি বললাম না, সময় নেই। তারপর সে বিস্ময় গোপন না করেই বললো, আপনি বোধহয় খেলা মানে ক্রিকেট ততো ভালবাসেন না। আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে শুধুই হেসেছি। কিন্তু কথাটা দিনভর কেন যেনো মাথায় গেঁথে রইলো। “ভালোবাসা” --- কতো দ্রুত সময়ের সাথে বদলে যায়। জীবনের প্রায়োরিটি পরিবর্তন হয় আর তার সাথে এই ভালোবাসা। আমি ফিরে যাই আমার হারানো অতীতে।
নব্বই এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন। বায়ান্ন, উনসত্তর কিংবা একাত্তরতো আমি দেখিনি। স্কুল বন্ধ আর আমরা সবাই সারাদিন দৌড়ে দৌড়ে ছাঁদে যাই, আন্দোলন দেখি। তখন ঢাকা জুড়ে এতো হাই রাইজ ফ্ল্যাট ওঠেনি। সাধারন পাঁচ তলা, ছ’তলা বাড়ি থেকেও অনেকদূর দেখা যেতো। সায়েন্সল্যাব কিংবা শুক্রাবাদ নিউমডেল হাইস্কুল কাম কলেজের সামনে ছাত্ররা টায়ার পুড়ায়, আর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। আহা কাঁদানে গ্যাস। আমরা স্কুলে গোয়িং লিটিস পিটিসরা এর কথা শুধু পেপারে পড়ি, ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা খায়, আহা আমাদের সে ভাগ্য কবে হবে। একদিন ছাঁদে কেমন যেনো চোখ জ্বালা করে উঠলো, আব্বু বললেন এই হলো কাঁদানে গ্যাস। কাঁদাতে দিয়েছে। কেঁদে কেঁদে ও মনে হলো জীবন সার্থক। আব্বু রেডিওতে বিবিসি শোনেন, আব্বুর বন্ধুরা, পাড়ার চাচারা আসেন, রাজনীতি, সিনেমা হরেক রকমের গল্প হয়। অনেক দূর থেকে পায়ে হেঁটে, গলির ফাঁক দিয়ে, আর্মি, পুলিশ ফাঁকি দিয়ে চলে আসা এটাও একটা বিরাট এডভেঞ্চার, সবাই গল্প করে। ভিডিও দেখি, পাড়ার ভিডিও ক্লাব খালি, সময়মতো না গেলে সবাই ফ্লিম হায়ার করে নিয়ে যায় কিচ্ছু পাওয়া যায় না। পাড়ার মধ্যেই সিনেমা এক্সচেঞ্জ হয়, আব্বুরা একসাথে তাস খেলেন আরো কতো কি। মুহু মুহু চা, পেয়াজু ভাজা, মুড়ি মাখা, আলুর চপ, শামি কাবাব। দুপুরে বিরিয়ানি কিংবা খিচুড়ি মাংস। হরতালে সব অচল। শাক, ডাঁটা খাওয়ার ঝামেলা নেই। আনন্দই আনন্দ। হই হই রবের এই খেলায় যিনি অনুপস্থিত তিনি হলেন আমার “মা”।
তিনি সারাদিন এইযে বাসায় মেহমান আসছে যাচ্ছে তাদের নাস্তা, খাবার, দাদুর খাবার, কাপড় ধোয়ানো, বাথরুম পরিস্কার করানো এগুলো নিয়ে তুমুল ব্যস্ত। উত্তেজিত গলায় এরশাদ সম্পর্কে বা টায়ার পুড়ানো নিয়ে কিছু বলতে গেলে মা চরম শান্ত মেজাজে তরকারী নাড়ার কাঠি দেখিয়ে বলতেন, যা এখান থেকে। সব কাজ শেষ করে মা আব্বুর কাছ থেকে সারাদিনের রাজনীতির সারাংশ শুনে নিতেন নিরুত্তাপ কিংবা অনাগ্রাহী মেজাজে। বিরক্ত হয়ে বলতেন কবে যে এগুলো শেষ হবে, বাসায় কোন তাজা সব্জি নেই, কি করে সবাই খাওয়া দাওয়া করবেন। রোজ মাংস খেয়ে দাদুর শরীরটা কেমন যেনো করছে। দেশ নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বাক্য নেই। মাকে কতোই না করুণা করতাম তখন। দেশের কোন খবর রাখে না, কোন সচেতনতা নেই, কি জীবন শুধু রান্না আর খাওয়া, কাপড় ধোয়ানো, কি সিলি মহিলা। এ জন্যেই দেশের এ অবস্থা, তসলিমা নাসরিন তাইতো বলে। আর নিজেকে ভাবতাম বড় সমাজ সচেতন কেউকেটা।
