Sunday, 14 October 2012

ইংলিশ ভিংলিশ আর ডাচ ভাচ



খুব ছোটবেলা থেকেই আমি হার্ডকোর হিন্দী সিনেমা ভক্ত। একদম কুট্টিকালের সিনেমা জীবনই ধরতে গেলে শুরু হয়েছে ভিসিআর, ভিসিপি তারপর জিটিভি ভিটিভি সনি এলটিভি দিয়ে। এরমধ্যে জিতেন্দ্র মানে জিতুজী আর মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন সেই সময়ের প্রিয় নায়ক। জিতুজী নায়ক মানে নায়িকা হলো শ্রীদেবী কিংবা জয়াপ্রদা। জয়াপ্রদার মধ্যে আবার ভাল মেয়ে ভাল মেয়ে ভাব প্রবল আর শ্রীদেবীর মধ্যে একটা উইটি লুক ছিল যার ছিলাম আমি যাকে বলে ফিদা। মাওয়ালী সিনেমা এতোটাই ভাল লাগল, এতোটাই ভাল লাগল যে চান্স পেলেই রামা রামা রামা রামা রে। চান্স কি করে পাবো? গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ এলে কিংবা এমনিতেও কেউ বেড়াতে এলে, ভিসিআর দেখতে চাইতো। দেখতে চাইলেই হলো আমি আর ভাইয়া পটিয়ে পটিয়ে মাওয়ালী আর জাষ্টিজ চৌধুরী আনাতাম। পম পম, ছোটবেলা থেকেই নাচ গানের বিশাল ভক্ত তাও যদি হয় আবার জিতুজীর। একটা সময়ের পর সেই ক্রেজ আবার মধ্যগগনে আনিল কাপুর আর মাধুরী উড়িয়ে নিয়ে গেলেন।

আমরা যে শহরে থাকি, সে শহর বাদে অন্য অনেক শহরে হিন্দী সিনেমা মুক্তি পায় মাঝে মাঝে। কিছুদিন আগে মনে হলো এক থা টাইগার না দেখলে এ জীবন বৃথা। গেলাম রাতের শোতে দেখলাম এক থা টাইগার। ক্যায়া ফিল্ম হ্যায়। ফিল্ম কা মাফিক ফিল্ম হ্যায়। শেষ হওয়ার পরও আমার মনে হতে লাগল কেন শ্যাষ হয়ে গেলো? এতো ছোট কেন? আরো একটু বড় হওয়া দরকার ছিল। পাঠা সাল্লুকে আমার এতো অপছন্দ, ধরমজীর মতো ওর মধ্যে একটা ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার ভাব আছে। সেই দাবাং এর পাঠাকেও এই সিনেমা দেখে ক্ষমা করে ফেললাম। সকালের শোতে দেখলাম বারফি। সেটাও অসাধারণ লাগলো। রাজ কাপুরের নাতি রাজ কাপুরের নাক রেখেছে। ঐ দুই সিনেমায় ট্রেলার দেখিয়েছিল “ইংলিশ ভিংলিশ”। তখনই ভাবলাম, এই সিনেমা মিস করা যাবে না। অনলাইনে দেখলাম ইংলিশ ভিংলিশ। আর একবার ফিদা হলাম শ্রীদেবীর কিন্তু তারচেয়েও বড় ফিদা হলাম, সিনেমার কাহিনীর। অনেক অনেক বছর আগে যখন এই ডাচল্যান্ডে উড়ে এসেছিলাম এক অক্ষর ডাচ না জেনে, কিভাবে এখানে সারভাইভ করেছিলাম সেগুলো অনেকদিন পর আবার স্মৃতির মনি কোঠায় ঝলক দিয়ে গেলো।

কফিশপের দৃশ্যটা যে কি সত্যি, সেটা যারা এই পরিস্থিতিতে পড়েননি তারা অনুভব করতে পারবেন না। প্রথম কথাতো দেশে সবসময় সব ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের সাথে একজন থাকে। একা কোথাও ছাড়ে না বলতে গেলে। আর এখানে আসা মাত্র, এসে গেছিস যা চড়ে খা। তারপর অন্যদেশের পয়সা চিনি না। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি নিজের টার্ন এলে কি চাই, কতোটা চাই, কিভাবে চাই গুছিয়ে মনে মনে দশবার রিহার্সেল দিয়ে রেখেছি। অথচ যে না নিজের টার্ন আসলো, নার্ভাসনেস আর সামনের ক্যাশে বসা আছেন যিনি তার অর্ধেয্য তাড়াতে যা বলবো তা ভুলে গেছি। ডাচ ভুলে টেনশনে ইংরেজীতে বলা শুরু করেছি। পয়সা দিতে গিয়ে বেড়াছেড়া অবস্থা। কতোদিন বাসা থেকে বলে দিয়েছে, পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে, ইউ টেক ইয়োর টাইম। কিন্তু পরদেশে, অজানা অচেনা লোক, ভাষা সংস্কৃতি যে কিভাবে আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়, ভুক্তভোগী ছাড়া তা কেউ উপলব্ধি করবেন না। অথচ সবাই উপদেশ দিতেন এভাবেই ডাচ প্র্যাক্টিস করতে হবে, এভাবেই মূলধারার জীবনের সাথে মিশে যেতে হবে।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এসেছি এখানে এসে এক অক্ষর সংবাদপত্র পড়তে পারি না। উলটে পালটে ছবি দেখে অনুমান করার চেষ্টা করি, কি আছে ওতে লেখা কি হতে পারে। শুধু অক্ষর জ্ঞান ছিলো বলে, পত্রিকা উলটো করে ধরিনি, সোজা দিকটাই ধরে রাখতাম। কি কষ্ট আর কি কষ্ট। বাজার করতে পারি না। সারাদিন ডিকশনারী ঘাটতে ঘাটতে মাথা ব্যাথা করে। অনেক স্পাইসের ইংরেজী নামওতো জানি না যে ডাচ ট্রান্সলেশন খুঁজবো। তখন ইন্টারনেটে এতো ইনফরমেশন গুগল ট্রান্সলেটর, গুগল ম্যাপ কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের কিছু খুঁজতে গেলে কি মুশকিল ছিল। ইয়াহু আর একটা কি যেনো সার্চ ইঞ্জিন ছিলো তা দিয়ে খুঁজতে যেতাম, মাত্র বাংলাদেশে কিংবা বাংলায় ওয়েবসাইট বানানো শুরু হয়েছে যাকে বলা চলে। মিনিমাম সব ইনফরমেশন দিয়ে নাম কা ওয়াস্তে সব ওয়েবসাইট। টিভি মানে শুধু বিবিসি কিংবা সিএনএন, ডিস্কোভারী কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফীক চ্যানেল। হয় যুদ্ধ দেখো নয় পশুপাখি। মাঝামাঝি আছে এমটিভি। আরো আছে ফ্রান্স চ্যানেল, টার্কিস চ্যানেল, জার্মান চ্যানেল কিন্তু ডাচ সাবটাইটেল দেয়া।

তবে শ্রীদেবী মানে শশীযে একবারে নিজে নিজে ম্যাপ মিলিয়ে ভাষা শেখার স্কুলটা খুঁজে পেয়েছে সেটা বেশ অবাক লাগলো কিন্তু অসম্ভব না। এটা হতেও পারে কারো বেলায় আবার নাও হতে পারে। এতোটা সাহস কেউ করবে কিনা সেটাও হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কতো জায়গায় জেনে বুঝে এড্রেস নিয়ে যাওয়া সত্বেও টেনশানে ভুল স্টপেজে নেমে পড়েছি। বাসের বোতাম না টিপলে বাস থামবে না সেটাও জানতে ছয়মাস লেগে গেছে। ডাক্তার, ঔষধ আর অন্য বিড়ম্বনার কথা নাহয় নাই বললাম। তবে শেষটায় শ্রীদেবী মানে শশীর আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার দৃশ্যটা খুব মধুর লেগেছে। কামনা করি এরকম অনেক শশীই যারা পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এভাবে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাক। নিজের গন্ডীর মধ্যে জীবনকে জয় করে নিক। অনেক অনেকদিন পর শ্রীদেবীকে শশীরুপে দেখে খুব ভাল লাগলো। শশীর মাঝে নিজেকে দেখে আরো আপন লাগলো।

