বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রয়াত লেখক ডঃ হুমায়ূন
আহমেদের লেখা “হিমু” উপন্যাসটা প্রথমে ভাল লাগলেও শেষের দিকে
আর সিরিজ গুলো পড়তে কোন আগ্রহ পেতাম না। একই রকম লাগতো অনেক সময় মজার পরিবর্তে
কিছুটা ছ্যাবলামোও মনে হতো। তবুও তাতে লেখা একটা বিষয় বারবার মাথায়
আসে। “হিমু”র বাবা হিমুকে (হিমালয়) মহামানব তৈরী করতে কিছু
পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন, বইটিতে বার বার ঘুরে ফিরে লেখক লিখেছিলেন। ট্রেনিং দিয়ে কী
মহামানব তৈরী করা যায়? আজকাল মনে হয়, মহা মানব তৈরী করা না
গেলেও হয়তো, মানুষ অনেকটাই বানানো যায়।
এদেশের
বাচ্চাদের কে প্লে স্কুল থেকে হাতে বানানো জিনিস এবং সেবা প্রদানের মাধ্যমে টাকা
অর্জন শেখানো হয়। স্কুলে জিনিস বানিয়ে, স্কুলেই বিক্রি করে, স্কুলেই সেই টাকা কোন
মহৎ কাজের জন্যে দান করা হয়। সেই দান বেশীর ভাগই সময়ই যায় তৃতীয় বিশ্বের কোন
দরিদ্র দেশের কোন সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে। চার বছর বয়স থেকেই তাদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি
সামাজিক কাজেও বাধ্যতামূলক ভাবে অংশ গ্রহন করতে হয়। বারো বছর বয়স থেকেই
শেখানো হয়, পড়াশোনা করছো ভাল কথা, সে তো নিজের জন্যে, মানুষের জন্যে, দেশের জন্যে, দশের জন্যেও কিছু করো। জানো, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। নিজের দেশে দরিদ্র, নিপীড়িত, সাহায্য প্রার্থী নেই তাহলে অন্য দেশে যাও
কিন্তু জীবনে সত্যি কিছু করো।
ক’দিন আগে আমাদের বাসার কাছের হাই স্কুলের পরিকল্পনা
জানলাম, পেরুতে বাড়ি বানাতে হবে, সেখানে অনেকের বাড়ি নেই। প্রথম ক্লাশ থেকে পঞ্চম
ক্লাশ পর্যন্ত সবাই সে জন্যে পয়সা যোগাড় করবে। ষষ্ঠ মানে ফাইন্যাল ক্লাশের
বাচ্চারা যাবে বাড়ি বানাতে। তারা সত্যি সত্যি ইট, কাঠ জোড়া দিয়ে, নিজেরা গায়ে গতরে
খেঁটে বাড়ি বানাবে সেখানকার দুস্থ গরীব লোকদের জন্যে। ফেসবুকে গ্রুপ বানিয়ে সেখানে
কর্মরত বাচ্চাদের ছবি, কাজের অগ্রগতি সব জানানো হচ্ছে ছবি দিয়ে, পোস্ট দিয়ে।
টাকা কীভাবে যোগাড় করবে? প্রত্যেক কে নিম্নে ত্রিশ ইউরো যোগাড় করতে হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সেটি শুরু করবে নিজের পকেট মানি দিয়ে। নিজের পকেট মানির
পর বাবা মা, আত্মীয়
স্বজন, প্রতিবেশী, চেনা জানার মধ্যে থেকে নিতে হবে। তার জন্যে ক্লাশে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, কেউ দিতে না চাইলে
তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না, তাকে বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিয়ে, মাথা নীচু
করে চলে আসতে হবে। টাকা দেয়া প্রত্যেকের ইচ্ছে, কাউকে জোর করা যাবে না। তারপর
গ্রুপ করে দেয়া হয়েছে ক্লাশ থেকে, স্কুলের সীমানা থেকে প্রত্যেকটি বাচ্চা একেক দলে
ভাগ হয়ে আট দশমিক এক কিলোমিটার হাঁটবে, এই পথের মধ্যে যত বাড়ি, পথচারী পরবে তাদের
কাছে তাদের পিগি ব্যাঙ্ক বাড়িয়ে ধরে সাহায্য চাইবে। স্কুলে যেয়ে পিগি ব্যাঙ্ক খুলে
