ছোটবেলায় মুরগীর মাংস খুব পছন্দ ছিলো। বিশেষ করে মুরগীর রান, একটু বড় হতে হতে পছন্দ
বদলালো, তখন রানের বদলে বুকের জাহাজ টুকরোটা বেশি পছন্দ ছিলো। কিন্তু মুরগী যখন
জবাই করা হতো, কাছে পিঠে থাকলে, চোখে পরলে ছোট বেলায় খুব কষ্ট হতো। মুরগীটার গলা কেটে ছেড়ে দিলে, ছটফট করে লাফাতে লাফাতে
এদিক ওদিক পরতো তারপর এক সময় সব শেষ। আমি মনে মনে ভাবতাম, মুরগীটার আম্মু আছে
হয়তো, আব্বু আছে, ভাই বোন আছে, তারা নিশ্চয় খুঁজছে, বাবা মায়ের কথা শোনেনি, মুরগী
ধরার হাতে ধরা পরেছে, এখন ওকে আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, আমরা কেটে খেয়ে
ফেললাম, ওদের পরিবার ওকে খুঁজছে, কিছুই জানতে পারছে না।
যখন অনেকটা বড় হলাম, দুপুরের ভাত ঘুম থেকে উঠে বিকেলটা তেমন
কিছু করার থাকতো না কিংবা করতে ইচ্ছে করতো না। উদাস উদাস মন নিয়ে কখনো ছাঁদে যেয়ে
কিংবা বারান্দায় এদিকে ওদিকে হেঁটে বাকি সময়টা পার করে দিতাম। মাঝে মাঝেই সেই
সন্ধ্যা লাগো লাগো সময়ে বারান্দায় বসে বই পড়তাম। বাবা অনেক বাজার টাজার নিয়ে বাড়ি
ফিরে আসতেন। শুরু হতো নীচে মুরগী জবাইয়ের পালা। গৃহ কর্মে সাহায্য করতে যেসব
পুরুষকর্মীরা ছিলেন তারা নীচে মুরগী জবাই করতেন, একটার পর একটা। কিন্তু ততো দিনে
চোখ এবং মন দুইই রক্তে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, কষ্ট লাগতো না। নেহাত আজাইরা বসে
থাকতাম বলেই, বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীচের মুরগী জবাই এর দিকে তাকিয়ে
থাকতাম, দেখতাম। হয়তো সাথে ভাবতামও কোনটায় রোস্ট হবে আর কোনটায় কোর্মা।
গ্রামের বাড়িতে সবাই কোরবানীর ঈদ করতে যেতাম। পিকনিক আমেজ
পুরো পরিবার জুড়ে। কতোদিন আগে থেকে চাল গুঁড়ো করে, মসলা গুঁড়ো করে দাদু সেই
প্রস্তূতি নিতেন, সবাই বাড়ি আসবে। ঈদের ঠিক দু’ তিন দিন আগে হয়তো, মুরুব্বীরা বাড়ি
আসতেন তারপর গরু কেনা হতো। বাড়িতে বছর জুড়ে যারা থাকতো, কাজ কর্ম দেখতো তাদের
ওপরেই ভার পরতো গরু-ছাগল গুলো দেখাশোনা করার। আমরাও পাশে পাশে থাকতাম, ভাল লাগতো। “আমাদের
গরু” কী গর্বই না লাগতো। যদিও ছাগল বেশি কিউট লাগতো, হাতে ধরে ধরে কাঁঠাল পাতা
খাওয়াতাম আর গরুকে একটু ভয় পেতাম শিং দিয়ে গুঁতো দেবে, সেই ভয়। গরুর চোখ গুলোর
দিকে তাকালে মায়া লাগতো, আহা, কাঁদছে, বুঝতে পারছে যে ওকে আমরা কোরবানী করবো। তুঁতো
ভাইবোনেরা সেসব বলাবলিও করতাম।
ছোট বেলায় ঈদের নামাজ পরে এসে যখন গরু গুলোকে শুইয়ে ফেলার
ভীষণ যে প্রচেষ্টা শুরু হতো, কী কান্নাই পেতো, কী মায়াই না লাগতো। প্রাণ ভয়ে গরু
গুলো কত ভাবে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করতো, সেগুলোও আমাদের গল্পের খোরাক থাকতো
সারাদিন। কিন্তু তারপর বিরিয়ানি, নেহারী, ঝুড়া মাংসের আড়ালে সেই কান্না কান্না
গরুর চোখ হারিয়ে যেতো। বড় হয়ে তো গল্প আরো ভিন্ন, কার গরু কত দাম, কোন প্রজাতি
মানে কত কুলীন সেটাও একটা ইস্যু ছিলো। গরুর রক্ত আর চোখের জলে তখন আমাদের অনেকেরই
শরীর মন, অভ্যস্ত।
এদেশে রাস্তা ঘাটে কোথাও প্রকাশ্যে মুরগী, গরু কিছু কাটা হয়
না। সাধারণত হাটে মাছের মাথা কাটা হয় তাও বরফে ডুবানো থাকা মাছ। এদেশের মানুষ তাজা
রক্তের উষ্ণতার মধ্যে তার গন্ধের মধ্যে নৃংশসতা খুঁজে পায়। খুব কাতর গলায় জিজ্ঞেস
করে, এরকম রক্ত দেখে তোমরা স্বাভাবিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করতে পারো? তোমরা ঘুমাও কী
করে? ঘুম আসে? একজন মানুষের এতোটা রক্ত তো অন্যদের মানসিক ভারসাম্যহীন করে তোলার
কথা ......
আসলে আমরা মুরগী কাটা থেকে গরু কাটা তারপর মানুষ কাটায় এতো
নিরিবিলি পৌঁছে যাই যে আমাদের ভেতরের পাকিস্তানি আর্মির নৃংশসতা আমরা নিজেরাও
অনুভব করতে পারি না। রক্তের গন্ধে আমাদের দেহ,মন, চোখ এত অভ্যস্ত যে কয় সাগর রক্ত
পেরোলে এ আঁধার কাটবে, আমরা নিজেরাও জানি না আজ ...............হয়তো নিজেদের অজান্তেই
তালেবানী অভ্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করতে শুরু করে দিবো, আজ কয় জন, কোথায় কিংবা আজ হয়
নি! কারণ কী! ......
No comments:
Post a Comment