Monday 17 January 2011

অহনার অজানা যাত্রা (এগারো)

সাইকেল চালানো শেখার পর থেকে অহনা সাইকেল নিয়ে বেশ ঘুরে বেড়াতো শহরের মধ্যে। সাইক্লিং সে খুব এনজয় করতো। আবহাওয়া অনুকূলে হলেই গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে, কান গলা মাফলারে প্যাঁচিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোত। এতে শরীর মন দুটোই চাঙ্গা থাকতো। অর্নও তাগাদা দিতো, সারাদিন বাড়ি বসে না থেকে বেরোলেই পারো। পার্কে হাটো কিংবা সাইক্লিং করো। মাঝে মাঝে দেশি কিছু খেতে ইচ্ছে করলে সিটির একমাত্র এশিয়ান শপ পাকিস্তানি দোকানে যেয়ে কিনে নিয়ে আসতো। বেশি বাজার হলে, বিশ কেজি চালের বস্তা, ডাল ইত্যাদি হলে গাড়িতে নিতে হয়, অর্নর সাথে যেতে হতো। ছোটখাটো আইটেম সে নিজেই নিয়ে আসতো। একদিন চমৎকার আবহাওয়া দেখে অহনা ভাবলো যাই একটু করলা, ভিন্ডি, লাউ সব্জি নিয়ে আসি। সাথে একটু ব্যায়ামও হয়ে যাবে। এসব দোকানে অনেকেই আড্ডা দেয়। অবৈধভাবে বসবাসকারীদের কাজের, কাগজের, টাকা পয়সার লেনদেনের মীটিং পয়েন্ট থাকে সাধারনতঃ এ দোকান ও রেষ্টুরেন্টগুলো। এখানেই দেখা যায় সাধারণত বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে কালো কাজের সন্ধান, বিদেশি মেয়েদেরকে কন্ট্রাক্টে বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী যোগাড় আর তার জন্য পুলিশের চোখকে এবং আইনকে ফাঁকি দেয়ার একশ একটি উপায় আলোচনা ও ব্যাখা করা হয়। এই বাবদ টাকা পয়সার লেনদেন এবং মাঝে সাঝে মতান্তরে মারামারিও হয়ে থাকে।

মুখ চেনা পরিচিত কেউ থাকলে অহনা একটু কুন্ঠিত থাকে, তার সাজ পোষাক আর এ্যটিচ্যুড নিয়ে। কথায় কথায় লজ্জা পেয়ে লজ্জাবতী লতার মতো মিইয়ে যাওয়া স্বভাবতো তার নয়। এটাও একটা নেতিবাচক দিক বাঙ্গালী মেয়ের। এমনিতে এসব দোকানে সাধারণতঃ বাংলাদেশি, পাকিস্তানী মেয়েরা আসে না। ভারতীয়রা আসেন, তারা এসব তোয়াক্কা করেন না। আর ভারতীয়রা যে স্ট্যাটাস নিয়ে থাকেন তাতে পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশিরা তাদের ঘাটাতে সাহসও করেন না। হয়তো ভাবেন, এগুলোতো এমনিতেই ঐ দুনিয়ায় দোজখে পুড়বে, এগুলোকে পৃথিবীতে ঘাটাঘাটির দরকার কি? আর বাংলাদেশি, পাকিস্তানি কেউ আসলেও তারা থাকেন আকন্ঠ মোড়া ঘোমটা আর পর্দায়, স্বামীর পশ্চাতে। অহনার মতো জীন্স স্কার্ট পরা, একা একা ঘোরা মুসলমান সমাজের কলঙ্ক খুব কমই আছে এই শহরে। অনেক সময় তাকে একা দেখলে সর্বদা টুপি পরিহিত চাপ দাড়ি সম্বলিত ইসলামিক মাইন্ডেড পাকিস্তানি শপ ওনার তার চেহারা কুঁচকে রাখতেন। অহনা দেখলো না পরিচিত কেউ নেই আজকে। একদিকে কটা অল্পবয়েসী উপমহাদেশীয় ছেলে গুলতানি করছে। কোন দেশীয় সেটা ঠাহর করা মুশকিল। আফগানি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, বাঙ্গালী সবাই হিন্দী বলে, ভাঙ্গা কিংবা চোস্ত, যে যেমন পারে। তবে নেপালী, শ্রীলঙ্কান, আর বাংলাদেশিদের গায়ের রঙ সাধারণত ওদের চেয়ে বেশি গাঢ়ো হয়। অপরিচিত কিছু লোকজন কেনাকাটা করছেন। তেমন ভীড় নেই দোকানে কাজের দিন বলে হয়তো। এখানে দোকান পাটে ভীড় হয় ছুটির দিনে কিংবা অফিস আওয়ারের পরে।

