Thursday, 29 November 2018

বিপ্লব

সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়,
এই চান্দের রাইতে তোমার হইছে গো সময়
আজ চল্লিশ দিন হয়ে গেলো, এভাবেই দিন গড়াবে মাসে আর মাস গড়াবে বছরে ।
আমাদের মধ্যে তুই প্রথম। হয়ত অনেক ব্যাপারেই তুই প্রথম ছিলি, এম-এস-এন, ইয়াহু। হারিয়ে গিয়েও যে সবার মধ্যে এখনও কিছুটা যোগাযোগ রয়েছে তার কারণটাও অনেক ক্ষেত্রে তুই। একে ফোন দেয়া, তাকে ডাকা, তুইই তো করতি, আমরাও জানতাম তুই করবি।
জীবনটা তারপর অগোছালো হয়ে গেলো, অবশ্য সে আমাদের সবারই। কে আর ঠিকমতো গোছাতে পারলাম বল, গোছানোর চেষ্টা করতে করতে যাওয়ার সময় হয়ে এলো কিন্তু ঠিকমত গোছানোই হয়ে উঠলো না। ওপারে কোন জীবন থাকলে আশাকরি ভাল থাকবি, অন্তত চেষ্টা করিস গুছিয়ে নিতে, ভাল থাকতে।
একসাথে আমরা ষোলজন এস।এস।সি দিলাম, সারা পাড়া গরম, বায়োলজি খাতা আঁকা, নোট দেয়া নেয়া, সাজেশান, কোচিং। নিজের মেয়ের এস।এস।সি দেয়ার সময় হয়ে এলো, অথচ মনে হয়, এই সেদিনের কথা। তোর গাঢ় লাল সোয়েটার, জীন্স এর প্যান্ট, কেডস, সদ্য উঁকি দেয়া গোঁফ। তখন খুব ব্যান্ডের যুগ, ব্যান্ড বানালি, ঐ দূর পাহাড়ে ---- লোকালয় থেকে দূরে ------
অনেকদিন পর তোর চলে যাওয়া উপলক্ষ্যে আমরা বন্ধুরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বললাম, এমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া। তোকে নিয়ে কথা হলো, নিজেদের কথাও হলো, অসংখ্য উচ্চারণ করা শব্দের মধ্যে যে শব্দগুলো অনুচ্চারিত থাকলো, তা হলো, কাউন্ট ডাউন হ্যাজ স্টারটেড, উই আর অন আওয়া ওয়ে
যারা চলে যায় তারা চলে যায়, পেছনের কথা ভাবে না, যেমন তুই ও ভাবিস নি, তোকে ছাড়া চাচা-চাচী’র দিনগুলো কতটা লম্বা হবে। মেঘকে নিয়ে তোদের বাড়ি গেলে, চাচা দরজা খুলেই হাসি মুখে বলতে থাকতো, মেয়েতো আমার পছন্দ হয়ে গেছে স্বাতী, আমিতো মেয়ে রেখে দেবো। মেঘ এসব রসিকতার কিছুই বুঝতো না, সে শুধু জানতো এই বাড়িতে তার অধিকার অনেক। সে তার ছোট ছোট পা ফেলে, ডাইনীং থেকে খাবার তুলতো, নির্দ্বিধায় ফ্রীজ খুলে দেখতো আর কি কি নেয়া যায়। দিন বাড়ি যায় – চড়ে পাখির ডানায়
দেখা হবে বন্ধু, হয়ত কিছুদিনের অপেক্ষা, চলে যাওয়াই নিয়তি, তবে তোর মত যেনো এক শটে চলে যেতে পারি, কেউ লক্ষ্য করার আগেই, দশ থেকে পনর সেকেন্ডের মধ্যে। তুই চিরদিনই বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা ভালবাসতি, শেষ বিদায়ে সবাইকে পাশে পেয়েছিস, তোর শেষ যাত্রা ছিলো রাজকীয় কিন্তু আমরা যাবো একা একা – কেউ থাকবে না শেষ যাত্রায়
একদিন এই পৃথিবীর কোথাও কোন অস্তিত্ব থাকবে না জেনেও যে রোজ এই বেঁচে থাকা, এর নামই কি জীবন!

