Friday 24 June 2011

কাছের মানুষ

রাসেলের “বাবার পোশাক” লেখাটা পড়ে মনটা খুব বিষন্ন হলো। অনেকদিন এমন মন ভিজিয়ে দেয়া ব্লগ পড়িনি। লেখাটা মাথায় ঘুরছিলো থেকে থেকে। হঠাৎ ইচ্ছে করলো আমার বাবাকে নিয়ে কিছু লিখতে। না, আমার বাবা আমার দূরের কোন মানুষ নন। খুব কাছের মানুষ, বন্ধু। মায়ের হাত থেকে বহুবার বাঁচিয়েছেন বাবা আমায়, বহু আবদার পূরন করেছেন, এখনো করেন হাসিমুখে। বাবার সাথে সারাবেলা খেলেছি এমনকি খেলতে খেলতে রেগে গিয়ে মারামারিও করেছি কখনো কখনো। ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন, তাস খেলা সবকিছুর হাতেখড়ি বাবার কাছে। বানিজ্যমেলা, বইমেলার পরিচয় বাবার কাছ থেকে। সত্যজিত – মৃনাল সেন জেনেছি বাবার কাছ থেকে। কিন্তু আজকাল কেমন যেনো একটা নাম না জানা দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। ফোনে কেমন আছেন, কি করছেন জিজ্ঞেস করে, এটা কেনো হলো না, সেটা কেনো হয় না, দু / একটা ঝাড়ি মারার পর আর কথা খুঁজে পাই না। যে জায়গায় মায়ের সাথে, বোনদের সাথে ঘন্টায়ও কথা ফুরায় না, সে জায়গায় পাঁচ মিনিটে বাবার সাথে কথা শেষ। অথচ ইচ্ছে করে বাবার সাথে ঘন্টা ধরে আলাপ করি। সেই আগের মতো। বাবা অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন। মা রাগ করে শুয়ে পড়তেন গেট তালা দিয়ে। আমি বসার ঘরে লাইট জ্বালিয়ে বসে গল্পের বই পড়তাম, এটার মানে ছিল বাবাকে জানানো, আমি আছি।

বাবা এসে আওয়াজ দিলেই আমি দারোয়ানকে ডেকে গেট খুলাতাম। তরকারী গরম করে বুয়া খাবার দিলে আমি বাবার পাশে বসতাম। বাবা খেতে খেতে তার প্লেট থেকে ভালো মাংসের টুকরো, মাছের টুকরো আমার মুখে তুলে দিতেন। আমি গল্পের বইয়ে ডুবে ডুবে সেসব খেতাম আর আগডুম বাগডুম ফালতু গল্প করে যেতাম। এখন অনেক কষ্ট হয়, একবেলা বাবা বাসায় খেতেন, তারও সব আমি খেয়ে নিতাম কাছে বসে। কিন্তু ঘটনা হলো এখনো তাই করি। এখনো বাড়ি গেলে বাবা তার প্লেট থেকে খাবার আমার আর আমার মেয়ের মুখে তুলে দেন, আমরা খেয়ে নেই। আমার মেয়েতো বাবা খেতে বসা মাত্র তার পবিত্র দায়িত্ব মনে করে বাবার পাশে যেয়ে দাড়াবেন আর বাটিতে আঙ্গুল দিয়ে বাবাকে দেখাবেন, এটা নাও, ওটা নাও, মাখো, লেবু দাও তারপর ওনার মুখে তুলে দাও। বাবা পরমানন্দ নিয়ে নাতনীকে খাওয়ান। বাবা হলেন আমার সারা জীবনের হিরো। সেলফমেইড ম্যান। বাবা – চাচাদের ছোট রেখে আমার দাদা মারা গেলেন। সংসারে সবার ছোট হয়েও বাবাই নিজ স্বার্থ ত্যাগ দিয়ে সংসারের দায়িত্ব নিলেন। নিজে ধূপ হয়ে পুড়ে গিয়ে আমাদের সবাইকে গন্ধ বিলালেন। এখনো তার নিজের জন্যে কি চাই জিজ্ঞেস করলে জানেন না, জানবেনই বা কোথা থেকে? আমাদের চাহিদা পূরন করতেই যে তিনি অভ্যস্ত। নিজের দিকে যে তাকাতে হয় তাই শিখেননি। কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে আজকের এই অবস্থায় এসেছেন, সাথে সবাইকে টেনে নিয়ে এসেছেন শুধুমাত্র পরিশ্রম করে। কাহানী একদম ফিলমি হ্যায়। তবে হ্যা, এগুলো সব আমি শুনেছি, দেখিনি কিছুই। আমার জন্মের আগেই বাবা তার ভাইদের নিয়ে এ পৃথিবীতে মাথা গোঁজার ঠাই করে নিতে পেরেছিলেন। তার জীবনের আঁচর তার ছেলেমেয়ের ওপর পড়তে দেননি।