ক্রিকেটেও মা একটু আধটু যোগ দিতেন। কিন্তু সেই, আমাদের সবার আরামের রুটিন ঠিক রাখতে রান্নাঘর থেকে শোয়ার ঘর কিংবা অন্যদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে যতটুকু দেখতেন। মাকে ভাবতাম এমন অনাগ্রাহী মানুষ হয় কি করে? ইঞ্জামামুল হক ব্যাটিং করছে, বলে বলে ছক্কা আর চার আর তুমি কি না বুয়া ঠিকমতো বাথরুম পরিস্কার না করলে দাদু পড়ে যেতে পারে তাই নিয়ে চেঁচামিচি করছো! হাউ সিলি ইউ আর। আমরা সারাদিন সচেতনভাবে ড্রইয়ংরুমে বসে মায়ের মাখিয়ে পাঠানো মুড়ি চানাচুর খেয়ে ক্রিকেট খেলা দেখছি। বিশ্বের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব কিংবা কর্তব্য আছে না? সাথে বোম্বে রিং চিপস, চা কোকতো আছেই। সমাজে অবদান রাখছি। সারাদিন ক্রিকেট খেলা দেখে সন্ধ্যায় কথা বলতে পারতাম না, এতো উত্তেজনা এতো চিৎকার করতাম, গলা বসে যেতো। অনেকদিন মাথাও ধরতো, পড়ালেখা বাদ দিয়ে ঘুমাতাম সন্ধ্যা ভরে। এখন ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলা হলে অনেকে আমার বাসায় আসে খেলা দেখতে। আমি কি করি? খেলা দেখি ওদের সাথে টিভির সামনে বসে? কিছুটা সময় অবশ্য দেখি আর বাকি সময়টা কি করি? হাউ সিলি এ্যাম আই নাউ? কখন মায়ের জায়গায় চলে গেছি নিজের অজান্তে নিজে কি জানি সেটা?
বাসায় যখন কেউ মহা উত্তেজিত সুরেঞ্জিতের সাংবাদিক সম্মেলনের নির্লজ্জ বক্তব্য নিয়ে কিংবা ইলিয়াসকে নিয়ে হাসিনা – খালেদার বাকযুদ্ধে আমি ভাবছি কাল কি বার? বুধবার হলে মেঘের ডান্স লেস, বৃহস্প্রতিবার হলে সুইম আর শুক্রবার হলে জিম। কোন ব্যাগটা গুছিয়ে দিবো? অনেকে মাঝে সাঝে বলেন, আপু অনেকদিন কিছু লিখেন না, একটা ভালো কিছু লিখেন। অনেক গল্প মাঝে সাঝে ভীড়ও করে মাথায়। ভাবি অবসর পেলে লিখতে বসবো, যখন সময় পাই ভাবি মাংসটা কষিয়ে রাখি বরং সেটা কাজে দিবে কিংবা মাছের আঁশ ক্লীন করে রাখি। প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। একবেলার খাবার রান্না করা থাকলে মনে আনন্দ হয় যাক, একবেলার খাবারের ভাবনাতো ভাবতে হবে না। পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারিনি বলে এখনো কতো কি টুকে রাখি, বইয়ের নাম, সিনেমার নাম। শুধু শুধুই হয়তো। একদিন এই টুকে রাখা খাতাটাই হারিয়ে যাবে কোথাও। বাড়ি ফিরলে আমার ড্রয়ার, পুরনো চুড়ি, দুল, আমার বই, আমার গানের ক্যসেট এখনো হাতে পাই। প্রতিবারই কিছু কিছু ফেলে দিয়ে আসি, নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা আর দরকার নেই। কাউকে দিয়েও দেই। মাঝে সাঝে যখন স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে গেছে এমন জিনিসের ওপর হাত পড়ে। আবৃত্তি ক্লাশের খাতা, পছন্দের টুকে রাখা কবিতা কিংবা লাইনগুলো অবাক হই, এ জীবনটাও কি আমারি ছিল? মাত্র কিছুদিন আগেও হয়তো ছিল। কিংবা হয়তো ছিল না, জন্মান্তরের সংশয়ে ভুগছি।
একটা জীবনে বৃষ্টি নামা অনেক আনন্দের ব্যাপার ছিল। রীতিমতো আয়োজন করে, পুরনো জামা পড়ে, আশেপাশের সব পিচ্চিদের ডেকে ছাঁদে যেতাম, বৃষ্টি ভেজা উৎসব আমাদের। সিড়ি ঘরে গান লাগিয়ে সব বোনেরা মিলে ঢং করে হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো বৃষ্টিতে নাচানাচি করতাম। খিচুড়ি খাওয়া, বাইরে না যাওয়া সব কিছুতেই উৎসব ছিল। এখন বৃষ্টি মানে কি? উটকো পানির ঝামেলা। শুধু ভাবি রাতে আমি ঘুমোলে যেনো বৃষ্টি নামে আর সকাল হওয়ার আগেই যেনো শেষ হয়ে যায়। তাহলে বাগানে পানি দিতে হবে না, গাড়িটা পরিস্কার ধোয়া হয়ে থাকবে আর আমি আরামসে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে নিজে অফিসে যাবো। বৃষ্টি আর মনে কাব্য আনে না। কাব্য বিদায় হয়েছে মাথা থেকে মন থেকে সেও এক শান্তি। নইলে ঘুরে ফিরে দুটো চারটে কবিতার লাইন মাথায় আসবে। মনটা ব্যস্ত থাকবে কবিতার মানে খুঁজতে, বুঝতে। কি হবে কবিতার মানে খুঁজে বুঝে? কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মেয়ের স্কুলের টিফিন যাবে মিস হয়ে তার থেকে কবিতা তোমায় দিলাম আজিকে ছুটি।