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ফুলের মেলা

নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বব্যাপী ‘টিউলিপের দেশ’ বলা হয়, যদিও এই ফুলটি ওদের নিজেদের নয়। এমন নয় যে ডাচরা এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়, ফুলের জন্য ভালোবাসা ওদের হৃদয়ের অনেক গভীরে অবস্থান করে।
এটাকে বিশদভাবে ব্যাখা করতে গেলে প্রথমে আমাদের সতেরশো শতাব্দীর আমাস্টার্ডামের খালের পাশের একটি বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হবে। একজন ধনী সওদাগর একটি চেয়ারে বসে আছেন, তন্ময় হয়ে আছেন তার ভাবনায়। না, তার ভাবনায় ফুলেল ডিজাইনের কোন দেয়ালপেপার ছিলো না, ছিলো ফুলদানিভর্তি ফুল। যদিও আমরা এখন যে ফুলদানিটা দেখতে পাই সেটির সঙ্গে কিন্তু আগের সেই ফুলদানির কোনো মিল নেই।
যেটাতে ফুল থাকে সেটাতে একটি ফুটো থাকে, রঙ ও ছাঁদে প্রতিটিই আলাদা। আমরা যদি হরেক রঙের মিশ্রণে একটি রঙিন ফুলের তোড়া বলি, সতেরশো শতাব্দীতে এটিই ছিলো সর্বোচ্চ প্রশংসার জিনিস।
তখন থেকে, ফুলের প্রতি গভীর আবেগ ডাচ সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে উঠলো। অনেক ডাচ নাগরিক বাড়িতে টেবিলের ওপর এক গোছা ফুল না থাকলে সে বাড়িটিকে বসবাসের যোগ্য বলে ভাবেন না, এবং অনেকেই বসন্তে আর গ্রীষ্মে বাগানের ফুলের রঙ দিয়ে দঙ্গল না বাঁধিয়ে বিশ্রাম নেন না।
এমনকি কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে, এক গোছা ফুল নিয়ে যাওয়া ডাচদের রীতি, শুধু অনুষ্ঠানে বা জন্মদিনই নয়, ফুল এখানে প্রথাগত, খুবই নৈমিত্তিক ব্যাপার। ডাচরা ফুল নিয়ে একথাটি খুবই বলে, ফুলের বিজ্ঞাপনেও এই স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়।
ফুলচাষের এই নেশাকে অনুশীলন করতে অগুনিত ফুলের দোকানের প্রয়োজন। শুধু ফুলের জন্য এখানে আলাদা বিশেষ বাজার আছে, যদিও আমস্টার্ডামের বাজারটাই পৃথিবীবিখ্যাত কিন্তু উইটরেক্ট বাজারের পরিবেশ ভালো।
বসার ঘরে সাজিয়ে রাখার চেয়ে ফুলচাষের এই সংস্কৃতিতে তাদের উৎপাদন ও ব্যবসায়ী মনোভাব বেশি পরলক্ষিত হয়। ফুলের রাজ্য শাসনকারী উদীয়মান ব্যবসায়ী ও সওদাগররা নিজেরাও বিরাট পুষ্পপ্রেমিক। বিলিয়ন ইউরোর ওপরে ফুল ও ফুলের বীচি চাষের এই বাজারে প্রতি হাজার জনে দশ জন ডাচ নাগরিক জীবিকা নির্বাহ করেন। বেশির ভাগ উৎপাদনের লক্ষ্যই থাকে দেশের বাইরে রপ্তানি। প্রায় পাঁচ দশমিক চার মিলিয়ন ইউরো প্রতি বছর ফুল আর ফুলের চারা বিক্রি করে আয় হয়।
ফ্লোরাহল্যান্ড এর নিলাম হলো এই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, এটি ফুলের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিলাম কেন্দ্র। বিশ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ফুল ও চারার নিলাম হয় এখানে, পাঁচ হাজার চাষীর হাতে উৎপন্ন প্রায় সাড়ে বারো হাজার বিলিয়ন চারা আর ফুল হাতবদল হয় এখানে। বড় স্তুপটি চলে যায় দেশের বাইরে। বলা হয়ে থাকে, সারা পৃথিবীতে যত ফুল ও ফুলের গাছ কাটা হয় তার অর্ধেক কাটা হয় হল্যান্ডে।
আলসমেয়ার এর ফ্লোরাহল্যান্ড হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল বাণিজ্যকেন্দ্র। পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, ফুলের গেঁড় এর মাঠ দেখতে যাওয়া। ষোলশ শতাব্দীর শেষ থেকে নেদারল্যান্ডসে ফুলের গেঁড় উৎপন্ন করা হচ্ছে। পঁচিশ হাজার হেক্টরের বিশাল প্রান্তর রঙ-বেরঙের ফুলের গেঁড় দিয়ে যেনো মোজাইক করা আছে।
সবচেয়ে বেশি ফুলের গেঁড় করা হয় টিউলিপ, লিলি, নার্সিসাস, গ্ল্যাডোলিয়া আর হিয়াসিন্ট দিয়ে। ফুলগুলো ফুটে গেলে, ফুলের মাথাটা যান্ত্রিকভাবে কেটে ফেলা হয়, তাতে করে গেঁড়গুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফুলের গেঁড় রপ্তানি করে প্রায় সাতশো মিলিয়ন ইউরো আয় করা হয়। উত্তর আলকামার শহরের হার্লেম আর লাইডেন হলো গেঁড় চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
সাম্প্রতিক কোইকেনহোফ বাড়িটি- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান। প্রতি বছর মিলিয়নের ওপর পর্যটক আসেন ওখানে। ব্লুমকোরসোতে ফুল দিয়ে নতুন ধরনের বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন প্রতিকৃতি তৈরি করে কার্নিভাল এর মতো শোভাযাত্রা করে নর্ডওয়াইক থেকে হার্লেম যাওয়া এখানের প্রচলিত প্রথা। এধরনের ফুলের শোভাযাত্রা অবশ্য পুরো বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হতে থাকে। ওয়েস্টল্যান্ড- যেটা গ্রীন হাউজ চাষের কেন্দ্র ‘গ্লাস-সিটি’ বলে পরিচিত, সেখানে প্রতি গ্রীষ্মের ‘ভাসমান শোভাযাত্রা’ খুবই প্রশংসিত।
সবোর্পরি, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সারা বিশ্বে নেদারল্যান্ডস ফুলের জন্যে বিখ্যাত। বিশেষ করে টিউলিপ নেদারল্যান্ডসের সবকিছুরই প্রতীক। উনিশো আশি আর নব্বই দশকের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফুটবলার রুড গুলিত, মার্কো ভান বাস্টেন আর ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড যারা এসি মিলানে খেলতো, তাদেরকে ইটালিতে ‘টিউলিপানি’ কিংবা ‘টিউলিপ্স’ নামে ডাকা হতো।
টিউলিপের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের এই একাত্বতাকে মূলধন করে ডাচ ব্যবসায়ীরা বিশ্বে আধিপত্য গড়তে চান, যেমন বিশ্বজুড়ে হোটেল গোল্ডেন টিউলিপের চেইন খোলা হয়েছে। যদিও, ডাচরা অন্যের আকর্ষণ নিজেরা জাঁকালো ভাবে প্রদর্শন করছে, কারণ টিউলিপ ওদের নিজেদের দেশিয় গাছ নয়, ষোলশ শতাব্দীতে তুর্কীর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এটি আমদানি করা হয়েছিল।
এমনকি টিউলিপ শব্দটিও টার্কিস টুলব্যান্ড (টারবান) শব্দের অপভ্রংশ হয়ে আমদানি করা হয়েছে। ঘটনাক্রমে, আমদানিকৃত ফুল থেকে ডাচেরা সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নতুন ধরনের টিউলিপের চাষ করেন, যেগুলো সতেরশো শতাব্দীতে টার্কিতে খুব প্রশংসিত হয়।
নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ সত্যিকার অর্থেই প্রাণবন্ত ব্যবসার প্রতিকৃতি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ষোলশ ছত্রিশ আর ষোলশ সাইত্রিশ সালে এত বেশি গেঁড় উৎপাদিত হয়েছিল যে অনেক মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছিলো এসব করতে গিয়ে। দুর্লভ গেঁড় এর চাহিদা অবশ্য আমর্স্টাডামের খালের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পুরো পৃথিবীজুড়েই আছে।
অনেকের মধ্যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ইয়ান ফান গোয়েন যিনি চিত্রশিল্পী ইয়ান স্টেইন এবং পোলাশ পোটারের শিক্ষক ছিলেন, তিনিও কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান। এখন আর ডাচেরা এত ঝুঁকির মধ্যে নেই, কারণ পৃথিবীর কোথাও এই সবচেয়ে বড় বাজারের চেয়ে সুলভ দামে ফুল বিক্রি হয় না।  
*মূল প্রবন্ধটি মারটাইন ড্যা রোই এর লেখা ‘দ্য ডাচ আই প্রিজ্যুম’ বই থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে। লেখাটি গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন লেখক। 

