Monday, 14 June 2010
অহনার অজানা যাত্রা (ছয়)
অহনাকে এতোদিন সবাই দেখেছে সোশ্যাল গেটটুগেদারে, শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরা অর্নের সাথে, তার বউ হিসেবে। এই পশ্চিমা কাপড় পরা, সাইকেল নিয়ে টো টো করা অহনা তাদের অজানা ছিলো। শহরে থাকা পুরনো বাঙ্গালী বাসিন্দারা যারা মসজিদের মাহফিল, বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা নেয়া, ডাক্তার আর সুপার মার্কেটের বাইরে মেয়েদের কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে তা জানতেন না। তাও আবার স্কার্ট টপস কিংবা জীন্স টিশার্ট পরে তারা প্রথমে রাগে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। হারাম হালালের বালাই নেই, ম্যাক থেকে বার্গার কিনে খায়। বাংলাদেশের আবার মুসলমানের মেয়ে সাইকেল নিয়ে ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেশের মানসম্মান সব ধূলোয় মিটিয়ে দিচ্ছে, একি করে সহ্য করা যায়? বাংলাদেশের কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে অহনা হুমকির মুখে ফেলে দিলো। ঈমান ধর্মতো আর রক্ষা করা যায় না। প্রথমে তারা কায়দা করে নানা ইশারা ইঙ্গিতে অহনার চালচলন ইসলামিক করার চেষ্টা করলেন তারপর বাগে আনতে না পেরে তাদের বউদেরকে অহনার সাথে মিশতে বারন করে দিলেন। মজার ব্যাপার বার্গার অর্নও খায় কিন্তু সেটা দোষের না। অহনা সবার কাছে ডবল দোষে দোষী হলো, কারন সে স্বামীকে সুপথে ফিরিয়ে আনার বদলে নিজেই কুপথে ঝাপ দিলো।
অহনা সদ্য দেশ থেকে আসা, ধরতে গেলে তাদের বাচ্চা কাচ্চার সমবয়সী। মোটামুটি হাসি খুশী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, মুরুব্বীদের যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা করেই কথা বলে সে। মহিলা কিংবা পুরুষ কারোই অহনা সর্ম্পকে অন্য কোন বিরক্তি ছিলো না শুধু এই পোষাক আশাক আর ঘোরাঘুরি আর হালাল খাবার ছাড়া। তবুও অনেক আন্টিই তাদের বরকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে সাঝে অহনার খোঁজ খবর নিতেন। রান্না করা খাবার দাবার পাঠাতেন। শুধু বাসায় এসো এটাই বলতে চাইতেন না। এই সীমিত যোগাযোগ অহনার জীবনে সাপে বর হয়ে দেখা দিলো। কারো বাসায় যেমন যাওয়ার নেই কাউকে বাসায় ডাকারও নেই। অহনার হাতে অফুরন্ত সময়। ডাচ টিভি, তুর্কী টিভি, জার্মান বিবিসি কোনটাই আর্কষনীয় লাগে না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, ডিসকোভারী কিংবা এমটিভি দেখে আর কতোক্ষন কাটানো যায়? এতো সাধের এমটিভি বিদেশে এসে পানসে মেরে গেলো। সে তার ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাশের বই উলটে পালটে চাল্টে পড়তে লাগলো। পড়াশোনা করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই সারাদিন কিংবা সন্ধ্যা রাত ভর। অর্নের অফিস আছে তার সময় কম কিন্তু অহনার সময়ই সময়।
ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাশের প্রথম পরীক্ষার পর অহনাকে মোটামুটি গ্রুপ থেকে বেষ্ট গ্রুপে তুলে দেয়া হলো। সে সময় নেদারল্যান্ডসে যাদের রেজাল্ট বেশ ভালো ছিলো তাদের নাম স্কুল থেকে ক্যারিয়ার গ্রুপের কাছে রিকোমেন্ড করা হতো। ক্যারিয়ার গ্রুপ তাদের সাথে যোগাযোগ করতো, তাদের আগ্রহ থাকলে তাদের ইন্টারভিউ নিয়ে জানতে চাইতো ভবিষ্যতে সে কি করতে চায়? বিনা পয়সায় তাদেরকে পড়াশোনা করার সুযোগ এবং চাকরী খুঁজে দিতো। এই সুযোগটা এখনো আছে তবে অন্য ফর্মে। সেই সময় মাঝ পথে কেউ পড়া থামালে কোন জরিমানা হতো না, আজকাল জরিমানা করা হয়। অনেকেই এসুযোগ হেলাফেলায় নষ্ট করেছেন বলে আজকাল ক্যারিয়ার গ্রুপ এবং সরকার দু’পক্ষই বন্ড সই করান যে গর্ভ ধারন করলেও কোর্স শেষ করতে হবে অন্যথায় জরিমানা সহ পয়সা ফেরত দিতে হবে। সেই থেকে অহনার বিনা পয়সায় পড়ার রাস্তা খুলে গেলো। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
