Tuesday 28 June 2011

অহনার অজানা যাত্রা (বারো)

অনেকদিন পর কোন একটা বড় অনুষ্ঠানে যাবে, এ নিয়ে অহনা মানসিকভাবে খুব উত্তেজিত। দিদির সাথে কি পড়ে যাবে প্রবাসীতে, কিভাবে সাজবে তা নিয়ে আলোচনা করে সেভাবে সে প্রস্তূত হল। লম্বা প্রতীক্ষার পর এলো সেদিন। অনেক লোকজনে গমগম করা হলে তারা ঢুকল। দেশ ছেড়ে আসার পর এ প্রথম প্রায় দেড়শ বাঙ্গালীর সমাগমে ভর্তি কোন জায়গায় অহনা পা রাখল। সুন্দর শাড়ি, সুবেশী সাজগোজ, চুড়ি গয়নার টুংটাং, হাসি উচ্ছাস এ পরিবেশে মুহূর্তেই মন ভাল হয়ে গেলো তার। অনেকের সাথে টুকটাক আলাপ হল। বাংলাদেশি কোলকাতা দুজায়গার বাঙ্গালীরাই আছেন। তবে কোলকাতার বাঙ্গালীর সংখ্যাই সেখানে বেশি। কিছু বাংলাদেশি পরিবারের সাথে আলাপ হলো। কিন্তু আন্তরিকতা বেশি পেলো কোলকাতার লোকদের কাছ থেকেই। বয়সে কাছাকাছি হওয়ার কারণেও হয়তো বন্ধুত্ব জমে উঠলো তাদের সাথে বেশি। সুন্দর অনুষ্ঠান দেখে, ভালো খাবার পেট পুরে খেয়ে অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে বাড়ি ফিরলো তারা। তার কিছুদিন পর থেকেই প্রবাসীতে পরিচয় হওয়া বন্ধুদের কাছ থেকে নিমন্ত্রন পেতে লাগলো। নিমন্ত্রনের সুবাদে এ শহর ও শহর ঘোরা হতে লাগলো। নতুন মানুষদের সাথে চিন্তা ভাবনার আদান প্রদান হতে অনেক নতুন জিজ্ঞাসা মনে জন্ম নিতে লাগলো তার। বাংলাদেশ ও কোলকাতাকে অনেকেই এপার বাংলা ওপার বাংলা বলেন বটে, কিন্তু মুখের ভাষা হতে আরম্ভ করে আমাদের দৈন্দদিন জীবন ধারণে যে কতোটা অমিল তা প্রকটভাবে অহনার চোখে ধরা পড়তে লাগলো।

যেটা বাংলাদেশে মাছের তরকারি সেটা কোলকাতায় মাছের ঝোল। শুধু নামে নয় রান্নায়ও পার্থক্য আছে। তারা সাধারণত মাছ রান্নায় পেয়াজ, রসুন ব্যবহার করেন না। কালোজিরে, সর্ষে কিংবা পোস্ত তাদের দৈনন্দিন রান্নার উপকরণ। আমরা যেমন সব্জিতে মাছ দিয়ে খাই সেটার প্রচলনও নেই কোলকাতায়। বড়জোর আলু দিয়ে মাছের ঝোল। আমরা যেমন বাদামী চামড়া দেখলেই হাই হ্যালো বলতে এগোই, সেটা তাদের মধ্যে নেই। তারা ভাবেন, আমি আগ বাড়িয়ে গেলে আমি ছোট হয়ে গেলাম। উলটো দিকে তাকিয়ে থাকাই তাদের দস্তুর। যেকোন জিনিস অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করতেও তাদের জুড়ি নেই। চলো পার্টি করি তারপর খরচ সমান শেয়ার করে নেই। এধরনের প্রস্তাব আমাদের বাংলাদেশিদের তরফ থেকে দেয়ার কল্পনাও করা যায় না কিন্তু অবলীলায় তারা বলেন এবং করেন। চলো একসাথে অন্য শহরে যাই, গাড়ির তেল খরচটা দুজনে ভাগাভাগি করে নেবোখন। এগুলো যে খারাপ তা নয় কিন্তু বাংলাদেশি সভ্যতায় টাকা পয়সার এধরনের খোলাখুলি ভাগাভাগির প্রচলন এখনো শুরু হয়নি। অহনার সবচেয়ে যে জিনিসটা পছন্দ হলো, এখানে সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে, তুমি করে বলে। দাদা বৌদি, আপনি আজ্ঞে করার কোন ব্যাপার নেই। বয়স ব্যাপারটা এখানে জরুরী নয়, সবাই সবার বন্ধু। আমাদের বাংলাদেশের সভ্যতা ধরলে বিবাহিত মেয়ে মানে সবাই তাকে ভাবী ডাকছেন। কোন অজানা কারণে পুরুষকে দুলাভাই বলা হয় না, তার স্ট্যাটাস অপরিবর্তিতই থাকে। বাবার বয়সী লোকও ভাবী আপনি বলে কথা বলে যান অনায়সে। আশার কথা পরিবর্তনের ঢেউ এখন বাংলাদেশের দিকেও আসছে। এখন অনেকেই এই দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। মেয়েরাও আজকাল সচেতন হয়েছে এ ব্যাপারে।

