Sunday, 23 September 2012

মাষ্ট বী ফেল্ট উইথ হার্ট



মাষ্ট বী ফেল্ট উইথ হার্ট

চলার পথে নিজের অজান্তেই জীবনে ছোট ছোট অনেক কিছু ভাল লেগে যায়। জিনিসগুলো হয়তো এতো সামান্য আর অপাক্তেয় যে অন্যে হয়তো ঠিক বুঝেই উঠবে না এরমধ্যে ভালো লাগার কি আছে? পুরনো ডায়রী হাতে পড়লে দেখি একটা গোলাপ ফুল শুকিয়ে আছে কোন একটা পাতায়। ডায়রীতে থাকতে থাকতে পাতায় দাগ লেগে গেছে । পৃথিবীর কারো কাছে এর কোন মূল্য নেই কিন্তু আমার অনেক ভালবাসা ওতে জমে আছে। আমার হাতে ফোঁটা প্রথম গোলাপ সে। ঠিক যেনো হুমায়ূন আজাদের কবিতার মতো, 

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো দোয়েলের শিসের জন্যে শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে

২০০৬তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যত্বত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে আন্তর্জাতিক নাট্যসপ্তাহের আয়োজন হয় সেগুনবাগিচার থিয়েটার হলেআমি প্রায় প্রতিদিনই নাটক দেখতে যাই, ভাল লাগে। কখনো কখনো একা, কারণ কারো এতো সময় নেই রোজ সন্ধ্যায় নাটক দেখবে। শেষদিনে সমাপনী উৎসব সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যত্বত্ত্ব বিভাগের নিজস্ব আয়োজন “বেহুলার ভাসান”পুরো নাটকটা লেখা হয়েছে ছন্দ মিলিয়েসারা মঞ্চকে সাজানো হয়েছে গোলাকার করে, প্রদীপ জ্বালা, আলপনা আঁকা, ধূপ ধূনোর গন্ধ, গান, ঢাক আর ঢোলের শব্দ, ড্রেসাপে এমন একটা মাঙ্গলিক আর পৌরণিক আবহাওয়া তৈরী হলো যে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে সে সৌন্দর্যে বিমোহিত হলাম। আমি একা। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করছিল, কাউকে দেখাই এই সৌন্দর্য। অসাধারণ কিছু সৌন্দর্য কেন যেনো একা উপভোগ করতে ইচ্ছে করে না। বারবার আমি ঢাকা থেকে হল্যান্ডে এস এম এস করে যাচ্ছি, বোঝাতে চেষ্টা করছি আমার অনুভূতি কিন্তু আসলে সব ভাল লাগা সবাইকে ভাষার অক্ষরে লিখে বোধহয় বোঝানো যায় না। তাইতো Helen Keller বলেছেন, The most beautiful things in the world cannot be seen or even touched, they must be felt with heart.  এটা বোধহয় শুধু সুন্দরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দুঃখের ক্ষেত্রেও তাই। কেনো কি জন্যে দুঃখ পাই, তা কি অন্যকে ব্যাখা করা এতো সোজা? না ব্যাখা করলেই লোকে তা বুঝতে পারে? 

টুকটাক অনেক জায়গায় ঘোরা হয়। অনেকেই কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যেয়ে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে এবং কেন? কেন ব্যাখা করা কি এতো সহজ? সব ব্যাখাই কি সবার জন্যে প্রযোজ্য নাকি সবার তা কোন কাজে আসে। 

ছোটবেলা থেকে মুঘল ইতিহাস পড়ে, সিনেমা দেখে, গল্প শুনে মুঘল রাজাদের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ জন্ম নেয়। আমি মুঘল রাজাদের বই যোগাড় করে পড়তাম। জীবনে যখন প্রথম সুযোগ আসলো দিল্লী - আগ্রা - জয়পুর যাওয়ার উৎসাহে চোখের পাতা বন্ধ করতে পারি না অবস্থা। দিল্লী – আগ্রা – জয়পুর-- রাজস্থান ঐদিকে যারা যায়, তারা বেশির ভাগই আজমীর ঘুরে আসেন। আমরাও আজমীর যাবো বলে রওয়ানা হয়েছি, সন্ধ্যার মুখে মুখে পৌঁছেছি। আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল পুস্কর। আজমীর থেকে দশ বারো কিলোমিটার দূরত্বের একটি ছোট শহর। ভারত সরকার ঘোষনা করেছেন, যাদের একশ বিঘার ওপরে জমি আছে ওপরের বাকিটা দান করে দিতে হবে। কোন পরিবারেরই একক একশ বিঘার ওপর জমির মালিকানা থাকতে পারবে না। এতে অনেক রাজপরিবারই অন্য কৌশল অবলম্বন করেছেন। নিজেদের বসতবাটিকে হোটেল বানিয়ে ফেলেছেন, অন্যের নামে মালিকানা দেখিয়েছেনতেমনি পুস্করের হোটেল, হোটেল মহারাজা প্যালেস। বিরাট সাদা রঙের প্রাসাদ যার দেয়ালে দেয়ালে তলোয়ার, ঢাল, বাঘের চামড়া, বন্ধুক আরো নানা ধরনের অস্র শস্ত্র ঝোলানো। লম্বা করিডোর দিয়ে হেটে যেতে হয়। করিডোর ভর্তি গাছের সমারোহ। বড় বড় পিতলের টবে বড় বড় গাছ। একজন আর একজনের মুখ দেখতে পাবে না এমন অবস্থা। এরকম বাড়ি আমি সিনেমায়ও দেখিনি। এতো কাছ থেকে ঢাল তলোয়ার এভাবে ছুঁয়ে দেখিনি। শাহবাগ যাদুঘর, সোনারগা যাদুঘর, ময়নামতি যাদুঘর যা দেখেছি জীবনে, এগুলোর কাছে সেগুলো দুগ্ধপোষ্য। আমাদের রুম ছিল একতলায়। করিডোর থেকে নীচে নামলেই বিরাট লন আর লনের গা বেয়ে শান্ত স্নিগ্ধ লেক। হোটেলে দুরকমের ডিনারের ব্যবস্থা, এক ডাইনীং এ আর দুই লনে বুফে দেয়া আছে। চেয়ার টেবিল পাতা আছে। কিন্তু চার্জ একটু বেশি। আর লনে কিছু ফেলা যাবে না, পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করা যাবে না এই শর্তও দেয়া আছেতবে না ডিনার করলেও লনে বসে চা খাওয়া বা এমনি হাওয়া খাওয়া যাবে। পুরো পুস্কর শহর নিরামিষাশী। এটা শুনে প্রথমে একটু নিরাশ হয়েছিলাম। কিন্তু যখন লনে বসলাম একদম লেকের গা ঘেষে চেয়ারে, তখনি বুঝলাম আজ এখান থেকে আর কোথাও যাওয়া হবে না। আর খাওয়ার পর জেনেছি এমন রান্না হলে নিরামিষাশী হওয়াও কোন ব্যাপার না। লেকের পাশেই ছোটমতো একটি টিলা। তার ওপরে মন্দির। টিলার বুক কেটে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা বানানো হয়েছে। লেকের পানিতে বিশাল সাদা উঁচু সেই মন্দিরের ছায়া পড়েছে। পুরো মন্দির প্রদীপে সয়লাব। মন্দির থেকে লেকে আসার জন্যে একশ এর ওপর সিড়ি আছে। সমস্ত সিড়ির দুপাশে প্রদীপ দেয়া। সেই সমস্ত প্রদীপের ছায়া লেকের পানিতে কাঁপছে। মন্দিরের মাঝ থেকে সন্ধ্যারতির ধ্বনি এসে সারা শহরকে চিরে দিচ্ছে। আর কোন শব্দ নেই। সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। আমরা দুজন মুখোমুখি নিঃশব্দ। আজো ভাবলে সে ভাল লাগা টের পাই। 



