Sunday 17 January 2021

“ত্রিভঙ্গ” কিছু স্বপ্নভঙ্গ

আজকাল এক কিলো করোলা কিনতে গেলে, কিংবা বাসার পর্দা পরিবর্তন করতে গেলে নইলে আইফোনের মডেল চেঞ্জ করতে গেলেও প্রথমে ভাবতে হয়, সব যথাযথ বিশুদ্ধ নারীবাদের সূত্র মতো হয়েছে কিনা। অবস্থা এমন জায়গায় যেয়ে দাঁড়িয়েছে নারীবাদ শব্দটাতেই ইচিং শুরু হয়ে যায়, এলার্জি এসে গেছে। তবে আগেও কখনো নারীবাদের চর্চা করেছি কিংবা আস্থা রেখেছি এমনও নয়। জ্ঞানচক্ষু খোলার আগেই নেদারল্যান্ডসে আগমন আর বরফের মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেশ কয়েকবার পরে, হাত-পা ছিলে মাস ছয়েকের মধ্যেই আমি জেনে গেছিলাম, এখানে টিকে থাকতে গেলে কোন বাদ আমাকে আবাদ করবে না, এদের একজন গণমানুষ হয়েই আমাকে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, এবারের সংগ্রাম, টিকে থাকার সংগ্রাম। এখনও টিকে থাকার সংগ্রামেই আছি বলে অন্যদিক নিয়ে চর্চা করাও হয়ে ওঠেনি। পনেরই জানুয়ারি নেটফ্লিক্সে এলো অজয় দেভগন প্রডাকশনের সিনেমা “ত্রিভঙ্গ-ট্যারি ম্যারি ক্রেজি”, চিত্রনাট্য আর পরিচালনায় রেনুকা সাহানে। তিনটি প্রজন্মকে নিয়ে তৈরি এই সিনেমাটি। প্রথমে মা নয়নতারা, নামিদামি লেখক, লেখাই তার একমাত্র প্যাশন। এক ছেলে, এক মেয়ে, স্বামী আর শাশুড়ি নিয়ে তার সংসার। ছিমছাম সংসার হলেও লেখা বাদে সংসারের অন্য কোন দিক দেখে না বলে শাশুড়ি পেছনে লেগেই থাকে। লেখার জন্যে, অভিনয়ের জন্যে, চাকুরীর জন্যে এমন গঞ্জনা অহরহ আমাদের উপমহাদেশের বেশীরভাগ মেয়েদের সহ্য করতে হয়। একদিন নয়নতারা আর সহ্য করতে না পেরে, গৃহকর্মী আর ছেলে-মেয়েসুদ্ধ বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। স্বামী যেহেতু বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্র, তাই তিনি মাকে ছেড়ে আসতে পারলেন না। যদিও এরপর সিনেমায় দেখানো হয়েছে, নয়নতারা চলে আসার পরই শাশুড়ি মারা যায়, তারপরও একই শহরে থেকে কখনও কেন নয়নতারার স্বামী, স্ত্রী আর বাচ্চাদের খোঁজ নেয়নি, কোন অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি, কিংবা তাদের বাড়ি ফিরিয়ে নেয়নি, নেয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি, সেটার কোন ব্যাখ্যা পরিচালক দেয়নি। কিংবা স্রেফ লেখালেখি করেই নয়নতারা কী করে এক সংসারের খরচ যোগাড় করতেন, তাও সেই সময়ে, সেটার ব্যাখাও আসেনি। তা যতো কয়টা পুরস্কারই তিনি পান না কেন।
এর অনেকদিন পর নয়নতারার বয়সে ছোট এক ফটোগ্রাফারের সাথে প্রেম ও বিয়ে। ওই ফটোগ্রাফার চৌদ্দ বছর বয়সী আনুকে ছাড়তে নারাজ। মেয়েকে নিপীড়ন শুরু করে সে। শুরু হয় অনুরাধা মানে আনু, কাজল, নয়নতারার মেয়ের গল্প। আনু ভাবে, মা জানে তার সাথে কী হচ্ছে, কিন্তু নিজের কথা ভেবে প্রতিকার করছে না, শুরু হয় মায়ের সাথে ঘৃণার, ভুল বোঝাবুঝির সম্পর্ক। নিরুপায় কষ্টে আনু আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করে, তারপরও মা বুঝতে পারেনি। এখন কেউ কেউ বলতেই পারে, নারীবাদী মা কী করে বুঝে না! আমার সাধারণ জ্ঞানে আমি ভাবি, অ-নারীবাদী মা নারীবাদী মায়ের চেয়ে কিছু কম