যাদের বাজার হয়ে গেছে তারা দোকানের সামনে তাদের থামিয়ে রাখা গাড়িতে জিনিসপত্র তুলছেন। অহনা তার বাজার সাইকেলের ব্যাগে ভরছে। একজন বেশ কেতাদূরস্ত পোষাক পরা মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক বাজার করতে ও জিনিসপত্র গাড়িতে তুলতে তাকে লক্ষ্য করছিলেন হয়তো। হঠাৎ তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া? অহনা একটু অবাক হয়ে পরিস্কার গলায় উত্তর দিলো, নো, আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ। ভদ্রলোক উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো, আপনি বাঙালী? অহনাও খুব খুশি হলো শুদ্ধ বাংলা শুনে। তারপর কথা হলো, তারা কিছুদিন ধরে এই শহরে আছেন, ফিলিপস নেদারল্যান্ডসে কাজ করেন। ভদ্রলোক তাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আছে কি করে ইত্যাদি। তারপর তার কার্ড অহনার হাতে দিয়ে খুব করে অনুরোধ করলেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। অহনা খুবই আনন্দিত হলো, আবার পূর্বের বাংলাদেশিদের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা থেকে কুন্ঠিত, ভারতীয়দের সাথে মেশার কোন পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায় কৌতূহলী। সে বাসায় এসে অর্নকে জানালো ফোনে এই ঘটনা। অর্ন শুনলো চুপচাপ, বললো ঠিকাছে ফোন করবো, যোগাযোগ করবো। তারপর ফোন করি করি করে আর করা হয়ে ওঠেনি, তারা ভুলে গেলো।

তার কিছুদিন পর একদিন শনিবারে অর্ন আর অহনা সিটি সেন্টারে বাজার করছিলো টুকটাক। ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই ভদ্রলোক আর তার পরিবারের সাথে দেখা হয়ে গেলো। স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে তিনিও এসেছেন বাজার করতে ছুটির দিনে। অহনা চিনতে পারেনি, ভদ্রলোকই চিনতে পারলেন প্রথমে। তিনি কলকলিয়ে ওঠলেন, তুমি কেনো ফোন করলে না? সরাসরি তুমিতে। সেদিন দুই পরিবারের সবার সাথে সবার সাথে আলাপ হলো। আলাপ জমতেই তারা পাশে ম্যাকে বসে কফি খেলেন একসাথে। বাসার ঠিকানা বদলাবদলি করে, পরবর্তী দেখার দিন ঠিক করে বিদায় নিলেন। অহনারা এক দুপুরে সেজেগুঁজে নিমন্ত্রন খেতে গেলো তাদের বাড়ি। তারা বেশ আন্তরিকভাবে রান্না বান্না করে প্রস্তূত ছিলেন এবং দুপুরের নিমন্ত্রন আড্ডায় আড্ডায় সন্ধ্যে পর্যন্ত গড়াল। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে অহনার জন্যে বিদেশ বাড়িতে অভূতপূর্ব এক লাইব্রেরীর খোঁজ পাওয়া গেলো। তাদের বিরাট কালেকশন ছিলো সিনেমা, বই, গানের। সত্যজিত রায়ের ধরতে গেলে পুরো কালেকশন, মৃনাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, হৃষিকেশ মূখার্জী। মহাশ্বেতা দেবী,আশাপূর্না দেবী, রবীন্দ্রনাথ, নীরেন্দ্রনাথ, সুনীল, বুদ্ধদেব, সমরেশের বইয়ের ভান্ডার আবার দাদা দিদি দুজনেই গান করতেন। সনু নিগম থেকে চিন্ময়, আদনান সামী থেকে সুচিত্রা মিত্রের সিডি আর ক্যাসেটের সম্ভারে তাদের বাড়ি পরিপূর্ন। তাদের বাড়িতে নিয়মিত কোলকাতা থেকে সানন্দা আসতো। দিদি আর সে মিলে প্রায়ই সানন্দার রেসিপি ট্রাই করতো।

ভারতীয় বাঙ্গালীদের জীবন যাত্রার মান এতো উন্নত ঢাকার থেকে যে সেটা চোখে পড়ার মতো চোখে পড়ে। প্রত্যেকটি খাবার দাবার, প্লেট গ্লাস, চেয়ার কুশন, বিছানা, জামা কাপড় সবকিছুতেই শিল্প। সাধারণ একটা খাবারকেও পরিবেশনের জন্যে এভাবে ডেকোরেশন করবে যে খাওয়া ছাড়াই খাওয়া হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, ঢাকার লোকজন মুম্বাইয়ের সিনেমা দেখে শাড়ি, কামিজ, জামা কাপড় কিনে কিন্তু কোলকাতার লোকেরা মুম্বাই ট্রেন্ড ফলো করেন না। তারা তাদের বিয়েতে তাদের ট্র্যাডিশনাল শাড়ি কাপড় ব্যবহার করেন। জড়ি, চুমকি জাতীয় কাপড় সাধারণত ক্যালকেশিয়ানকে ব্যবহার করতে দেখা যায় না। রাজস্থানী, পাঞ্জাবী, গুজরাটিরা করছেন হয়তো। অহনা গোগ্রাসে তাদের বাড়িতে গেলে ঘর সাজানো, ডিনার টেবল সাজানো, খাবার সাজানো, ড্রিঙ্ক সাজানোর পদ্ধতি সব গিলে গিলে শিখতে লাগলো। বাড়ির পর এ প্রথম সে কোথাও কি করে থাকতে হয় বা বাঁচতে হয় যাকে কখনো কখনো সুশীল ভাষায় আর্ট অফ লিভিং বলে শিখতে লাগলো। এবং নিজের মতো চেষ্টাও করতে লাগলো। কি করে বিভিন্ন রঙের সব্জির কম্বিনেশন করে সব্জি নির্বাচন করলে এবং এগুলোকে এক মাপে কাটতে পারলে মিক্সড ভেজ করার পর সুন্দর দেখায় সেটা সে দিদির কাছে প্রথমে লক্ষ্য করলো এবং নিজের মগজে ঢোকালো।

