Friday 19 June 2020

আকাশ কেন ডাকে মন ছুটে যায়


প্রায় এক বছর হয়ে গেছে প্রায় বাড়ি যাইনি। আমার বাড়ি, নিজের বাড়ি। যেখানে নিজের সবাই আছে, নিজস্বতা আছে, আর আছি আমার আমি। পা থেকে চটিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার স্বাধীনতা আছে, চিৎকার করে কাঁদার সুযোগ আছে, হা হা করে হাসার উপলক্ষ্য আছে। কারণে এবং অকারণে বোনদের জড়িয়ে ধরে সারা বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার আনন্দ আছে। ভাইয়ের ওপর বিনা কারণে চেঁচানোর ফান্ডা আছে। আমার লাগানো মানিপ্ন্যান্টের লতা আছে, মায়ের হাতের বোগেনভিলিয়ার ঝাড় আছে। সারা ঘর জুড়ে মায়ের হাতের স্পর্শ আছে, ডাইনীং টেবলের ওপর রোজ ছাঁদ থেকে তুলে আনা তাজা পুঁদিনার ভর্তা আছে। তেমন কিছু হয়তো নেই উল্লেখ করার মতো আবার সব আছে।


বাসার জানালায় যেখানে বোগেনভেলিয়ার ঝাড় আছে, সেখানে হঠাৎ একদিন একটি পাখির বাসার দেখা পাওয়া গেলো। সবাই খুব উৎসাহী খুশি, যত্নআত্তি শুরু হলো। এলো আমফান, দেখা গেলো ঝড়ে নুইয়ে পরে বোগেনভেলিয়া টিকে গেলেও পাখির বাসাটা নেই, উড়ে গেছে। শুধু বাসা দেখে, ভেবে নেয়া সেই পাখি দুটোর জন্যে, তাদের ঝড়ে উড়ে যাওয়া বাসাটার জন্যে মন কেমন করে। টকটকে বোগেনভেলিয়া ফোটা সেই জানালাটায়, মনে মনে পাখিদের ডাক শুনতে আমি কতবার পায়ে পায়ে হেঁটে গেছি। অলস দুপুরে জানালায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে, রাস্তা দেখতে দেখতে আমি পাখি দুটোর সাথে এলোমেলো কত গল্প করেছি।

ভাইবোনের বাচ্চাগুলোর সাথে কচলাকচলি, জাপটাজাপটি মিস করি। মায়ের চুলের তেলের গন্ধ পাইনা আজ কতোদিন। আমার নিজের মেয়েটা রোজ কতো স্বপ্ন বুনে তার তুতো ভাইবোনদের নিয়ে সেগুলোতে রঙ মাখানো হলো না। ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে রবীন্দ্র সরোবরে এলোমেলো হাঁটা আর বটি কাবাব মিস করি। ধানমন্ডি পাঁচ নম্বরের মহুয়া চটপটি মিস করি, আট নম্বরের কোনের ঝালমুড়ি মিস করি, মুড়ি খেয়ে ঝালে পাগল হয়ে দোকানে ঢুকে কোক খাওয়া মিস করি। কোক খেতে খেতে আবার বীফরোল কিংবা চিকেন প্যাটিস সাথে চকলেট পেস্ট্রি মিস করি। এই গরমে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে বাবার কড়া উপদেশ মাখা ঠান্ডা বেলের শরবত মিস করি। মায়ের আদর মাখা ঠান্ডা ডাবের পানি মিস করি। হাঁতে আঁটে না এত বড় আমের বড়া খাওয়া মিস করি, কনুই গড়িয়ে আমের রস না পড়লে কি আম খাওয়া হয়! ভ্রাম্যমান আদালতের ভিডিওতে দেখা সেই স্টারের পঁচা ফালুদা খেতে মন কেমন করে, প্রিমিয়ামে মিষ্টি কিনতে গেলে, টেবলে বসিয়ে যে নতুন মিষ্টি টেস্ট করতে দেয় তার জন্যে মন কেমন করে, জিঞ্জিরার মোগলাই আর সপ্তডিঙ্গার হালিমের জন্যেও মন কেমন করে। সারা ঢাকায় আখের রস বিক্রি হয়, আমি বলেছি, আখের রস খাবো না, আখ খাবো, বলেছি এবং এত খাবারের ভীড়ে যথারীতি ভুলেও গেছি। কিন্তু আনোয়ার খুঁজে খুঁজে মিষ্টি আখ এনেছে, এনেছে বুন্দিয়া আর মেঘের জন্যে ডালপুরী।

একটানা বর্ষনের সাথে যুদ্ধ করে যে ক্লান্ত কাকটা নিরিবিলি জানালার সানশেডে আশ্রয় নিয়ে তার ডানা দিয়ে গা চুলকায় তাকে মিস করি। স্যাঁতস্যাঁতে ঢাকা মিস করি, ঘেমো ঢাকা মিস করি, হাস্নাহেনার গন্ধ মিস করি। ভয়াবহ জ্যামটার জন্যও আজকাল খারাপ লাগে। বসুন্ধরার এক টিকেটে দুজনের সিনেমা দেখা মিস করি। খোঁজ দ্যা সার্চ এর অনন্তকে মিস করি। আশেপাশের বাড়ির নাম না জানা সব ছেলেগুলোকে মিস করি। যাদের ফ্যাশন–ফ্যুশন, চুল-দাড়ি নিয়ে হাসাহাসি করে আমরা অনায়াসে সময় পার করে দিতে পারি। গোধূলি বেলায় ছাঁদের ওপর দাঁড়িয়ে বিদায় নিতে থাকা গোমড়া মুখো সূর্যটাকে মিস করি আর তার সাথে মিস করি নীড়ে ফেরার আনন্দে হুটোপুটি করতে থাকা আনন্দিত সেই পাখির ঝাঁকটাকে। শেষ পূর্নিমার মলিন কিন্তু বড় আপন চাঁদটাকে মিস করি। ঢাকার বাইরের ট্রিপে গাড়িতে আন্তাক্ষরী খেলা মিস করি, ভয়াবহ ডেঙ্গু মশার কামড় মিস করি। ফেরা হবে না হয়তো আরো একটি বছর এই প্রিয় জিনিসগুলোর কাছে।

No comments:

Post a Comment