মা নন। আর নারীবাদী মায়ের কোন এক্সট্রা সেনসেশনাল পাওয়ারও থাকে না। আজকাল আমরা সবাইকে যত সন্দেহের চোখে দেখি, কিছুদিন আগেও সেই সতর্কতা আমাদের কারও মাঝেই ছিলো না। বাড়ি বসে, শিক্ষক, মৌলভি, আত্মীয়দের হাতে নির্যাতিত হওয়ার অনেক ঘটনা বিশ্বজুড়ে সবাই জানি। খোদ এমেরিকাতেই স্টেপ ফাদারের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অগনিত ঘটনা রয়েছে। অনেক বছর পর আনু যখন কোন এক সাক্ষাতকারে তার এই যন্ত্রণার কথা বলেছিলো, মা সেটা পড়েছিলেন, জেনেছিলেন, কিন্তু ততদিনে দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, করার আর কিছুই থাকে না। মা ক্ষত-বিক্ষত হন। আনুর কিংবা আনুর ভাইয়ের পড়াশোনা নিয়ে খুব কিছু দেখানো হয়নি সিনেমায়। উঠতি বয়সী আনু সিনেমায় অভিনয় শুরু করে, তার রাশান বন্ধু হয়, লিভ টুগেদার শুরু করে, যার ব্যবস্থা মা নয়নতারাই করে দেয়। আনু প্রেগন্যান্ট, বয়ফ্রেন্ডের সাথে মারামারি, তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সব শুনে মা দৌড়ে এলে মাকেও বের করে দেয়। এরপরও আনু যখন তার মেয়ে মাশার জন্ম দেয়, মা আবার দৌড়ে আসে, কিন্তু এবার সাথে মায়ের নতুন বয়ফ্রেন্ড রায়না। আনুর ভাষায়, রায়না মায়ের জীবনে আগে এলে তাদের সবার জীবন অন্যরকম হতে পারতো। রায়নাকে সেই পুরুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে যাকে প্রতিটি মেয়ে কামনা করে। মা এবং সন্তানদের যোগাযোগের বন্ধন হয়ে ওঠেন রায়না। এমনকি নাতনি মাশাকেও কোলেপিঠে করে বড় করতে থাকেন তিনি। রায়না শিল্প ভালবাসেন, সাহিত্য ভালবাসেন, সংগীত ভালবাসেন, কিন্তু বিয়ে প্রথায় বিশ্বাস করেন না। তারপরও আনু তার মাধ্যমে খুঁজে পায় তার জীবনের ভালবাসা ওড়িশি নাচ, আর ছেলে রবীন্দ্র পায় ঈশ্বরের খোঁজ। মায়ের সাথে উত্থান-পতনে চলছিলো জীবন আনুর। পুরুষ বন্ধুদেরকে টিস্যু দিয়ে নাক পরিস্কার করে ফেলে দেয়ার মতো আরামের তত্ত্বে বিশ্বাস করা আনুর মেয়ে যখন এক প্রাচীনপন্থী পরিবারের এক ছেলেকে বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে ফেললো, এখানে এসে নারীবাদ প্রচণ্ডভাবে আছাড় খেলো। কী করে সম্ভব! সেই পরিবার এতোই রক্ষণশীল যে বাড়িতে মেয়েরা মাথায় কাপড় দেয়, বাচ্চা হওয়ার আগে তারা বাচ্চার “লিঙ্গ” সম্পর্কে নিশ্চিত হতে যায়, মেয়ে সন্তান তাদের কাম্য নয়। নারীবাদীর মেয়ে এই সংসারে কী করে থাকতে পারে? তাইলে এতোদিনের নারীবাদ বিফলে গেলো। আমার প্রশ্ন এখানে, একজন ধার্মিকের মেয়ে যদি নাস্তিক হতে পারে, একজন অ-নারীবাদীর মেয়ে যদি নারীবাদী হতে পারে, তাহলে উল্টোটা হবে না ভাবার কারণ কী? ডাক্তারের মেয়ে ডাক্তারই হয়? যে বাচ্চাটি নানী বা মায়ের কাছে পরিবার পায়নি, স্কুলে বুলিংইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তার কাছে হয়তো যেকোন মূল্যে এরকম পরিবারই প্রায়োরিটি। সবার প্রায়োরিটি আর চাহিদা একই হতে হবে কেন? কত মানুষতো নিজেই পরিবর্তন হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনপ্রিয় নায়িকা শাবানা, পরিবার নিয়ে দেশত্যাগ করেছে, চলচিত্রের সাথে কোন