Saturday 11 June 2011

আকাশ থেকে ফেলছে ছায়া মেঘের ভেসে যাওয়া

একাগ্র চিত্তে তিতলি ডুবে গেলো নিজের মধ্যে। লাষ্ট সেমিষ্টারে নিজের রেজাল্ট দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। রেজাল্ট ভালো হওয়াতে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়ে গেলো। মন্দ লাগে না পড়াশোনা করতে বরং বেশ ভালো সময় কেটে যায় তার পড়ার মধ্যে ডুবে থেকে। মাঝে মাঝে এক মনে ইজেলে তুলি ঘষতে থাকে। নানা রঙ এক সাথে মিলিয়ে নিজে একটা আলাদা রঙ তৈরি করে। কল্পনা তার সীমাহীন বিস্তৃত। একদিন ভাবল আকাশটাকে লেমন ইয়েলো করে দিলে কেমন হয়? আকাশকে সবসময় আকাশি রঙের হতে হবে কেন? লেমন ইয়েলো আকাশ একে তার নীচে পিঠ ভর্তি খোলা চুলের ম্যাজেন্টা শাড়ি পড়া এক মেয়ে আঁকলো। বড় বড় চোখের কাজল পড়া সেই মেয়ে হাতে হালকা বেগুনী রঙের ছাতা ধরে রেখে ছাই রঙা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। নিজের সৃষ্টির প্রতি নিজেই অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আর কি করবে? মোবাইল নিয়ে মুখে খই ফুটিয়ে যা মনে আসে তা বকার মতো এখন আর তার কেউ নেইকখন আকাশে মেঘ ভাসে, কখন রিমঝিম রিমঝিম ছন্দ তুলে বৃষ্টি উথলে কেঁদে পড়ে মাটির খরতাপ শুষে নিয়ে যায় তিতলি জানে না আজকাল আর সেসব। জানলেও এক মুহুর্তের জন্য তার উদাস হতেই মনের বলগা সে চেপে ধরে। না কারো কথা ভাববে না, দুর্বল হওয়া চলবে না তার আর। পিছনে আর না তাকাবে সে শুধু নিরন্তর তার আজ সামনে তাকানো।

বন্ধুদের সাথে প্রচুর হই হই করতে লাগলো। সিনেমা, পিজা, লাইব্রেরী, পিকনিক, আড্ডা সবকিছুতেই যায় আজকাল তিতলি। বরং একা হতেই তার ভয় লাগে। প্রথমে অনেকদিনের অনভ্যাসের আড়ষ্টতা থাকলেও একসময় তার এই হৈহুল্লোড় ভালোও লাগতে লাগল। মনে হতে লাগলো জীবনটা কোথাও আটকে গেছিল তার। তারচেয়ে এই বাঁধনহীনতাই ভালো। এক একবার হালকা লাগে নিজেকে। মুক্ত বিহংগ হয়ে আকাশে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। শিকল কেঁটে গেছে সে আনন্দে বিভোর হতে চায়। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছিল ধীরে ধীরে। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রন বাড়ছিল। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন ফিরে পেয়ে তিতলির ভাল লাগছিল। কিন্তু ঠিক তার পরের মূহুর্তেই জীবনের সব চাইতে প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে ফেলার কষ্টে সে কাতর হয়ে পড়ে। সব কিছু তার শূন্য আর ফাঁকা মনে হতে লাগে। রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, ঘুম আসে না তার চোখে, তখন কেঁদে কেঁদে মনের ভারটা একটু কমিয়ে নেয়। সবকিছু কি আসলেই কখনো হারায়? তাহলে কেন রোজ তিতলি ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে মোবাইলটা চেক করে? জানে কোন ম্যাসেজ কেউ পাঠাবে না তারপরেও অভ্যাসবশত প্রথমেই মোবাইল চেক দিয়ে তার দিন শুরু হয়। শুধু অভ্যাসে করে সেটাও সত্যি নয়। মনে একটা ক্ষীণ আশা উঁকি দিয়ে যায় রোজ ভোরে, হয়তো তার সায়ান তার কাছে ফিরে এসেছে। কিন্তু এসএমএস না দেখে আগের মতো বুক ভাঙ্গা কষ্ট তার আজকাল আর হয় না। রুটিনে ডুবিয়ে দেয় সে নিজেকে। কখনো চোখটা নরম হয়ে এলে হাতের উলটো পিঠে চোখটা মুছে নেয় সে। ভালোবাসা ভুলবে কেনো সে? ভালবাসা ভোলা বা মোছা কোনটাই যায় না। ভুলে গেছি ভাব করা যায়।