এরপর গেলাম নেপালের পোখরা বলে একটা জায়গায়। রাতে ডিনার করছি হোটেলেরই রেস্টুরেন্টে। খাবার সাথে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় নেপালী ভাষার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নির্দিষ্ট সময় দেয়া থাকা সত্বেও বেশ দেরী করে গেলাম খেতেভাবলাম কি আর হবে, স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় নেপালী ভাষার অনুষ্ঠান। খেতে যেয়েও পিলে চমকে যাওয়ার যোগাড়। আশে পাশের টেবিলে ইয়া ইয়া চেহারার তিব্বতী লোকজন বসে খাচ্ছেন। কিছু কিছু জিনিসের কোন ব্যাখা হয় না। কালোদের যেমন দেখলেই ভয় লাগে, ভীষন ষন্ডা ষন্ডা লাগে অকারণেই। তেমনি তিব্বতীদের দেখে অকারণেই ভাবছি খাবার শেষ করেই লন থেকে দৌড় দিব রুমে। খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি, নেপালীদের গান শুনছি। ভাষা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারছি লোকগীতি হচ্ছে। সুরের মিল আছে, কিছুটা আমাদের দেশের পাহাড়ী গানের সুরের সাথে। তারচেয়েও ভাল লাগছিল তারা গান গাইছিলেন অভিনয় করে করে। ছেলে মেয়ের মান ভাঙ্গাচ্ছে, ঝগড়া করছে, মেয়ে চলে যেতে চাইছে, তাকে মিনতি করছে। ভাষা বুঝতে না পারলেও বাকি সবই বুঝতে পারছি এবং খুব উপভোগ করছি। আমরা কোন ধরনের কোন আশা নিয়ে ডিনারে যাইনি বলে একদম খালি হাতে গিয়েছিলাম। ওমা দেখি পাশের লোক, আমাকে ষন্ডা তিব্বতীদের মাঝে রেখে রুমে দৌড় দিয়েছে তার ক্যামেরা নিয়ে আসার জন্যে। তারপর দেখা গেলো রাত বারোটা অব্ধি অনুষ্ঠান উপভোগ করে সবাই চলে গেলেও আমরা দুজন তখনো লনে বসে আছি। পুরো জায়গাটা জুড়ে যেনো তখনও সুরগুলো, বাঁশির মূর্ছনা ভেসে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ঠিক করে হাত মেললে যেনো ধরতে পারবো ভেসে যাওয়া সুরের মূর্ছনাকে। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার আর পাহাড়ের ওপর আমরা। নেপাল সম্পর্কে একটা কথা না বললেই না। ছোট একটা দেশ। আকাশ পরিস্কার থাকলে এর যেকোন কোনা থেকে হিমালয় দেখা যায়। নেপালের যে প্রান্তেই যাকনা কেউ মন খারাপ করে থাকার কোন উপায় কারো নেই। হিমালয় তার রুপে মন ভাল করে দিবেই দিবে।



একবার বোনেরা সবাই গিয়েছিলাম সেন্টমার্টিনে। দারুন একটা রিমোট এরিয়া কিন্তু ট্যুরিষ্ট দিয়ে একাকার। হোটেল থেকে জিজ্ঞেস করা হলো রাতে কি বারবিকিউ চাই কিনা। বললাম হ্যা চাই। তারপর তারা জিজ্ঞেস করলেন কিসের বারবিকিউ চাই। আমাদের মাথা ঘুরিয়ে গেলো এমন অফার শুনে। তাদেরকে মাছের অর্ডার দেয়া মাত্র, তারা জেলেদেরকে ফোন দিলেন সেইসব মাছ তাজা হোটেলের কিচেনে পৌঁছে দিয়ে যেতে। রাতে ডাকা হলো বারবিকিউ শুরু হচ্ছে, যেতে। গেলাম, দেখি আরো কয়েক পার্টি আছে। সেসব পার্টিতে কিছু নওজোয়ান আছে, খুবই করিৎকর্মা। তারা স্থানীয় কিছু গায়ক জোগাড় করে ফেলেছেন। শুরু হলো গান বাজনা। পাশেই সমুদ্রের বাজনা আর তার সাথে পুরুষ গায়কের গলায় ওরে সাম্পানওয়ালা আমারে তুই করলি দিওয়ানা। চারদিকে বিদ্যুৎ নেই, দূর দূরান্তে আছে কিছু অচেনা পাখির নিশি পাওয়া ডাক। সারা দ্বীপের যতোদূর চোখ যায় টিম টিম হ্যাজাকের আলোর সাথে এই ছোট একটু ক্যাম্প ফায়ার আর এই বারবিকিউ এর চলার জ্বলন্ত কয়লার আলো। সমুদ্র গর্জে যাচ্ছে রাগত আহত ব্যাঘ্রের মতো। ঢেউ একটু জোরে ধাক্কা দিলেই আমরা তলিয়ে যাবো সমুদ্রের অনেক অনেক নীচে। মাঝে মাঝেতো মনে হচ্ছিল ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বীপ বুঝি দুলে উঠলো। মূল ভূখন্ডের সাথে আমাদের কোন যোগ নেই। সেখানে ছেলের গলায় মেয়ের গানও আসলে কোন ম্যাটার করে না। অদ্ভূদ রকমের একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। গান হচ্ছে সাথে পুড়ছে মাছের কাঁটা আর মুরগীর ঠ্যাং। আস্তে আস্তে তারা সে সময়ের হিট ছবি মনপুরার গান গাইছিলেন যাও পাখি বল তারে। এই গায়ক দলে দু একটা কিশোর গায়কও ছিল। তারাও যে আধুনিক দুনিয়ার খোঁজ খবর রাখেন সেটা আমাদের জানাতে তৎপর হয়ে হঠাৎ গাইতে শুরু করলেন, মনে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা। সাথে সাথে পাশের সিনিয়র গায়ক সেই কিশোরের মাথায় চাঁটি মারতে লাগলেন সবার সামনে। পুরো পরিবেশটাই কেমন যেনো অতিপ্রাকৃতিক বা আনরিয়েল লাগছিলো। অনেক অনেক রাত অব্ধি গান শুনে, সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেটে বেড়িয়ে ঘরে ফিরেছি। মনে হচ্ছিলো সত্যি সত্যি এগুলো ঘটছে না। অসাধারণ এক অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেখান থেকে যা কাউকে ব্যাখা করে বোঝানো যায় না। 




