Sunday 8 May 2016

মা দিবসটি কেমন করে মায়েদের হলো

বছর ঘুরে আবার এলো মে মাস। এ মাসের দ্বিতীয় রোবাবারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটা করে পালিত হবে "মা দিবস' । এ দিবসকে উপলক্ষ্য করে দোকানীরা তাদের পশরা সাজাতে ব্যস্ত এখন, "মা দিবস' এর বিশেষ মগ, চকলেট, লকেট, শোপিস, টিশার্ট আরো কতো কি। তাদের গায়ে লেখা থাকে "মা তুমি কতো মিষ্টি", কিংবা "তুমিই সবচেয়ে লক্ষ্মী মা", "মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি" ইত্যাদি নানা রকম মিষ্টি মধুর কথা। ছেলেমেয়েদের মনের কথাই দোকানীরা তুলে রেখেছে তাদের পন্যের গায়ে। যে কথাটা হাজারো কাজের ভীড়ে দিনে হয়তো লক্ষ বার মনে পড়ে কিন্তু বলি বলি করেও মাকে বলা হয়ে উঠে না, সেটিই তখন মগ কিংবা চকলেটের মধ্যে দিয়ে মায়ের কাছে পৌছে দেই আমরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ‘মা দিবসের’ প্রচলন শুরু হয় প্রথম প্রাচীন গ্রীসে। সেখানে প্রতি বসন্তকালে একটি দিন দেবতাদের মা ‘রিয়া’ যিনি ক্রোনাসের সহধর্মিনী তার উদ্দেশ্য উদযাপন করা হতো। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ‘মা দিবস’ পালিত হতো বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে। রোমানরা পালন করতেন ১৫ মার্চ থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে, তারা দিনটিকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘জুনো’র প্রতি। ষোলশ শতাব্দী থেকে এই দিনটি যুক্তরাজ্যেও উদযাপন করা হতো ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে। ইষ্টার সানডের ঠিক তিন সপ্তাহ আগের রোববারে এটি পালন করেন তারা। নরওয়েতে ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় রোববারে, সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর, লেবাননে বসন্তের প্রথম দিন অর্থ্যাৎ ২১শে মার্চে এই দিনটি উদযাপিত হয়। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এই যে বনার্ঢ্য ‘মা দিবস’ এর উদযাপন, এটি আসে মূলত এ্যামেরিকানদের থেকে। ১৮৭০ সালে সমাজসেবী জুলিয়া ওয়ার্ড হো এ্যামেরিকার নারীদেরকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান, সাথে এই দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের কাছে প্রচুর লেখালেখি করেন। তার ঘোষনাপত্রে লেখা ছিল,
As men have often forsaken the plough and the anvil at the summons of war, Let women now leave all that may be left of home For a great and earnest day of counsel. Let them meet first, as women, to bewail and commemorate the dead.
যদিও এটা হো’র মৌলিক পরিকল্পনা ছিল না, তিনি ১৮৫৮ সালে শান্তিকর্মী এ্যান জার্ভিসের শুরু করা প্রচেষ্টাকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এ্যান জার্ভিস যুদ্ধ বিধ্বস্ত এ্যামেরিকার নারীদের নিয়ে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারীতা নিয়ে প্রচার ও কাজ শুরু করেছিলেন। ১৮৬৮ সালে তিনি নারীদের সংঘবদ্ধ করেন এবং এ্যামেরিকার কিছু কিছু জায়গায় প্রচারনা চালান টম্যেটোর চারা যেনো সবাই ‘মা দিবসে’র পরেই রোপন করেন তার আগে নয়। এ্যান জার্ভিস দিনটির সরকারী অনুমোদন পাওয়ার জন্য বিভিন্নধরনের চেষ্টা চালাতে থাকেন, কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে এ্যানা জার্ভিস মায়ের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরনের কাজে হাত দেয়। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন একটি বিশেষ দিন ঠিক করে ‘মা দিবস’টি উদযাপন করার জন্য। সেই লক্ষ্যেই ১৯০৮ সালের ১০ইমে তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফিটন শহরের সেই চার্চে, যেখানে তার মা এ্যান জার্ভিস রোববারে পড়াতেন সেখানে প্রথমবারের মতো দিনটি উদযাপন করলেন। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে এটি বিস্তার হতে থাকে চারিধারে এবং এক সময় এ্যামেরিকার ৪৫টি অঙ্গরাজ্যে এই দিনটি পালন হতে থাকে। ১৯১২ সালে সর্বপ্রথম এইদিনকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারী ছুটি ঘোষনা করা হয় এ্যামেরিকার কিছু কিছু অঙ্গরাজ্যে। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৯১৪ সালে দেশব্যাপী সরকারী ছুটি ও জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দেন এই দিনটিকে। সে সমস্ত মায়েরদের সম্মানে দেশব্যাপী পতাকা অর্ধনিমিত রাখা হতো যাদের পুত্ররা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এরও নয় বছর পর থেকে আজকের মতো ব্যবসায়িক আঙ্গিকে ‘মা দিবসে’র উদযাপন শুরু হয়েছে। যাতে এ্যানা জার্ভিস স্বয়ং ভীষন আহত ও ক্ষুবধ হয়েছিলেন। ‘মা দিবসে’র গাম্ভীর্য ও মর্যাদা তার মতে এতে ব্যাহত হবে।
কিন্তু তবুও আজ অবধি মা দিবস যথেষ্ঠ ভালোবাসা ও উৎসাহের সাথে বিশ্বব্যাপী উদযাপন হয়ে আসছে। যান্ত্রিক জীবন আর অপরিসীম ব্যস্ততা যা আজকাল মানুষের পারিবারিক জীবনের অনেকটা সময় কেড়ে নেয়, যার কারণে প্রিয়জনদের মধ্যে অনেকটা অকারন দূরত্বও তৈরী হয়, সে সমস্ত দূরত্ব কাটিয়ে নৈকট্য নিয়ে আসতে ‘মা দিবসে’র তুলনা নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন কারণে যারা মায়ের কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেন পশ্চিমে তাদের কাছে এইদিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। সে জন্যই হয়তো পশ্চিমের দেশ গুলোতে এটি রোববারে উদযাপন করা হয়। বেশীর ভাগ লোকদেরই সেদিন ছুটি থাকে, দেখা যায় তারা মায়ের পছন্দের ফুল, চকলেট, কিংবা পারফিউম উপহার নিয়ে চলে যায় মায়ের কাছে। সারাদিন মায়ের কাছে তারা দিনটি কাটান। বিভিন্ন ভাইবোন বিভিন্ন জায়গায় থাকার কারণে রীতিমতো দেখা - সাক্ষাত যাদের মধ্যে সম্ভব হয় না, সেদিন দেখা যায়, সবাই মাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসে একে অপরকে পেয়ে আহলাদিত হয়ে উঠেন। জমে উঠে পারিবারিক উৎসব। অনেক সময় এ উৎসব আরো বড়ো আকারে নানা বাড়িতেও উদযাপন হয়ে থাকে। মা চলে যান তার নিজের মাকে শুভেচ্ছা জানাতে, সেখানে তখন জড়ো হোন পুরো পরিবার, মামা - খালা, তাদের সন্তানরা। যাদের মধ্যে হয়তো সারা বৎসর কোন যোগাযোগ থাকে না, এই একটি দিনে তারা কাছাকাছি চলে আসেন। সেসব দিক দিয়ে এই দিনটির গুরুত্ব অনেক। তবে যারা মায়ের কাছেই থাকেন, যেমন শিশুরা, তারা সাধারণত সেদিন মাকে বিছানায় ফুল নিয়ে যেয়ে ঘুম ভাঙ্গান, গিফট দেন, ছোট ছোট শিশু হাতে নাস্তা সাজিয়ে দেন, মাকে সেদিনের তার রুটিনের অনেক কাজ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মাকে ঘিরে চলে সারাদিনব্যাপী উৎসব।
পরিবারের সুখ - সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখতে যেয়ে, প্রতিদিন নিজের আরাম নষ্ট করে, নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সন্তানদের পৃথিবীতে চলার যোগ্য তৈরী করে দেন যিনি, তিনি মা। সেই নমস্যা ‘মা’ কে বছরে একটি দিনও যদি আনন্দ দিতে পারি, জানাতে পারি বিশেষভাবে তোমার তুলনা তুমিই ‘মা’, সেটাই কম কিসে?

No comments:

Post a Comment