পড়াশোনা নিয়ে তুমুল ব্যস্ততা থাকলেও মাঝে মাঝে একা লাগতো অহনার। চরম আড্ডাবাজ স্বভাবের মেয়ে সে, যৌথ পরিবারে বড় আর এই বিভূইয়ে একদম একা। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি তার জন্যে আর কি হতে পারে? দোষ অহনারও অনেক। সে কারো সাথে ঠিক বন্ধুত্ব করে ওঠতে পারছিলো না। দ্রুত রেগে যায় যদিও পরক্ষনে রাগ সে ভুলে যায় কিন্তু পরের সাথেতো ঘরের ব্যাপার আর চলে না। আর এই বিদেশে থাকা মহিলারাও জানি কেমন। অনেকেই ফ্রী হওয়া সত্বেও সাধারন ভাষাটুকু পর্যন্ত শিখেননি। অজুহাত দেন বাচ্চা কাচ্চা দেখে সময় করে ওঠতে পারেননি, সংসারের ঝামেলায় পারেননি ইত্যাদি। মেয়েরা পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্বেও বিজনেক এ্যাডমিনিশট্রেশন কিংবা ডাক্তারী পড়তে মেয়েকে বাইরে পাঠাবেন না। শহরে যে ইউনিভার্সিটি আছে তাতে যে সাবজেক্ট সেটাতেই পড়তে হবে, যোগ্যতা আর সাবজেক্ট থাকা সত্বেও বাইরের শহরে মেয়েদেরকে পড়তে পাঠাবেন না, ছেলেরা হলে ঠিকাছে। ঠিক করে বাংলা বুঝতে পারে না এমন মেয়েদেরকে আঠারোর কাছে পিঠে দেশে নিয়ে ভাশুরের ছেলে কিংবা ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে আনবেন। মেয়েকে কোন বিদেশী ছেলের সাথে কোন ধরনের অঘটন ঘটানোর সুযোগ দিবেন না। বিয়ের ব্যাপারে অবশ্য ছেলেদের বেলায়ও তারা সজাগ কিন্তু তাদের ব্যাপারে মনোভাব নমনীয়। অহনা বাংলাদেশে বাংগালী মেয়েদের যে দূরবস্থা চিন্তা করতে পারে না সেটা এখানে হরদম ঘটছে।
এধরনের আন্টি কিংবা ভাবীদের সাথে কথা বলতে গেলে অহনার মধ্যে এক ধরনের কমপ্লেক্স শুরু হয়ে যায়। তাদের জীবন ঘোরে অন্যের চাকায়। মাইনাস শীতের মধ্যে উলেন বা নিদেন পক্ষে জীন্স না পরে তারা সালোয়ার কামিজ পরে বাইরে চলাফেরা করেন। কারন তাদের বরেরা পছন্দ করে না, তাই ইসলামী লেবাস করতে হবে। ঐদিকে বরেরা কিন্তু দিব্ব্যি কাফেরী লেবাস মানে উলেন প্যান্ট, গলা বন্ধ সোয়েটার পরে চলাফেরা করছেন। রান্না করেন তাদের বর যা পছন্দ করেন, টিভি দেখেন বরের যে প্রোগ্রাম পছন্দ সেটা। সবকিছুই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বলার সময় তারা এভাবেই বলেন যেনো অহনার গায়ে সেটা একটু হলেও লাগে। অহনা কি তাহলে খারাপ বউ? তার যা খেতে ইচ্ছে করে সে অর্নের পছন্দের সাথে সেটাও রান্না করে। তার যা পরতে ইচ্ছে করে কিনে পরে। অর্নের মতামত অবশ্যই সে নেয় কিন্তু অনুমতি নেয়া নয় সেটা মোটেই। সে সব ব্যাপারেই তার বরের সাথে আলোচনা করে, যেকোন জিনিসের পজিটিভ এবং নেগেটিভ দিক নিয়ে আলোচনা হয়, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু অর্ন কোন কিছুই তার ওপর চাপায় না। তার মধ্যে সংসার সম্বন্ধে অপরিপক্কতা আছে জানা সত্বেও অর্ন তার মতামতকেই প্রাধান্য দেয়, তার পছন্দকেই গুরুত্ব দেয়। তার সংসার তার ইচ্ছে মতোই হোক এ ভাবনা অর্নেরও।
একা একা দেশ থেকে দূরে, বহু কারনেই অহনার মন খারাপ থাকতো। কেউ ফোন করে যদি দেখতো অহনার মন খারাপ সমানে প্রশ্ন করতো, ভাই কি কিছু বলছে? তাইলে মন খারাপ কেনো? ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে? এর থেকে বিরক্তিকর আর কিছুই নেই। তার সব মন খারাপ বা ভালোর সাথে অর্নকে জড়িয়ে ফেলার একটা প্রানান্ত চেষ্টা সকলের মধ্যে কাজ করে। যেনো বিয়ে হয়েছে বলে অর্নের সাথে ঝগড়া না হলে অহনার জীবনে মন খারাপের আর কোন কারনই থাকতে পারে না। তাকে পাস করে সবকিছু অর্নকে জড়িয়ে যায়। রাগে একবার ভাবলো এরপর থেকে কেউ যদি বলে গলা এমন কেনো, ও বলবে আমার মাথা খারাপ। মনের সাথে বরকে জড়ানো গেলেও মাথার সাথে আশাকরি কাউকে জড়ানো যাবে না। নিশ্চয় কেউ প্রশ্ন করবে না, মাথায় কি ভাই লাঠির বারি দিলো নাকি? মাঝে মাঝে অহনা অনুভবও করতে পারে, তাদের জীবনের মতো তার জীবনও কেনো বরের মর্জি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তার একটা পৈশাচিক জিদ কাজ করে অনেকের মধ্যে।
অর্নকে এসব বলতে গেলেই সে হাসে আর বলে ওরা নিজেরা পরাধীন জীবন যাপন করছেন সারা জীবন ধরে, তোমার স্বাধীনতা তারা সহ্য করতে পারছেন না। এসব বাদ দিয়ে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হও। বলে এসব ফোনের পিছনে এতো এনার্জী খরচ না করে কম্পিউটার শিখো, ইংরেজি আরো ভালো করে প্র্যাক্টিশ করো। নিজেকে তৈরী করো ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভালো কথা কোনদিনই অহনার ভালো লাগে না। সে থাকে তার প্যাচালের ভাবনায়। ও এটা কেনো বললো, সে এটা কেনো করলো। অর্নকে বিরক্ত করতে করতে সে পরে মাকে ফোনে বলা শুরু করলো। আম্মি আমাকে কেনো ও এটা বললো, আমাকে কেনো সে ওটা বললো। আম্মি বিরক্ত হয়ে হয়ে ফোনে বললেন একদিন, খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনাকে রোজ যে পরিমান গালি মানুষ দেয় তাদেরতো তাহলে মিনিটে মিনিটে আত্মহত্যা করতে হতো। তারা কি শোনে? তুই শুনিস কেনো এগুলো?ওরা যেমন নিজের কাজ করে যাচ্ছে, তুইও তোর নিজের কাজ করতে থাক।
(চলবে)
তানবীরা
১৪.০৬.১০
এই পর্বটি ব্লগার শাওন আর মীরকে উৎসর্গ করা হলো। তাদের পুনঃ পুন তাগাদার কারনে ভাত না খেয়ে রান্না না করে আমাকে টাইপ করতে হলো।
.