আরোও একবার এরকম অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গেছি ভেনিসে। পুরো শহরটিতে কোন রোড কানেকশান নেই। পুরোটা শহর পানির ওপর ভাসছে। শহরের লোকদের যেমন নিজের গাড়ি আছে, ওখানেও আছে নিজের বোট। ওয়াটার বাস, ওয়াটার ট্যাক্সি আর গান্ডোলা। এই চড়ে চড়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, লোকে ব্যবসা করছে, কাজে যাচ্ছে। বিখ্যাত মুরানো গ্লাস ফ্যাক্টরীগুলো সেখানেই অবস্থিত, এবং প্রোডাকশান হচ্ছে আর সারা বিশ্বব্যাপী রফতানীও হচ্ছে। হাতের তৈরী ও পেইন্ট করা সুন্দর সব মুরানো গয়নাও সেখানে তৈরী হয়। বলা হয় ভেনিস হলো মার্চেন্ট সিটি। সেজন্যেই এর নাম ভেনিস। অসম্ভব রকমের ধনী লোক ছাড়া কেউ মূল ভেনিসে বসবাস করতে পারে না। যারা ওখানে কাজ করেন, অনেকেই পাশের শহর থেকে ট্রেনে এসে তারপর ফেরীতে করে এখানে কাজ করতে আসেন। ভেনিস ঘুরে দেখার দুরকম ব্যবস্থা। এক হলো ট্যুরিষ্ট ফেরীতে করে, দ্বিতীয় নিজের ওয়াটার ট্যাক্সি হায়ার করে। আমরা সেই ট্যুরিষ্ট ফেরীতে করে এই দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপ, তারপর এদিক তারপর ওদিক সব যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ একটা যত্ন করে ছবি এঁকে রেখেছেন আমরা তার বুক চিরে যাচ্ছি। মাথার ওপরে নীল আকাশ, নীচে নীল সমুদ্র আর মাঝখানে আমরা। সামনে ছবির মত কিছু সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর, স্থাপত্য। মাঝে মাঝেই রাজকীয় নকশার গান্ডোলা যাচ্ছে সমুদ্রকে ভেদ করে। আর নীলের মাঝে কন্ট্রাষ্ট নিয়ে আসছে ঝাকে ঝাকে সাদা পাখির দল। নাম না জানা হরেক রকমের বক। আজো সে সন্ধ্যার কথা মনে পড়লে, গায়ে কাঁটা দিয়ে আসে। মনে হয়, সত্যিই কি ছিল সে সন্ধ্যাটা জীবনে? নাকি সবটাই আমার কল্পনা?

একটা বেশ ঘটনা হলো, অনেক সুযোগ থাকা সত্বেও এ জায়গাগুলোতে এখনো দ্বিতীয়বার যাওয়া হয়নি। যেখানে অনেক কম ভাল লাগা যায়গায় পাঁচ/ছয় বারও যাওয়া হয়েছে। খুব ইচ্ছে করে আবার সে জায়গাগুলোকে ছুঁয়ে দেখে আসতে। কিন্তু আজকাল কেমন যেনো ভয় হয়, মনে হয় না যাওয়াই ভাল হবে, হয়তো মুগ্ধতার সে রেশ কেটে যাবে। হয়তো আগের বারের মতো এতো ভাল লাগবে না। কি দরকার ভাল লাগাটাকে নষ্ট করে, তারচেয়ে আছে থাক না। 



কিছু কিছু মুগ্ধতা বোধহয় চিরন্তন, কখনো কমে না। তিতাস নদীর পারে আমার দাদীর বাড়ি। আগে আমাদের নিয়ম ছিল, কোরবানী ঈদ করতে বছরে একবার সব আমরা বাড়িতে যেতাম। সে উপলক্ষ্যে পাঁচ/ছয় দিন থাকা হতো বাড়িতে। আমাদের বাড়ি ভর্তি ছিল কবুতর। সাধারণ যে কবুতর আমরা খাই, সেগুলোর থেকে এগুলো আকারে বড় আর গা ভর্তি নানা রকমের ছিটা। এগুলোকে বলা হতো জালালী কবুতর আর এগুলোকে পবিত্র কবুতর হিসেবে মানা হতো বলে এগুলো খাওয়া নিষেধ। সকালে ঘুম ভাঙ্গতো কবুতরের বকরম বকরম আর ওদের ডানার ঝাপটা ঝাপটির শব্দে। নদীর পাড়ে বাড়ি বলে, বন্যার কারণে বাড়ি অনেক উঁচুতে বানানো। বিছানায় শুয়ে নদী দেখতে পেতাম। নদীর দুপাশ ঘিরে সবুজ ধানের জমি। যতোদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে বাড়িঘর। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলতে চাইতাম না, ভাবতাম এটা যদি সত্যি না হয়, যদি দেখি ঢাকার বাসায় শুয়ে আছি, সব আমার কল্পনা যদি হয়। যতোবার যেতাম ততোবারই মুগ্ধ হতাম। এখনো যতোবার যাই, ততোবারই মুগ্ধ হই। এ মুগ্ধতা বোধহয় নাড়ীতে পোতা। এ মুগ্ধতার সাথে অবশ্য বিশ্বের অন্য কোথাও বেড়ানোর তুলনা হয় না।
 

তানবীরা
২৩.০৯.২০১২

Thursday, 30 August 2012

যে কথা যায় না বলা




পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্যালোক এসে কনার চোখ ছুঁয়ে দিল। অভ্যাসমতো হাত তুলে ঘুম চোখ রগড়ানোর জন্যে হাত তুলে চোখের কাছে নিতেই, কনা তার ভেজা গালটা অনুভব করলো। দশ সেকেন্ড অবাক হয়ে এলোমেলো ভাবতেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা। আর সেটা মনে পড়তেই ভোরের সতেজ মনটা মরে সেখানে জায়গা নিলো এক রাজ্যের বিষন্নতা। তখন খেয়াল করলো কনা, সারাটা রাত ঠিক করে শোয়নি পর্যন্ত সে, এককোনে পড়ে আকাশ পাতাল ভাবছিল, কাঁদছিল না, চোখ দিয়ে আপনাতেই জল গড়াচ্ছিল। কখন যে তারমধ্যেই চোখ লেগে গিয়েছিল টের পায়নি সে। সারাদিনের রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে শোয়, যতোই দুঃখ থাকুক, কোন এক মুহূর্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসে, কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তি মেলে হাজারো সাংসারিক চিন্তার মাঝ থেকে। কনা আপ্রাণ চায় শুয়ে পড়া মাত্রই তার দুচোখ জুঁড়ে ঘুম নেমে আসুক। মুক্তি মিলুক কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া এই ভাবনার বেড়াজাল থেকে। কিন্তু চাইলেই ভাবনা থেকে মানুষের মুক্তি মিলে? যে কথা কাউকে বলা যায় না, সে কথারতো মনই আধার। ঘুরে ফিরে সে ভাবনা নিজেকেই কুঁড়ে খায়।