কোলকাতার লোকেরা পড়তে ভীষন ভালোবাসে। আমাদের বাংলাদেশি নতুন জেনারেশনের মতো পেপারব্যাক কিংবা হুমায়ূন আহমেদ নয়। জ্ঞান অর্জনের জন্যে পড়াশোনা করা যাকে বলে। যেকোন ব্যাপারে ভাসা ভাসা নয়, আদ্যোপান্ত পড়া তাদের স্বভাব। তবে বাংলাদেশের লোকেরা কোলকাতার গানের শিল্পী, সিনেমা, লেখক, কবি সম্পর্কে অনেক খোঁজ রাখেন, কোলকাতার লোকেরা বাংলাদেশের সম্বন্ধে সে তুলনায় কিছুই জানেন না বলতে গেলে। তাদের বাঙ্গাল মিশ্রিত অবজ্ঞা আছে বাংলাদেশের প্রতি। তারা বাংলাদেশকে জানে তাদের পূর্ব পুরুষদের বর্ননা থেকে আর ভাবে এখনো বাংলাদেশ সেখানেই পরে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে বলা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের নিদারুন তাচ্ছিল্য কাজ করে। তাছাড়া প্রবাসে নানা ক্যাটাগরীর বাংলাদেশি তারা দেখেন, তাদের পোশাক আশাক, চলন বলন দেখে তারা আরো বেশি নাক সিঁটকাতে থাকেন। কৃষ্টি কালচারে বাংলাদেশিদের তাদের সমান সমান ভাবতে তারা চান না কিছুতেই। মুসলমান নামের উচ্চারন যদি তারা ঠিক করে বলেনও, কিছুতেই তারা তা ঠিক বানানে লিখবেন না। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে খটকা থাকা সত্বেও নিদারুন একাকীত্বের কারণে অনেক দ্রুতই তাদের সাথে ভাব হয়ে গেলো অহনার। বন্ধুদের গ্রুপে সে একাই বাংলাদেশি। তাই বন্ধুত্ব হলেও কোথাও একটা ফাঁক ছিলই।