টাকা গুনে দেখা হবে।
বারো থেকে আঠারো, প্রতি বছর তাদেরকে একবার এ ধরনের কিছু
করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও, এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি থাকবে, দরিদ্র,
নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে তুমি কী করেছো? যার কারণে দেখা যায়, মেধাবী সব ছেলে
মেয়েরা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের অনেক প্রকল্পে, উন্নয়নের কাজে নিজের মেধা আর
পরিশ্রম ব্যয় করছে। স্বার্থপরের মত শুধু নোট মুখস্থ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে, ভাল
চাকরি করে দামী গাড়ি হাঁকাবে এর নামই কী তবে মানব জীবন? সমাজের প্রতি, পৃথিবীর
প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেটাও জানতে হবে, শিখতে হবে না? কে সে
শেখাবে তা? হ্যাঁ রাষ্ট্র ... তার দায়িত্ব নিয়েছে।
মানুষ বানানোর মত আবার স্বার্থপর অমানুষও বানানো যায়।
আমাদের দেশের বাচ্চাদের ছোট থেকে শেখানো হয়, বাড়িতেও তোমার কোন কাজের দরকার নেই,
তুমি শুধু পড়বে আর রেজাল্ট ভাল করবে কারণ বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা রোজগার করতে
হবে। হয়তো বাড়িতেই সেই বাচ্চাটার সম বয়সী আর একটা বাচ্চা আছে যে তার সব কাজ করে
দিচ্ছে। সেই বাচ্চাটিকে অবহেলা করে নিজের কাজে ব্যবহার করতে সেই বয়স থেকেই তাকে
শেখানো হয়ে যায়। অন্যেকে টেক্কা দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার এই নিম্ন মনোবৃত্তি নিজ
পরিবার থেকেই বাচ্চারা প্রথম শেখে। কাউকে সাহায্য করবে না, খেলা ধূলা, গান বাজনা
ইত্যাদি করে সময় নষ্ট করা যাবে না। বি।সি।এস দিতে হবে, বিদেশ যেতে হবে, নিজের
ক্যারিয়ার, নিজের ভবিষ্যত সব সব নিজের নিজের নিজের জন্যে।
না স্কুলে না পরিবারে না সমাজে বাচ্চাদের কোন সুযোগ আছে,
পরের জন্যে কোন কিছু করার। তারা কাউকে করতে দেখে না, তারা জানে না “পরের কারণে
স্বার্থ দিয়ে বলি” কী বস্তুর নাম। এই নেতিবাচক মনোবৃত্তির ফল আজকের এই অস্থির
সমাজ। স্বার্থপর সমাজে রোজ নানান ঘটনা ঘটে চলছে, কেউ তা সামাল দিতে পারছে না,
নাভিশ্বাস উঠছে সবার। মগজে পচন ধরেছে তাই সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। গত চল্লিশ বছর
ধরে যে দিকে সমাজের মানসিকতা দৌড়েছে, আজ তারই ফল সবাই ভোগ করছি। এর থেকে পরিত্রাণ
পেতে সবাই শক্ত করে ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। নৈতিকতা তো নেই কোথাও ধর্ম যদি রক্ষা
করে এই সমাজকে। ধর্ম না কর্ম মানুষের পরিচয় নির্ধারন করবে?
পাদটীকাঃ ধর্মহীন রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসে কয়েদীর অভাবে কয়েকটি জেল বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকবার নিউজে এসেছে। আর বাংলাদেশে যত অপরাধী জেলে আছে তার চেয়ে কয়েক গুন বেশি বাইরে খোলা হাওয়ায় ঘুরছে।
পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !
মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো ।
কাজী নজরুল ইসলাম
No comments:
Post a Comment