যা বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে কিংবা মানুষের জীবনে স্বাভাবিক তা তার কাছে কেন অস্বাভাবিক হয়ে ধরা দেয়? অমি প্রায় তাকে বলে, তার এ জিনিসটা স্বাভাবিক নয়। অমির কথা শুনতে শুনতে সে প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিল, হয়তো এ ব্যাপারটায় সে কিছুটা অস্বাভাবিক। অমিকে না জানিয়ে সে একজন ডাক্তারের কাছে কয়েকটা সীটিং ও দিয়ে ফেললো। ডাক্তার অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পায়নি তার মধ্যে। তবে খোলামেলা কিছু উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বললেন, ছেলেদের আর মেয়েদের মানসিক গঠন প্রণালী একেবারেই ভিন্ন। শারীরিক সম্পর্ক হলো ছেলেদের নিজেদের রিলাক্স করার প্রধান উপায়। আর মেয়েরা চায় ভালবাসা, আদর। তারা সেটা পেয়ে রিলাক্সড হওয়ার পরই শারীরিক সম্পর্কে যেতে চায়, তার আগে না। কিন্তু কনার বেলায় সেটা কিভাবে সম্ভব? কনা, অমির বিয়ে করা স্ত্রী, তার সন্তানের মা। বিশ্বাস – ভালবাসা সবই এখানে উপস্থিত। হ্যাঁ ছোট খাট মতান্তর ঝগড়া হয়েই থাকে আর সব সাধারণ সংসারের মতো তার সংসারেও, তার বেশি কিছুতো নয়। তখন ডাক্তার আরো খুঁটিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের খসড়া নিলেন। কনা ব্যস্ত তার অফিস, সংসার, ছেলে নিয়ে। অমি ব্যস্ত তার ব্যবসা নিয়ে। সকাল সকাল বেড়িয়ে যায়, ফিরে প্রায় রাত নটা দশটা। মাঝে মাঝেই তাকে ট্যুরেও বেড়োতে হয়। কনা আর ছেলের সাথে দেখা হয় না বললেই চলে। শুধু রাতটুক অমি বাড়িতে থাকে।

ডাক্তার হয়তো বুঝতে পারলেন সমস্যা কোথায়। তিনি বললেন, আসলে সারা সপ্তাহ তাদের মধ্যে দেখা না হতে হতে, স্পর্শবিহীন তাদের শরীরটাও অচেনা হয়ে যায় দুজনের কাছে। তাই রাতে কনা ছেলেকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মাঝে মাঝেই যখন অমি এসে নিজের প্রয়োজনে কনার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্যে কনার গায়ে হাত রাখে, কনার শরীর নিজের অজান্তেই কুকঁড়ে যায়। তারপর কনা আর ভালবাসার খেলার সারাটা সময় সহজ হতে পারে না, আড়ষ্ট হয়ে থাকে। কখন অমি ছাড়বে, সে নিস্তার পাবে, ছেলের কাছে যাবে। এতে অমি ভীষন রেগে যায়, অপমানিতবোধ করে। বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে, ন্যায্য দাবীর উপেক্ষা আর অবহেলা তাকে হিংস্র করে। কিন্তু কনা এটা কিছুতেই ইচ্ছে করে করে না। সে সহজ হতে পারে নাতো কি করবে? ডাক্তার কনাকে উপদেশ দিলেন, অমি বাড়ি ফিরলে কনা যেনো কিছুটা সময় অমির সাথে কাটায়। দুজনে একসাথে বারান্দায় বসে চা খেতে পারে, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে টিভি দেখতে পারে, কিংবা বিছানায় শুয়ে প্রথমে কিছু নিয়ে গল্প করতে পারে। হয়তো দুজন দুজনকে ম্যসেজ দিতে পারে। এতে হঠাৎ ছোয়ার আড়ষ্টতা কেটে শরীরটা সহজ হয়ে যাবে। দিনের পর দিন স্পর্শ না পেতে পেতে শরীর যতোটুকু অচেনা হয়ে যায়, তা কেটে যাবে।

কনা ডাক্তারের উপদেশ শুনে খুব খুশি হয়েছিল, সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছে ভেবে। ভাবল এই বুঝি শান্তি ফিরে এলো সংসারে। প্রথম দিকে সে সেই চেষ্টাও করে দেখলো। কিন্তু অমির সেসব দিকে কোন মন নেই। সে ক্লান্ত হয়ে ফিরে, খেয়ে দেয়েই তার নিজের কাজ নিয়ে বসে। বারান্দায় বসে চা খাওয়ার চাইতে, টেবলে বসে বসে ভাত খাওয়ার সময় সাংসারিক আলাপ সেরে নিতে চায় সে। তারপর সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার ব্যবসায়ের ফোন নিয়ে। বিছানায় শুয়ে গল্প করার চাইতে সে সরাসরি বউয়ের বুকে হাত দিতে অভ্যস্ত। তাই কনার ডাক্তারী পরামর্শ শেষ পর্যন্ত কোন কাজে আসলো না। কনা মিনমিন সুরে একদিন অমিকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে যেতে তিক্ত গলায় ধমক দিয়ে অমি ওকে থামিয়ে দিল। এমনিতেই সব ব্যাপারে কনা বইয়ের রেফারেন্স নিয়ে আসে বলে অমি কনার ওপরে যথেষ্ঠ বিরক্ত থাকে। বেশি বেশি বই পড়ে যে কনার মাথাটা গেছে, সেটা বলতেও সে দ্বিধাবোধ করে না। আবারো বলল, একদিন সময় করে সে কনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে, কনার নিশ্চয় কোন শারীরিক সমস্যা আছে। নইলে একটি যুবতী মেয়ে স্বামী সঙ্গের সময় এতো ঠান্ডা আচরন করতেই পারে না। অমি পঁচিশ বছরের যুবক না আর কনাও ষোল বছরের খুকি নয়। এতো ছেঁদো রোমান্টিকতা নিয়ে, বউয়ের সাথে ন্যাকা প্রেম প্রেম খেলার সময় নেই তার এখন। ভয়ে, দ্বিধা কিংবা লজ্জায় কনা আর কিছু বলে উঠতে পারলো না।

অথচ কনাও এতো শান্ত ছিল না সবসময়। ঘুরেফিরে তারও মনে আসে পুরনো সেসব দিনের কথা। অমি যখন পাগলের মতো কাছে চাইতো তাকে। কবে জ্যোস্না হবে পত্রিকায় তারিখ দেখে রাখতো। হাত ধরে দুজনে আকাশ দেখতো, জ্যোস্না দেখতো। চাঁদের বুকে মাঝে মাঝে অমি কনার আদল খুজে পেতো। কনার কোন সুগন্ধি পাউডার কিংবা পারফিউম মাখা নিষেধ ছিল। অমি বলতো কনার গায়ের গন্ধে নেশা আছে। তাকে চুম্বকের মতো টেনে তা নিয়ে আসে বউয়ের কাছে। অমি শুধু সে গন্ধে মাতাল হতে চায়। সারাদিনের কাজের ফাঁকে সন্ধ্যের প্রতীক্ষা থাকতো। কখন দুজন দুজনকে একান্তে পাবে, নিজের করে। পাছে অন্যকেউ শুনে ফেলে, কিংবা টের পায়, মাঝ রাতে এরা দুজন বসতো ছাদে। তাই মাঝে মাঝেই কনাকে গলার স্বর নীচু করে গাইতে হতো “তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা, তুমি আমারো সাধেরও সাধনা”। আবেশে কনার গলায় ঠোঁট ঘষতো অমি, আর সে স্পর্শের কামনার আগুনে কনাও গলে গলে পড়তো। উন্মত্তা হরিনী হয়ে সেও অমির সারা শরীরকে প্রতিদিন নতুন করে আবিস্কারের নেশায় থাকতো। কতো ছোট ছোট জিনিসে সুখী হতো তারা তখন। এক গোছা রজনীগন্ধা, কিংবা এক ডজন রেশমী চুড়ি। বালিশে ঘুমায়নি বিয়ের পর অনেক দিন কনা। অমির হাত কিংবা বুকই ছিল তার বালিশ। কতো স্বপ্ন ছিল, যতো যাই ঘটুক দুজনের ভালবাসার মধ্যে কোন দূরত্ব আসতে দিবে না। কিন্তু কনার অজান্তেই সেই স্পর্শ সেই কামনা ভরা চোখের দৃষ্টি, সেই ভালবাসার স্পর্শ হারিয়ে যেতে লাগলো।

