বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই, মুভি আমাকে বরাবরই খুব টানে।
একটানে পড়ে শেষ করলাম জলদস্যুদের কবলে পরা বাংলাদেশের জাহাজ “জাহান মনি” র চীফ
ইঞ্জিনিয়ার মতিউল মাওলা’র একশ পাঁচ দিনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা “জলদস্যুর
কবলে জাহান মনি” – খুব সাদামাটা ভাষায় লেখা হলেও বিষয়ের গুনেই বইটি হাত থেকে
নামাতে পারি নি আর বইটিও মাত্র চৌষট্টি পৃষ্ঠার।
এর আগে এ বিষয়ে ওপর একটা মুভি দেখেছিলাম ক্যাপ্টেন ফিলিপস।
টম হ্যাঙ্কস অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ঐ সিনেমাটিতে। একাডেমি এওয়ার্ড ফর বেস্ট
পিকচার নমিনেশান পেয়েছিলো সিনেমাটি। সেখানেও সোমালিয়ান দস্যুদের কবলে একটি এমেরিকান জাহাজের আক্রমনের ঘটনাই ছিলো। তবে তারা জাহাজটিকে ছেড়ে
দিয়ে শুধু ক্যাপ্টেনকে নিয়ে যায় মুক্তিপনের জন্যে। আর এখানে পুরো জাহাজটিকে
সোমালিয়া নিয়ে যাওয়া হয় এর ক্যাপ্টেন আর ক্রু সব সহ। আর এমেরিকারন সরকার বা মালিক পক্ষ তাদের নাগরিক বা কর্মচারীদের
জন্যে যে কেয়ার করবেন সেটা তো বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশী মালিক পক্ষ
থেকে আশা করা যায় না।
https://www.youtube.com/watch?v=AAZ0Su_iqYA
শেষে বাংলাদেশ সরকার আর জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষই তাদের
উদ্ধার করেন। সে কারণেই হয়ত মতিউল মাওলা যতটা কম নেতিবাচক পেরেছেন তাদের সম্পর্কে ততটাই
বলেছেন। নেহাত যতটুকু না বললেই নয়। আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন এটিএন এর সাংবাদিক
মুন্নী সাহাকে। এও জানিয়েছেন তাদের দুর্ভোগ নিয়ে রিপোর্ট করা নিয়ে মুন্নী সাহার
ওপর বাংলাদেশ সরকার আর জাহাজ মালিক পক্ষের চাপ ছিলো। জন সম্মুখে ভাবমূর্তি যেনো
ঠিক থাকে।
বইটি থেকে
জানলাম, আরাকানের মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুর আক্রমনে একদিন উপকূলীয়
এলাকা বিরান হয়ে গেছিলো। তাদের হটিয়ে, আগা বাকের খাঁ বসতি স্থাপন করেন বাকেরগঞ্জে।
বাকের খাঁ ও তার স্ত্রী খনি বেগমের নামে এখন বাকরখানি রুটি প্রসিদ্ধ।
আরো জানলাম, ওমানের সালালাহ বন্দরে যেখানে জাহাজ জাহান মনি সোমালিয়া থেকে এসে নোঙর
করে তার কাছেই নাকি সে জায়গাটা যেখানে ইউনুছ নবীকে মাছ তার পেট থেকে লাউ গাছের তলায়
রেখে গিয়েছিলো, সেখানে তিনি ও তার স্ত্রী গিয়েছিলেন জাহান মনির মালিকের স্ত্রীর সাথে।
মতিউল মাওলা প্রচন্ড
রকম ধার্মিক। পুরো বইতেই এই বিপদের দিনে তিনি বা পুরো জাহাজের সবাই কীভাবে আল্লাহর
কাছে দিনরাত প্রার্থণা করেছেন তার বর্ননা আছে। সারা দিনরাত বন্দুকের নলের সামনে থাকলে
সেই মানসিক অবস্থায় এটা খুব স্বাভাবিক বটেই। তবুও সে আমলে ওমানে লাউ
গাছ ছিলো কিংবা এখনো সেখানে লাউ গাছ আছে, সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ
করছি। তবে সোমালিয়ানরা মুসলমান বলে তাদের ওপর কম অত্যাচার করেছে
সেটা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। ধর্ম কোথায় না কাজ করে! যেমন রাজনীতিতে ঠিক তেমন ডাকাতিতেও।
তবে এই জলদস্যুতা নিয়ে
আন্তর্জাতিকভাবে যে কিছু সিন্ডিকেট আর ব্যবসা জমে গেছে সেটার ওপর তিনি অল্প সল্প আলোকপাত
করেছেন। কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, এমেরিকার, মাফিয়া- গড ফাদার-অনেকেই এতে জড়িত। জলদস্যুদের
থেকে নিরাপত্তা দিতে কেউ কেউ আলাদা কোস্ট গার্ড সাপ্লাই করবেন পয়সার বিনিময়ে, কোন কোন
ব্যাঙ্ক নগদ ডলার দেবেন, কেউ কেউ তেল, খাবার পানি সাপ্লাই করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। দিনের
শেষে সকলই পয়সার খেলা, সকলই ব্যবসা। পেশাদার লেখক তিনি নন, খুব গুছিয়ে বিস্তারিত লিখতে
তিনি পারেন নি, হয়ত সে উদ্দেশ্যও তার ছিল না। তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক অংশটিকে সকলের
সামনে তুলে ধরা হয়ত তার উদ্দেশ্য ছিলো। {এই ঘটনার ভয়াবহ একটা পরিনাম তার পরিবার ভোগ
করেছে, তার স্ত্রী মাঞ্চু তার সাথে সে সময় জাহাজে ছিলেন, এবং এই যাত্রা থেকে ফিরে
আসার কিছুদিন পরেই তার মৃত্যু হয়। অনেকেই মনে করেন, একশ পাঁচ দিনের এই ভয়াবহ
টেনশান তার অকাল মৃত্যুর কারণ।} এই অংশ টুকু বই থেকে নয় ব্যক্তিগত সোর্স থেকে
পাওয়া।
এই বছরই অক্ষয় কুমার অভিনীত একটি দূদার্ন্ত সিনেমা মুক্তি
পায়, ইরাকের কুয়েত আক্রমনের সময় সেখানে আটকে
পরা ভারতীয়দের উদ্ধার করার সত্যি ঘটনা অবলম্বনে “এয়ারলিফট”। অনেক বাংলাদেশিও সে
সময় সেখানে আটকে ছিলেন, পরে তাদেরকে সরকার কি ভাবে উদ্ধার করলো, তারা কিভাবে
সেখানে সময় পার করলেন, সে সম্পর্কে বাংলাদেশে কেউ কিছু লিখেছেন কি না, জানতে ইচ্ছে
করে।
বন্ধু সম দীপন একবার তার ব্যবসা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলো,
বই বিক্রি এত কম। আমি তাকে বলেছিলাম, তার প্রকাশনার বইয়ের লিস্ট দিতে আর সাজেস্ট
করতে পড়ার মত কি কি বই আছে। সে আমাকে বলেছিল, অনেক দেশ বিদেশ বেড়াও তুমি, এ বইটা
পড়ে দেখতে পারো, তোমার ভাল লাগতে পারে।
বইটা আসলেই ভাল লেগেছে দীপন। অনেক দূরে যেখানেই থাকো,
শুভেচ্ছা তোমাকে।
জাগৃতি প্রকাশনী
০২/১২/২০১৬
No comments:
Post a Comment