আস্তে আস্তে নতুন বছর বরন করার প্রস্তূতি প্রবাসেও শুরু হলো। উইকএন্ড ছাড়া যেহেতু রিহার্সেল দেয়া সম্ভব হয় না তাই প্রবাসে মোটামুটি ফেব্রুয়ারী থেকেই বর্ষবরন প্রস্তূতি শুরু হয়ে যায়। প্রবাসীতে তখন একটা মোটামুটি নিয়ম ছিল নববর্ষে নৃত্যনাট্য আর শারদীয়া সম্মেলনে নাটক হবে। নৃত্যনাট্যের জন্যে লোক পাওয়া একটু মুশকিল হয়। মেয়েদেরকেই অনেক সময় ছেলে সেজে নাচতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলায় জুতসই নৃত্যনাট্য পাওয়াও ভার। সেবার ঠিক হলো শাপমোচন করা হবে। একদিন কারো বাড়িতে ডিনারের পর আড্ডা হচ্ছিল। কে কোন চরিত্র করবে সেসব ঠিক হচ্ছিল। আচমকা কেউ বলে উঠল অহনাকে, তুমি কিছু করছো না? তুমি করছো না কেন? যারা এতোক্ষণ অহনাকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি তারাও হৈ হৈ করে উঠলো। সে খুবই নার্ভাস গলায় মাথা নেড়ে না না বলে উঠল। আমি পারি না, আমি পারবো না। কবে সেই ক্লাশ থ্রী ফোরে প্রজাপতি প্রজাপতি নেচেছে আজ আর কিছুই মনে নেই তার। অহনাকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে তারা অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো। নাচ করার জন্যে প্রাথমিকভাবে যা যা প্রয়োজন মানে সৌন্দর্য, ফিগার, বয়স সবই আছে তাহলে অসুবিধা কোথায়? অহনার অনমনীয়ভাব দেখে পরে ভাবলো মুসলমান ঘরের মেয়ে কিংবা অর্ন বাধা দিতে পারে এ কারণে হয়তো সে রাজি হচ্ছে না। কেউ একথা অর্নকে জিজ্ঞেস করতেই সে মাথা ঝাকিয়ে জানিয়ে দিল, অহনা করতে চাইলে তার কোন সমস্যা নেই।

একথা শুনে স্তিমিত হয়ে যাওয়া হৈ হৈ আবার চড়ে উঠলো। নিরুপায় অহনা জানালো সে সবার সাথে তাল মিলিয়ে হয়তো নাচতে পারবে না। সে কখনো নাচ শিখেনি, জানে না নাচতে। পার্টিতে এলোমেলো নাচা আর রবীন্দ্র নৃত্যতো এক কথা নয়। তখন একজন উঠে দাড়ালো, রাঙিয়ে দিয়ে যাওগো এবার যাবার আগে গানটি বাজানো হলো স্টিরিওতে আর অহনাকে বলা হলো তাকে অনুসরন করতে। নগদ নগদ পরীক্ষা হয়ে যাক সে পারে কি না। দেখা গেলো দেখে দেখে অহনা ভালোই তুলছে। ব্যস, সাব্যস্ত হয়ে গেলো শাপমোচনের কমলিকার সখীদের চরিত্রের একজন সে। এবার রাজপুত্রের সখাদের পালা। তখন স্ত্রীর নাচের প্রতি অতি উৎসাহের দন্ড হিসেবে অর্নকেও সখাদের চরিত্র দেয়া হলো। প্রত্যেক উইকএন্ডে এর বাড়ি তার বাড়ি ঘুরে ঘুরে রিহার্সেল হতে লাগলো, সাথে আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া। অর্ন আর অহনাকে আড্ডার নেশায় পেয়ে বসলো। সেসাথে সিনেমার ক্যসেট, গানের সিডি, বইয়ের আদান প্রদান ও হতো অনেক। বেশির ভাগ অহনাই নিতো, তারই সর্বগ্রাসী জানার ক্ষুধা, অর্নের এতো সময় নেই। অন্যপক্ষের থেকে বাংলাদেশি লেখকদের বইপত্র কিংবা গানের প্রতি আগ্রহ তেমন ছিল না। এরসাথে একটি ইতিবাচক জিনিস চলে এলো অহনার জীবনে। একাকীত্ব তার আর তেমন খারাপ লাগে না। বই, সিনেমা কিংবা নাচে নিবিষ্টভাবে নিজেকে ঢেলে দেয়ার জন্যে মনে হয় একাকীত্বই বেশি জরুরী। একাকীত্বের সাথে সারা জীবনের সখ্যতার সেই হলো শুরু । আস্তে আস্তে অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে এলো। চুড়ান্ত নার্ভাসনেস আর উত্তেজনা উৎকন্ঠার মধ্যে দিয়ে অহনা তার সখী চরিত্র চরিত্রায়ন করলো। পুরো নৃত্যনাট্যটি ভিডিও করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে সবাই একসাথে বসে ভিডিও দেখলো। অবাক হয়ে অহনা উপলব্ধি করল, তার এই নার্ভাসনেসের কিছুই ভিডিওতে আসেনি বরং সে বেশ ভালোই করেছে। নিজের পার্ফমেন্সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলো সে। অন্যদের কাছ থেকেও অনেক বাহবা পেলো।