আজ অফিসে সারাদিন অনেক ঝামেলা ছিল। এমডি স্যার যাচ্ছেন তার তিন বাচ্চা আর বউকে নিয়ে ছুটি কাটাতে। যদিও প্রাইভেট ট্যুর কিন্তু সব আয়োজনতো অফিস থেকেই করে দিতে হয় ওদেরকে। সেসব নিয়ে এম্বেসী আর ব্যাঙ্কে ছুটোছুটি করে বড্ড ক্লান্ত ছিল কনা আজকে। বাড়ি ফিরেই গোসল সেরে ছেলেকে নিয়ে খেতে বসে গেছে। এই যানযট ঠ্যাঙ্গিয়ে যারা অফিস বাড়ি করেন না রোজ তাদেরকে এ কষ্ট বোঝানো সম্ভব না। কখন শুয়ে পড়বে বিছানা যেনো টানছে তাকে। বাড়ির মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, অমি এলে কিভাবে সব গুছিয়ে অমিকে খেতে দিবে। এর মধ্যেই অমি ফিরলো দেখে কনা খুশী হলো। যাক, কাজ সব নিজের হাতে সেরে রেখেই শুয়ে পড়বে। খাওয়া শেষ করে অমি তার ফোন নিয়ে বসে গেলো আর কনা শুয়ে পড়লো তার ছেলেকে জড়িয়ে। ছেলে ঘুমের মধ্যে বড্ড হাত পা ছুড়ে, অমি ঘুমাতে পারে না। আবার বাচ্চা ছেলেটা একা ঘুমাবে, সাত রাজার মানিক ধন, তাই এই ব্যবস্থা। মা আর ছেলে এক ঘরে আর অমি আলাদা ঘরে। কনা ঘুমে বেহুঁশ তাদের ঘরে। এমন সময় কনার গায়ে কিসের স্পর্শ। ঘুমের ঘোরেই ক্লান্ত কনা ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো সেই অনাকাঙ্খিত স্পর্শ। আবার নাড়া পড়তেই আধো ঘুমে আধো জাগরনে কনা চোখ খুললো।

অমিকে দেখে কিছুটা সময় লাগলো ধাতস্থ হতে কনার। তারপর মিনতি করে বললো, আজ না অমি প্লিজ, আমি ভীষন ক্লান্ত। অমি আবার কনার বাহু টেনে ধরতেই কনা কঁকিয়ে উঠলো। পাছে ছেলে জেগে যায় তাই সাথে সাথে কনার মুখ চেপে ধরলো সে। তারপর টেনে কনাকে বিছানা থেকে জোর করে নিজের ঘরে নিয়ে এসে দরজা আটকালো। কনা মিনতি করছিলো না অমি না, প্লিজ আজ না। অমি বিরক্ত গলায় বলে উঠলো তোমারতো নিত্যই হরেক বাহানা। বলতে বলতে কনার গাঁয়ে হাত দিয়ে জামাকাপড় খুলতে খুলতে তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় নিয়ে ফেললো। আজ কেন যেনো কনার শরীর কনার অজান্তেই অমিকে বাঁধা দিতে চাইলো। বাঁধা পেয়ে অমি আরো হিংস্র হয়ে উঠলো তার পাওনা আদায় করে নিতে। শক্তিতে না পেরে উঠে একসময় নিস্তেজ হয়ে কনা পড়ে রইলো দাঁতে দাঁত চেপে। কিছুক্ষণ নাকি অনেকক্ষণ পর, জানে না কনা, মনে হলো শরীর থেকে কিছু একটা ভারী নেমে গেলো। তারপর চোখ খুলে চাইলো কনা। লবনাক্ত কিছুর স্বাদ তার ঠোঁটে লাগতেই অনুভব করলো চোখের জল আজ আর বাঁধা মানছে না। কিছুটা সরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কনা, অমির বিছানার এক পাশে পরে রইলো। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও রহিত যেনো।

শরীরের সাথে মনটাও বিদ্রোহ করছিল, কেন কেন কেন? বিবাহিতা স্ত্রীর কি ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই? কেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে কারণে অকারণে এ লোকটি এ ঘর থেকে অন্যঘরে প্রায়শই মাঝরাতে টেনে নিয়ে যাবে? কি জানে সে তার সম্বন্ধে? তার প্রিয় রঙ কি, কার কবিতা তার পছন্দ, কার গান সে ভালবাসে, কোন জিনিসটার খোঁজ এ লোকটা রাখে এখন? পাশে তখন অমি মৃদ্যু গর্জনে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মুখটার দিকে তাকাতেই বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো তার মন। দিনের পর দিন একটা কাগজে সই হয়েছে বলে, এভাবে মুখ বন্ধ করে এই ঘরে তাকে কাটাতে হবে? সন্ধ্যে রাতে ক্লান্তিতে ঘুমে তাকাতে পারছিলো না সে কিন্তু এখন শরীর জুড়ে ক্লান্তি থাকলেও ঘুম কোন দূর দেশে পালিয়ে গেছে। সারা রাত কতো কি ভেবে যাচ্ছে সে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে তার কান্নায়। শরীরটা চেপে রেখেছে যাতে কান্নার দমকে পাশের জনের ঘুম না ভাঙ্গে। মেয়ে বলেই কি এ অপমান দিনের পর দিন সহ্য করে যেতে হবে? বিয়ে করা মানে কি আর একজনের শরীরের ওপর বিনা শর্তে অধিকার করে নেয়া? শরীরের খেলায় সামান্য ভালবাসা কিংবা সম্মান কি থাকতে নেই? আর পারছে না কনা। আর যেনো পারছে না কিছুতেই। রাতের পর রাত এ অপমান তার গায়ে হুল বিঁধাচ্ছে। এ কখনো দাম্পত্য হতে পারে না। এ শুধুই নারীত্বের অপমান। কিন্তু কাকে বলবে কনা একথা? কে বুঝবে তার এ দুঃখ?