Saturday, 5 June 2010
অহনার অজানা যাত্রা (পাঁচ)
অহনার মা এতো ধৈর্য্য রাখতে পারেন না। মেয়েকে তিনিও অনেক মিস করেন। তাই তিনি প্রায়ই টিএন্ডটিতে বুকিং দিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলেন। একদিন মাঝ রাতে তার মায়ের কাছে ফোন এলো টিন্ডটি থেকে, প্রস্তাব দিলো তিনি চাইলে অহনার সাথে ফোনে কথা বলতে পারবেন প্রতি পনর মিনিট, বাংলাদেশি টাকায় চারশত টাকা। মা ঘুমের মধ্যে হ্যা না বলতে বলতেই তারা তাকে অহনার সাথে ফোনে ধরিয়ে দিলো। এহেন স্বর্গীয় প্রস্তাব ও ঘটনা থেকে অহনার মা আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। ফোন বিল এক ধাক্কায় অনেক কমে গেলো। এরপর এটা অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিনত হলো, প্রত্যেক সপ্তায় বাংলাদেশ সময় রাত দুটো থেকে তিনটের মধ্যে মা অহনাকে ফোন করতেন। প্রত্যেক ফোনেই পরের সপ্তাহের ফোনের তারিখ জানিয়ে দিতেন। অহনাও তীর্থের কাকের মতো দিনক্ষন দেখে ফোন নিয়ে বসে থাকতো। এ লাইনে পরিস্কার কথা শোনা যেতো যেনো পাশের ঘরে মা বসে আছেন। শুধু একটা অসুবিধা হতো, ভাইবোনেরা পরদিনের স্কুল কলেজে যেতে হবে সে কারনে রাতে ঘুমাতো বলে, মা বাবা ছাড়া আর কারো সাথে এফোনে কথা হতো না। এঘটনা অনেকদিন চলছিল।
আস্তে আস্তে বরফ কেটে সূর্য উঁকি দিলো। চারধারে রঙ বেরঙের টিউলিপগুলো মাথা তুলে দাড়াতে থাকলো। অহনার এই পরিস্কার আকাশ দেখলেইন বাইরে যেতে ইচ্ছে করে। সারাজীবন সে শুনে এসেছে বাংলাদেশ ভীষন সবুজ। বিদেশীরা বাংলাদেশে বেড়াতে এলে এই সবুজের প্রশংসা করে যান। কিন্তু এখন অহনার মনে হতে লাগলো, হয়তো বাংলাদেশে প্রশংসা করার মতো আর কিছু খুঁজে পান না তারা তাই সবুজ বলে যান। আসলে সবুজতো এই দেশ। ঘাস, গাছ, ফুল, লতা পাতা গুল্ম দিয়ে কি বাড়ি, কি রাস্তা, কি শপিং মল সব যেনো একদম সাজানো। এর মাঝ দিয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে একা একা হেটে যেতে তার খুবই ভালো লাগে। আর এখন এখানে রাত এগারোটা অব্ধি আলো থাকে। অফিসের পর লেকের পাশে পার্কে প্রচুর লোক লেকে ছিপ ফেলে বই নিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে সেটাও দেখতে ভালো। মাথায় টুপি, পাশে মৃদ্যু লয়ে গান বাজছে, কুকুরটা শান্ত হয়ে মনিবের কাছে বসে আছে আর তারা ছিপ ফেলে নিবিষ্ট মনে বসে আছেন। মজার ব্যাপার হলো এতো ঘন্টা অপেক্ষা করে যে মাছটি তারা তুলেন পানি থেকে, তাকে দেখে, তেমন বড় হলে অন্যদেরকে দেখিয়ে ছবি তুলে আবার পানিতে ছেড়ে দেন। যদিও মাছ ধরার জন্য পয়সা দিয়ে তারা লাইসেন্স নেন কিন্তু কে খাবে এতো বড় মাছ, কি করবেন, তাই প্রান নষ্ট না করে পানির মাছকে আবার পানিতেই ফিরিয়ে দেন। বসন্ত আসার পর এদেশটাকে ঠিক তার আর ততোটা অসহ্য লাগছিলো না।
অফিসের পরে অর্ণ সপ্তায় দুদিন ডাচ ক্লাশ করে যখন রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে তখন সে প্রায় বিধ্বস্ত। কিন্তু অহনার একা ঘুরে বেড়ানোর সমস্যা অন্য জায়গায়। মোটামুটি আধুনিক এই ফ্ল্যাটের দরজায় ডাবল লক দেয়া। এক লকের চাবি মিলে দ্বিতীয় লকে যাবে তবে দরজা খুলবে। চাবির খাঁজগুলো সেভাবেই কাটা। যেটা প্রায়ই তারজন্যে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এতো ওজনের চাবি ধরে প্রথম তালা খুলে তারপর দ্বিতীয় তালা পর্যন্ত যাওয়া অহনার অনেক সময়ই সম্ভব হতো না। চাবি লকের ভিতরে ঢুকিয়ে নাড়ানাড়িই সার হতো তার। এই শীতের মধ্যেও সে ঘেমে ওঠে। অপেক্ষায় থাকতো কেউ যদি কোন কারনে সিড়ি দিয়ে ওঠে নামে, তাকে বিপদগ্রস্থ দেখে সাহায্য করে। অহনাদের পাশের ফ্ল্যাটে সেসময় একজন ডাক্তার থাকতেন, যিনি অনেক সময়ই রাতের ডিউটি শেষ করে দিনে বাসায় ঘুমাতেন, তিনিই ছিলেন শেষ ভরসা যার ঘুম নষ্ট করিয়ে দিয়ে অহনা বাড়িতে ঢুকতে পারতো। প্রথম যেদিন এই ঘটনা ঘটলো অহনা অর্নকে বলতে গেলো তার এই দুর্ভোগের কথা। অর্ন তার কথা শুনে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখানোতো দূরে থাক আরো চোখ কপালে তুলে এমন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো যে সে অন্য কোন গ্রহ থেকে এইমাত্র নেমে এসেছে। খরখরে গলায় বললো অহনাকে, ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়ে তুমি একটা লক খুলে ভিতরে ঢুকতে পারো না, এ গল্প করতে তোমার লজ্জা করছে না। অহনার খুবই লজ্জা করতো সেটাও যেমন সত্যি আবার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে পারত না সেটাও ছিল সমান সত্যি। আর এ সমস্ত ব্যাপার অর্নকে বলতে গেলে অর্ন চরম বিরক্ত হতো সেটা তার চেয়ে বড় সত্যি। কাউকে বেল করে, তার সাহায্য নিয়ে দরজা খোলা স্বামীর চরম অপছন্দ জানা সত্বেও কখনো কখনো অনন্যেপায় হয়ে অহনা পাশের ফ্ল্যাটেই বেল টিপতো। তিন চার মাস চাবি নিয়ে ধস্তাধস্তির পর এক সময় অহনা নিজেই ডবল লক খোলা ম্যানেজ করতে শিখল।
