Thursday 13 January 2011

অহনার অজানা যাত্রা (দশ)

অহনা রাগ দেখিয়ে ঘুমুতে গেলেও অর্ন হার মানতে রাজি ছিলো না। সে তার ভুল ঠিক করতে বদ্ধপরিকর হয়ে গেলো। হয়তো অর্নের সিক্সথ সেন্স কাজ করছিলো যে এই ঝাল এখানেই থেমে থাকবে না, অন্য অনেক জায়গায় গড়াবে। সারারাত সে অনেক ভাবে অহনাকে বুঝিয়ে মানিয়ে ফেললো। প্রায়ই দেখা যেতো কাল বৈশাখীর মতো ঝড় আসতো সংসারে। কথা নেই বার্তা নেই কোথা থেকে অনেক কালো মেঘ আর জোর দমকা হাওয়া, মনে হতো এই বুঝি সব ওড়ে গেলো। আবার আধ ঘন্টা কিংবা এক ঘন্টা টানা বর্ষন কিংবা ঝড়ের পর, চারধার সব ধোঁয়া পরিস্কার, নিরিবিলি ঝকঝকে রোঁদ। মাঝে মাঝে খটকা লাগতো আসলেই কি ঝড় হয়েছিল। প্রায় দেখা যেতো ঝড় বৃষ্টির পর স্নিগ্ধ রোদেলা পরিবেশে দুজন বেশ হাসিমুখে, পাশাপাশি শুয়ে নানান অর্থহীন গল্প করতে করতে বেশ আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক সময় গল্প করতে করতে রাত অর্ধেক পার হয়ে যেতো। পরদিন অফিস কিন্তু তারপরো বাঁধ না মানা কথার তোড়ে দুজনেই ভেসে যেতো। ঝড় আর রোদের মিশেলে কাটছিলো জীবন।

পরদিন অর্ন অফিস যাওয়ার সময় বারবার অহনাকে তাগাদা দিয়ে গেলো কিছু পছন্দ করে রাখতে সিটি সেন্টারে যেতে। অহনা খুব দ্বিধার সাথে জানতে চাইলো কতো বাজেট। অর্ন হেসে বললো কোন বাজেট নেই, এনি থিং ফর ইউ। তবুও অহনার দ্বিধা যায় না। এখানে এসে টাকা পয়সার ঝামেলার ব্যাপারটা সে ঠিক বুঝতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায় প্রতিটি সেন্টের হিসেব অর্নকে করতে হচ্ছে। গাড়ি পার্কিং থেকে একটা কোকের জন্যেও। দু ঘন্টা গাড়ি পার্ক করলে হয়তো পাঁচ ইউরো দিতে হবে। অহনার কাছে ওটা পাঁচ টাকা। কিন্তু অর্ন ভাবছে পাঁচ ইন্টু নব্বই টাকা। শুধু অর্ন না সমস্ত সবাইকেই তাই করতে দেখে কম বেশি। তাছাড়া সংসারে শুধু সে আর অর্ন নয়, বাংলাদেশে অর্নের বাবা – মা পরিবার আছেন। অন্যান্য ছেলেদের মতো তারও দ্বায়িত্ব আছে তাদের প্রতি। নতুন সংসার, বউ আর বাবা মায়ের দ্বায়িত্ব নিয়ে অর্ন মাঝে মাঝে রীতিমতো হিমশিম খায় এটা তার নিজের চোখের দেখা।

এসব কারনে প্রায় স্বল্প পরিচয়ে অর্নের সাথে সংসার করতে এসে অহনা টাকা পয়সার দ্বিধাটা এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেনি। অর্নের কাছে কিছু চেয়ে নিতে কিংবা চাইতে তার খুবই সঙ্কোচ হয়। কোনটা বেশি চাওয়া হয়ে যাবে, অর্ন হয়তো মনে মনে তাহলে অহনাকে অন্যরকম ভাববে সেগুলো নিয়ে সে কুঁকড়ে থাকতো কিছুটা। আসলে দেশেতো তাকে চেয়ে চেয়ে তেমন কিছু পেতে হতো না। চাওয়া ছাড়াই অনেক কিছু পেতো। আর নিজের বাড়িতে কিছু চাইতেও তার তেমন সঙ্কোচ হতো না। টাকা পয়সার এতো কঠিন হিসাব নিকাশ তার কাছে অচেনা। বরং বাবা মায়ের কাছে তার বায়নার শেষ ছিলো না। একটা হাতে না পেতেই আর একটা শুরু হতো। বিদেশে আসা মানেই অহনার ধারনা ছিলো বেশুমার টাকা পয়সা খরচ, দামি ব্র্যান্ডেড জিনিসপত্র। অন্তত ইংরেজি সিনেমা দেখে তার তাই ধারনা হয়েছিলো। তখনো পর্যন্ত সে সিনেমা দেখেই জীবন সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতো। কিন্তু এটাতো হলো উলটা, গ্যাড়াকল। সিনেমা জাতীয় কিছুই নেই। বরং বজ্রকঠিন নিয়ম কানুন। পার্কিং এর বেশ সমস্যা সিটিতে। কোথাও গাড়ি পার্ক করতে হলে আধ ঘন্টা ঘুরতে হয় নইলে পুলিশ আর টিকিট। সিনেমায় সে কখনোই এসব দেখেনি। সেখানেতো সে দেখেছে যেখানে ইচ্ছে গাড়ি থামালেই হলো। এর থেকেতো বাংলাদেশই ভালো ছিলো।