তানবীরা
১৪.১০.২০১২


সেই ছেলে ও মেয়েটির কথা



http://www.unmochon.com/2012/10/14/29795.html#.UHsgx65qCko

সকালে অফিস আওয়ারে রাস্তায় খুব রাশ থাকে তাই মেয়েটির ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করে না। প্রায়ই পথে কিছু না কিছু হয়, অনেকেই সকালের স্ট্রেস নিতে পারেন না, অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন আর ফলাফলে রাস্তা বন্ধ। দেখা যায় মেয়েটি অফিসে অনেক সময় এই কারণে দেরীতে পৌঁছায়। দেরীতে পৌঁছানো মানেই দেরীতে বের হওয়া আর সারাদিনের সবকিছুতে দেরী মানে মেজাজ খিঁচরে দিনভর নিজেকে স্ট্রেস করা। তাই সে আজকাল বাসেই অফিসে যাওয়াটাকে শ্রেয় ভাবে। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আরামে বাসে করে অফিসে যাওয়া। সকালটা শুরু হয় একটু ঢিলেঢালা ভাবে। আরামে মেয়েকে নিয়ে ঘুম থেকে উঠে, বিছানা গুছিয়ে, বাসি কাজ শেষ করে, নাস্তা সেরে রেডী হয়ে মা মেয়ে একসাথে বের হয় বাড়ি থেকে। আবার ফেরার পথের ড্রাইভিং স্ট্রেস থেকেও বেঁচে যায়। অনেক সময় স্বামী বাড়ি ফেরার পথে মাকে অফিস থেকে আর মেয়েকে ডেকেয়ার থেকে তুলে বাড়ি ফিরেন, নইলে মেয়েটি বাসে ডে কেয়ারে পৌঁছে মেয়েকে নিয়ে বেশ গল্প করতে করতে হেটে বাড়ি ফিরে আসে।

মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাসে উঠে শুরু হয় মোবাইলে ফেসবুকিং। তাতে বাস যাত্রার বিরক্তিও কাটে আর সারারাতে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটলো তার আপডেটও পাওয়া যায়। একই রুটে একই সময় একই বাসে যাতায়াত করলে অনেক সময় এক আধটা মুখ পরিচিত হয়ে যায়মেয়েটির বেলায় এটা একটু টাফ কারণ বাসে সে সহযাত্রীদের মুখ দেখে না বললেই চলে, সে দেখে ফেসবুক। এরকম এক রৌদ্রজ্জল সকালে বাস থেকে নেমে মেয়েটি নিজের মনে অফিস পানে হাঁটছিল। সহযাত্রী এক কালো যুবক যে কিছুদিন যাবত তার সাথে স্টেশন থেকে অফিস পর্যন্ত যায় তাকে বললো, নাইস ওয়েদার হ্যা? আগে হলে ঠিক এমন অপরিচিত সম্ভাষনে মেয়েটির কি প্রতিক্রিয়া হতো, বলা যায় না। কিন্তু আজকাল সব অচেনা লোকের মাঝে বসবাস করতে করতে কিছুই আর গায়ে মাখে না। মেয়েটিও মাথা নেড়ে হেসে তাতে সায় দিল। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটি টুকটাক কিছু কথা বলার চেষ্টা করতো হাটা পথে।

মেয়েটিও হ্যাঁ না টুকটাক জবাব দিত। মায়া লাগতো আহারে, কাছে কেউ নেই, কথা বলতে হয়তো পারে না। এবার জিজ্ঞেস করলো ছেলেটি, কখনো আফ্রিকা গিয়েছো। মেয়েটি মনে মনে ভাবলো আফ্রিকা যে কেউ সাধ করে বেড়াতে যায় সেটাইতো জানতাম না এখানে না এলে। তাও ভাগ্যিস আফ্রিকা বলেছে, নিজের নেটিভ কান্ট্রি ইথিওপিয়া বলেনি ছেলেটি। ইথিওপিয়া শুনলেই টিভিতে দেখা ভুখা নাঙ্গা চোখে ভেসে উঠে। নিজে যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে, আর এক ভুখা নাঙ্গা দেশের প্রতিনিধি, সে কথাতো আর মনে থাকে না। মুখে একটা সুশীল হাসি ফুটিয়ে বললো, নট ইয়েট, মে বি সাম ডে, হ্যাভ সীন পিকচারস, ভেরি বিউটিফুল ইনডিড। দু তিন সপ্তাহ, গোনা নেই, এভাবে ওয়েদার আর এশিয়া আফ্রিকা আলোচনার পর একদিন ছেলেটি মেয়েটিকে চট করে জিজ্ঞেস করে বসলো, ডু ইউ মাইন্ড টু হ্যাভ সাম কফি উইথ মি আফটার অফিস? এধরনের একটা প্রস্তাবের কোন সম্ভাবনা যে থাকতে পারে অপর পক্ষ থেকে তাই মেয়েটির মাথায় কোনদিন উঁকি দেয়নি। প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও, মেয়েটি মনে মনে হেসে ফেললো। স্বভাব রসিক মেয়েটি, চট করে ছেলেটিকে একটু নাড়িয়ে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলো না। যতোদূর সম্ভব একটি নিষ্পাপ মুখ করে বললো, হোয়াই? উই ক্যান ড্রিঙ্ক কফি এ্যাট অফিস, ফ্রী অভ কষট, এজ মাচ এজ উই ওয়ান্ট। ছেলেটি এবার একটু অস্বস্ত্বিতে পরে গেলো মনে হয়। প্রায় অপরিচিত একটা মেয়েকে ডিনারে ডাকা কি ঠিক হবে? তাও ডিনার মানেই টাকা পয়সার ব্যাপার। ছেলেটি চুপ করে রইলো।

ছোটবেলা থেকেই ডানপিঠে স্বভাবের মেয়েটির মনের সুখে একটু হেসে নিল। ডানপিঠে স্বভাবের কারণে প্রায় কোন ছেলে বন্ধুই তাকে ঠিক ভরসা করে উঠতে পারতো না বলে, কখনো একান্ত আমন্ত্রনের ডাক সে পায়নি। যদিও বা কেউ তাকে কখনো কিছু ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে, মেয়েটি তাকে নিয়েই উলটো এমন মজা করেছে যে, সেই ছেলে বন্ধু প্রায় পালিয়ে মান রক্ষা করেছে। তা নিয়ে পরিনত বয়সে তার অবশ্য একটু দুঃখবোধ ছিল। কিন্তু আজ এই প্রায় চল্লিশের দিকে ধাবিত হওয়া বয়সে তাকে কেউ কফি খেতে বলাতে সে অসাধারণ কৌতুক অনুভব করলো। বাদামী রঙের মানুষের বয়স আন্দাজ করা বেশ কঠিন। তাকে এখনো হয়তো কিছুটা বয়স আন্দাজে ছোট দেখায় কিন্তু এই ছেলে যে ত্রিশ পার করেনি তা মুখ দেখেই বোঝা যায়। কালো তা সেই যতোই কালো হোক, ত্রিশ আর চল্লিশের রয়েছে আলাদা চোখমেয়েটির হঠাৎ মনে হলো, ছেলেটি তাকেই কেনো এ প্রস্তাব দিলো? হয়তো কালো বলে বাদামী চামড়ার প্রতি আপনতার কারণে? নাকি বাদামী আর কালো চামড়ার দেশে একা একটি মেয়েকে দেখলে এ ধরনের অভব্য প্রস্তাব দেয়ার রীতি আছে বলে? একবার ইচ্ছে হলো বলে, আমার একটি প্রায় তোমার অর্ধেক বয়সী মেয়ে আছে জানো? পরের মুহূর্তেই আবার ক্ষমা করে দিলো, এতোটা কঠিন হতে ইচ্ছে করলো না, নাম না জানা সেই কালো যুবকের প্রতি। 

আপাততঃ ছেলেটির আর মেয়েটির গল্প এখানেই অসমাপ্ত আছে। 

তানবীরা
০৯.১০.২০১২

Wednesday, 10 October 2012

চৌধুরী আলমের গল্পখানা


  http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=2a9ad255fab5e331a8c07180ade367b9&nttl=20121010052314144462