বাবা অনেক ডানপিঠে ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। সেজন্যে নাকি অনেক মার খেতেন। এটা শুনলে বাবার টীচারদের ওপর, দাদা – চাচাদের ওপর রাগ লাগে, কেনো আমার বাবাকে তারা মেরেছেন? তবে তার এই ডানপিঠেপনা বহুদিন চালু ছিল। একবার ঈদের সময় বাবার জাহাজের শিডিউল ছিল। পুলিশ অন্যকারো কাছ থেকে পয়সা খেয়ে শিডিউল পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। বাবা তাতে খুব রেগে গেলেন। তিনি কাগজ দেখালেন, তার শিডিউল, টিকেট বিক্রি হয়েছে তার জাহাজই যাবে। এই নিয়ে রাগারাগির এক মূহুর্তে তিনি পুলিশ অফিসারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে জাহাজের ডেক থেকে পানিতে ফেলে দেন ফেলে দিয়ে ঘাট থেকে যাত্রীসহ জাহাজ ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি চলে যান পরে তার খেয়াল হয় পুলিশ নিশ্চয় এতোক্ষণে সব জায়গায় খবর দিয়ে দিয়েছে, তাকে হয়তো অন্যঘাটে ধরতে পারে। তিনি জাহাজে তার কর্মচারী সবাইকে করণীয় বুঝিয়ে দিয়ে মাঝ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে অন্যদিকে চলে যান। একবার সুন্দরবন থেকে রয়েল বেংগল টাইগারের ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে এসেছিলেন পুষবেন বলে। স্বাধীনতার পর পর যখন সবে তিনি খেটেখুটে তার ব্যবসাকে আলোর মুখ দেখাচ্ছেন, ডাকাতের জ্বালায় নাকি তখন রাতের দিকে জাহাজ চালানো দায় হয়ে পড়ে। তিনি নিজে ছোট আর একটা লঞ্চ রেডি করেছিলেন, জাহাজের পাশে পাশে যেতেন ডাকাত ধরবেন বলে। এগুলোর কিছুই আমার স্মৃতিতে নেই। এ গল্পগুলো আমাদের পরিচিত মহলে বাবাকে নিয়ে এতোবার আলোচিত হত যে শুনে শুনেই আমি জানি, মনে হয় আমি যেন দেখেছি সব।

পুরুষেরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না এই অভিজ্ঞতাও বাবাই আমাকে প্রথম দিয়েছেন। তিনি জীবনেও কথা রাখার উদ্দেশ্যে কথা দিতেন না। মায়ের সাথে তার নিত্য ঝগড়া ছিল এই নিয়ে। পরে আমার সাথেও একই দাঁড়ায়। মাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা দিয়ে তিনি পগার পাড় থাকতেন। পরে আমার সাথেও তাই। শিশু পার্ক কিংবা ঈদের কাপড় কিনতে নিয়ে যাবেন। এই আসছি এইতো, বারোটার মধ্যে ফিরছি। দুপুর বারোটা থেকে তিনটে তারপর ইফতারের সময় পার হয়ে যেতো। কোন খবর নেই। আমি কেঁদেকেটে না খেয়ে ঘুম। তিনি বাড়ি এসে ঘুম থেকে তুলে তেল মেখে মেখে আমাকে খাওয়াতেন। একটার বদলে আমার কান্নার হেঁচকির তোড় অনুযায়ী দশটা জামার প্রমিস করতেন সংসার আর সন্তানদের সময় দিতে না পারাটা তিনি পয়সা দিয়ে অনেক সময় পূরন করে দেয়ার চেষ্টা করতেন। ছোট ছোট অনেক অনেক দোষ থাকা সত্বেও আমার বাবা আমার পৃথিবীতে থাকা মানুষদের মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। যার পৃথিবী আমাদেরকে কেন্দ্র করে শুরু হয়, আমাদের মধ্যেই শেষ হয়। আমরা ছাড়া তার আর কোন জীবন কোনদিন ছিল কি না কিংবা আছে কি না জানতেই পারিনি।