সিটিতে যেয়ে সে বেশ কিছু দোকান পাট ঘুরে মোটামুটি একটা কিছু পছন্দ করে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরতেই আবার স্বামীর ফোন, গিফট পছন্দ করা হয়েছে কি না জানতে চেয়ে। সে জানালো করে এসেছে। তারপর আস্তে সুস্থে সে রেডি হয়ে অর্নের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। অর্ন সুন্দর দেখে বাইশটা বিরাট গোলাপ নিয়ে এলো তারজন্যে। তারপর দুজনে একসাথে আবার সিটিতে গেলো। অহনা পছন্দ করেছিলো সাদা পাথরের একটা দুল, পঞ্চাশ ইউরো দামের, তাই দেখে অর্ন বেশ হাসলো। সে বুঝতে পেরেছিলো হয়তো এর পিছনের কারন। তারপর বললো, আচ্ছা চলো আর একটা দোকানে যাই, আরো একটু দেখি। তারপর দুজনে গেলো বাইয়েনক্রোফে। সেখানে শুধু দামি ব্র্যান্ডের জিনিস বিক্রি হয়। অনেক দেখে টেখে অর্ন নিজেই অহনাকে মোনেটের গলার আর কানের একটা সেট কিনে দিলো। অহনার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম দাম দেখে। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, কিন্তু বুঝতে পারছিলো আজ অর্ন প্রস্তূত হয়েই তাকে নিয়ে শপিং এ এসেছে। এমনকি তারা যখন বিল পরিশোধ করতে কাউন্টারে গেলো তখন সেলস ও্যমান ভদ্রমহিলা তাদেরকে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, তারা কি ভারত থেকে বেড়াতে আসা ট্যুরিষ্ট কি না, যারা এতো দামি কিছু কিনছেন।

উপহার পেয়ে অহনা প্রায় বাক্যহারা। প্রায়ই দোকান থেকে শপিং গাইড গুলো বাড়ির লেটার বক্সে ফেলে দিয়ে যায়। সে পাতা উল্টায় দেখে, এখানে দাগায়, সেখানে দাগায়। একটা জিনিস অহনার কাছে পরিস্কার হলো, এগুলো অর্ন তাহলে লক্ষ্য করে কিন্তু কিছু বলে না। বঊযে তার কাছে মুখ ফুটে চাইতে পারে না কিন্তু দেখে দেখে চোখের আশ মিটায় সেটা তার জানা ছিলো। দোকান থেকে বের হয়ে অর্ন বললো, পরে আবার এসে তুমি এর সাথে মিলিয়ে আংটি আর ব্রেসলেট কিনে নিও, একটা সুন্দর সেট হয়ে যাবে তোমার। আর ঐ দুলটা কি সত্যিই তোমার পছন্দ ছিলো নাকি? তাহলে তুমি ওটা অন্য সময় কিনে নিও। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কথা শুনছিলো, বলে কি এই ছেলে, তার মাথার ঠিক আছেতো? বলবে না বলবে না করেও সে বলে ফেললো, এতো টাকা হঠাৎ এভাবে খরচ করে দিলে যে? অর্ন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, তোমাকে কখনোতো ভালো কিছু কিনে দেয়া হয়নি, এতোদিন হলো তুমি এলে এখানে। এ উপলক্ষ্যে দিলাম। দিতেতো ইচ্ছে করে সব সময়, হয়ে ওঠে না। চলো এবার যাই খেতে। তারপর তারা একসাথে ইটালিয়ান এক রেষ্টুরেন্টে খেতে গেলো। বহুদিন পর তারা এ উপলক্ষ্যে বাইরে খেতে গেলো অহনার পছন্দের খাবার। অনেক মূল্য দিয়ে প্রতিটি জিনিস পেতে হতো বলে প্রতিটি জিনিসই ছিলো তখন অমূল্য। খুব সহজে জীবনে কিছু পেয়ে যাওয়াও বোধ হয় ঠিক না, তাতে জীবন তার আকর্ষন হারিয়ে ফেলে।

তানবীরা
১৩.০১.২০১১

No comments:

Post a Comment