নকলের ভরসায় বার তিনেক ম্যাট্রিকে পাশ দেয়ার চেষ্টা করিয়া অবশেষে ক্ষান্ত দিয়া দিলেন চৌধুরী আলম। তারপর কিছুদিন ইতিউতি ঘুরিলেন। কি করিবেন, কি করা যায়, অল্পসময়ে অধিক উপার্জনের সমস্ত নাড়ি নক্ষত্র পুক্ষানুপুক্ষ বিবেচনা করিয়া বিদেশ যাওয়াটাকেই শেষ পর্যন্ত বাছিয়া লইলেন। তাহাদের উপজেলার নাঈম মাষ্টারের ছেলে মোখলেছ জার্মানী থাকে। কিছুদিন আগে যখন দেশে আসিয়াছিল গলায় বিরাট ক্যামেরা আর হাতে আলোজ্বলা ঘড়ি পড়িয়া মনে হয় সমস্ত উপজেলায় যেনো আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। টেরি কাটা সিঁথি নিয়ে যে যখন বাজারে আসিত তখন সে এবার বিয়ে করিবে কিনা তাহা জানিবার জন্যে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা প্রায় উন্মাদ হইয়া পড়িয়েছিলেন। সেই সব গুনবতী কন্যাদের মহান পিতাদের বাড়িতে বাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষা করাই শেষ পর্যন্ত অসম্ভবে যাইয়া দাড়াইয়াছিল তাহার জন্যে। বাড়িতে নানা পদের আর্শ্চয জিনিসপাতি নিয়া আসিয়াছে সে। মেশিন টিপিয়া মশলা বাটনা করা যায়, ভাত রান্না করিবার জন্যেও মেশিন আনিয়াছে। যদিও গ্রামে বিদ্যুৎ পাওয়াই মুছিবত। বিদ্যুৎ একদিন থাকেতো তিনদিন থাকে না। কিন্তু সেটা বড় কথা নহে, বড় কথা হইলো সে সমস্ত মেশিন নাঈম মাষ্টার তাহার কাচারী ঘরে কাঁচের পাল্লা দেয়া আলমারীতে সাজাইয়া রাখিয়াছেন, সেগুলো দেখিতে প্রায়ই এ গ্রামের সে গ্রামের লোক তাহার বাড়ির কাঁচারীতে যাইয়া বসেনসম্ভ্রমের সহিত সেগুলোকে নাড়াচাড়া করিয়া নাঈম মাষ্টারের ভাগ্যে নিয়া ঈর্ষান্বিত হন ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন

পিতাকে বুঝাইয়া সুঝাইয়া বংশের ভাগে পাওয়া কিছু জমিজমার বেশ অনেকখানিই বন্ধক দিয়া আর ভগ্নীপতিদের নিকট হইতে কিছু ঋন লইয়া দালালের সহিত পরামর্শ আর আঁতাত করিয়া জার্মান যাইবার ব্যবস্থা সেও করিয়া লইল। তারপর এক শুভদিন দেখিয়া মায়ের দোয়া মাথায় লইয়া উড়োজাহাজে চাপিয়া বসিল। আসিয়া নামিল জার্মান দেশে। প্রথমে পুলিশের হ্যাঁপা। বহুকষ্টে সে হ্যাপা কাটাইয়া ইমিগ্রেশন পার হইয়া বিমানবন্দরের বাহিরে আসিয়া পড়িলমুগ্ধ বিস্ময়ে চারপাশে ঘাড় ঘুরাইয়া যতোই তাকাইতেছিল তাহার বাক ততোই রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। খুশী হইয়া মনে মনে তিনবার কহিল, সুভানাল্লাহ – সুভানাল্লাহ – সুভানাল্লাহদেশ হইতেসিবার সময় দালাল তিনজনের ঠিকানা দিয়াছিলেন, কাহাদের সাথে তাহাকে যোগাযোগ করিতে হইবে,  সে নিজেও তাহার ভগ্নীর শ্বশুরকূলের এক নিকট আত্মীয়ের ঠিকানা নিয়া আসিয়াছে। এখন তাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া যোগাযোগের পালা। ভগ্নীর শ্বশুরকূলের আত্মীয়ের তাহাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসিবার কিঞ্চিত সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কাহাকেও সেরকম দেখা যাইতেছে না। কোনদিকে যাইবে কোথায় খুঁজিবে ভাবিতে ভাবিতে দিশাহারার ন্যায় সামনে পা বাড়াইলো। দরজার বাহিরে আসিতেই ঠান্ডা একখানা দমকা বাতাস তাহাকে কাবু করিয়া ফেলিল। বুঝিতে পারিতেছিল না, কি করিবে? বোঝা না বোঝার দোলার মাঝেই সাথে করিয়া আনা কিছু শীতের কাপড় বাহির করিয়া পড়িয়া ফেলিল। শুরু হইলো তাহার যাত্রা অজানার উদ্দেশ্যে। 

পরিচিত বাঙ্গালী ভাইদের পরামর্শে উকিল ধরিয়া, দেশ হইতে পিতা আর ভগ্নীপতির সাহায্যে কিছু ভুয়া কাগজপত্র আনিয়া, পাসপোর্টের নাম ঠিকানা বদল করিয়া রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর কেস ঠুকিয়া দিল। দেশে সে অমুক বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিল, অমুক তকুম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ তাহাকে সরকারী দলের রোষানলে আনিয়া ফেলিয়াছে, তাহার এখন বাংলাদেশে জীবন বিপন্ন ইত্যাদি প্রভৃতি বহু মিথ্যার আশ্রয় লইয়া সে জজ সাহেবদের মন গলানোর চেষ্টা করিল। যদিও প্রথম দুইবার অকৃতকার্য হইলো, তৃতীয়বার আবার নতুন নাম ঠিকানা, নতুন কাগজপত্র লইয়া আবার চেষ্টা দিল, এবার অন্য আর এক শহর হইতেদান দান তিনদান। এইদানে জজসাহেব কিঞ্চিত বিগলিত হইয়া বিবেচনার জন্যে তাহার মামলা নথীভুক্ত করিলেন। কিন্তু পেট পুড়ে আগের শহরের জন্যে, তাছাড়া পরিচিত না থাকিলে কাজও পাওয়া যায় না। তাই সে আপাতত পুরনো শহরেই ডেরা গাড়িলো। কেইসের তারিখ আসিলে সে আসিয়া নতুন শহরে হাজিরা দিয়া যায়, মাসে মাসে সরকারের ঘর হইতে পাঠানো হাত খরচ নিয়া, পুলিশের খাতায় সহী দিয়া আবার পুরনো শহরে ফিরিয়া যায়। সেখানে সে একটি রেষ্টুরেন্টে সপ্তাহে সাতদিনই দশ থেকে বারো ঘন্টা ধোয়াপোঁছার কাজ করিয়া থাকে থাকে কিছু বাঙ্গালী ভাইয়ের সহিত একটি বাড়ি ভাগাভাগি করিয়া সব ব্যাচেলররা। বেশিরভাগ দিনই রেষ্টুরেন্ট হইতে খাইয়া আসে বিধায়, খাওয়ার খরচও তাহার বাঁচিয়া যায়। মাস না ঘুরিতেই পয়সা, মাস না ঘুরিতেই হাত লাল।

কিন্তু শেষ রক্ষা হইলো না। এইখানেও তাহারা কাগজপত্র নিয়া আবার সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগিলেন। গাট্টি পুট্টি বাঁধিয়া না আবার ফিরিয়া যাইতে হয় এই দুশ্চিন্তায় প্রায় পাগল হইয়া যাইবার দশা হইল তাহার। এতো টাকা খরচ করিয়া আসিয়া যদি এতোদিন পর খালি হাতে ফিরিয়া যাইতে হয়, তাহা হইলে কি হইবে তাহার উপায়। দেশে ফিরিয়াই বা করিবে কি? অনেক ভাবিয়া শেষে সহদেশীদের পরামর্শমতো একটা জার্মান বুড়ি যোগাড় করা হইলো। বুড়ির শরীর ভর্তি অনেক দয়া। তিনি পয়সার বিনিময়ে এইসব বিপদগ্রস্ত বালকদের উদ্ধার করিয়া থাকেন। একেবারে বিয়েতে চৌধুরী আলমের কেমন যেনো বাধো বাধো লাগিতে লাগিল। সারা জীবন বিবাহ নিয়ে অনেক স্বপ্ন, কল্পনা ছিল তাহার। এ কিসের মধ্যে সে পড়িয়া যাইতে লাগিল। অনেক ভাবিয়া ঠিক করিল কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করিবে। যে যে যার যার বাসায় থাকিবে। শুধু কাগজের স্বামী – স্ত্রী হইবেন তাহারা, তাতে পয়সা গেলেও ধর্ম, সমাজ আর কুমারত্বতো টিকিয়া থাকিল, এইগুলাই যদি না থাকিবে তাহলে এই জীবন রাখিয়া আর কি লাভ। বুড়ি মহিলা মেমসাহেব তাতেও রাজি। চৌধুরী আলম হইবে তাহার চার নম্বর বাঙ্গালী স্বামী। এর আগেও তিনি আরো তিনজন বাঙ্গালী বালককে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করিয়াছেন। এই পেশায় তিনি বিস্তর অভিজ্ঞ। আগের স্বামীদের নিকট হইতে পোলাও, রোষ্ট খাইতে শিখিয়াছেন, শাড়ি আনিয়া দিয়াছিল একজন বাংলাদেশ হইতে, তাহাও প্যাচাঁইতে জানেন অঙ্গে, বাংলাদেশ ও তাহার পারিবারিক কালচার সম্পর্কেও যৎসামান্য জ্ঞান আছেনেহাত পুলিশ ধরিলেও কোন সমস্যা হইবে না, ম্যানেজ করিয়া লইতে পারবেন। কিন্তু তাহাকে তাহার টাকা প্রথমেই দিয়া দিলে ভাল, তাহার এখন কিঞ্চিত হাত টান যাইতেছে।