কনকনে শীত কেটে উত্তর সমুদ্রের কাছে অবস্থিত এই টিউলিপ ভূমি এখন সূর্যের রঙ মেখে উত্তাল। এতোদিন বাসায় বসে বসে অনবরত টিভি দেখে দেখে আর গল্পের বই পড়ে ক্লান্ত অহনা। ইউনিভার্সিটি নেই, পড়াশোনা নেই এমন জীবনে কোনদিন অভ্যস্তই ছিল না সে। অর্ন ব্যস্ত তার অফিস নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে, অহনার কি শুধু আকাশ দেখে দেখে সময় যেতে চায়? অপেক্ষা করে থাকতে হয় কখন শনিবার রবিবার আসবে, অর্নের সাথে একটু কোথাও বাইরে যাওয়ার কিংবা গল্প করার সুযোগ পাবে। কিন্তু দেখা যায় তাও সব সময় হতো না, সারা সপ্তাহ অফিস করে ক্লান্ত অর্ন হয়তো তখন একটু বিশ্রামের জন্য আকুপাকু করছে। সারাক্ষন বাসায় থেকে খেয়ে তাজা সে আর কর্মক্লান্ত অর্ন এ হলো সংসার স্ট্যাটাস। যদিও ডাচ ভাষা শেখার ক্লাশ জয়েন করতে পেরে সে মোটামুটি বেশ আনন্দিত, এতোদিন যেনো কোন এক বিচ্ছিন দ্বীপে ছিল, লোকালয়ের সংস্পর্শে আসাতে সে অভাব পূরন হলো। ভাষা শিক্ষার কোর্স মেটেরিয়ালও বেশ ভালো ছিল, নবাগত লোকজনদেরকে নেদারল্যান্ডসের কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে সাথে রোজকার জীবনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এর মাধ্যমে। ক্লাশের অন্যদের সাথে বেশ দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো, নেদারল্যান্ডসের সংস্কৃতি আলোচনার পাশাপাশি অন্যদেশীয় সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা হতো।
বই পড়া কেতাবী জ্ঞানের থেকে চাক্ষুস জ্ঞান অর্জন অনেক আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, হয়তো কোনদিনের পড়ার বিষয় ছিল, খাদ্যাভাস। সেখানে নেদারল্যান্ডসের লোকেরা সাধারনত কোন বেলায় কি ধরনের খাবার খায় সে আলোচনার পাশাপাশি, অন্য দেশের লোকেরা সকালে, বিকেলে, রাতে কখন কি খায় সে আলোচনা হতো কিংবা সে দেশের প্রধান খাবার কী এবং কেনো ইত্যাদি। এভাবে ডাচ কালচারের পাশে পাশে রাশান, ইরাকী, তুর্কী, সোমালিয়া সব দেশ সম্পর্কেই কম বেশি জানা হতো। অহনা বাংলাদেশের খাদ্যভাসের কথা বলতেই টীচার টাশকিত। কি করে কোন দেশের লোক প্রত্যেক বেলায় গরম খাবার খেতে পারে, তাও এমন একটি বিশ্বনন্দিত গরীব দেশ। আমাদের দেশে সকালে রুটি - ভাজি কিংবা পরটা - মাংস নাশতা, কিন্তু পশ্চিমে সেটা রাতের খাবার। এর একটা বাস্তব দিকও আছে ভরপেট এতো খেলে শরীরে আলস্য যেমন আসে তেমনি প্রতিবেলায় এধরনের খাবার তৈরী করার সময়ও এদেশের লোকের হাতে থাকে না।
শুধু ডাচ কথা নয়, ডাচ জীবনে মানিয়ে নেয়ার জন্য অহনা সাধারণ ডাচ লোকদের মতো সাইকেল চালানোও শিখতে লাগল। কাওকে যদি বলা হয় পাঁচটি শব্দের দ্বারা নেদারল্যান্ডসকে বর্ননা করো তাহলে সে হবে, সাইকেল, উইন্ডমিল, দুধ -চীজ, খাল - বিল আর টিউলিপ। এদেশের লোকের সংখ্যা পনর মিলিয়ন কিন্তু কথিত আছে পনর মিলিয়ন লোকের জন্য আঠারো মিলিয়ন সাইকেল আছে। প্রতিটি বাড়িতেই প্রতিটি লোকের সাইকেল আছে, সে চালাক বা না চালাক। যদিও এরা প্রত্যেকেই সাইকেল চালায়। সাইকেল যেহেতু তাদের প্রধান বাহন তাই প্রতি বাড়িতেই দু একটা রিজার্ভ সাইকেল থাকে বিপদের সময়ের জন্যে। পরিবেশের জন্য মানুষের ভালোবাসা কি অকৃত্রিম হতে পারে তা এ জাতির থেকে শিক্ষনীয়। বাড়ির দরজায় গাড়ি লক করে রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দর পরিবেশ উপহার দেয়ার জন্যে সাইকেল চালিয়ে সাধারনত দৈনন্দিন কাজ সারে। সাথে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ব্যায়ামটাও হয়ে যায়। ডাচ শেখা আরামের ছিল কারণ তারা দুজনেই ডাচ বলতে পারত না তাই ভাষার ব্যাপারে দুজন দুজনার ওপর নির্ভরশীল কিন্তু সাইকেল শেখা নিয়ে অর্ন অহনার উপর চড়াও হয়ে পড়ত। এভাবে কেনো সাইকেল কাঁপছে, কেনো পড়ে পড়ে যাচ্ছো, সাইকেল চালানো কি এতো কঠিন যে এতো সময় লাগবে, দু ঘন্টায় লোকে সাইকেল চালানো শিখে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে অহনা দেখল অর্ন পাশে থাকলেই সাইকেল নিয়ে অহনা পড়ে যায়, নইলে একা একা সে বেশ ভালোই ম্যানেজ করতে পারে।
তানবীরা
০৬.০৬.১০
(চলবে)
Wednesday, 2 June 2010
কেউ কথা না রাখলেই বা কী
জন্মের আগে বংগবন্ধু তার আবেগঘন ভাষণে বলেছিলেন
আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদেরকে স্বধীনতা দিবো।
রক্ত দিলাম, জীবন দিলাম, সম্মান দিলাম
কিন্তু সেই অভীষ্ট স্বাধীনতা আজো এলো না, উনচল্লিশ বছর অপেক্ষায় আছি।
ভোটের আগে বড়আপা বলেছিলেন, আর কিছুদিন অপেক্ষা করো, তোমাদেরকে আমি বিদ্যুতের কষ্ট থেকে মুক্তি দিবো
বড়আপা আমি আর কতো অপেক্ষা করবো
বিদ্যুতের অভাবে যেদিন এসি বন্ধ হয়ে, ফ্যান বন্ধ হয়ে, আইপিএস বন্ধ হয়ে আমার মেকাপ গলে, চামড়ায় ফুসকুড়ি বেরোবে, তারপর তুমি আমায় বিদ্যুত দিবে?