আজকাল বেশ ছোট ছোট মেয়েরা বিয়ে হয়ে স্বামীর সাথে সংসার করতে বাইরে আসছে। বেশির ভাগই পি।এইচ।ডির ব্যাপার। আমরা এখন আপুদের রোল প্লে করছি। খেতে বসেই শুরু করবে, এটা কি করে রান্না করেছো আপু? ঐটা কোথায় পাওয়া যায়? আমাকে শিখিয়ে দিবে, আমাকে রেসিপি দিবে। বড় ভালো লাগে জীবনের এই কলতান দেখতে। মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে যেনো পাই ফিরে ফিরে। মনে হয় এইতো সেদিন ঠিক এভাবেই ফোন কানে লাগিয়ে ম্যাকারনি, সর্ষে ইলিশ কিংবা কলাইয়ের ডাল রাধার রেসিপি নিয়েছি। নতুন কেক বানানোর উত্তেজনায়, কে খাবে সে কেক তার তোয়াক্কা না করে, সকালে এক স্বাদের কেক, বিকেলে অন্য স্বাদের আর এক কেক বানিয়েছি। আর আজকাল সুপার মার্কেটের বেকিং সেকশন দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবি, দরকার কি, থাক। কলোস্টোরেল এর ডাব্বা এগুলো। আবার এটাও ভাবি পাঁচ টাকা দিলে এতো বড় কেক পাওয়া যাবে, দরকার কি এক ঘন্টা কষ্ট করার? বরং এক ঘন্টা ঘুমালে কাজে দিবে। এতো অনীহা কাজ করে সব কিছুতে। সবকিছু থেকে আগ্রহ চলে গেছে। অথচ নতুন মেয়েদের দেখলে মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা কিন্তু কখন কাটল সেই সময়?
বাবা, ভাই, স্বামীর আশ্রয়ে থাকা আসলে একটা দুর্বল মানুষ আমি। যেকোন ঝাঁকুনিতেই বড় নড়বড় করি। আজকাল জাব উই মেট সিনেমার কারিনার ডায়লগটা খুব মনে পড়ে আর মহাবিশ্বের কাছে মিনতি করি, এক জীবনের জন্য অনেক এক্সাইটমেন্ট হয়ে গেছে, আর কোন এক্সাইটমেন্ট চাই না জীবনে। বাকি জীবনটা ঝাঁকুনিবিহীন শান্ত কাটাতে চাই। যারা সংসারের অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে স্থির থাকতে পারেন তাদের নমস্য মনে হয়। হাজারটা চিন্তা মাথায় রেখে যারা হাসিমুখে ক্রিকেট উপভোগ করেন, কবিতা পড়েন, বৃষ্টি উপভোগ করতে পারেন তাদের হিংসে করি চরমভাবে। দ্রুত বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়া, খুব সহজে ঘাবড়ে যাওয়া দুর্বল চিত্তের আমি অনেক কিছুতেই আর আনন্দ খুঁজে পাই না।
তারপর ......... হ্যা তারপর একদিন মাথায় গল্পেরা আর আনাগোনা করবে না। লেখার প্রেষনাও চলে যাবে। এ সমস্ত আসা যাওয়া গান গাওয়া একদিন সব গল্প হয়ে যাবে। আচ্ছা যাক, যা গল্প হওয়ার তা গল্প হয়ে যাক। আসুন আমরা একটা গান শুনি
তানবীরা
২৮/০৪/২০১২
{অনেক চমৎকার সব মূল্যবান লেখায় এবির নীড়পাতাটা আজকাল ঝকমক করে। আমারো কেনো জানি হঠাৎ লেখা দিতে ইচ্ছে করল। তাই দিলাম বেহুলার ভাসান। আগের অফিসগুলোতে লুকিয়ে অভ্র ইন্সটল করে নিয়েছিলাম। এই অফিসের লক্ষীন্দরের বাসর ঘরে কোন সাপ গলছে না, তাই লেখালেখি আপাততঃ শিকেয়। যতোদিন কোন সাপ গলানো অফিস না পাবো, লেখালেখি বোধহয় এখানেই সমাপ্ত। অফিসে বসে না লিখলে আর লেখাই হয়ে ওঠে না। যারা না লেখার কারণ জিজ্ঞেস করেন, আপাতত এটাই কারণ}

Monday, 9 April 2012

হোয়াট ইজ বৈদেশ?