টাকার অঙ্ক শুনিয়া চৌধুরী আলমের পিলে চমকাইয়া গলায় আটকাইয়া বাধিয়া গেলো প্রথমে। কিন্তু এরচেয়ে যোগ্য পাত্রীও আর নাই। জার্মান পাসপোর্ট হইল একখানা সারাজীবনের নিশ্চয়তাপত্র। টাকাটা ভাবিলেই শুধু চলিবে না। আজকাল পুলিশের সন্দেহ আর উৎপাতও সাংঘাতিক বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু এতো টাকা তাহার হাতে সত্যই নাই। টাকা পাওয়া মাত্রতো সে দেশে পাঠাইয়া দেয়। তাছাড়া যিনি এই বুড়ি জার্মান মেম যোগাড় করিয়া দিয়াছেন তাহাকেও কিছু কমিশন দিতে হইবে। সেইটাও একদম ছোট কিছু না। যাহা ছিল তাহা অগ্রীম দিয়া, বাকি টাকা মাসে মাসে পরিশোধ করিবে অঙ্গীকার করিয়া, পরিচিতজনদের সাক্ষী রাখিয়া তাহারা কাগজপত্রে সই সাবুদ করিল। মাসে মাসে গভর্মেন্ট হইতে পয়সা আসা মাত্র সে মেম বুড়ির হাতে নিজে যাইয়া টাকা দিয়া আসিতো। আর রেস্টুরেন্টে কাজ করিয়া যাহা পাইতো তাহা প্রতি মাসে পিতার কাছে টাকা পাঠাইতে লাগিল। প্রথমে বন্ধকী জমি ছুটাইতে পিতাকে অনুরোধ করিল। এই না শুনিয়া ভগ্নীপতি তেলে বেগুনে জ্বলিয়া গেলেন। তাহার টাকা আটকাইয়া রাখিয়া এহেন মশকরা। বেঈমান শ্যালক আর তাহার চাইতেও ততোধিক বেঈমান শ্বশুরের সাথে আর কোন সম্পর্কই রাখিবেন না তিনি। বিবাহের পর থাকিয়া এই বাড়ির জন্যে কি তিনি কম কিছু করিয়াছেন? নাবালগ শালা শালীদের পড়াশোনা বিয়েশাদী কোনটায় চুপ থাকিয়াছেন? নিজের আপন রক্তের ভগ্নীদের জন্যে যাহা তিনি করেন নাই, তাহার চাইতে অনেক বেশি শালীদিগদের জন্যে করিয়াছেন। এই কর্মের এই প্রতিদান? কন্যার নিকট এই সংবাদ শুনিয়া নিরুপায় পিতা প্রথমেই ছুটিলেন তাহার “বাড়ির মাথা” স্বচ্ছল বড় জামাইকে ঠান্ডা করিতে। যাহাই হোক কিছু বড় জামাই এর হাতে গুঁজিয়া দিয়া তাহাকে ঠান্ডা করিয়া আসিলেন পিতা। তিন চার বছর না ঘুরিতেই বিস্তর দেনা শোধ করিয়া ফেলিল কৃতিমান ছেলে চৌধুরী আলম। আরো দেনা শোধ করিতে পারিত কিন্তু এইদিকে মেমবুড়িকেও মাসে মাসে টাকা দিতে হয়। আজকাল মাঝে মাঝে এইটা ঐটা বায়না করে তাহাও সাথে কিনিয়া দিতে হয়। হোক না কাগজের তবুও বউ বলিয়া কথা।

এর মাঝে আর এক অঘটন ঘটিয়া গেলো। মেম বুড়ির দেনা যখন প্রায় শোধ করিয়া আসিয়াছে কোন দুর্বৃত্ত যাইয়া পুলিশের কাছে রিপোর্ট করিয়া দিলো। পুলিশ আসিয়া তাহাকে মেম বুড়ির বাসায় না পাইয়া থানায় তলব করিল। সেই যাত্রায় বিস্তর মিথ্যা কথা বলিয়া রক্ষা পাইলেও দুশ্চিন্তায় পড়িয়া গেলো। বারবার আল্লাহ বাঁচাইয়া দিবেন না। কিছু একটা করা দরকার। সবার পরামর্শে সে মেম বুড়ির সাথে তাহার বাড়িতে থাকিতে লাগিল। ইহাতে আর এক গোল বাধিল। সংসারের বিস্তর খরচাই বাড়ি ভাড়া, বিল আজকাল তাহাকে বহন করিতে হয়। তাহার ওপর আছে মেম বুড়ির মদ, সিগারেট, দামি ফল, মাংসের খরচা। শুধু তাহাই নহে মেমবুড়ি ঘরের কুটোটিও নাড়তে চায় না, রান্না হইতে শুরু করিয়া পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার যাবতীয় গৃহস্থালী কাজও তাহাকেই করিতে হয়। নইলে মেম এমন অকথ্য জার্মান ভাষায় গালাগালি শুরু করেন চিৎকার করিয়া যে ঘরে টেকাই দায় হইয়া পড়ে। হাড় কালা করিয়া খাটিয়া যাহা রোজগার করিতো আজকাল মেমবুড়ির চাহিদা মিটাইতে তাহাও সুড়সুড় করিয়া বাহির হইয়া যাইতো। বারবার সে তাহার অভীষ্ট লক্ষ্য হইতে দূরে সরিয়া বা পড়িয়া যাইতে লাগিল। ঐদিকে বাড়ি হইতে পিতার নিদারুন তাগাদা ঋন শোধ করিবার জন্যে। চৌধুরী আলম কাহাকেও কিছু কইতে পারে না, সইতেও পারে না। নিদারুন মানসিক পীড়নের মধ্যে তাহার কালাতিপাত হইতে লাগল। কি করিবে উপায় না দেখিয়া সে, সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেট খাওয়া, আফটার শেভ ব্যবহার করা, সস্তার জামা কাপড় পড়া ইত্যাদি শুরু করিয়া দিলো। ইহা করিয়া যে কয়টা পয়সা সে বাঁচাইতে পারে। এইভাবে বছর পাঁচেক সময় লাগিল তাহার ঘরে বাইরে সমস্ত দেনা শোধ করিতে। এবার কিছু নতুন ধানী জমি কেনাতে হাত দিবে মনস্থ করিয়া বাবাকে পত্র দিল। প্রত্যুত্তরে তাহার পিতা জানাইলেন, ছোট বোন সেয়ানা হইয়া গেছে, জমি কেনার চাইতেও তাহার বিবাহ দেয়া অতীব জরুরী। হাতে একখানা সুপাত্র আছে, সে টাকার বন্দোবস্ত করিলেই তিনি শুভকাজে হাত দিতে পারেন। চৌধুরী আলম শুধু সম্মতিই দিল না, সমস্ত বন্দোবস্ত সহকারে পিতাকে বারংবার বলিয়া দিল, বিবাহ এমনভাবে সম্পন্ন করিতে হইবে যেনো সবাই বুঝিতে পারে চৌধুরী বংশের মেয়ের বিবাহ হইতেছে, জার্মান প্রবাসী চৌধুরী আলমের ভগ্নীর বিবাহ হইতেছে