একটাও দামী গাড়ি চড়তে পারিনি কোনদিন
মার্সিডিজ, ক্যাডিলাক দেখিয়ে দেখিয়ে চড়েছে ম্যাডামের ছেলেরা
বাবা আমাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিলেন দেখিস একদিন তোরাও
বাবা এখন বৃদ্ধ, আমাদের চড়া হয়নি কিছুই
সেই মার্সিডিজ, সেই ফেরারী, সেই ক্যাডিলাক
আমাদের কেউ কোনদিন চড়তে দিবে না
মুখের মধ্যে সুগন্ধী ক্রীম মেখে দাদু বলেছিলেন
যেদিন তোমরা হাবিবের পার্সোনায় যাবে
সেদিন তোমাদের চামড়াও এই আমার মতো টাইট হবে
সৌন্দর্য রক্ষার জন্য আজ আমরা হাতে নিয়েছি আড়ংয়ের নিম সাবান
অনন্ত টাকা খরচ করছি ওমেন্স ওয়ার্ল্ডে
তবুও কাজ হচ্ছে না কিছুই, চামড়া এখনো খুলন্ত
উনচল্লিশ বছর কাটল কেউ কথা না রাখলেই বা কী
তানবীরা
০২.০৬.১০
Saturday, 22 May 2010
অহনার অজানা যাত্রা (চার)
সেই ফ্ল্যাটের আবার জানালা শীতের জন্য কায়দা করে লাগানো, দেশের মতো পাট পাট করে খোলা যায় না। ফ্ল্যাটটা সিটি সেন্টারের কাছে হওয়ায় আশপাশে লোকালয় ভাব নেই। একই কম্পাউন্ডে কিছু ফ্ল্যাট আর কম্পাউন্ডের বাইরে আরো কিছু বড়ো বিল্ডিং এ নানা কোম্পানীর অফিস। এই পুরো জেলখানার মধ্যে একটু মুক্তি হলো বেডরুমের পাশের ব্যালকনি যেখান থেকে নীল আকাশটা দেখা যায়। কম্পাউন্ডের মধ্যে সব বিলডিং গুলো পাশে অনেক জায়গা রেখে ফাঁকা ফাঁকা করে বানানো, প্রায় পুরো ফ্ল্যাটের মধ্যে থেকেই আকাশ চোখে পড়ে। অর্ন এতো আগ্রহ করে তার নিজের হাতে সাজানো ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো যে অহনা মনে মনে যাই ভাবুক মুখে বেশ একটা খুশী খুশী ভাব ধরে রেখেছে। বেচারার সাথে একটা ভদ্রতা আছে না। ফ্ল্যাট দেখা শেষ হলে সে গেলো ফ্রেশআপের জন্য। ততোক্ষনে অন্যদিকে ফোন বাজতে শুরু করেছে অর্নর বন্ধুদের, ওরা অপেক্ষায় আছে, কখন আসবে, তারপর পার্টি শুরু হবে।
এখন এখানে মোটামুটি সবারই ক্রিসমাস ঈভের ছুটি, সবাই বেশ অহনার নেদারল্যান্ডস আসাকে উপলক্ষ্য করে পার্টির আমেজে আছে। এরপরের বেশ কদিন ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার্স ঈভ পর্যন্ত হৈ হুল্লোড় করে আর পার্টি করে দাওয়াত খেয়েই কাটল তাদের। দেখতে না দেখতেই চোখের পলকে এছুটি শেষ হয়ে গেলো, অর্নেরও অফিস শুরু হলো। সে এখন সারা ফ্ল্যাটে একা। কি করবে কি করবে হঠাত একা হয়ে কিছু কাজ খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিছুক্ষন বাড়ি ঘর গোছালো, টিভি দেখল। টিভিও কি দেখবে, সি।এন।এন, বি।বি।সি, এম।টি।ভি ছাড়া আর সব কিছুইতো ডাচ, ডয়েচ, ফ্রেঞ্চ কিংবা টারকি ভাষায় যার এক বর্ণও সে বুঝতে পারছে না। আর আছে ডিসকোভারী কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফীক চ্যানেল যা সব সময় তার কাছে এতো ইন্টারেষ্টিং না। একা একা একদিনও বাইরে যায়নি তাই বাইরে যাওয়ার অপশনটাও বাদ দিলো। আবার এই ঠান্ডার মধ্যে বেরোনো মানেই একগাদা জামা কাপড় চাপাও, সেটাতেও মন সায় দিচ্ছে না। কি করি আর নাকরি ভাবনার মধ্যেই অফিস থেকে অর্নের ফোন আসলে কথায় কথায় অহনা জিজ্ঞেস করলো, ‘রাতের খাবার কি হবে’? অর্ন বলল, ‘তোমাকে সে সব নিয়ে ভাবতে হবে না তুমি রেষ্ট নাও’। এ আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়ে সে ঘুমাতে চলে গেলো, কাজ যখন কিছু নেই এই শীতের মধ্যে তখন একটু ঘুমোনোই যাক এই ভেবে।
ঘুম ভাঙ্গল একেবারে অর্ন বাড়ি ফেরার পর, অর্নই জাগালো তাকে। এ কথা সে কথা, টুকটাক গল্প হলো তারপর যখন খাওয়া দাওয়ার প্রসংগ এলো সে রান্নাবান্না করেনি কিছু শুনে অর্নের মুখের আলোটা যেনো কোথাও চলে গেলো। তখন কেনো জানি তার মনে হলো অর্ন ভদ্রতা করে রান্নার কথা না করলেও মনে মনে হয়তো আশা করে ছিলো অহনা রান্না করে রাখবে। কিন্তু এ কদিনে চাল ডাল কোথায় কী কিছুই দেখিয়ে দেয়নি তাকে। সে কি করবে আর কি না বুঝেই পেলো না, এই নতুন পরিবেশে এখনও অহনার স্বাভাবিক বুদ্ধি কাজ করছে না। বিয়ের হুড়োহুড়ি বাদ দিলে একা এই পরিবেশে দু সপ্তাহ ধরে অর্নের সাথে তার পরিচয়। অন্য দেশে অন্য পরিবেশে অনেকটা অপরিচিত অর্নের কাছে অনেক সময় সে ততোটা স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করে না। অর্নই রান্না করতে গেলো, কিছু না বুঝতে পেরে সেও তার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেলো। অপটু অহনা কি করবে বুঝতে না পেরে একবার এদিক যাচ্ছিল আর একবার অন্যদিকে। তারপর না পেরে গম্ভীর অর্নকে বলেই ফেলল সে এক সময় ভদ্রতা করে, ‘আমি কি কিছু করব’? বলে তার মনে হলো অর্ন হয়তো এই অপেক্ষাতেই ছিলো, ফস করে বলে উঠল, ‘তুমি আর একা একা দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে, চলো দুজন একসাথেই রান্না করি, তাহলে কিছুটা শিখবে আর তাড়াতাড়িও হবে’। বলেই ইয়া বড় একটা ছুরি আর আপেলের সাইজের একটা পেয়াজ অহনার হাতে ধরিয়ে দিলো।
এই সাইজের ছুরি অহনা কোরবানী ঈদের সময় ছাড়া আর কখনও তেমন দেখেনি আর এই সাইজের পেয়াজতো নয়ই, দেখেই ভয় পেলো সে। আনাড়ি অহনা ছুরি সামলাবে না পেয়াজ। নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে যাচ্ছ কিন্তু পেয়াজ সামলাতে পারছে না। কিন্তু অর্নকে তা বুঝতেও দিতে চাচ্ছে না যদিও অর্ন তা ঠিকই টের পেয়ে গেলো আর হতাশ গলায় বলে উঠল, ‘একটা পেয়াজ কাটাও কি আমাকে শেখাতে হবে’! লজ্জায় সে মাটির সাথে মিশে গেলো অর্নের এ কথায়। যদিও তার বিয়ের আগে যখন অর্নের সাথে কথা হয়েছিলো, বলেছিলো রান্নাবান্না সে বিশেষ কিছুই জানে না, অর্ন তখন বলেছিলো বউকে দিয়ে রান্না করানোর জন্য সে বিয়ে করছে না। কে জানে সত্যি না মিথ্যে বলেছিলো।
যে অহনা বাবা মায়ের কাছে থাকতে নাকের জ্বালায় অনেক সময় চোখে দেখতে পেতো না, এই অচিন ভূমিতে এসে সে মোটামুটি সিধা হয়ে গেলো। যে আনন্দের জন্য বিয়ে করেছিল, ভেবেছিল বিয়ে হয়ে বেঁচে যাবে সে ভুত মাথা থেকে নেমে গেলো অচিরেই। আসার দুমাসের মধ্যেই অর্ন তাকে ডাচ ভাষা শিখার স্কুলে ভর্তি করে দিলো। এখানে a,b,c উচ্চারন দিয়ে শুরু হলো আবার পড়াশোনা। গ্রামার, শব্দের বানান, বাক্যের গঠন, টেন্স......