অনেকেই বিদেশ নিয়ে অনেক কিছু কল্পনা করেন। এটা ভাবেন ওটা ভাবেন। আপনারা জানতে চান বৈদেশ কেমন? ঠিকাছে, তাহলে বলি, এখন আমি ডানদিকে কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে বলছি, বিদেশে তাপমাত্রা সবসময় পঁচিশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট। বাগানের ঘাস সবসময় তিন সেঃমিঃ উঁচু থাকে। ঘাস বাড়ে না, বাগানের ঘাস কাঁটতে হয় না। বাড়িঘরের রঙ পোঁচ দিতে হয় না, ধূলোবালি ঝাড়তে পরিস্কার করতে হয় না। সবসময় পরিস্কার। বাড়িঘর ঝাট দিতে হয় না, বাগানে পাতা পড়ে না। ড্রাইভওয়েতে ধোয়া পরিস্কার গাড়ি। আপেল গাছে আপেল, আঙুর গাছে আঙুর । গাছে গাছে রঙীন ফুল, তারপরে প্রজাপতি উড়ছে। ঠিক যেনো ক্যালেন্ডারের পাতা। সেই গাছ বাগানের মাটি খুঁড়ে লাগাতে হয় না। পছন্দসই গাছকে নিশানা করবেন, চোখ দিয়ে ইশারা করবেন, গাছ আপনাতেই বাগানে, আপনার পছন্দের জায়গায় পোঁতা হয়ে যাবে। অসুখ হয় না কারো। বাচ্চা কাঁদে না। ন্যাপি বদলাতে হয় না। বিদ্যুৎ পানি সবসময় অফুরন্ত। মানুষ মারা যায় না। পরীক্ষা পাশের টেনশান নেই। কারো সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন নেই, সে নিয়ে মনে কষ্ট নেই।

শুনতে বোর লাগছে। ঠিকাছে বামকাত হয়ে শুয়ে বাকি গল্প করি। বরফে চার পাশ সাদা। মাইনাস বিশ। আহ শুনতেই কি রোমান্টিক লাগছে। তারমধ্যে লম্বা ওভারকোট পরে, মুখে চুরুট জ্বালিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে হেটে যাবো, পায়ে উইন্টার বুট, আহা রাজকাপুর, জুতা হ্যায় জাপানী। সেই বরফে কেউ পড়ে না, পড়ে পা হাত ভাঙ্গে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে না। বরফ গলে প্যাঁচপ্যাঁচে কোন কাঁদা নেই। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, বন্যা নেই। বাড়িঘর নোংরা হয় না। অন্ধকার সকালে উঠে স্নো কেটে তার তলা থেকে গাড়ি বের করতে হয় না। শুধু ভদকার গ্লাস নিয়ে ফায়ার প্লেসের সামনে বসে বসে সময় কাটানো। আহা কি রোমান্টিক। বিদেশে জুস, খাবারে কোন ভেজাল নেই, অসুখ নেই। ম্যাডকাউ ডিজিজ নেই। হাইব্রিড খাবারে কোন সমস্যা নেই। নেই মৃত্যু জরা। নেই কোন দুঃখ অপমান, আলু আর মাংস সব এক সমান। এহেন আনন্দের বৈদেশের প্রথম শ্রেণীর দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের না দেশের ব্যাপারে কোন মতামত দেয়ার অধিকার থাকে না বৈদেশের ব্যাপারের। যেখানেই কথা বলবেন, সেখানেই বলবে তুমি কে? তুমি চুপ থাকো।

তানবীরা
০৯/০৪/২০১২