সবার সম্মতিনুসারে বিরাট ধূমধামের মধ্যে দিয়া ভগ্নীর বিবাহ হইয়া গেলো। সোনা গহনা, ফার্নিচার, খাওয়া দাওয়ার সমস্ত খরচ মিটাইতে চৌধুরী আলমের সে বছরের পুরা রোজগার চলিয়া গেলো। চৌধুরী আলম আস্তে আস্তে খেয়াল করিতে লাগিল টাকা উপার্জন সে করে বটে কিন্তু দেশ হইতে বাবা মা, ভাই, বোন, বোনের জামাইরা কি করিয়া তাহার টাকা খরচ হইবে তাহা আগেই প্ল্যান করিয়া ফেলে। তাহার ইচ্ছা বা স্বাধীনতার কিংবা মতামতের মূল্য সেখানে খুবই সামান্য। চিঠিতে তাহার স্বাস্থ্য, শরীর, মন, ঈদে সে কি খাইয়াছে কিংবা কি করিয়াছে এধরনের শারীরিক মানসিক অবস্থার খোঁজ খবর নেয়া আজকাল প্রায়ই নাইয়ের কোটায় গিয়া ঠেকিয়াছে। বরং চিঠি জুড়িয়া আজকাল বিশদভাবে লিখা থাকে আরো কিছু টাকা হইলে আরো কিছু আরামের রসদ কিনিয়া তাহারা হয়তো আরো একটু আনন্দ করিয়া থাকিতে পারিতো। সে কবে দেশে আসিতে পারিবে, আদৌ আসিতে পারিবে কি না, সে খোঁজটুকুও সেইভাবে আজকাল আর কেউ নেয় না। প্রতিটি চিঠিতে সে এই লাইনটি খুঁজিয়া বেড়ায়, তোমাকে দেখিতে ইচ্ছা করিতেছে, তুমি কবে বাড়ি আসিবে। কিন্তু লাইনটির সাক্ষাত আজকাল আর মিলে না। মা নিজে পত্র লিখিতে পারেন না, ইহাকে তাহাকে ধরিয়া লিখান, মা হয়তো বলেন লিখিতে, কিন্তু যাহা্রা লেখেন, তাহারা লেখেন না বা লেখাটা দরকারী মনে করে না। এইভাবে আশা নিরাশায় দিন কাটিয়া রাত্রি আসে। রাত্রি কাটিয়া ভোর হয়।

এখন চৌধুরী আলম ভুল উচ্চারণে হইলেও বেশ কাজ চলিয়া যাইবার মতো জার্মান বলিতে পারেন। বন্ধুরা বেশ গাড়ি হাকিয়া বেড়ায়। তাহারও বহুদিনের শখ, একটু গাড়ি চালাইয়া দাপাইয়া বেড়াইবে। আস্তে আস্তে ড্রাইভিং এর কোর্স করিয়া নিয়া তিন চারবার অকৃতকার্য হওয়ার পর ডয়েচ ড্রাইভিং লাইসেন্সও হাসিল করিলেন। মনের আনন্দ আর মনে থাকিতে চায় না। প্রায় গাড়ি হাকাইয়া এই সিটি ঐ সিটি চলিয়া যান। পুরনো বন্ধু বান্ধবের সহিত সাক্ষাত করেন, খোঁজ খবর করেন। বুড়ি মেমকেও হাত করিবার রাস্তা সে খুঁজিয়া পাইয়াছে। আগেরমতো সব এতো দুর্বিসহ লাগে না। কিছুটা সহিয়া আসিয়াছে।

হাতে কিছু পয়সা জমিয়াছে, সাথে শরীরে কিছু মেদ। আর সপ্তাহে সাতদিন জানে খাটিতে ইচ্ছে করে না। তাই কিছু ভাল কাপড় চোপড়ও খরিদ করিলেন। মাঝে সাঝেই ক্যামেরায় নিজের ছবি তুলিয়া নিজেই মুগ্ধ নয়নে নিজের দিকে তাকাইয়া থাকেন। হাতে কাগজ আসিলেই প্রথমে যে জিনিসটি তিনি করিবেন তাহা হইলো দেশে গিয়া একটি সুকন্যা দেখিয়া বিবাহ। মেম বুড়ির সাথে ইহা নিয়া মাঝে মাঝে আলোচনাও করেন। মেমবুড়ির সুবাদে এখানেও তাহার কিছু এদেশী বান্ধবী আছে, তাহাদের সাথে সময় সুযোগমতো মেলামেশা করেন তিনি। কিন্তু বিবাহের একান্ত আশা আর্দশ বাংগালী রমনীকেই। জার্মান মেয়েরা যে খারাপ তাহা নহে, বরং অনেকদিকে হয়তো দেশি মেয়েদের থাকিয়াও ভাল। কিন্তু মুসলমান না, কলেমা জানে না, পর্দা করে না এগুলো আসলে সব বিরাট সমস্যা। এভাবেই প্রায় আট বছর তাহার কাটিয়া গেলো একাকী সুদূর প্রবাসে। আট বছর পর পুলিশের কাছ হইতে বহু কাংখিত সেই চিঠি আসিয়া হাজির হইল, যাহাতে লেখা আজ হইতে তাহাকে জার্মান দেশে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেয়া হইলো। সে এখন চাহিলে এই দেশের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করিতে পারে। এই আনন্দে দিশেহারা হইয়া চৌধুরী আলম প্রথমে জার্মানের বাঙ্গালী মসজিদে বিরাট আয়োজন করিয়া মিলাদ পড়াইল। যথাসময়ে কাগজপত্র জমা দিয়া নাগরিকত্বের আবেদন করিয়া দিয়া দেশে আসার যোগাড়যন্ত্রে মন দিল। বহুদিন কাটিয়া গেলো অনাথের মতো প্রবাসে, এইবার তাহাকে রুখিবে কে?

পিতাকে ফোন করিয়া এই সুসংবাদ জানাইয়া টেলিফোনে মাকে চাইলো। মা শুনিয়ে যারপর নাই খুশী হইলেন, আল্লাহর দরবারে সিন্নী মানত করা ছিল তাহাও সামনের জুম্মাবারেই মসজিদে পৌঁছাইয়া দিবেন বলিলেন। এবার লজ্জা লজ্জা গলায় চৌধুরী আলম কহিলেন, বিবাহের বয়সতো তাহার প্রায় যায় যায়। তাহার জন্যে একখানা সুন্দরী, গুনী পাত্রীর সন্ধান করিয়া রাখিতে, আসিয়া এইবার এই শুভকাজও সে সমাধা করিয়া যাইতে চায়। বিস্তর টাকা পয়সা সে বাড়িতে পাঠাইয়াছে, ধুমধাম করিয়া বিবাহ করিবে, বাবাকে বলিয়া সব আয়োজন যেনো মা করিয়া রাখেন। এইখানে বাঁধলো গোল। বাবার কানে কথা মা পৌঁছাইয়া দিলেন। বাবা কহিলেন বিবাহ করিবে ঠিকাছে। কিন্তু টাকাপয়সাতো তিনার হাতে নাই। সমস্ত টাকা তিনি ব্যবসা, জমিতে লাগাইয়া ফেলিয়াছেন। বিবাহের খরচ তাহাকেই যোগাইয়া আনিতে হইবে। তিনার দ্বারা সম্ভব না। চৌধুরী আলম ইহা শুনিবা মাত্র প্রায় মূর্ছা যায় যায় অবস্থা। এই দশ বছরে তাহার সঞ্চয় বলিতে কিছুই নাই। যাহা আয় করিয়াছিল নিজের কাছে এক কড়িও না রাখিয়া সমস্তই পিতার কাছে পাঠাইয়া দিয়াছিল সরল বিশ্বাসে। আজ তার এই প্রতিদান। তাহার হৃদয় চূর্ণ বিচূর্ন হইয়া গেলো। সে পণ করিলো ঠিকাছে নিজের দায়িত্ব নিজেই লইয়া সে দেশে গমন করিবে। দ্বিগুন উৎসাহে ঝাপাইয়া পড়িয়া সে কাজে লাগিল আর প্রতিটি সেন্ট সে নিজের কাছে রাখিয়া দিল। এখন থেকে টাকাই তাহার বাবা – ভাই – বন্ধু আপনজন। টাকা দিয়া সে কাহাকেও আর বিশ্বাস করিতে রাজি না। বাড়িতে চিঠি লেখা, ফোন করা ইত্যাদি যোগাযোগ তাহার কিঞ্চিত কমিয়া গেলো। মাসে মাসে আগের মতো মানিঅর্ডার না পাইয়া বাবা ভাই ভগ্নীপতি তাহার প্রতি বেশ রুষ্ট হইলেন। অবশেষে পকেটভর্তি জার্মান মার্ক নিয়া প্রায় তের বছর পর এক সকালে সে প্রথমবারের মতো স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলো।