মনে হচ্ছিল তার চেয়ে সেই ইংরেজিতে নোট মুখস্থ, ভাইভা, টিউটোরিয়ালই ভালো ছিল। সাথে আবার একা একা অপটু হাতে তাকে গোটা সংসার সামলাতে হয়। যার সবচেয়ে কঠিনতম অংশ হলো মেহমানদারী। অপরিচিত সব লোকজনকে হাসি মুখে সামলানো তার কাছে বিরাট এক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে উঠলো। লোকজন এলে চা নাস্তা কী দিবে না দিবে না সেটাই বুঝতে পারে না আদ্ধেক সময়। কে ভদ্রতা করে না করছে আর কে সত্যিকারের না করছে, তার মুখ আর ভাবভঙ্গী থেকে আন্দাজ করা ত্রিকোনমিতি করার চেয়েও কঠিন আকারের সমস্যা হয়ে ওঠল। মোটামুটি হিমসিমের মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছিল তার। যে বাড়ি প্রথমদিন দেখে অহনার ছোট পাখির বাসা মনে হয়েছিল সেই বাড়ি সামলানোই আজ তার কাছে বিরাট দক্ষ যজ্ঞ মনে হতে লাগল।
কতো দ্রুত জীবন অন্য অপরিচিত খাতে বইতে লাগল অহনা তার কোন নাগালই পাচ্ছিল না। এক সময় দিনের শুরু হতো খবরের কাগজ নিয়ে ভাইবোনদের কাড়াকাড়ির মধ্যে দিয়ে। আর এখন বিনা পয়সায় খবরের কাগজ পোস্ট বক্সের মধ্যে ফেলে দিয়ে যায়, কাড়াকাড়ির করারও কেউ নেই কিন্তু নিরক্ষর লোকের মতো তার ভেতরের ছবি দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না যে দিনের পর দিন খবরের কাগজ ছাড়াই সে বেঁচে বর্তে আছে। আগে খবরের কাগজের অফিসের ছুটির কারণে একদিন কাগজ না আসলে সে দিনে কমসে কম তিন বার খবরের কাগজের খোঁজ করতো। সেই জীবন কতো দ্রুত আলু - পটলের হিসাবের মধ্যে ডুবে গেছে।
স্বামী ছাড়া আর তেমন কোন বন্ধু তৈরী হয়নি তার এ দেশে। দেশ থেকে চিঠি আসতে বারো থেকে পনেরদিন সময় লাগে। স্কুলের পড়া আর চিঠি লেখার বাইরে একমাত্র কাজ তার সারাক্ষন ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে সেই আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকা। খুঁজ়ে দেখার চেষ্টা করতো এইযে মেঘটা ভেসে আসছে এটা কী বাংলাদেশ থেকে আসলো? এতে কি অহনার মায়ের চোখে তার জন্য লুকিয়ে থাকা মায়াটুকুর ছায়া দেখা যায়? নাকি বোনের ভালোবাসার গন্ধ পাওয়া যায়? নাকি এইযে মেঘটা যেটা এখন ভাসতে ভাসতে তার দৃষ্টি সীমার আড়ালে চলে যাচ্ছে, সে তার মায়ের কাছে তার খবর পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। বারো তলার ওপর থেকে নীল আকাশটাকে অনেক কাছের মনে হতে লাগল তার, বেশীরভাগ সময় মেঘাচ্ছন্ন থাকা এই আকাশের সাথে গল্প করে আর কিচেন ক্যালেন্ডার এর এক তারিখকেই দশবার দশ রঙের পেন্সিল দিয়ে কেটে একাকী তার দিন কাটতে লাগল। আকাশটাকেই নিরাপদ বন্ধু মনে হতো, আর অন্য যা করতেই যেতো তাতেই যেনো কেমন একটা বিভীষিকা মাখানো ছিল।
(চলবে)তানবীরাপরিশোধিত ২৩.০৫.১০
Monday, 17 May 2010
অহনার অজানা যাত্রা (তিন)
তারা তাদের কথাবার্তা বলার ফাঁকে ফাঁকে কফি খাচ্ছিলো আর মাঝে মাঝে এসে সেখানে থাকা ভিনদেশীদের ধরে ধরে বেশ জোরে হাত মুচরে দিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জোরে মারছিলো। মাথা দেয়ালে ঠুকে দিয়ে, নাকে চোখে মুখে এলোপাতাড়ি ঘুষি। মারার সাথে সাথে সেসব ভিনদেশীদেরকে কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছিলো যেমন তাদের পাসপোর্ট কোথায়, তারা কি যুগোশ্লাভিয়া থেকে এসেছে কিনা, কি জন্যে এসেছে? ভিসা কোথা থেকে যোগাড় করলো ইত্যাদি ইত্যাদি। ছেলেগুলো কিছুক্ষন চুপ থাকে আবার কিছুক্ষন কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ছেলেগুলো যাইই বলছে তা তারা শুনছে কি শুনছে না বোঝা যাচ্ছে না, কারন তারা ছেলেগুলোকে মেরেই যাচ্ছিলো। এমনভাব করে মারছিলো যে ও কিছু নয়। কিন্তু ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো অহনা কারণ অহনার চোখের সামনে এ ধরনের কঠিন পদ্ধতির মারধোর এই প্রথম। তার সহযাত্রী ভদ্রলোকের পাসপোর্ট নিয়ে ইউনিফর্ম পরা লোকগুলো তাকে সমানে জিজ্ঞেস করে চলেছে কেনো সে নেদারল্যান্ডসে এসেছে, কে তাকে ভিসা যোগাড় করে দিয়েছে, কি চায় সে ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি যাই বলছিলেন তাতেই অফিসারদের গলা আরো চড়ছিলো, অফিসাররা তার জবাব মেনে নিতে পারছিলেন মনে হচ্ছে। অফিসাররা তার সহযাত্রীকে তখনও না মারলেও প্রায় মারার পর্যায়েই চলে এসেছে এখন ঘটনাটি। অন্যএকজন অহনাকে একটু দূরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সে এই ভদ্রলোককে চেনে কি না? ভয়ে আধমরা অহনার মুখ দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো সত্যি কথাটা বেরিয়ে গেলো, “না”। হয়তো দুদেশের পাসপোর্ট ভিন্ন হওয়ায় তারা অহনার কথা বিশ্বাস করে নিলেন আর তাকে তারা ঘাটালেন না।
তার চেয়েও বিস্মিত সে, তার প্রতি তাদের সৌজন্যের কোন ঘাটতি নেই। অহনাকে দিব্যি জিজ্ঞেস করল কফি খাবে কিনা, ঠান্ডা লাগছে কিনা ইত্যাদি। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অহনাকে এই ফাঁকে একজন বলল তার চোখ খুবই সুন্দর কালো, এটাকি সত্যিকারের চোখের রঙ্গ না লেন্স লাগিয়েছে সে !! হকচকানো অহনা তার সামান্য জ্ঞান দিয়ে এইলোকগুলোকে কি ভালোর দলে ফেলবে না খারাপের তাও বুঝতে পারছে না। তখন ভিতর থেকে সেই অফিসার ফিরে এসে অহনাকে তার পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে বললেন, ‘It’s alright, you may go”. অহনা উঠলো বসা থেকে বটে কিন্তু এখন তার কী করনীয়, কোনদিকে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মুখচোখ দেখে হয়তো সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। একজন ইউনিফর্মধারী এগিয়ে এসে তাকে বলল তুমি জানো তোমার লাগেজ কোন বেল্টে আসবে? মাথা নেড়ে সে বলল, ‘না’। তখন লোকটি বলল, ‘চলো আমার সাথে’। সেই লোকটি যেয়ে অহনার লাগেজ খুজে বের করল, দেরী দেখে বেল্ট থেকে সুটকেস তুলে কেউ একপাশে রেখে দিয়েছে। তিনি অহনার ভারী সুটকেস ট্রলিতে তুলে কাষ্টমস পার করে একেবারে দরজার সামনে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অর্ণকে কোথাও দেখা যাচ্ছে কী না। অন্য পরিবেশ প্রথমে অর্নকে চিনতেই পারছিলো না সে। অনেকক্ষন তাকিয়ে অহনা দেখলো অর্ণ দাঁড়িয়ে আছে অস্থির এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। সে মাথা নেড়ে অফিসারকে জানাতে, তিনি তাকে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন।
যাত্রার ধকল আর স্বামীর কাছে আসার আনন্দ নিয়ে অহনা সামনে আগালো। মনে মনে ভাবছে তাকে দেখে অর্ন না জানি কতো খুশী হবে। কিন্তু অহনাকে দেখে বেশ একটু যেনো রেগেই বলল, ‘তুমি এতোক্ষন কোথায় ছিলে? সব্বাই চলে গেলো আর তোমার কোন পাত্তা নেই। আমি বারবার লষ্ট পারসানে যাচ্ছি তারা বলছে একঘন্টা না হলে লষ্ট পারসন ঘোষনা করার নিয়ম নেই’। অহনাতো আকাশ থেকে পড়ল, ‘তারমানে? আমি আবার কি করলাম’? সে তার জীবনের সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা শুরু করতেই অর্ন থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি কেনো পুলিশকে বললেনা তোমার বর বাইরে দাঁড়ানো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলেইতো তারা তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতো’। অহনাতো আরো অবাক, এরমধ্যে পুলিশ আসলো কোথা থেকে? কোনটা পুলিশ? তারচেয়েও বড় ‘আমি কেনো শুধু শুধু তোমার কথা বলতে যাবো? তারাতো জানতে চায়নি তোমার কথা’? তুমি আসলে কোথা থেকে এরমধ্যে? এরকম অনেক কথার পর অহনা জানতে পারলো যে আসলে অহনাকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটকে নিয়ে গিয়েছিলো এবং এতোক্ষন তাদের হেফাজতে ছিলো সে। অহনা কি ছাই তা জানে? সেতো ভেবেছে ইমিগ্রেশনের বুঝি এই নিয়ম এভাবেই সকলকে আন্তর্জাতিক ভ্রমন করতে হয়। পুলিশ যদি অহনাকে ধরে নিয়েই যাবে তবে কেনো সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে আর কফি খেতে সাধবে? সিনেমায় যে দেখি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তার সাথে কোন মিল থাকলে তবেই না বুঝবো যে কি হয়েছিলো???!!!