জীবনে এতো জায়গায় ঘুরতে গেছি, বন্ধুদের সাথে গেছি, স্বামীর সাথে গেছি কিন্তু বাবার সাথে বেড়িয়ে যে আনন্দ সেটা কখনো অন্যকারো সাথে পাইনি। যে নিশ্চিন্ততা, নির্ভরতা বাবা দেন তা পৃথিবীর আর কেউ দিতে পারেনি। নিজেকেও নিজে দিতে পারিনি। কি খেতে ইচ্ছে করে, শুধু মুখ দিয়ে বের করার দেরী, সীজন থাকুক আর না থাকুক, ঢাকা, কুমিল্লা, খুলনা যেখান থেকেই হোক, বাবা ঠিক কোথাও না কোথাও থেকে ম্যানেজ করে নিয়ে আসবেন। বাবার সাথে দাদুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া কিংবা কাপ্তাই লেক, চিটাগাং, কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার যা আনন্দ তা চাঁদের দেশে বেড়াতে যেয়েও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। নৌকায় চড়ে জ্যোস্না রাতে নদীতে এলোমেলো ঘোরানিশ্চুপ গ্রাম, এখানে ওখানে কোন ঘরে টিমটিম হারিকেনের আলো জ্বলছে আর চারধার শুনশান। থেকে থেকে কোথাও থেকে নাম না কিছু ডেকে উঠতো। কি একটা শান্তি চারধারে মাখানো, পাশে বাবা বসে মানে ভয়ের কিছু নেই। মনে হতো জীবন এখানেই শেষ হয়ে যায় না কেন। বাবার হাত ধরে ভুবনেশ্বর পাহাড়ে চড়ে যে আনন্দ পেয়েছি সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের সৌন্দর্য তার কাছে অনেক ম্লান।

অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে বাবা আজ অনেকটা পথ এসেছেন। বাবা বোধহয় খানিকটা ক্লান্তও। দুপুরে বাড়ি ফিরেন প্রায়ই, ঢাকা কোলকাতা চ্যানেলের যতো ম্যাটিনি শো আছে সব দেখে ফেলেন, দুপুরে ঘুমাবেন না বলে। আমি পাশে বসি যেয়ে, জিজ্ঞেস করি, আব্বু কি সিনেমা দেখছেন? ঠোঁট উলটে হাসেন। কি দেখছেন নিজেও জানেন না। এক সময় সিনেমা পাগল বাবা এখন টিভির সামনে বসে থাকেন শুধু। হয়তো টিভিতে চোখ রেখে নিজে কোথাও হারিয়ে যান। বসে বসে হয়তো জীবনের হিসাব মিলান। একজন মানুষের সমাজে অনেক পরিচয় থাকে, অনেক মূল্যায়ন থাকে। একজন মানুষ কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো বন্ধু, কারো স্বামী। সব ক্ষেত্রে তার সফলতা ব্যর্থতা মূল্যায়ন করা হয় আলাদাভাবে। কিন্তু আমি জানি বাবা হিসেবে আমার বাবা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার কোন তুলনা হয় না। বাবা শুধু বাবা হয়।

তানবীরা
২৫.০৬.২০১১

2 comments:

  1. পড়ে ভালো লাগলো।

    http://diary.nawaze.info/
    আমার ডায়েরীতে আমন্ত্রন রইলো

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ আপনাকেও

    ReplyDelete