তানবীরা
১৯/০৬/২০১২

Sunday, 26 August 2012

জলে ভাসা পদ্ম আমি




অনেকদিন পর চেনামুখগুলো দেখলেও হঠাৎ একটু সময় লাগে সবকিছুতে আগেরমতো হয়ে উঠতে। অনেকদিনের না দেখা, না ছোঁয়ার একটা প্রতিক্রিয়া আছেই। স্কাইপি, এসএমএস কিংবা দূরালপনী যন্ত্র পুরোটা দূরত্ব মনে হয় অতিক্রম করতে পারে না। এর রেশ কাটতে কিছুটা সময় যায়। আমি বাড়িতে এলে আমার ছেলে মেয়েগুলো কিছুদিন একটু দূর দূর দিয়ে ঘুরে ফিরে দেখে। তারপর একসময় জেনে যায়, আমি এদেরই লোক। তখন ওপরে এসে ঝাপিয়ে ঘুপিয়ে পড়ে। মেঘলার ভাষায় আসো তোমাকে চ্যাপ্টা ভ্যাপ্টা করে দেই। এবার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটালো আমাদের দুই ছেলে। আমাদের রাজাবেটা এমনিতে চুপচাপ কিন্তু কোলে ওঠার ব্যাপারে একটু চুজি। সবার কোলে তিনি যেতে চান না। আমি অনেক রাতে বাসায় ঢুকলেও একটু হাউকাউতো হয়ই। তাতে তার নিদ্রা টুটে গেলো। তিনি তার মাতৃদেবীর কোলে উঠে ডাইনীং এ এলেন খুবই গম্ভীরমুখ করে। এতো রাতে কিসের উৎপাত। ছোট্ট আঙ্গুলটা তার চেয়েও ছোট্ট গালে ঢুকিয়ে অবাক বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো ভাবছেন এ আবার কে? আমি যেয়ে দুহাত সামনে বাড়াতেই, দু সেকেন্ড ভাবলেন তারপর আমার কোলে চলে এলেন। সেইযে এলেন, এরপর যতোদিন বাড়ি ছিলাম, শুধু একবার বললেই হতো, রাজা.........। নির্ভার নির্ভয়ে আমার আঙ্গুল ধরে ধরে পাড়াময় উনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। কতো জনমের চেনা আমি তার।

আরভিনও পাশে পাশে ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু তার প্রথম ব্যাপারটা ছিল, ঐ বড় বড় স্যুটকেসে কি আছে সেই ভাবনায়। আমি এতো ক্লান্ত ছিলাম ছুটির আগে এতোটাই ক্লান্ত যে ঢাকা যেয়ে ঐ বড় বড় ঢাউস স্যুটকেস খুলতে আর ইচ্ছে করছিল না। তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন স্যুটকেস খুলছি না তখন অস্থির হয়ে আরভিন বলেই ফেললো, কবে খুলবে মিষ্টিমা? কি আছে ওটাতে। আমি কিছু ডিজাইনটাইপ ক্যান্ডি ফ্লস নিয়ে গেছলাম। যার কিছু কিছু ঢাকনা হয়তো অন্যকিছুর গুঁতোয় ফুটো হয়ে গেছল। বাতাসে সেগুলো বক্সের মধ্যেই শুকিয়ে অনেকটা কমে গেছল। আমি ভাবলাম বাচ্চার কেউ খেয়েছে কিনা। বিশেষ করে অরভিন অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে এগুলো কি মিষ্টিমা? আমি আরভিনকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি খেয়েছো, সত্যি করে বলো? তিনবারের বেলা আরভিন তার বড় বড় নিষ্পাপ চোখ আমার দিকে তুলে বললো, আমি কি চোর মিষ্টিমা? যে চুরি করে তোমার জিনিস খেয়ে ফেলবো? আমার শিরদাঁড়া দিয়ে কি যেনো শিরশির করে নেমে গেলো। লজ্জায় আমি মাটির সাথে মিশে যেয়ে কয়েকবার সর‍্যি বলেছি আমার আব্বুকে। কিন্তু বাসায় একটা ঝামেলা হয়ে গেলো। কেউ কিছু খুঁজে না পেয়ে অন্যকে জিজ্ঞেস করলেই, সবাই উত্তর দেয়, আমি কি চোর যে তোমার জিনিস নিয়ে যাবো? তখন আমাকে বলতে হয়, আমি জানি তুমি চোর না কিন্তু তুমি কি আমার জিনিসটা দেখেছো?

দুপুরে খেতে বসলে সবগুলো খুটাখুটি করতে থাকে অকারণেই। ভাইয়ের মেয়েটা তখন অনেক ফ্রী আমার সাথে। রেগে আমি বললাম কথা যে শুনিস না জানিস আমি কে? তিনি অবলীলায় উত্তর দেয় হুমম জানিতো, তুমিতো মিষ্টিমা। আমি এখানে ওদের ছাড়া থাকতে থাকতে কেমন যেনো শুধু নিজের একটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাই। মনে হয় আমার কেউ নেই। আমি মরে গেলে কারো কিছু আসবে যাবে না। সব ভুল সব ফালতু। কিন্তু বাসায় গেলে খেতে বসলে ওরা যখন আমাকে টানে, মিষ্টিমা তুমি আমার পাশে বসো কিংবা আমি মিষ্টিমার পাশে বসবো। তাদের মায়েদের হাতে খায় না। তাদের মায়েদের হাত থেকে রক্ষা করতে আমি নিয়ে আসলে, দিব্যি আমার কাছে খেয়ে নেয়। এমন করে গায়ে লেপটে থাকবে যেনো সারা পৃথিবীর বজ্রপাতের একমাত্র আশ্রয় আমি। রাতে শোয়ার সময়ও একই কান্ড। বিছানাপত্র ফেলে রেখে সব মাটিতে ঢালা বিছানায়। টানাটানি, মিষ্টিমা তুমি আমার কাছে শোও, আমি তোমার পাশে শুবো। শুধু পাশে শোওয়া না, যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার বুকে মাথা ঢুকিয়ে শুবে তাতে আমিতো আমি, মেঘ শুদ্ধ অবাক হয়, তাদের মাকে অন্য সবাই এতো ভালবাসে। এতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ তার মা!