সম্পর্কই রাখেনি, ফেরদৌস ওয়াহিদ গান ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে গেছে, গুলশানের বিলাসবহুল জীবন বাদ দিয়ে বৈমানিক কামাল মাহমুদ গাজীপুরের অদূরে নিভৃতে আছে জল ও জংগলের কাব্যে। সোশ্যাল মিডিয়া যারা চালায় তাদের পুত্র কন্যাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন একাউন্ট করাও নিষেধ দেখলাম নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টরি সোশ্যাল ডেলিমাতে। তারপর আসে, সেই যুগান্তকারী সংলাপ, মা-বাবা কী শেখালো? একটা মানুষ তার নিজের মতো থাকে সত্তর ভাগ, আর বাকি ত্রিশ ভাগ থাকে বাইরের শিক্ষা। বাবা-মা আর পরিবার চাইলেই তাদের ছেলে-মেয়েদের সব শেখাতে পারে? শিখেছি আমরা? হয়েছি বাবা-মায়ের চাহিদানুযায়ী? নজরুলের ছেলে নজরুল হয়েছে? মা ছাড়া গৃহভৃত্যের কাছে মানুষ, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তিনি আর তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী মিলেও আর একজন রবীন্দ্রনাথ আসেনি। ধার্মিকরা যেমন বলে, কন্যা সন্তান দত্তক নেয়া জায়েজ নয়, তেমনি নারীবাদীরা যখন বলে, ঐরকম পরিবারে বিয়ে করা নারীবাদ নয়, দুটোকেই আমার চরম জাজমেন্টাল, মৌলবাদিতা মনে হয়। কয়েকদিন আগে আনুশকার মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে গেলো আনুশকার মাকে ধুয়ে দিয়ে। কী করতো আনুশকার মা? সতের বছরের মেয়ে কোলে করে বসে থাকবে? মেয়ের ফেবু একাউন্ট চেক করবে? মেয়ের সাথে স্কুলে ক্লাশ করবে? বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি যাবে? মেয়েকে যদি বলে ওর সাথে মিশিস না, মেয়ে লক্ষী হয়ে শুনে বসে থাকবে? পৃথিবীর কোথাও এরকম হয়? যেটুকু হয়, সেটা হলো আইনের শাসনের কারণে মানুষ অপরাধ করতে সতর্ক থাকে বা অপরাধপ্রবণতাই তাদের মধ্যে জন্ম নেয় না। একসময় ট্রেন্ড ছিলো, ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরা ড্রাগ নিতো। এখন? ড্রাগ না নেয়াটাই বরং অসাধারণ ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেধাবীরা হচ্ছে জঙ্গি। জীবন তো কোন ফর্মূলাকে অনুসরণ করে না, ফমূর্লা জীবনকে অনুসরণ করতে পারে। এই সিনেমার সকল ঘটনা ঘুরেছে তিন নারীকে কেন্দ্র করে, ছেলে রবীন্দ্রের চরিত্র এখানে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কয়দিন আগেই দেখেছি বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ শকুন্তলা দেবীকে নিয়ে বানানো সিনেমা, সেখানেও মায়েতে-মেয়েতে সংঘাত ছিলো। গণিতজ্ঞের মেয়ে গণিতজ্ঞ হয়নি, মলেস্টও হয়নি, তাই বলে সংঘাত থেমে থাকেনি। প্রাকৃতিক কারণেই হয়তো মা আর মেয়ের মধ্যে সংঘাত কিছু হয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আজ মাকে যতটা বুঝতে পারি, আগে পারিনি, এও জানি, আজ মেয়ে যত রিয়াক্ট করে, আমার জায়গায় এসে গেলে সেও জেনে যাবে, মা হলে কীসের মধ্যে দিয়ে যায়। বিভিন্ন ঘটনায় যারা জাজমেন্টাল রায় দিতে ব্যস্ত থাকেন, তাদের জন্যে বলছি, এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা করো। কল্যাণ হোক সকলের। ১৭/০১/২০২১

No comments:

Post a Comment