অনেক অনেক বছর পরে দেশে আসিয়া বিমানবন্দরে আপনজনদেরকে দেখিয়া প্রথমে বাকরুদ্ধ হইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। বাবা আরো কতো বুড়িয়ে গেছেন, মাকেও কেমন যেনো কাহিল লাগছে। ছোট বোনটাকে এইটুকু দেখিয়া গিয়াছিল, তাহার বাচ্চা পায়ে পায়ে কাছে আসিয়া তাহাকে মামা বলিয়া জড়াইয়া ধরিল। বিমানবন্দর হইতে মাইক্রোবাস রিজার্ভ করিয়া সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইল, বাকি কুশলাদি কথাবার্তা পথে যাইতে যাইতে হইবে। প্রথম কয়েকদিন চলিল সবার আনাগোনা, কুশল বিনিময়, দেখা সাক্ষাত পালা, উপহার বিনিময়পালা। একটা ঘোরের মধ্যে চৌধুরী আলমের প্রথম কিছুদিন কাটিয়া গেলো। যখন তাহার কানে উপহার সম্বনীয় কিছু অসন্তোষ আসিতে লাগিল তখন আস্তে আস্তে তাহার ঘোর কাটিতে আরম্ভ করিল। সে একা উপার্জন দিয়া পরিবারের সবার জন্যে উপহার কিনিতে হইলে এমনিতেই তাহার জন্যে অনেক, এরমধ্যে তাহার টিকিট, বিয়ের খরচ, টুকটাক সংসারের অন্যান্য খরচতো আছেই। চৌধুরী আলমের মনে অনেক আশা ছিল তাহার পরিজন তাহাকে এতোদিন পর কাছে পাইয়া, শুধু তাহাকেই ভালবাসিবে, সেই মূখ্য হইবে, উপহার হইবে গন্যভালবাসার কাছে উপহার কি বস্তুর নাম? কিন্তু বাস্তবে উলটা ঘটিয়া গেলো। এতো খরচা করিয়া, সাধ করিয়া, যে ছোট বোনের বিবাহ সে দিল, তাহার স্বামীর জন্যে সে কোট নিয়া আসিয়াছিল জার্মান হইতে। প্রথম দেখিবে ছোটবোনের স্বামী বলিয়া কথা। কাঁদো কাঁদো মুখে, সে কোট তাহার ছোটবোন ফেরত লইয়া আসিল। কহিল, এই কোটের জন্যে সে স্বামী ও শ্বশুর বাড়িতে বিস্তর অপমানিত হইয়াছে। তাহারা গরীব বলিয়া ঠিক ততো গরীব না যাহা তাহার ভাইজান ভাবিয়াছে। দুই চারিটা ভালো কাপড় চোপড় কোট প্যান্ট তাহাদেরও আছে। এই ধরনের সস্তা কমদামী জিনিস দিয়া তাহাদের না অপমান করিয়া বরং কিছু না দিলেই তাহাদের তাহারা খুশী থাকিতো। চৌধুরী আলম টাশকিত হইয়া নিশ্চুপ হইয়া গেলেন, আশি মার্কের কোট তিনি নিজে কোনদিন পরিধান করেননিদশ মার্কের ওপরে কোন কাপড়ই তিনি নিজের জন্যে প্রথমাবস্থায় কিনেন নাইসেই জায়গায় আশিটি মার্ক খরচ করিয়া কেনা কোটে লোকে অপমানিত হইয়া গেলো। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। সে কোন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না। কি করিয়া সে বিদেশে উপার্জন করে তাহাও কেউ তাহার কাছে জানতে চায় নাইকি চাকুরী করিলে কতো টাকা রোজগার তাহা জানার প্রতিও কারো আগ্রহ নাই। সবাই ব্যস্ত তাহার কাছ হইতে কতো খসানো যায় সেই চিন্তায়।


Monday, 1 October 2012

কাশফুলের ফটোওয়াকে একদিন




আমাদের এবিবাসীদের হুজুগের অভাব নাই। যাকে বলে উঠল বাইতো কটক যাই। কয়দিন পিকনিকতো কয়দিন টাঙ্গুয়া, এরপর ব্লুমুন ট্যুর। বার মাসে চব্বিশ পার্বন। বর্ষা যেতেই শরৎ এর আগমন। আর শরৎ মানেই স্নিগ্ধ মেঘমুক্ত আকাশ, দুর্গাপূজার কাঁসা আর ঢাকের বাজনার সাথে বোনাস হলো শ্বেত শুভ্র কাশফুল। এবি ভর্তি ফটুরে সেটা আজ আর কে না জানে। দিনরাত তারা স্কেল কম্পাস দিয়ে ফোকাস মেপে মেপে ফিজিক্স পড়ে যাচ্ছে। বর্ষার ছবির উৎসব শেষ এখন শরতের পালা। তাই আঠাশে সেপ্টেম্বর, রোজ শুক্রবার বেলা তিনটায় এই ফটোওয়াকের আয়োজন, স্থান আফতাবনগর। যা হয়, ফটোগ্রাফার প্রচুর কিন্তু মডেলের অভাব। আর যে সে মডেল হলে হবে না, বেঁকা হয়ে, কাঁত হয়ে পোজ দিতে পারে এমনসব মডেল হতে হবে। কয়েকজন একাব্যাকা স্পেশালিষ্টকে অনেক তেল মেখে রাজী করানো হলো মডেলিং এর জন্যে। এর মাঝে আবার রিদওয়ান ঘোষনা দিয়ে দিল, ওর আন্ডার টুয়েন্টি মডেল লাগবে। টুয়েন্টি প্লাস মডেল আর কাশফুল নাকি ব্যাড কম্বিনেশন। মোটেই কেউ রাজি হয় না তার আবার টুয়েন্টি, হুহ।

কিন্তু এরপরে বাঁধলো আর এক গোল। সবুজ গাছ, সাদা ফুল, নীল আকাশের কম্বিনেশনের সাথে তাদের চাই লালশাড়ি পরা মডেল। মডেল হতে রাজী হলেও শাড়ি পড়তে অনেকেই রাজী না। আর লাল শাড়িতো কাভি নেহি টাইপ অবস্থা। এদিকে মেয়ে ফটুরেরাও ছেলে মডেলদের ড্রেসকোড দিয়ে দিলো। নীল পরী আসবে না এই শোকে মনজুর ভাই কালো শার্ট পরে আসবেন বলে ব্রত নিলেন। জেবীন বললো ঠিকাছে কালো শার্টের ওপর নীল ফুল পরে সবাইকে নীল পরীর প্রক্সি দিবেন বলে আপনি আমাদের কথা দিলেন। এসব গোল সামলানোর মধ্যে সাঈদ ভাই, ইভু, আমাকে ধরল, আপা আপনাকে আসতেই হবে, নইলে কিছুতেই চলবে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি এসে করবোটা কি? না জানি ফটোগ্রাফী না জানি মডেলিং। সাঈদ ভাই বললো, এই যে আমরা পাঁচ মিনিট পর পর সবাই তর্ক লেগে যাই, এটা সামলাতে আপনার দরকার। আপা প্লীজ না করবেন না, আপনাকে নাহয় আমরা সবাই একটা শাড়ি স্পন্সর করবো। আমি বললাম, শাড়ি না বরং কনকর্ডের একটা টিকিট স্পন্সর করেন। বৃহস্প্রতিবার অফিস করে রওয়ানা দিবো আবার শনিবার বিকেলের মধ্যে এসে পৌঁছতে হবে, কনকর্ড ছাড়াতো গতি নেই। সাঈদ ভাইকে আমরা সবাই চিনি, রুমাল কেটে টুপি বানানোর লোক উনি, এমনিতেই মাথায় তার চুল কম, তারপরেও যা অবশিষ্ট ছিল, তা ধরেই এমন হ্যাঁচকা দিল যে, সামনে ওনার দোকা হওয়ার যে কিঞ্চিত সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল তাহাতে আরো একমুঠো ধূলা পড়ে গেলো।