এতো একদিকের কথা। অন্যদিকেও আছে কারো চাচি কারো মামি। কারো কারো আবার দাদী নানী। কি করবে আমার জন্যে। কি হলে আমার আরো একটু বেশি ভাল লাগবে কিংবা বেশি আরাম হবে তারজন্যে তারা ব্যস্ত। আর মেঘকে জানের টুকরা করে কোলে তুলে নাচবে, কি খাবে মেঘ, কি খেলবে। মেঘ এখন সারাক্ষণ প্রার্থণা করছে আমাদের চাকরি চলে যাক কিংবা কিছু একটা হোক যাতে আমরা দেশে যেয়ে থাকতে বাধ্য হই। বারবার বলে, এখানে আমি একা একা কি করে থাকবো? আমার খেলারতো কেউ নেই। চলো বাংলাদেশে চলে যাই। সেখানে থাকি সবাই। ভরভরতি এই সংসার থেকে খালি বাসায় আসলে প্রথম কয়েকটা দিন শরীর চলতে চায় না। শরীর চলবে কিভাবে মন আর আত্মাতো সেখানে রেখে আসি। ফোনে আমার গলা শুনলে ফোনটা আছরে পাছরে আমাদের রাজাবেটা নাকি খুঁজে দেখে, মানুষটা কোথায়, তাকেতো সে চেনে। গল্পগুলো যখন শুনি হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়। একদিকে আরভিন অন্যদিকে তাহিয়া ধরে, আর কয়েকটা দিন থাকো মিষ্টি মা, আর অল্প কয়েকটা দিন। আমাদেরতো মেঘ আপুর সাথে খেলাই হলো না। বড়দের কথা শুনে শুনে বলে, ঈদ করে যাও মিষ্টিমা প্লীইইজ। এক জায়গা থেকে হৃদয়টা তুলে অন্য জায়গায় এনে সেট করা খুব সোজা কিছু না। লোকে যতোই বলুক নিজের সংসার আর এটা আর সেটা। যদিও জানি একসময় এক ঘেয়ে জীবনের চাকায় পিষতে পিষতে পেছনের অনেককিছু ভুলে যাবো, অভ্যস্ত হয়ে যাবো আবার একাকীত্বে। এখন যে প্রিয় ডাকগুলোর জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে, না শুনতে শুনতে আবার সেই না শোনায় জীবন মন অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এই কষ্ট পাওয়াও যেমন সত্যি ভুলে যাওয়াও হয়তো ঠিক ততোটাই সত্যি।
কয়েকদিন আগে বাসায় ফোন করলাম, ফোন ধরলো ভাইয়া। আমি যারপর নাই তার গলা শুনে চমকালাম। একেতো ভাইয়া আব্বুর ঘরের ল্যান ফোন কখনোই তেমন ধরেন না। দ্বিতীয়ত তার সেদিন বাসায়ই থাকার কথা না। ডেলিগেট নিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা। বল্লাম কখন যাচ্ছো? ভাইয়া বল্লেন, ফ্লাইটের অপেক্ষায় আছেন। ফ্লাইট রেডি হলে, ফোন করবে, তাহলেই রওয়ানা হবেন। কিন্তু গলাটা কেমন কেমন যেনো? আমি বল্লাম, তুমি কি হ্যাপি না? ভাবলাম ঈদের ঠিক মুখে যাচ্ছেন তাই কি? ভাইয়া বললো না, ডোমেষ্টিক ফ্লাইটগুলোর যা অবস্থা, তাতে আমার পেটের মধ্যে মেঘলার মতো বাটারফ্লাই আসা যাওয়া করে, কখন কি হয়। ভাইয়াকে অনেক ফ্লাই করতে হয় দেশে আর বিদেশে। তাই আমি সেসব আমলে না নিয়ে আরো মজা করলাম। বললাম বড় দেখে একটা হুজুরের কালো ছাতা নিয়ে যাও, প্যারাসুট না খুললে, তুমি ছাতা নিয়ে ঝুলে থাকবা। ডোমেষ্টিক ফ্লাইটতো বেশি ওপরে ফ্লাই করে না। ছাতাতেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। এরপরে অন্যকথায় চলে গেছি। পেপারে নিউজও দেখেছি http://www.amadershomoy2.com/content/2012/08/17/middle0496.htm
কিন্তু ভাবিনি এর সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে। যথারীতি ভাই বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু না বলে গতানুগতিক জীবন পার করছিলেন। গোল বাধালো অফিস ইনকোয়ারী মোবাইলে ফোন করে, তখন ভাইয়া ঈদের ছুটিতে বাসায়। অবশ্যই ভাইয়া কাউকে কিছু বলে বিব্রত করার বা দুশ্চিন্তা দেয়ার মানুষ নন। এতো বড় ঘটনা বিলকুল গিলে ফেলতে পারেন। এ ঘটনাটা শোনার পর থেকে আমার মাথা হাত ঝিম ঝিম করে। ঈদ কত অন্যরকম হয়ে যেতে পারতো আমাদের বাড়িতে। পত্রিকায় পড়ি, সড়ক দুর্ঘটনায় এতোজন কিংবা ততোজন নিহত। এ সংবাদ্গুলো মনে আর কোন প্রতিক্রিয়াই আনতো না। তাদের বাড়ির ঈদ কি রুপ নেয় তাও কখনো ভাবতাম না। কিন্তু এখন কেন যেনো খুব দুর্বল লাগে। মানুষের জীবন বদলাতে বোধহয় মূর্হুত লাগে। আবার ডেলিগেট এসেছে। তাদেরকে নিয়ে ভাইয়াকে সামনের দুই সপ্তাহ আবার উড়তে হবে। কোন প্রাণে তিনি উড়বেন আর আমরা কোন প্রাণ নিয়ে ধরায় থাকবো, কে জানে। কতোদূরে কোথায় পড়ে আছি। কেনো আছি কি জন্যে কে জানে? কতো বিপদের মধ্যে দিয়ে পরিবারের লোকগুলো যায়। কখন কি হয়ে যায় কে জানে? কাউকে ছুঁয়েও দেখতে পারি না। হয়তো পারবোও না। এভাবেই কাটবে জীবন।

পৃথিবীর সবাই যেনো ভালো থাকেন। এই কামনা।

বহুদিন কিছু না লিখতে লিখতে লেখার হাত, ভাবনা প্র্যাক্টিস সব চলে যাচ্ছে। তাই এলেবেলে এই লেখাটা। নিতান্তই ব্যক্তিগত হয়তো তাও।
তানবীরা
২৬/০৮/২০১২