মন খারাপ করা বিষন্ন সন্ধ্যায় একা একা ছাঁদে সে হাঁটে। টবে লাগানো দোলনচাঁপা আর বেলির গন্ধে মন আকুল হতে থাকে প্রিয়জনের জন্যে। সায়ানের স্পর্শ পাওয়ার জন্যে কিংবা গলা শোনার জন্য হু হু কাঁদতে কাঁদতে তিতলি ভাবে, কি করে মানুষ বদলে যায়? এই আকাশ, এই মেঘ, এই ফুল, এই বৃষ্টি সবতো একই আছে। এক সময় সায়ানের প্রতিজ্ঞা ছিল, যত যাই হোক, তিতলির গলা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অন্তত একবার তাকে শুনতেই হবে। সায়ান তার গলা না শুনে চব্বিশ ঘন্টা পার হতে দিবে না। অভিমান হলে তিতলি যদি তার ম্যাসেঞ্জার কিংবা মোবাইল বন্ধ করে রাখতো তাহলে সায়ান বার বার বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন করতে থাকতো। বাসার সবাই বিরক্ত হতো কে বার বার ফোন করে কিন্তু কথা বলে না। তিতলিকে তখন বাধ্য হয়েই সায়ানের কাছে ফিরতে হতো। কতো সময় হয়তো একঘন্টা কথা বলে ফোন ছেড়েছে তিতলি আবার আধ ঘন্টা পরেই সায়ানের ফোন। মিস করছে থাকতে পারছে না ওর গলা না শুনে। দিনে দশবার ওর গলা শুনতে হতো। এখন কতো চব্বিশ ঘন্টা কেটে যায় সায়ান তার তিতলির সাথে কথা বলে না। কি করে পারে তার গলা না শুনে থাকতে? ক'দিন দেখা নাহলে পাগল হয়ে যেতো দুজনেই। একবার তিতলি ধুম জ্বরে পড়ল। মাথা তুলতে পারে না আর বাইরে যাবে কী। একদিন সন্ধ্যায় বাবার সাথে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে বাড়িতে ঢুকতে যেই যাবে তার অবচেতন মনটা আচমকা কেমন যেনো দুলে উঠল। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল ল্যাম্পপোষ্টের নীচে কিসের যেন ছায়া নড়ছে। তিতলির মন জেনে গেল কিসের সেই ছায়া। তার হৃদয়ে হাজার তারের বীনার ঝংকার উঠলো। সেই খুশিতে না ওষুধে তার সে রাতেই জ্বর নেমে গেলে, বাড়ির সবার বাঁধা অতিক্রম করে পরদিনই সে জরুরী ক্লাশের বাহানা করে পড়িমড়ি ইউনিতে ছুটে ছিলো। কতোটুকু বদলায় এক জীবনে একজন? তবুও মনকে প্রবোধ দেয় কাটবে যদি দিন এমন করে তবে কাটুক না।