আমি মন খারাপ করে যখন আসার পরিকল্পনা প্রায় বাদই দিয়ে দিচ্ছিলাম, যখন মেসবাব দাদাভাই বললেন, তিনি নতুন চাকরী উপলক্ষ্যে ফটুরে দলের সবাইকে ট্রিট দিবেন তখন আর কনকর্ডের টিকিট না কিনে থাকা গেলো না। দাদাভাইয়ের আত্মার কথা কে না জানে। এই ট্রীট মিস করা যায়। যাহোক ওনাদের অবস্থা দেখে শেষে আমাকে শাড়িতেই রফা করতে হলো। বললো, আপা আপনার জন্যেও লাল শাড়িই কিনবো। আমি আৎকে উঠে বললাম, না না, আমার হুজুরের নিষেধ আছে, লাল পরতে পারবো না। এবার সাঈদ ভাই অন্যনোপায় হয়ে বললেন, ঠিকাছে আপনার যে রঙ ইচ্ছা। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি কিছু দূ সামনে এগোলেই একটা বেইলী ব্রিজ, সেখানেই আমরা সকলে উপস্থিত থাকবো, অবশ্যই যথা সময়ে এই কথা ঠিক হলো। শুক্রবার দুপুরে একদল পাখির কিচির মিচিরে বেইলী বিজ্র যখন প্রকম্পিত, তখন দাদাভাই তার চিরাচরিত ধমক দিয়ে বললেন, সবার রিকশা ঠিক করা আছে, যাও উঠে পড়ো। কিন্তু জেবীন, জয়িতা আর ফারজানা তখনো এসে পৌঁছেনি। এক ঘন্টা ধরে যতোই জিজ্ঞেস করছি কই তোরা, তারা বলে যাচ্ছে, এসে গেছি আর পাঁচ মিনিট। তখন ওদেরকে রেখেই সামনে এগোনো ঠিক হলো।

যখন সবাই শুধু রিক্সাতে উঠতে যাবো তখন মায়াবতী বলে উঠল, যাচ্ছি যে সবাই কিন্তু ওখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভেবেছেন? আমার কয়েকজন বন্ধু বান্ধব কদিন আগেই ওখান থেকে ছিনতাইকারীর কবলে পরে সর্বস্ব হারিয়ে শুধু ইজ্জত নিয়ে ফিরে এসেছে। সবাই ভাবনায় পড়ে গেলো। মায়াবতী মানুষটা ছোট হলেও কথাটা বড় বলেছে। দলের একজন টিমটিম কন্ঠে বললো, সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। অন্যেরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল কিভাবে? বললো, মখা আলমগীর তার দুসম্পর্কের দাদার ফুপার নানার জ্যাঠার শালার মামার অনেক কাছের আত্মীয়। সবাই নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম এই ভেবে, “বাগাল ম্যায় ছোড়া শাহার ম্যায় ঢেন্ডোরা”। তাড়াতাড়ি মখাকে ফোন দেয়া হলে ওনি বললেন, দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে টপ অবস্থায় আছে, আপনারা নিশ্চিন্তে যেয়ে ঝুলে পড়েন, আমিতো আছি। ফোনটা স্পীকারে দেয়া আছে, সবাই শুনতে পাচ্ছে। পাশ থেকে একজন চিঁচিঁ করে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল না মানে যদি ঠ্যাক পার্টি ধরে। মখা অম্লান বদনে বললেন, ধরলে জিজ্ঞেস করবেন, কোন দল করে? ছাত্রলীগ হলে অবশ্যই সাথে যা আছে তা নজরানা দিয়ে দিবেন, বিনাবাক্যে। তারা আমাদের ত্রানকর্তা, তাদের দিকে লক্ষ্য রাখা আমাদের একটা কর্তব্য না? চিঁচিঁ আরো শুকনো গলায় বলে উঠল, জ্বী তাতো বটেই, তাতো বটেই। মখা তখন গলাকে আরো হেড়ে করে বললেন, আর অন্যদল হলে চোর সন্দেহে পিটাইয়া ঐখানেই খেইল খতম করে দিবেন। আপনারা অনেকেইতো আছেন এখন একসাথে , দেশকে শত্রুমুক্ত রাখতে হবে।

আমর আর কি বলবো, জ্বী আচ্ছা সালাম বলে ফোন রাখতে গেলে তিনি একটু আমতা আমতা গলায় বললেন, ইয়ে মানে সব যে বের হইছেন, বাসা ঠিক করে তালা বন্ধ করছেনতো? আমরা সমস্বরে বললাম, জ্বী স্যার, একেবারে খাঁটি সাহারা তালা লাগিয়ে বন্ধ করে এসেছি। তিনি এই শুনে উৎফুল্ল গলায় বললেন, তাহলে সবাই ইয়া মুকাদ্দেমু ইয়া মুকাদ্দেমু করে পা বাড়ান, ওপরে আল্লাহ নীচে মখা। বেডরুমে কিছু হলে আমার দায় না, কিন্তু কাশবনে কিছু হলে সেটা আমি দেখবো। দরকার হলে এটিনের মাহফুজরে আবার বিবৃতি দিতে ডেকে আনবোযান ভাই সকলেরা আমার ওপর ভরসা রেখে আনন্দ ফুর্তি করতে যান।

এরপর আমরা বেইলী ব্রিজ প্রকম্পিত করে ইয়া মুকাদ্দেমু ইয়া মুকাদ্দেমু করে আফতাব নগরে যাওয়ার জন্যে রিকশায় চড়লাম। মেঘ বুঝতে না পেরে আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে, কাকে ডাকছো আম্মি, কেনো চিৎকার করছো? আমি একটা বোকা হাসি দিলাম, কারণ উত্তর আমিও জানি না। ওখানে যেয়ে কাশবনের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো সবার হুটোপুটি। শুভ ক্যামেরা নিয়ে ভাবের বিষয় খুঁজতে লাগলো। কোন ভাবই তার মনেরমতো ভাব হয় না। ম্যাক ভাই আবার সবকিছুতেই ভাব দেখতে পান। তিনি রিলাক্স শাটার টিপছেন। তারেকুল ভাই চাইছেন তার আইফোনগ্রাফী দিয়ে পাপ্পারাজি স্টাইলে সুন্দরী ললনাদের দুর্লভ মুহুর্তের কিছু হাস্যময় ছবি বন্দী করে রাখতেগ্রুপে যেহেতু আগেই “কাশফুলের নরম ছোয়া” বিখ্যাত লাইনটি আলোচনা হয়ে গেছে, তাই কোন মেয়েই কাশফুলের খুব কাছে যেতে চাইছিলো না, কি মুশকিল। তারপরও ভাইজান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারেক ভাইয়ের সর্তক চোখ আর হাতের ফোন ক্যামেরা ছাড়াই ফটোগ্রাফারদের ভাত মেরে দেয়ার জন্যে যথেষ্ঠ।

টুটুল ভাই কোন দিকে শাটার তাক করছে তার দিকে শ্যান দৃষ্টি রাখছে নাজ। মনজুর ভাই, মুখ কালো করে বার বার তার কালো নীল শার্ট এর হাত বুলাচ্ছেন আর নীল পরীকে এসএমএস করে প্রতি মূহুর্তের আপডেট দিচ্ছেন। জেবীন, জয়িতা, ফারজানা মানে সুন্দরী কুমারী এবি টিম এসে তখন সেখানে পৌঁছলেন। বেলা তখন সাড়ে পাঁচটা। তাদের দেখে অবশ্য বোঝা গেলো দেরীর রহস্য। যে পরিমান ডলা পোচা করেছেন এক একজন, জলিল ভাইয়ের ভাষায় বলতে গেলে, ইট টেকস টাইম ম্যান। জেবীন এসেই ক্যামেরা নিয়ে শাটার টিপায় ঝাপিয়ে পড়লো। মেসবাহ ভাইয়ের হলুদ ফতুয়ার কম্বিনেশন যে সবুজের সাথে এতো ভাল আসবে তা জেবীন বুঝতেই পারে নাই প্রথমে। মৌসুমের মুড অফ, ক্যামেরা বন্ধ করে বসে আছে। শওকত মাসুম ভাই আসবে বলেও শেষ মূহুর্তে আসতে পারেলন না, ওনাকে দেশ টিভিতে যেতে হবে, হলমার্ক কেলেঙ্কারীর পোষ্টমর্টেম করতে। তাই তিনি ফেসবুকে আপডেট দিলেন, “কাশফুল দেখতে যায় মাইনষে”, ঘরে বসে দেশ টিভি দেখেন, একথাটা অবশ্য উহ্য ছিল, লিখেন নাই।