কোলকাতার লোকজনদের নিয়ে তার নিজের দেশে ও দেশের লোকজনদের কাছে অনেক ধরনের নেতিবাচক গল্প শুনেছিলো সে। কিন্তু সে সবের কিছুই অহনা তাদের মধ্যে দেখতে পেলো না। দু পরিবারে বেশ আন্তরিকতা গড়ে ওঠলো। এতোদিনে প্রবাসে মন খুলে গল্প করার মতো কাউকে পাওয়া গেলো। দিদি দিনের বেলায় শপিং এ গেলে কিংবা কোথাও এমনি ঘুরতে গেলে প্রায়ই ফোন করে অহনাকে সাথে নিয়ে যান। দাদা দিদি এর আগে সিঙ্গাপুর আর কানাডা ছিলেন, এখন হল্যান্ডে আছেন। এ সময়ে তাদের ইচ্ছে যতোটা সম্ভব ইউরোপ ঘুরে নেয়া, আবার কোথায় বদলি হয়ে যান। বাড়িতে অহনা মেয়ের মতো ছিলো, গৃহিনী হওয়ার পর মা শাশুড়ি কেউই সাথে নেই বলে, সে অনেক কিছুই জানতো না, শিখেনি। এই প্রথম কারো কাছ থেকে সে সত্যিকারের শিক্ষা পেলো কি করে সংসারকে সামলাতে হয়। এখানে জিনিসপত্র শেষ হয়ে গেলেই, কাউকে দোকানে পাঠানো যায় না, যা চিনি নিয়ে আয় কিংবা কাঁচামরিচ। কি করে বাজারের লিষ্ট রাখতে হয়, বেশি করে কিনে ফাষ্ট ইন ফাষ্ট আউট পদ্ধতিতে কাঁচামালের এক্সপায়ার ডেট দেখে স্টোর করতে হয় কিংবা সেল থাকলে নষ্ট হবে না এমন জিনিস সস্তায় অনেক কিনে রেখে সাশ্রয় করা যায় ইত্যাদি অনেক কিছু দিদি অনেকটা হাতে কলমে শিখিয়ে দিলেন।

দিদিদের ছেলে অহনার থেকে সামান্য বড়। তারা অনেকটা সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন তাকে। অহনা পারে না বা পারবে না বলে অনেক কিছু নিয়ে নার্ভাস থাকতো। দিদি এবং দাদা দুজনেই সমানে তাকে সাহস দিতেন। কমাস আগে দেশ ছেড়ে এসে সে এতো কিছু পারছে একা একা সেটাই অনেক তাদের চোখে। কিংবা তারা অনুপ্রেরনা দেয়ার জন্যেই বারবার বলতে লাগলেন। অহনার মধ্যে যা কিছু ভালো বা ইতিবাচক ছিল সেটাকে সামনে আনতেন বার বার করে। এতে অহনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিতে লাগলো আস্তে আস্তে না আমি পারবো। হয়তো সত্যজিতের পাঁচটা সিনেমার ক্যাসেট আনলো অহনা সে বাড়ি থেকে, সেগুলো দেখার পর, সেই সিনেমা নিয়ে, সিনেমার সমসাময়িক ঘটনা পারিপ্বার্শিকতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতো। শেখা, জানা, একে অপরকে সম্মান তিনটে জিনিস একই গতিতে চলতে লাগলো। দিদিদের কাছ থেকে সে বেনেলুক্স বাঙালী সমিতি প্রবাসীর খোঁজ পেলো। দিদিরা ধরলেন সামনের দুর্গা পূজার অনুষ্ঠানে অহনা অর্নকে যেতেই হবে। খুব ভালো অনুষ্ঠান হয় তাছাড়া এতো লোক আসে বিভিন্ন শহর থেকে, অনেকের সাথে আলাপ হবে। এভাবে এক জায়গায় মুখ গুঁজে পরে থাকলে চলবে কেনো? অহনা অত্যান্ত আনন্দিত হলো শারদীয়া সম্মেলনে যাওয়ার খোঁজ পেয়ে। সে দিনরাত অনুষ্ঠানের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

তানবীরা

১৭.০১.২০১১

ডিসক্লেমারঃ এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কারো সাথে মিলে যাওয়া নিতান্তই দুর্ঘটনা।

No comments:

Post a Comment