বনফুল

১.


আজকাল আমরা “অনুগল্প” কিংবা “পরমানু” গল্পতে খুব অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সময় কোথা আমাদের অনেক বেশি পড়বার? কত কি করার আছে, সময় বড্ড কম। আমরা অনেকে ভাবি ব্লগ কিংবা ফেসবুক আধুনিক সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই ঝরঝরে মেদহীন বর্ননায়, টু দ্যা পয়েন্ট লেখার প্রচলন করেছে। আসলে কি তাই? একটু পেছনে তাকালে ইতিহাস কিন্তু অন্যকথা বলে। বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে পড়তে ভাবছি, অধুনা “অনুগল্প” এর পথ প্রদশর্ক তিনি কি? “লিপিকা”য় গ্রন্থিত করা কবিতা গুলো’র জন্যে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গদ্য কবিতা”র পথ প্রদর্শক বলা হয় তাহলে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নিসন্দেহে “অনুগল্প” এর দিক দিশারী।
আয়তনে হয়ত অধুনা অনুগল্পের কাছাকাছি কিন্তু বিষয়, বর্ননা আর তার শান দেয়া ধার, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা যেগুলো আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে আজও চরম বাস্তব। অনুগল্পের চেয়ে আয়তনে বড় নয় বটে – এত স্বল্প পরিসরে এত কঠিন বক্তব্য কিংবা বিদ্রুপ বা হাস্যরস অবিশ্বাস্য। আমরা আজকাল এত লেখা পড়ি, হোমফীড ভরা স্ট্যাটাস, নোট, বিভিন্ন সাহিত্যের গ্রুপ কিংবা দৈনিক পত্রিকা গুলোর সাহিত্য পাতাগুলোই ধরি না কেন, রাতে যখন ঘুমোতে যাই, কটা লেখা আমাদের পুরোপুরি মনে থাকে? কিন্তু বনফুল আপনার মাথায় ঘুরবে, ঘুরেই যাবে, আপনাকেও ঘোরাবে, বিশ্বাস হয় না? পড়ে দেখুন তবে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প নিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্যের আলোচনা।
[[[স্বপ্নে আর বাস্তবে, মানুষের আশা আর প্রাপ্তিতে যে অসামঞ্জস্য এবং সেই অসামঞ্জস্য সত্বেও মানুষ যে ভাবী জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলেছে, জীবন-দার্শনিকের কাছ তাও কম হাসির বিষয় নয়। “সুলেখার ক্রন্দনে”র কথা মনে পড়ছে। জ্যোৎস্নামদির গভীর রাত্রে স্বপ্নময় আবেষ্টনীর মধ্যে দুগ্ধফেননিভশয্যায় একটি ষোড়শী তণ্বীকে কাঁদতে দেখে কবিকল্পনায় প্রশ্ন জেগেছে, কেন এ ক্রন্দন? – পুত্রশোক? সিনেমায় না যেতে পারার অভিমান? শাড়ির পাড় পছন্দ করা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মতভেদের পরিণাম? না কুমারী-জীবনের মধুর পূর্ব-রাগের স্মৃতিমথিত বেদনা? অমন চাঁদনীরাতে কৈশোরের সেই অর্ধ-প্রস্ফুটিত প্রণয়-প্রস্থান সহসা পূর্ণ- প্রস্ফুটিত হতে পারে না কি? দূরে “চোখ-গেল” পাখি অশ্রান্ত সুরে ডেকে চলেছে। সম্মুখের বাগানে রজনীগন্ধাগুলি স্বপ্নবিহবল-চারিদিকে জ্যোৎস্নার পাথার! এমন দুর্লভক্ষণে হারানো প্রেমের কথা মনে হওয়া কি অসম্ভব, না অপরাধ? কাল্পনিক যখন এমনি কল্পনার জাল বুনে চলেছেন তখন সুলেখার ক্রন্দনের সত্য কারণটি আবিস্কৃত হল। সুলেখা কাঁদছে দাঁতের ব্যথায়। - কল্পিত সত্যের সঙ্গে বাস্তব সত্যের কত তফাত!]]]