অনেকেই তার হাতের মুদ্রা, মুখের এক্সপ্রেশান ইত্যাদির ভূয়সী প্রশংসা করল। তাদের মধ্যে কিছু বিদেশীও ছিলেন। বিদেশিরা মিথ্যে বলছেন না এই বিশ্বাস নিয়ে অহনার প্রথম সাফল্যে বেশ মাথা খারাপ হয়ে গেল। সে একজন বিদেশিনীর পরামর্শ্যে কিছুদিন সালসা নাচের ক্লাশ করল। মনে হলো অর্ন ততোটা আনন্দিত নয় তার সালসা নাচ নিয়ে। সে নিজেও সালসার চেয়ে ক্লাসিক্যাল ভারতীয় নাচের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু যে শহরে অহনা থাকে সেখানে সেধরনের কিছু তখন নেই। তখন আবার কিছুদিন নাচ বাদ দিয়ে বাড়ি বসে থাকলো। তারপর এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়ে দক্ষিন ভারতীয় শিক্ষিকার কাছে নিয়মিত ভারত নাট্যম শিখতে লাগলো সে। সপ্তাহে একদিন তিনি অন্যশহর থেকে অহনাদের শহরে আসেন নাচ শেখাতে তাও মাত্র দু ঘন্টা। রোববারে সকাল দশটা থেকে বারোটা। প্রেমিক যেভাবে প্রেমিকার জন্যে অপেক্ষা করে, চাতক যেভাবে পানির অপেক্ষায় থাকে ঠিক সেভাবে অহনা প্রত্যেক রোববারের অপেক্ষায় থাকতো। শেখার আনন্দে সে তখন বিভোর। নাচ আর প্রার্থনা অহনার কাছে তখন সমার্থক হয়ে গেল। মন ভালো কিংবা মন খারাপ যেকোন সময়েই সে তার তাট্টি মাট্টি মুদ্রায় দাঁড়িয়ে নাচের অনুশীলনে হারিয়ে যেতে পারতো। অহনা অল্পদিনেই শিক্ষিকার খুব প্রিয় একজন হয়ে উঠল সাথে কারো কারো চক্ষুশূল। চক্ষুশূল হওয়ার কারণ সেই মুহূর্তে সে ধরতে পারলো না যদিও, সে নাচার আনন্দেই বিভোর ছিল। শিক্ষিকার সাথে যখন সে আলারিপ্পুর তাম ধিতাম তেই তা তেই তাম ধিতাম তেই তা তেই করতো, অন্যজগতে হারিয়ে যেতো। মনে হতো সব দুঃখ, কষ্ট পাওয়া না পাওয়া সব মিথ্যে, শুধু সুন্দরের এই সাধনা, সুন্দরের মাঝে হারিয়ে যাওয়া, সুন্দরকে খুঁজে বেড়ানোর এইক্ষণটিই সত্যি। নাচ তার মনের অস্থিরতা কাটিয়ে এক অনাবিল স্থিরতা যাকে বলে প্রশান্তি এনে দিলো। নাচের কম্পোজিশন ভাবার ব্যস্ততা তাকে অনেক কুটিল জটিল ভাবনা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করতো। অর্নের সাথে লাগাতার ঝগড়ায় কিছুটা বিরাম এলো প্রবাসীর আড্ডা আর নাচের কারণে।

চলবে (অনিবার্য কারণে অহনার সবগুলো পর্ব ব্লগে প্রকাশিত হবে না, অগ্রীম ক্ষমা প্রার্থণা করছি পাঠককূলের সাথে সেজন্য, আপনাদের উৎসাহ আর ভালবাসার কাছে আমি চিরঋনী)

প্রিয় সখিঃ শুধু তোমার উৎসাহে .........শুধু তোমার প্রেরণায়, শুধু তোমার কারণে ...............
মামুন ভাইঃ একজন প্রিয় মানুষ, বন্ধু
ভাই

তানবীরা
২৯.০৬.২০১১

No comments:

Post a Comment