Friday, 8 June 2012

আমার যত সিনেমা - ২


আমি সব কাজে লেট লতিফা। সিনেমাও তার ব্যতিক্রম কিছু না। আমি জানি যে সিনেমাগুলোর কথা আমি বলবো তার বেশিরভাগই ইতিমধ্যে সবার কয়েক দফা দেখা হয়ে গেছে, তবুও সিনেমাগুলো দেখে আমার কি অনুভূতি হয়েছে তাই লিখবো।
এক মুঠো ছবিঃ রুপা গাঙ্গুলী’র প্রোডাকশনের পরিবেশনা এটি। হিন্দি দশ কাহানীয়া ছবির মতো ছয়টি ছোট গল্প নিয়ে সিনেমাটি বানানো। জন্মদিন, পঙখীরাজ, তপন বাবু, রাগুনবাবুর গল্প, তারপর ভালবাসা আর প্রোগ্রেস রিপোর্ট। তারপর ভালবাসা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে। খ্যাতি কিংবা ব্যস্ত জীবনের কারণে আমরা কতোজনকে তুচ্ছ করি, কতো কিছুকে তুচ্ছ করি। কোন দুর্ঘটনা কিন্তু জীবনটাকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। সেরকম, একজন খ্যাতিমান ব্যস্ত অভিনেত্রী কি করে এক দুর্ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েন, তার অসাধারণ গল্পটি উঠে এসেছে। দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন রুপা এখানে। তার অতি অভিনয়ের যে একটা বদভ্যাস ছিলো, সেটা এখানে অন্তত আসেনি। নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্যে কেউ কেউ এই সিনেমাটা দেখতে পারেন। পঙখীরাজ সিনেমাটার হৃদয়বিদারক পরিনতি, আজকালকার ঢাকাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়। বাস্তব হয়তো কিন্তু মন মানতে চায় না। একটি ছোট চায়ের দোকান চালায় মেয়েটি আর স্বপ্ন দেখে একদিন তার সব কষ্ট শেষ হবে আর সে হবে সোকলড ভদ্রলোক। তার চায়ের দোকানের সামনে দিয়েই তার স্বপ্নের রাজকন্যা রোজ অফিসে যায়। কিন্তু বাস্তবের আঘাতে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো। রাগুনবাবুর গল্পটিও অতি বাস্তব। সহ্য করলে যে সামনের লোকটির অন্যায় একসময় বেপোরোয়া হয়ে উঠতে পারে তারই বাস্তব ইতিহাস এটি। বাকিগুলো আপনারা দেখে নিবেন।
ইচ্ছেঃ সুচিত্রা ভটাচার্যের উপন্যাস থেকে করা এই সিনেমাটি। একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত উচ্চাকাংখী মায়ের গল্প। মায়ের হাতে নিষ্পেষিত হতে থাকা, শেষে কিছুটা জেদের বশে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলা ছেলের গল্প। সিনেমাটিতে কিছু কিছু দৃশ্য আছে যা আমাদের টিপিক্যাল বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজকে উপস্থাপন করে। যেমন দুই কাজিনের মধ্যে সাধারণ জ্ঞানের লড়াই আর সাথে মায়েদের আর বাবাদের মুখোভাব। সন্তানের ক্যারিয়ার, প্রেম সবকিছুতে মায়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ। অসহায় সন্তানের নিষ্ফল মনোবেদনা বার বার ফিরে এসেছে। একবার শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যাবে না।
রঞ্জনা আমি আর আসবো নাঃ ছোটবেলা থেকেই আমি দেখেছি কারো পরামর্শে কিংবা উপদেশে সিনেমা দেখলে সেটা আমার ঠিক হজম হয় না। তখন আমরা স্কুলে পড়ি, বলিউড মুভির পোকা। কোন একটা সিনেমা দেখে, তার গান শুনে আমরা হাওয়ায় ভাসছি। এমন এক দুপুরে আমি আর চাচাতো বোন গেলাম, ভিডিও ক্লাবে সিনেমা আনতে। লোকটাকে দুই বোনে ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, খুউউউব রোমান্টিক একটা হিন্দী ছবি দিতে। তিনি দিলেন সানি দেউলের “ডাকাইত”। আমরা দুই বোনে সারা দুপুর সেই সিনেমা দেখলাম আর খুঁজলাম এই বুঝি রোমান্স আসলো এই বুঝি রোমান্স আসলো। এ রকম ডাকাইত অনেকবার আমাদের ওপরে গছানো হয়েছে। রঞ্জনা আমি আর আসবো না ও আমার কাছে সেই ক্যাটাগরীরই লেগেছে। অসাধারণ গান কিংবা গল্প কোনটাই লাগেনি। আর অঞ্জন দত্তের গান শুনে মনে যে ছবি আঁকা ছিল, সিনেমা দেখে সেটা চিরতরে ধুয়ে গেছে। সেজন্যই হয়তো কবি বলেছিলেন, মোষ্ট বিউটিফুল থিংস কানট বী সীন অর ইভেন চাটড। কবি আগেই অভিজ্ঞ ছিলেন।
বেডরুমঃ আধুনিক কালের বেশ আলোচিত সিনেমা এটি। অনেকের কাছেই বেশ প্রশংসা শুনলাম সিনেমাটির। আমার কাছে বেশ গতানুগতিক লেগেছে। এর দুটো কারণ থাকতে পারে, সময়ের আধুনিকতার রেসে আমি পিছিয়ে পড়েছি কিংবা সময় এগিয়ে গেছে। এতো উচ্ছৃখংল জীবন, যা ইচ্ছে তা করা কিংবা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করা, এসবে এখনো চোখ মন অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শুধু বুঝিনি সিনেমার নাম কেন বেডরুম হলো। যেকোন টাইপ নাম হতেই পারতো দ্যান বেডরুম। বানিজ্যক চিন্তা থেকে নাকি কে জানে?
শ্বেত পাথরের থালাঃ অনেক আগে ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, বাবার সাথে বসে। পরিবেশের কারণেই হোক কিংবা গল্প বা সিনেমার কারণেই হোক, সিনেমাটি আমার মগজে আজো দাগ কেটে বসে আছে। অপর্না সেন আর সব্যসাচী চক্রবর্তী, ঋতুপর্না সেনগুপ্ত আর দীপঙ্কর রায় অভিনিত সিনেমাটি। নতুন প্রজন্ম যারা দেখেনি সিনেমাটি তারা দেখে নিতে পারে। ভাল লাগবেই, বিফলে মূল্য ফেরত। ১৯৯২ এর ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছে সিনেমাটি। বানী বসুর লেখা উপন্যাস থেকে এ সিনেমাটি বানিয়েছেন প্রভাত রায়। একটি আধুনিক শিক্ষিত মেয়ের একটি সনাতন পরিবারে বিয়ে হয়। বিয়ের পর ভালই চলছিল গোঁজামিল দিয়ে। হঠাৎ স্বামী মারা গেলে তার বৈধব্য জীবন আর আত্মসম্মানের মধ্যে শুরু হয় চিরদিনের সেই প্রভু – সামন্ত খেলা শ্বশুরবাড়ির সাথে। শেষে ছেলে নিয়ে বাধ্য হয়ে আলাদা হয়ে যান। অনেক কিছু সহ্য করে একা ছেলে মানুষ করলেও, ছেলেও পরে মায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটা হলো খুব ছোট করে দেয়া সিনেমার বিবরণ।
পাদটিকাঃ আজকাল মাঝে মাঝে বাসাটা একটু স্থিতিতে থাকে। সন্ধ্যাবেলা মা মেয়ে এক সাথে বসি আগের মতো। এটা আমাদের প্রিয় একটি জিনিস। একই কম্বলের নীচে দুজন জড়াজড়ি করে বসে ল্যাপটপে ফেসবুকিং করি, সিনেমা দেখি। কুংফু পান্ডা, স্নিউচে, স্পঞ্জ বব, লোলেক পোলেক কিংবা ভূতের ভবিষ্যত। আরো অনেক নাটক কিংবা সিনেমা। আজকাল লক্ষ্য করি আমার নয় বছরের মেঘ, দুষ্ট – মিষ্টি দৃশ্যে লজ্জা পায়। সে তখন কোক আনতে যায়, চিপস আনতে যায়, আইসক্রীম নিয়ে আসে। কিংবা চোখ বন্ধ করে, মুখ ফিরিয়ে রেখে হাসে। ছোটবেলায় মা – বাবাকে ফাঁকি দিতাম, ভাবতাম বুঝে না। আজ জানি জেনে শুনে হাসি মুখেই তারা এই ফাঁকি মেনে নিতেন। এখন এও উপলব্ধি করলাম, কখন মেয়েকে কোক আনতে পাঠাই আর চিপস আনতে পাঠাই তা মেয়েও বুঝে গেছে। আমি শুধু যে রামে ছিলাম সেই রামেই আছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রাসেল আশরাফ ছেলেটা আমার অফিস – বাসা, বাসা – অফিস মার্কা বৈচিত্রহীন প্রবাস জীবনে প্রায়ই একটু আনন্দের ছোঁয়া রেখে যায়। আপা, এই ফিল্ম কিংবা নাটকটা দেইখেন। কিংবা গানটা শুনেন। আর আমার সিনেমা, সফটওয়্যার, গান যেকোন দরকারে একটু নক করলেই হলো। দরকার হলে রাত জেগে কাজ করে দিবে। কোনদিন সামনে থেকে না দেখা এই ছেলেটা অন্য দেশে থেকেও আমার দৈন্দদিন জীবনে একজন পারিবারিক সদস্য। সুখ আমার কপালে সয় না। পুলাটা বিয়ে করতেছে। কোন ডাইনি আমার এই ভাইকে কেড়ে নিচ্ছে। বিয়ের পর জীবন বদলে যাবে। ব্যস্ততা বদলে যাবে। হয়তো এই টুক টুক করে দেয়া লিঙ্কগুলো আর ফেসবুকের ম্যসেজ বক্সের ওপরে লাল টিপ হয়ে জ্বলবে না। তবুও দুয়া করি পুলার জীবনটা সুখে কাটুক। দিল্লী কা লাড্ডু খেয়েই গান করুক, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
তানবীরা
০৬/০৯/২০১২