২.

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ, কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক-দাঁত ভাল থাকে। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এল। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলে শুধু।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষী বউটির ঠিক এই দশা।
বনফুলের “নিমগাছ” গল্পটি পড়তে পড়তে বহুকাল আগে দেখা অর্পণা সেনের সিনেমা, “পরমা” চোখের পাতায় ভেসে উঠল। বলাই থেকে অপর্ণা, বদলায় নি কিছুই, জীবনের কঠিন বাস্তবতার কাছে, সব বিপ্লব কেমন যেনো হার মেনে যায়

Thursday, 1 November 2018

মীটু


পৃথিবী জুড়ে ছুটে চলা “মী টু” এর ধাক্কা অবশেষে বাংলাদেশেও লেগেছে। সাহসী কেউ কেউ লিখছেন, তাদের এতো দিনের বয়ে চলা যন্ত্রণার কথা। মেয়ে মাত্রই আমরা জানি, সেসব স্পর্শ, চাহনী, নিপীড়ন, নিগ্রহের কথা। এটা বৈশ্বিক সমস্যা, বাংলাদেশের একার নয়। ছোট সে বয়সে বিশ্ব জুড়ে মেয়েরা, অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেরা এই নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যায় বলেই, এত “এওয়ারনেস” ভিডিও, প্রবন্ধ সমস্ত লেখা হয়, প্রচারণা চালানো হয়। মানুষের মধ্যে বিবেক এবং চেতনা জাগরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ছোটবেলায়, মা ভীষণ পাহারা দিতেন, বকা দিতেন, এদিক গেলি কেন? ও ডাকলেই যেতে হবে, তখন বিরক্ত হতাম, মা এত সন্দেহ করে, পাহারা দেয়, আজ জানি, বিশ্ব জুড়ে মা মাত্রই পাহারা দেয়, সবাই সন্তানের “ওয়েলবিং” নিয়ে কনসার্ণ। বহু বছর আগে এই নিয়ে লিখেছিলাম “সাবধানতাঃ সন্তানের জন্যে”, ফেসবুক ও ব্লগের কল্যানে তখন এই লেখাটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু হায়, এত সাবধানতার পরেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

প্রতিবার যা হয়, এবারও তাই হচ্ছে, “মী টু” নিয়ে বাংলাদেশে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে, এক পক্ষ ভিক্টিমদের পাশে আর অন্য পক্ষ ভিক্টিমদের ব্যবচ্ছেদ করছে, তাদের জামা-কাপড়, চাল-চালন, কেনো গেছিলো, এত দিন পরে কেন, এত বছর কোথায় ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ বলছেন, “মী টু” ধরতে গেলে, কারো, বাবা-চাচা-দাদা ও বাদ যাবে না। এই পয়েন্টটাতে অবশ্য আমিও একমত। “মী টু” এই জেনারেশনই থাকা ভাল, বাবা-চাচা-দাদা’দের ধরলে “মী টু-টু দ্যা পাওয়ার টেন” এ চলে যাবে। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি এর সাক্ষী, আমাদের ইতিহাস, যৌতুকের কারণে বউ পুড়িয়ে মারার ইতিহাস, তালাক দেয়ার ইতিহাস, একাধিক বিয়ে করার ইতিহাস, সতীদাহের ইতিহাস। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, কেশব চন্দ্র সেন এরকম হাতের আঙুলে গোনা দু’চার জনকে ছেড়ে দিলে পূর্ব পুরুষদের কারো ইতিহাসই উইম্যান ফ্রেন্ডলি নয়। ধর্মের কাহিনী গুলোও যদি ধরি, সীতার বনবাস, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, দ্রৌপদী’র বস্ত্রহরণ, বিবি মরিয়মের নিগ্রহ, কিংবা বিবি আয়েশা’র (রাঃ) সত্বীত্বের পরীক্ষা কোনটাতেই নারীর গৌরবের কিছু নেই, সবই অবমাননার ইতিহাস।

পয়ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীতে “মী টু” কনসেপ্ট ছিলো না। কেউ মুখ খুলতো না। এখনও মুখ খুলে কেউ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নেদারল্যান্ডসের বেস্ট সেলার লেখক, সাস্কিয়া নোর্ট তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “স্ট্রমবলি”তে তের বছর বয়সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া “মী টু” লিখেছে ২০১৭ সালে। তাতে তার ছেলে তাকে রোজ অপমান করে, মা তাকে ধিক্কার দেয়, কেন লিখতে গেলো এতদিন পরে আবার এসব। পয়ত্রিশ বছর পরে মুখ খুলে যে মানুষটা চরিত্র ব্যবচ্ছেদের সম্মুখীন হচ্ছে দিনরাত, পয়ত্রিশ বছর আগের কথাটা ভাবুন, প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের বিরুদ্ধে নিতান্ত একজন নাবালিকা যার ধরতে গেলে কোন সহায়-সম্বল কিংবা পরিচয় নেই। বাঘা বাঘা মানুষেরা আজ তাকে যেভাবে পেড়ে ফেলছে তখনকার পরিস্থিতি ভাবুন।

