Sunday 3 January 2021

‘সোভিয়েত নারীর দেশে’

ছোট্টবেলায় রুশদেশের উপকথা, বাড়ির কাছে রাশান কালচারাল সেন্টার, রাশান সালাদ, ক্রিস্টাল, রাশান মাত্রিউশকা ডল, মস্কোর জার বেল, বৈকাল হ্রদ, মুখ থুবড়ে পড়া সমাজতন্ত্র, সেন্ট পিটার্সবুর্গ, ভদকা, সব মিলিয়ে এক বিস্ময়ের নাম ছিলো "রাশিয়া"। "সোভিয়েত নারীর দেশে" শুরুও হয়েছে সেই ছোটবেলার প্রান্ত থেকেই, সুপ্রীতিদি শুরু করলেন, ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বারের মেফেয়ার থেকে স্টেপস স্টাইলে চুল কেটে --- আমাদের ছোটবেলায় একটা সময় ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বারের মেফেয়ারই ছিলো ঢাকায় মেয়েদের চুলকাটার দুটো দোকানের একটা। সম্ভবত গুলশান মেফেয়ার আর ধানমন্ডি মেফেয়ার (স্মৃতি থেকে লিখছি)। শুক্রবারে চুল কাটতে গেলে অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যেতো, বউ খোঁপা, বউ সাজ, যাদের বিয়েতে দাওয়াত হয়নি, তাদের কার কোথায় বিয়ে হচ্ছে, খোঁজ পাওয়া যেতো। আরও ছোটবেলা আছে বইতে, আমি যখন বেণী দুলিয়ে স্কুলে যাই, তখন সুপ্রীতিদি কলাবাগানে থেকেই এইচএসসি পড়ছেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন … লাকি দিদি, সোভিয়েট ইউনিয়নে অন্য ভাষায়, সব অন্য গ্রহের মানুষদের সাথে কিন্তু বিরাট আনন্দ নিয়ে দিন যাপন করেছেন। মুক্তমনা মানুষ ছিলেন, না খাওয়ার সমস্যা হয়েছে, না ধর্মের, না জামাকাপড় কিংবা বন্ধুত্বের, এ যেনো ভূপেন হাজারিকার সেই গান, "রঙের খনি যেখানে দেখেছি, রাঙিয়ে নিয়েছি মন"। ভিন্ন জাতীয়তার মানুষদের সাথে না মিশলে আসলে মানুষ হিসেবে শিক্ষার অনেক অপূর্ণতা থেকে যায়, সেটা মেশার পরেই অনুভব করা যায়। আর্মেনিয়ানদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, তুর্কিদের অত্যাচার, আরারাত পাহাড় বেদখল কত কী জানলাম দিদির হাত ধরে, সাথে তাদের অতিথিপরায়ণ স্বভাব, মানুষকে আপন করে নেয়ার অদ্ভূত ভালবাসার ক্ষমতা, বইটি না পড়লে অজানাই থেকে যেতো। যে সময়টিতে মানুষের আজীবনের বন্ধুত্ব হয়, নির্ভেজাল বন্ধুত্ব, স্বার্থহীন, সেসময়টা কেটেছে তার রাশিয়ায়। তাই আজও সেসব দিন, সম্পর্ক, তার স্মৃতিতে, বাস্তবে জ্বলজ্বল করছে। সুখের দিন ছিলো, ছিলো দুঃখেরও দিন। প্রেম, প্রণয়, মেয়ের জন্ম, রাশিয়াতেই। উনিশ থেকে উনত্রিশ, নিজেকে গড়ে তোলার দশ বছর, মানুষের জীবনের একটি মাইলস্টোন টাইমিং, কত কিছু ঘটে এসময়টায়। ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে তিনটি সময়ের কথা লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, তার পতন আর সোভিয়েত রাশিয়া। কত নিরাপদ, সম্মানজনক সমাজ ব্যবস্থাও তাদের নিজেদের পতন ঠেকাতে পারেনি। দেখেছেন রাজনৈতিক পতনের এক ধাক্কায় চেনা মানুষদের নৈতিকতাও বদলে যায় অনেকগুণ। রাশিয়ার উন্নত ট্রাম, বাস, রেলের সিস্টেম, বড় বড় প্রাসাদোপম বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা ঘাটের প্রাচুর্য্যের সাথে ছিলো সাবান-শ্যাম্পুর মতো প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জিনিসের অপ্রতুলতা, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে তো খাবার জিনিসের দুষ্প্রাপ্যতা। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার না পেয়ে ফিরে যাওয়ার গল্প আমি ছোটবেলায় শুনেছি, পত্রিকায় পড়েছি, কিন্তু কেউ কেউ সেগুলোর ভুক্তভোগীও বটে, তা জানলাম। আবার সেই একই সময়ে, যে সোভিয়েত ইউনিয়নে খাবার পাওয়া যাচ্ছে না, শুধুমাত্র খাবারের জন্যে মেয়েরা নিজেদের শরীর পর্যন্ত বিক্রি করছে, অনেকেই ব্যবসা করে মিলিওনিয়ার হয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের যেকোনো পরিবর্তনে আজও নারীরাই প্রথম শিকার হয়, এই তিক্ত বাস্তবতাটিও কোথাও বদলায়নি। অথচ রক্ষণশীল রাশিয়ায়, নারীরাই ছিলো অর্থনীতি থেকে পরিবার, সব জায়গায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। "একাত্তরে বাবাকে হারিয়ে একাকি বড় হতে থাকা মেয়েটির মানসিক অবস্থার কথা কেউ কোনদিন ভাবেনি, কাউন্সেলিং তো দূরে থাক। তাই অনুকূল বিষয়কেও সহজেই সে প্রতিকূল করে তুলেছে শুধুমাত্র মানসিক স্থিরতার অভাবে। এমন কতো একাত্তর প্রজন্ম যে আছে, যারা আমারই মতোন হতাশায় ভুগেছে, কে জানে। কার খবর কে রাখে!" এইটুকু পড়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকেছি, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ নিয়ে অনেক স্বপ্ন আর বাস্তবতার গল্প, প্রকল্প শুনেছি। কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মানসিক কষ্টের কোন রেমিডির কথা কি উল্লেখ ছিলো? নাটকে কিংবা সিনেমায়? না, মনে পড়ছে না। তারা তাদের মতো নিজেদেরকে এ সমাজে টেনে নিয়ে গেছেন। "কোথাও কি কেউ ছিল আমার? ওই যে ইউক্যালিপটাস বনের পাতার ফাঁক গলে আজ যে দোল পূর্ণিমার চাঁদটা ঝুলে রইলো মধ্য আকাশে, সেই আলোর নিচে আমি কি আছি কোথাও?" যেমন মিষ্টি করে কথা বলেন দিদি, ঠিক তেমন মিষ্টি বাংলায় লেখা তার সেসব গৌরবোজ্জল এবং মধুর দিনের কথা। ইয়েরেভান লেলিনগ্রাদ, ককেশাস পাহাড়, সিভান লেক প্রভৃতির দারুণ বর্ণনা উঠে এসেছে তার লেখায়। শুধু এক দুরন্ত তরুণীর স্মৃতিকথা হিসেবে নয়, সাহিত্যমানেও বইটি পাঠকের হৃদয় কেড়ে নেবে। রাশিয়া, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে যারা আগ্রহবোধ করেন, অবশ্যই বইটি পড়ে নেবেন, মিস করবেন না। সব্যসাচী থেকে প্রকাশিত, পাওয়া যাবে এবারের বইমেলাতে ০২/০১/২০২০

No comments:

Post a Comment