কোরিয়া রাসেল ফটোওয়াক শুনে যারপর নাই আনন্দিত হয়েছিল। ভেবেছিল এ সুযোগে তার মিষ্টি বউয়ের মডেল মার্কা কয়েকটা ফটো তুলে ফেসবুকে আপলোড করবে। এ আশায় রোজ টিস্যু দিয়ে ঘষে ঘষে ক্যামেরার লেন্স পরিস্কার করছিল। রোমান্টিকতায় আপ্লুত হয়ে বউকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিল আগের দিন। আর যায় কোথায়? রাত থেকেই শুরু হলো ধুম জ্বর। মাথা তুলতে পারছে না আর ফটোওয়াকে যাবে কি? তাই রাগে দুঃখে ক্যাম ধরে জোরে জোরে আছার দিল ভাঙ্গার জন্যে। জ্বরের ঘোর আর রাগের তোড় কমলে দেখা গেলো, চৌকি ভেবে যেখানে সে জোরে জোরে ক্যাম আছাড় দিয়েছিলো, আসলে সেটা ছিল তার মিষ্টি বউয়ের মাথা। ক্যাম ভেঙ্গেছে কম কিন্তু মাথা ভেঙ্গেছে অনেক বেশি। এ দেখে মাথা ঘুরে আবার বিছানায় ধপাস। শেষ মুহুর্তে পায়ে জুতা গলানোর সময় সাঈদ ভাইয়ের ডান পাটা ঝিমঝিম করে উঠল তাই সাঈদ ভাই একটু দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন। হাতে একটা কয়েন নিয়ে টস করলেন, হেড না টেল। টস এর রেজাল্ট বিপক্ষে যাওয়াতে, যাবেন না বলেই ঠিক করে ইস্ত্রি করা শার্ট খুলে রেখে দিয়ে ইভুকে ফোন দিলেন। মিরপুরবাসীর নেতা সাঈদ ভাই যাবেন না, তাই ইভু আর আনন্দবাবুও না যাওয়াই স্থির করলো। আর আমার শাড়ির আশায়ও জলাঞ্জলি হলো।

জয়িতা লাল জামা পরে ঘুরে ঘুরে মনের আনন্দে পোজ দিচ্ছে আর এফবিতে স্ট্যাটাস আপডেট করে যাচ্ছে। ঋহান ফুপ্পীর কান্ড দেখে হাসছে আর জামা টানাটানি করে খেলে যাচ্ছে। শর্মি এতোক্ষণ মৌসুমের মুড ঠিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে নিজেই এদিক সেদিক ক্লিক করতে লাগল। কাশফুলের ওপর কতোক্ষণ নিজের চটি, নিজের পলিশ করা বুড়ো আঙ্গুল ইত্যাদি রেখে ইন্টেলেকচুয়াল ফটোগ্রাফী ট্রাই করে যাচ্ছে। রেজওয়ান আর রনি এজ ইউজুয়াল একা একা ভাবুক ভাব ধরে দিনের শ্রেষ্ঠতম ফটোখানা তোলার চেষ্টায় মনপ্রাণ চোখ ক্যাম সব নিয়োজিত করে দিলো। যদিও তারা ভাব ধরে রাখে ক্যাম বাদে পৃথিবীর সর্ব ব্যাপারে তার অনাগ্রহী, কিন্তু আসল খবরতো অন্য। হিনা বিলওয়ালের প্রেম থেকে সানি লিওনের বাড়ি ভাড়ার সমস্যাসহ সর্ব দুঃখ তারা সমানভাবে ফেসবুকে শেয়ার করে। নূপুর এর মুখ ব্যাকা, চোখ ব্যাকা করে পোজ দেয়ার কান্ড দেখে নিধিপরীটা হা হয়ে গেছে। সুন্দরী মায়ের একি ভীমরতি। নিধিপরীটা জানে মা ছবি তুলতে খুবই ভালবাসে, সেজেগুজে ছবি তোলা মায়ের প্রধান হবি কিন্তু তাই বলে কি এইই!!

ফারজানা বহুদিন পর ওটির বাইরে তাজা বাতাসে শ্বাস নিতে পেরে মহাখুশী। কাশফুলে তার হুটোপুটি দেখে মেঘ, ঋহান আর নিধিপরী হাসতে লাগলো আর লাজুক চোখে এর ওর পানে চাইছিলো। মাঞ্জা যা মেরেছে সেদিকে আর না যাই। কে যে বলেছিল এই মেয়েকে মেডিক্যাল পড়তে, প্রতিভার অপচয়, এরতো নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। লাজুক লাজুক মুখ করে জেবীনের পিছনে পিছনে ঘুরে ঘুরে নানা ভঙ্গীমায় ঢঙ্গী ঢঙ্গী সব ফটো তুলে যাচ্ছিল। যার বার বলে যাচ্ছিল, ওহ কি গরম, মেকাপতো পুরোই নষ্ট হয়ে গেলো। নওরোজ সারাক্ষণ গেয়ে যাচ্ছিল, “এই কাশের বনে লাগলো দোল, তোরা সবাই টিভি খোল টিভি খোল”। স্বর্না মোবাইলের ভিডিও অন করে কাশফুলের মাঝে নওরোজের সচিত্র গান রের্কড করে চললো। বেচারী মেয়েটা এতো সুন্দর করে সেজে এলো, ভাবলো নওরোজ তার কিছু এক্সক্লুসিভ ফটো তুলবে, উলটো তাকেই নওরোজের গান রের্কড করতে হচ্ছে। তবুও ভাবছে থাক, প্রাণ ভরে আজ গান গাক। ছেলেটা এতো গান গাইতে পাগল কিন্তু কোন সুযোগই পায় না, আজকে খোলা আকাশের নীচে সুযোগ পেয়েছে, মন ভরে গেয়ে নিক। হাসান মুর্শেদ ভাই ছেলে লাজুক হলেও মানুষ ভালো। নিরিবিলি তার ক্যাম নিয়ে ক্লিক ক্লিক করছেন আর বার বার ভিউতে চেক করছেন শ্যুট মনের মতো হচ্ছেতো। একাত্তরের রাজাকার বাহিনী বেড়ে এই চল্লিশ বছরে পাঁচগুন বেশি হয়েছে। যার মধ্যে ছদ্মবেশী রাজাকারদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে এরা। এদের কারণে হাসান ভাইয়ের মন অনেক বিক্ষিপ্ত থাকে। মন দিয়ে লেখালেখি ফটোশ্যুট অনেক সময়ই করতে পারেন না। ভাবেন পাখির ছবি তুলবেন, শেষে দেখা যায় মাছের ছবি তুলে বসে আছেন। তাই আজকাল ভিউই ভরসা।

কাছেই কোথায় যেন ঘুড়ি উৎসব হওয়ার কথা। আমরা সেদিকটা খুঁজছি, উৎসব দেখতে যাবো এরমধ্যেই হঠাৎ টিপটিপ বৃষ্টি। অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন না। দৌড়ে যেয়ে যার যার রিক্সায় উঠে পড়লেন অনেকে। মেসবাহ ভাই সবাইকে জানালেন, আজকের মতো এবছরের মতো ফটোওয়াক এখানেই শেষ। বিকেলও শেষ হয়ে আসছিলো সাথে আবার যোগ হলো বৃষ্টি। ফটুরে যারা বৃষ্টিভেজা কাশফুলের ফটো তুলতে চায় তুলুক, অন্যেরা সবাই যেন পূর্ব নির্ধারিত রেষ্টুরেন্টে চলে যায়, সেখানে এখন শুরু হবে স্পেশাল চাকরী ট্রীট। আমরা সবাই হই হই করে ছুটলাম রেষ্টুরেন্টে। টুটুল ভাই গম্ভীর মুখ করে সবকিছুর তদারকী করে যাচ্ছেন, তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। ইচ্ছেমতো সবাই কাবাব লুচি কোক আইসক্রীম খেতে খেতে প্রজেক্টারে সবার তোলা ছবিগুলো সবাই দেখলাম। খাবার খেয়ে সবাই দাদাভাইয়ের উজ্জল ভবিষ্যত আর সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। এমন সময় এলো স্পেশাল মধু দেয়া চা। আমরা মধু হই হই চা খাওয়াইলা গান গাইতে গাইতে যার যার গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলাম। 

ইহা যারপর নাই একটি নিদারুন সত্য ঘটনা, এখানে কল্পনার আশ্রয় খুঁজে বের করা দুষ্ট মনের একটি কুটিল ও বৃথা চেষ্টা মাত্র


27.09.2012