এখন কথা হলো, এত দিন হয়েছে বলে, চির জীবনই একই থাকবে, বদলাতে দেবো না কিছু? বাবা-চাচা-দাদা’রা অন্যায় করেছেন বলে, সব অন্যায় জায়েজ হয়ে যাবে! প্রতিবাদ হবে না? পরিবর্তন চাইবো না? তাহলে আদিম যুগে ন্যাংটো হয়ে থাকা, শিকার করে পশু পুড়িয়ে খাওয়া থেকে, আজ এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ফেসবুকে তর্ক করা কি, পরিবর্তন, বদল না সেই সনাতনতা? “মী টু” বাংলাদেশের জন্যে না, যারা বলছেন, তারা কোন সোশ্যাল প্যারামিটারে সেটা মেপে বলছেন, সেটা অবশ্য জানাননি। আইফোন টেন এক্স, বিএমডব্লু গাড়ি, লিভাইস এর জীন্স, কেভিন ক্লাইন এর টি শার্ট, মাইকেল কোরস এর পার্স সবই বাংলাদেশের জন্যে শুধু সামাজিক কোন পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্যে নয়! মজার তো বটেই। সামাজিক পরিবর্তন বাংলাদেশের বাইরের সারা পৃথিবীর জন্যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের মত বাংলাদেশ যে কোন পরিবর্তনের আওতামুক্ত থাকবে।

আলোচিত “শাজনীন” হত্যা’র ঘটনা হয়ত আমরা অনেকেই ভুলে যাই নি। গুলশানে নিজের বাসায়, নিজের ঘরে খুন হয়েছে শাজনীন। শাজনীন রাত পোশাকেও ছিলো না, বাইরেও যায় নি কাউকে প্রলুব্ধ করতে, যারা মেয়েদের চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করতে ব্যস্ত, দয়া করে জানান, শাজনীন এর “মী টু’ এর ব্যাখা কি হতে পারে? তাসলিমা মুন শেখ তার “পাথরনদী কথন” বইতে লিখেছেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার সময়, পরিচিত এক পরিবারকে রূপাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়, তাদের মেয়েটির পরীক্ষা, তাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই এই কারনে। রূপা’র সাথেই মেয়েটি রাতে শুয়েছে, সেই বিছানায়, আশ্রিত সেই মেয়েটির ভাই, বোনের পাশে শুয়ে থাকা, ঘুমন্ত রূপার গায়ে হাত দেয়। এই “মী টু”র ব্যাখা জানতে চাই। রূপা সালোয়ার-কামিজ পরেই শুয়েছিলো, কোন উত্তেজক রাত পোশাকে নয়। কুঙ থ্যাঙ লিখেছেন, তার পরিচিত বোনটি এপেন্ডিসিটাইস এর অপারেশনে বিছানায় শুয়ে, স্যালাইন হাতে, প্রতি রাতে তাকে ইন্টার্নী ডাক্তারদের হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে হাসপাতালে, সেই অসুস্থ মেয়েটি কি কি পন্থা অবলম্বন করে ইন্টার্নী ডাক্তারদের তার দিকে আমন্ত্রণ করেছিলো কে জানে। “মী টু” এর ব্যবচ্ছেদকারীরা এর ব্যাখা দিতে পারবেন। অজস্র এরকম উদারহণ লিখতে পারবো, কিন্তু দরকার আছে কি? আমরা কি নিজেরাই জানি না, নিজেদের কথা?

“মী টু” এর দরকার আছে কি নেই, সেটা সময় বলে দেবে। এক সময় পৃথিবীর কোন প্রান্তেই মেয়েরা স্কুলে যেতো না, চাকুরী করতো না, দশ চড়ে রা করতো না, কিন্তু প্রয়োজন সব বদলে দেয়। “মী টু” এর চেয়েও শক্ত কোন ঝড় সময়ের প্রয়োজনেই হয়ত তৈরী হবে। আমরা চাই কিবা না চাই। তাই বরং সমস্যাকে ঢেকে না রেখে, চলুন সেটাকে স্বীকার করে নিয়ে, সমাধানের দিকে কিংবা নিদেনপক্ষে পুনরাবৃত্তি রোধের কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেই দিকে সবাই হাতে হাত ধরে আগাই। কথায় আছে, “সমস্যা চিহ্নিতকরণ” সমাধানের দিকে আগানোর প্রথম পদক্ষেপ।

সবশেষেঃ বাংলা ব্যাকরণ পড়েছিলাম, “যিনি রাজা তিনিই ঋষি” – এই লাইনটির সাথে অবশ্য চলমান “SAD” বিতর্কের কোন সম্পর্ক নেই।


তানবীরা
০১/১১/২০১৮
 



Saturday, 13 October 2018

ডিজিটাল বাংলাদেশ

ডিজিটাল বাংলাদেশে কাউকে ইমেইল পাঠালে আবার অন্য মাধ্যমে খবর জানাতে হয়, মেইল করেছি - চেক করো, নইলে মেইল চেক করে না। এখানে ফোনের বিল, অফিসের বেতন, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান, মেয়ের স্কুলের চিঠি, বাস থেকে নেমে গেছি ভুলে চেকাউট না করে কিসের মেইল না আসে। প্রতিদিন কয় বার মেইল চেক করতে হয়!