একদিন রাতে সে অবাক হয়ে দেখল ম্যাসেঞ্জারে সায়ান সবুজ নক্ষত্র হয়ে জ্বলে আছে। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। চুপচাপ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো প্রিয় সে নামটির দিকে। তারপর কোন ক্ষুদ্রতাকে মনে স্থান না দিয়ে সায়ানকে নক করলো সে নিজে থেকেই। কিরে কেমন আছিস? শুরু হলো টুকটুক করে কথা। বেশির ভাগই সায়ানের খোঁজ নিল। কতোদিন বাদে জানতে পারছে কেমন ছিল সায়ান আর কেমন আছে এখন। কে বলবে এর মাঝে পাঁচ মাস কেটে গেছে। মনে হচ্ছিল কোনদিন কোন বিচ্ছেদ বুঝি দুজনের মাঝে ছিল না। সায়ানের দুঃখে তার চোখে পানি এসে গেলো। ফেসবুকে দেখা সেই স্বর্নকেশির সাথে সায়ানের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। স্বর্নকেশি নিজেই সায়ানকে ছেড়ে চলে গেছে। সে সায়ানের মধ্যে নাকি তার স্বপ্নপুরুষকে খুঁজে পায়নি। বলেছে, ইট ইজ গোয়িং বাট নট থ্রিলিং ইনাফ টু লিভ উইথ ইউ। স্বর্নকেশির মতে সায়ান অনেক বেশি গৃহি, ঠিক সেরকম রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ নয় যাকে সে খুঁজছে। ও আরো বেশি ম্যানলি, এম্ববিশ্যাস আরো দুর্ধষ কাউকে চায়। প্রত্যাখানের কষ্টে সায়ান এখন বেশ মন মরা। মায়া লাগতে লাগলো তিতলির, বুকটা মুচরে উঠলো তার প্রিয় বন্ধুর কষ্টে। সে সায়ানকে চিয়ারআপ করতে চাইলো নানাভাবে। একজন প্রকৃত বন্ধুর মতো হাত ধরে রইল তার। ভালোবাসে সেতো মিথ্যে নয়।

আজকাল প্রায়ই ওদের দুজনের কথা হয়। টুকটুক দুই জানালায় দুজনের ভাবের আদান প্রদান চলতে থাকে। অস্বীকার করবে না তিতলি মনের কোথাও একটা জ্বলুনি আছে তার। প্রত্যাখানের কষ্ট, অবজ্ঞার জ্বালা তাকে পোড়ায়। তার ভালবাসাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছিল এই পুরুষ, তার সেই একা থাকার কষ্ট, সেই নিংসংগতা, সেকি ভোলার? কিন্তু তিতলি নিজের কষ্টের ওপর ছাই চাপা দিয়ে রাখলো। কিছুতেই সায়ানের কাছে নিজেকে ছোট করবে না সে। বন্ধুর দায়িত্ব পালনে সে ব্যর্থ হবে না, দুর্দিনেইতো লোকের বন্ধুর দরকার সবচেয়ে বেশি। আজকাল সায়ান আবার আগের মতো তিতলিকে মেইল করতে লাগলো। পরীক্ষার রুটিন, রেজাল্ট, কি রান্না করলো নতুন সব জানাতে লাগলো। মেইল বক্সে সায়ানের নাম দেখলেই চোখ নরম হয়ে যায়। কতো দিন রাত ঘন্টা প্রহর কেটেছে তার এই মেইল বক্সের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। দুটো লাইনের জন্যে কতো তড়পেছে তার ভিতরটুকু। কতোদিন জ্বরতপ্ত মাথায় পিসি খুলে ঠায় বসে ছিল সে চোখের পলক না ফেলে, আসবে চিঠি আসবে সেই আশায়। অসহ্য যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে পুরনো মেইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখে, বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছে সে। জ্বরের ঘোরেও তারই নাম জপেছে। সেসব মুহূর্ত তার কিভাবে কেটেছে, জানে কি সায়ান নাকি চাইবে কোনদিন জানতে? সেইতো এলো চিঠি কিন্তু বড্ড দেরী হলো তার কাছে পৌঁছতে।

সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অবাক তিতলি। সারাদিন যেনো তিতলির ভালো যায় সেই উইশ রেখে এসএমএস করেছে সায়ান তাকে। কতোদিন পর!! চোখ পানিতে এভাবে ভরে গেলো ম্যাসেজটাই ঠিক করে পড়তে পারছিল না সে, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল বার বার সবকিছু। আজকাল ম্যাসেঞ্জারে কথা হলেও সায়ান অন্যরকম করে কথা বলে। ফোনেও আবেগে ভরা থাকে সায়ানের গলা। কিন্তু আজ যখন তিতলি সায়ান নামক ঘাতক ব্যধির আক্রমন থেকে প্রায় সেরে উঠেছে তখন তার মনের দরজায় আবার কেনো এই কড়া নাড়া? যে যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে একবার গেছে সে, কোন কিছুর বিনিময়েই আর একবার সে কষ্ট পেতে চায় না। তিতলি এখন কি করবে?

তানবীরা
১২.০৬.২০১১

No comments:

Post a Comment