প্রতিটি অফিসে সরকারী কিংবা বেসরকারী, ফোন করলেই যান্ত্রিক গলায় যেই বার্তাটি বেজে ওঠে সেটি হলো, প্রয়োজনীয় সব তথ্য ওয়েবসাইটে দেয়া আছে, পড়ে নাও, তারপরও যদি না বোঝো তবে মেইল করো, একান্তই যদি কারো সাথে কথা বলতে চাও, তাহলে লাইনে থাকো, তোমার সিরিয়ালের অপেক্ষা করো, টেলিফোন করতে মানুষকে নিরুৎসাহী করতে অনেক সময়ই এই টেলিফোনগুলোতে পয়সা চার্জ করা হয়, পুরো নেদারল্যান্ডসে ল্যান্ড ফোন প্রায় ফ্রী, এমনকি মোবাইলও আনলিমিটেড। পুরো ইউরোপকে জোনে ভাগ করে নিয়ে, এখন ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে ইউরোপের মধ্যে আনলিমিটেড টক টাইম দেয়া নিয়ে।


এখানে যদিও যানজট এত প্রকট নয়, তারপরও বিশেষ কোন প্রয়োজন না হলে কোন অফিসে কোন এপয়ন্টমেন্ট দিতে চায় না, যতটুকু সম্ভব ইমেইলের মাধ্যমেই সমাধান করে দিতে চায়। এর অবশ্য আর একটি কারণ, সময় বাঁচানো, খরচ বাঁচানো। অথচ বাংলাদেশে প্রতিটি জিনিস নিয়ে মৌখিক আলোচনা হয়। মেইলের সুবিধা হলো, ভুলে গেলে লেখা আছে, আবার দেখে নেয়া যায়। লিখিত থাকে বলে, কথা ঘোরানোর সুযোগও অনেক কম থাকে। প্রতিটি শহরে যে পরিমান যানজট, মানুষের প্রতি নিয়ত হয়রানী অথচ মেইল এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান দিতে পারে। কিন্তু হায় --- লেখালেখিতে কেউ নেই


বাংলাদেশের প্রায় কোন শপিং মলেই এটিম কার্ডে পে করার সুযোগ নেই। এর বদলে আছে ডেবিট কার্ড, তাতে যত পয়সা চার্জ করা আছে, তার বেশি খরচ করার সুযোগ নেই, যাকে বলে পকেটের টাকার একটা লিমিটেড ভার্সন। কিন্তু ডিজিটালি পুরো ব্যাঙ্ক হাওয়া হয়ে দেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে! আজব কারখানা। দেশে ছিনতাই এর এত প্রকোপ, দিনরাত মানুষ আহত এবং অনেক ক্ষেত্রে নিহতও হচ্ছে, তারচেয়ে ও কষ্টকর বিদেশে’র এই ব্যাঙ্কিং সিস্টেমগুলো’র ইনোভেশান এবং ডেভেলাপমেন্টে বাংলাদেশের অনেক তরুণ/তরুণী প্রশংসনীয় অবদান রাখছে অথচ বাংলাদেশের নাগরিকরা এই সুবিধার কোন ছিটেফোঁটা ও উপভোগ করতে পারলো না! তাদেরকে ময়লা –ছেড়া নোট ঘসতে ঘসতে, গুনে গুনেই জীবন কাবার করতে হবে। দুর্নীতিবাজ দেশের যে তকমা গায়ে সাঁটা আছে তার থেকে বের হতে “ট্রান্সপেরেন্সি” এর প্রয়োজন আর নগদ লেনদেন করে সেটা থেকে কখনও উত্তরণ সম্ভব কি? ডকুমেন্টবিহীন লেনদেন সবসময় ম্যানিপুলেট করা যায় এমনকি পাড়ার কনফেকশনারীতেও


তাই তো বলি, সতের কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, ফেসবুক দিয়েছো কিন্তু ডিজিটাল করোনি।


*** মাল্টিন্যাশনাল, ইউএন, বা পুরোপুরি বিদেশী কনসার্ণে যারা কাজ করেন শুধু তারাই এর ব্যতিক্রম। তারা রোজ মেইল চেক করে এবং জবাবও দেয়। ***


Friday, 7 September 2018

পাথরনদী কথন

প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম, শেখ তাসলিমা মুনের লেখা উপন্যাস “পাথরনদী কথন”। যদিও লেখক “মুখবন্ধ”তে বলেছেন, উপন্যাসটি প্রচন্ড একরৈখিক, রুপার কারণে অন্য কোন চরিত্র এটিতে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় নি। বইটি পড়তে যেয়ে রুপার মা শাহানা, ভাই সুমন, বোন শম্পা কিংবা রুপার নানা, রহিমা ফুপু, রুপার নাটক পাগল মুক্তিযোদ্ধা বাবা সবাইকে যেন আমি চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছিলাম। এরা আমাদের খুব চেনা, আমাদের আশেপাশের মানুষ।


আর দশটা এই আমাদের সাধারণ মেয়েদের মত রুপার সংগ্রাম এতটাই বাস্তব, এতটাই তিক্ত, রুঢ়, বইটি পড়তে শুরু করলে কখন এর সাথে মিশে যাবে পাঠক তা নিজেও অনুভব করবে না। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা অনেক কঠিন হবে। রুপা একাই যথেষ্ঠ বইটি সামনে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কুয়াশা, দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা কিংবা সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান বা বায়োনিক ওম্যান কারো কাছ থেকে রুপা কিছুতেই কম নয়, একটা বই টেনে নিয়ে যাওয়ার মত পুরো ক্ষমতা আর আর্কষন বইটিতে আছে। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে ক্লাশ সিক্স-সেভেনে প্রায় বিয়ে হয়ে হয়ে যাওয়া রুপার ডিভোর্সের পর একা ইংল্যান্ডে মাস্টার্স পড়তে আসার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে লোভনীয় ছোট বেলার প্রেম এসে ডাক দিয়ে গেছে, রুপা’র ভাষায়, “ছেলেটির প্রতি প্রেমের যে আগ্রহ তার জন্মেছিল সেটিকে দমন করার আত্মশক্তিও রুপা অর্জন করেছিলো”।


রুপার সাথে কোথাও আমার দেখা হয়েছিল। তপ্ত গ্রীস্মের এক সবুজ শ্যামল প্রকৃতি পুড়িয়ে দেয়া দুপুরে, ভারী পর্দা টেনে আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরে যখন আমরা মুখোমুখি নির্ভেজাল টুকটাক গল্প করছিলাম, রুপা আমাকে বলেছে, ইংল্যান্ডে আসার পরের সংগ্রাম নিয়ে রুপার চতুর্থ বইটি লেখা হচ্ছে এখন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, মেদহীন, বর্ণনার বাহুলতাহীন, ঝরঝরে ভাষায় লেখন পটিয়সী রুপার সেই সংগ্রামের ইতিহাস জানতে। কিছুটা তো আমরা সবাই কম বেশি, জানি। রুপা, অহনা, কিংবা আরও অনেকেই আছে যারা এই বিদেশে নিজের মাটি খুঁজে পেতে অহরহ কত লড়াই চালাচ্ছে, একাকী, ইথারে হয়ত কোথাও তার দাগ থাকবে না কিন্তু তারপরও তারপরও কোথাও কালির আচঁরটুকু অন্তত থাকুক।


পুরো বই জুড়ে মায়ের সাথে রুপার সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে। যুদ্ধে বিধবা দিশেহারা তরুণী মা তিনটি সন্তান নিয়ে তার প্রায় সমস্ত “নিরাশা আর গ্লানি” রুপাকে মেরেই মেটাতে চেয়েছেন। তারপরও রুপা অনেক ভাগ্যবতী, বার বছর বয়সে প্রতিবেশী কাকুর দ্বারা “ধর্ষিতা” হওয়ার পর তার সহায় সম্বলহীন, একাকী মা পিছিয়ে যান নি, লোক লজ্জার ভয় পান নি, মেয়ের সো কলড ভবিষ্যত কি হবে সে ভেবেও পেছোন নি। আনুষ্ঠানিক ভাবে সে পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। সে যুগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি বিরল ঘটনা। ভাশুরের দ্বারা নির্যাতনের পরেও ডিভোর্সের জন্যে মেয়ের পাশে থেকেছেন। মায়ের মরু সম রুক্ষতা ভুলে যাওয়ার জন্যে হয়ত রুপার কাছে এগুলো ঝর্ণা’র কাজ করবে।


সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত লেখক সাসকিয়া নোর্ট ফোল্কসক্রান্তে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, তের বছর বয়সে প্রতিবেশীর ছেলের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনাটি তিনি এতদিন প্রকাশ করার সাহস পাননি। “মি টু” ক্যাম্পেইনের কারণে এখন যখন তার বইতে এটি তিনি লিখেছেন, প্রায়ই তার নিজের ছেলে কিংবা মায়ের কাছ থেকে এ নিয়ে নানা তির্যক মন্তব্যের শিকার হন তিনি। দেশে বা বিদেশে, কোন পরিবারে, কোন সমাজে মেয়েরা নির্যাতিতা নয়? বৈষম্যের স্বীকার কোথায় হয় না? কোথাও বেশি কোথাও কম। কোথাও খালি চোখে দেখা যায় আর কোথাও দূরবীক্ষণ দিয়ে দেখতে হয়।


লাজুক মুখচোরা কিশোরী রুপার আত্মবিশ্বাসী রুপাতে পরিনত হওয়ার চিত্রও এসেছে খুব নির্ভরযোগ্য ভাবে। নিজেকে লুকাতে লুকাতে আর যখন লুকানোর কোন স্থান রইলো না, তখন ধীরে ধীরে লাজুক রুপা পরিবর্তিত হলো স্বনির্ভর এক তরুনীতে। যার অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, পেছনে কে কি বলছে সেই সংকোচ কাটিয়ে উঠেছে, শুরু করেছে দৃঢ় পায়ের পদক্ষেপ। কিশোর বেলার ভয়কে জয় করা শুরু করেছে তার তারুন্য।


আমি সবসময় আত্মজীবনী, ইতিহাস, বাস্তব থেকে তুলে নেয়া গল্পের প্রতি তীব্র আকর্ষন বোধ করি। বিখ্যাত সব মানুষদের সাজানো গোছানো, খুব পরিনতি পরিকল্পনা করে লেখানো আত্মজীবনী নয়, এরকম আমাদের পাশে থাকা লড়াকু মানুষদের, খুব আটপৌঢ়ে, নিজেকে খুলে বিছিয়ে দেয়া আত্মজীবনী। অনুপ্রাণিত হই, সাহস যোগায় মনে, এত হেরে যাওয়া গল্পের মাঝে কিছু কিছু বিজয়ীরা থাকুক আমাদের মুখ উজ্জল করে।


একশ চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠার পুরো বইটিতে অসংখ্য (বানান) মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে যা একটানা পড়ার সময় খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক করে বই কি। রুপা কে রুপো, ওপো, সেগুলোকে সেগল বারবার করে হয়েছে। এটুকু মেনে নিলে, আশাপূর্ণা দেবী’র উপন্যাসের মত ঝরঝরে বাংলায় এই উপন্যাসের মাঝে নিজেদের আশপাশের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায় ।

Monday, 27 August 2018

চন্দ্রমুখী

খুব সম্ভব প্রথম আলোতে রবি’র লেখা একটি ছোট গল্প প্রথমে পড়ি, যতদূর মনে পড়ে তখনও হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে আছেন। চমকে উঠেছিলাম, একদম হুমায়ূন আহমেদের ধারা পুরোই অনুকরণ। সেই গল্পের রিভিউ তে আমি লিখেছিলাম, এই ভদ্রলোক তো হুমায়ূনে আহমেদে’র নায়িকার নামও নিয়ে নিয়েছে। একজন তখন মন্তব্যে জানালো, না, সত্যিই ওর বউয়ের নাম নীতু। তারপর কিছু দিন পরেই রবি’র সাথে আলাপ হলে, আমার স্বভাব মত প্রথম আলাপেই, রবিকে আমি বলেও ছিলাম সে কথা। রবি ব্যাপারটা সহজ ভাবে নেয় নি। না, নামের ব্যাপার নয়, রবি’র অগোচোরে রবি’র সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। আমি বললাম, পত্রিকায় গল্প ছাপা হলে আলোচনা ত হবেই, সব জায়গায় কি আপনি থাকবেন নাকি? তখন থেকেই আমাদের আলোচনা অম্ল-ক্ষারে যায়, কখনই আর মধুর দিকে বাঁক নেয় নি। হুমায়ূন আহমেদ নেই কিন্তু তার যোগ্যউত্তরসূরী রেখে গেছেন – আসিফ এন্তাজ রবি।
এবারের বইমেলায় এসেছে রবি’র লেখা উপন্যাস “চন্দ্রমুখী”। রবি’র ক্লাশমেট গৌতমের পড়া হয়ে গেলে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে বইটি। যথারীতি, কড়া জ্বরের সহজ পাচ্য পথ্য হিসেবে এক বসাতেই মেরে দিলাম। গল্পের নায়িকার নাম মুনা, নায়কের নাম ফরিদ আর নায়কের মায়ের নাম ফরিদা। আশাকরি এখানে আর বিশেষ না বললেও চলে। হূমা আহমেদ রবি।
ভালবাসা বিশারদ রবি নিজের অভিজ্ঞতা বেশ জুত করে লিখেছেও,
“ চাকরি হচ্ছে স্ত্রীর মতো আর ব্যবসা নতুন প্রেমিকা। একটায় দায়িত্ব লাগে, আরেকটাতে নিবিষ্ট মনোযোগ।“
মুনা এবং ফরিদের প্রেমেও যথারীতি পাঞ্জাবী ছিলো যার রঙ ফরিদের পছন্দ হয় নি তাই এখানেও মুনাকে পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ফেলতে হলো। ফরিদের বাবা আর পুলিশ থানা’র বর্ণনা বলাই বাহুল্য। এরকম হুবহু মিলিয়ে লেখা সহজ কর্ম কিছুতেই নয়।
উপন্যাসের শেষটি আমার ভাল লেগেছে, সত্যি বললে বেশ ভাল লেগেছে। ফরিদকে এমন জায়গায় রাখা হলো যেখান থেকে জীবন মুনার কাছেও যেতে পারে কিংবা অন্য কোথাও। পাঠক যেভাবে চান সেভাবেই উপন্যাসের শেষটি ভেবে নিতে পারে। বাস্তবতার নিরিখেই আমি ভেবে নিয়েছি, ফরিদ সিএনজি খুঁজে পেয়েছে এবং কমিউনিটি সেন্টার পার হয়ে বাড়ি চলে গেছে। পরিশিষ্টটি পড়ে মনে হলো, এসব ভাবাবেগ কেন শুধু বইয়ে থাকে। পুলিশ-ডিবি দিনরাত মানুষ তুলে গুম করে দিচ্ছে, গুম কি শুধু পেশাজীবি অপরাধীরা করে? তারপরও পরিশিষ্টটি আরও একটু বড় হতে পারত। চন্দ্রমুখী বইটিও আরও একটু বড় হতে পারত। এক ঘন্টা বিশ বা ত্রিশ মিনিটে একটা বই পড়া হয়ে গেলে, বই পড়ছি, বই পড়ছি আমেজটা কোথায় যেনো কেটে যায়।
আমাদের বাংলার ম্যাডাম মকবুলা মঞ্জুর, হুমায়ূন আহমদে সম্বন্ধে বলেছিলেন, সহজ কথা গুলো সহজ ভাষায় লেখা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। রবি’কেও তাই বলবো, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা তার পায়েও লুটাক, সহজ ভাষায় আরও সহজ গল্প-উপন্যাস লেখা হোক। পাঠকরা সারাদিনের যন্ত্রণা-বঞ্চনা থেকে রবি’র লেখায় দু দন্ড মুক্তি খুঁজে পাক, কেনো যাবে সবাই সব এত মাথা খাঁটিয়ে কঠিন কঠিন বই পড়তে। যারা নিবিষ্ট পাঠক তারা হাতের কাছে বই পেলেই উলটে পালটে কখনও মাঝ থেকে, কখনও শেষ থেকে পড়তে থাকবে কিন্তু যারা অ-পাঠক, মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি জেনারেশান তাদের পাঠক করে তুলতে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন কিংবা আসিফ এন্তাজ রবি’র জুড়ি নেই। বাংলা সাহিত্যে আমি রবি’র উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতি যে এত আর্কষনীয় হতে পারে বইটি হাতে না নিলে আমি জানতেই পেতাম না। পরে অবশ্য জুড়ে দেয়া আছে, লেখক নিজেই নিজের ঢোল পিটিয়েছেন। বইটি না পড়লেও লেখক পরিচিতিটি পড়া অবশ্যই পাঠকদের কর্তব্য। নির্ভুল ছাপায় বইটি পড়তে বেশ আরামদায়ক।