একথা সেকথা বলতে বলতে, বিশাল ঝকঝকে সুসজ্জিত এয়ারপোর্টের চারিধার দেখতে দেখতে হেটে অহনা অর্নের সাথে এয়ারপোর্টের পার্কিং এ এলো। অর্ন যে গাড়ির লক খুলছে তা দেখে অহনার চক্ষু যাকে বলে চড়ক গাছ, সুজুকি গাড়ি, তাও আলটো!! বি, এম, ডব্লিও, মার্সিডিজ দূরে থাক ওপেলও না। মোহ ভঙ্গের এই ছিল শুরু। বিদেশ এসেছে অহনা সুজুকি চড়তে! অনেক কষ্টে সৃষ্টে আলটোতে মালপত্র ঢোকানো হলো। তারপর শুরু হলো যাত্রা বাড়ির পথে। পার্কিং এর বাইরে বেরিয়ে দেখল চারদিক ধূসর হয়ে আছে, হাইওয়ের পাশে সারি সারি গাছ লাগানো আছে যেগুলোকে গাছ কম আর শুকনো খড়ি মনে হয় বেশী। কোন গাছেই কোন পাতা নেই শুধু ডাল গুলো নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পুরো রাস্তা ছাই রঙ্গা, স্থবির একই রকম ঘোলা ঘোলা ছবি দেখতে দেখতে অহনা বাড়ি এলো। যদিও এ ধরনের ছবি অহনা এর আগে ভিউকার্ডে বা ক্যালেন্ডারের পাতায় অনেকবার দেখেছে, তখন দেখলে বুকের ভিতরে একটা শিরশিরানি অনুভব হতো, মনটা বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক লাগতো, মনে হতো আহা না জানি কি শান্তি, কি সুন্দর। কিন্তু এখন এর মাঝে এসে পরে একে বড় বেশী প্রাণহীন মনে হচ্ছিল। আকাশ দেখে অহনার মনে হচ্ছিলো ভোরবেলা যদিও হাতের ঘড়ি জানান দিচ্ছিল দুপুর বেলা। গাড়ি এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাকিং লটে এসে পৌঁছলো, চারিদিক ফাঁকা কোথাও কেউ নেই।
(চলবে)
তানবীরা
পরিশোধিত ১৮.০৫.১০
Sunday, 9 May 2010
অহনার অজানা যাত্রা (দুই)
সারারাত বৃষ্টি হয়ে সকালে খুব মিষ্টি রোদ উঠেছে। চারপাশটা তাই অনেক স্নিগ্ধ। দুরু দুরু বুকে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে অহনা এ্যম্বেসীর ভিতরে গেলো হাতের ফাইল শুদ্ধ, সে টেবিলের একপাশে বসল আর অন্যপাশে বসলেন একজন শ্বেতাঙ্গ আর একজন দেশী ভাই। শ্বেতাঙ্গ ভাই অবশ্য বেশ হেসে তার খোঁজ খবর নিলেন, সে কি করতো, কবে বিয়ে হলো, অর্ন অহনার পূর্ব পরিচিত কিনা, বাবা মাকে ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি, দেশী ভাই অবশ্য তেমন কোন কথা বললেন না শুধু শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে তার ভিতরটা এফোড় ওফোর করে এক্সরে করে দেখার চেষ্টা করলেন। দৃষ্টি দিয়ে উনি বুঝার চেষ্টা করছিলেন সে কি টেররিষ্ট কিংবা কোন ভয়াবহ অপরাধী কী না, যে নেদারল্যান্ডসে চলে যেতে চায় তাকে ফাঁকি দিয়ে। শ্বেতাঙ্গ ভাইয়া অবশ্য খুব আরামদায়ক ভঙ্গীতে ছিলেন, অহনা কফি খাবে কিনা তাও এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন এমনকি চলে আসার সময় তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। এরি মধ্যে ফাইলে থাকা কাগজগুলো দু আঙ্গুলে সামান্য একটু উলটে পালটে দেখলেন, সমস্ত কাগজের মধ্যে থেকে তার পাসপোর্টটাই শুধু রেখে দিলেন আর একটা রিসিট দিয়ে বলে দিলেন দু দিন পর এসে এতো টাকা ভিসা ফি দিয়ে যেনো সে পাসপোর্টটা নিয়ে যায় সাথে সেফ জার্নি টু হল্যান্ডও উইস করলেন। শ্বেতাঙ্গ ভাইয়ের ভদ্রতায় বিমুগ্ধ অহনা ভেবেই পেলো না কেনো লোকে এ্যাম্বেসী নিয়ে এতো খারাপ খারাপ গল্প ছড়ায়। আসলে লোকের খেয়ে দেয়ে কাজতো নেই, কাজ একটাই ভালো ভালো জিনিসের বদনাম দিয়ে বেড়ানো। এরপর থেকে তার যার সাথেই দেখা হলো তাকেই তার এই ‘জার্নি টু এম্বেসী’ গল্প করে শোনাতে লাগল। যথাদিনে ভিসা কাম পাসপোর্ট আনতে গেলো সে, রিসিপশনে বসা সুন্দরী ঘটি (কোলকাতাইয়া) আন্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে পাসপোর্ট দিতে দিতে একটু গল্পও করল তার সাথে, কবে যাচ্ছে, শপিং করেছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, খুলে অহনাতো অবাক, একটা ঝিকমিক দেয়া ষ্টিকার আছেতো বটে লাগানো কিন্তু সেখানে কোথাও নেদারল্যান্ডস লেখা নেই, আছে ‘বেনেলুকক্স’ লিখা। এই বেনেলুকক্স মানে কি? অহনা অবশ্য অর্নের কাছে শুনে ছিলো বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের ভিসা এই এক এ্যম্বেসী থেকেই ইস্যু হয়। কি দিতে কি দিয়ে দিলো চিন্তায় পড়ে গেলো সে। শ্বেতাঙ্গ ভাইয়ার মিষ্টি মিষ্টি হাসি ভদ্রতার পিছনে কি তাহলে এই শয়তানীই লুকিয়ে ছিল? তাহলে কি এ্যাম্বেসী নিয়ে লোকজনের ভয়াবহ সব গল্প সত্যি!? যাই হোক উপায় না দেখে রিসিপশনে বসা আন্টিকেই জিজ্ঞেস করল সে এই ‘বেনেলুক্স’ চীজটি কি? আন্টি দেখতে বেশ কনফিডেন্ট, বেশ সবজান্তা সবজান্তা ভাব আর সাজগোজের বাহারি কারণে তখন তার মনে হয়ছিল পৃথিবীর চলমান সমস্ত ঘটনাবলী আন্টির নখদর্পনে। কথাবলার ভঙ্গীতে আরো মনে হয় আন্টি সব প্রশ্নের উত্তর জানে। কিন্তু তার বিধি বাম। আন্টি আবার চিরকালের চরম সেই সত্যটি প্রমান করলেন, ‘মুখ দেখে ভুল করো না, মুখটাতো নয় মনের আয়না’ । আন্টি দেখা গেলো নিজেও বিশেষ কিছু জানেন না এ ব্যাপারে, তো তো করে যা বললেন তার মানে দাড়ায় এই, যা দিয়েছেন তারা বিচার বিবেচনা করে ঠিকই দিয়েছেন, অহনার এতো কথা বুঝে কাজ নেই, সে যেনো বিসমিল্লাহ বলে প্লেনে ঝুলে পড়ে। এদিকে অহনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, যাবার আর মাত্র দু সপ্তাহ আছে, প্লেনের কনফার্ম টিকিট, শপিং, আত্মীয় স্বজনের বাসায় দাওয়াত খাওয়া প্লাস বিদায় নেয়া প্রায় সব সারা, এখন যাওয়া না হলে কিংবা এয়ারপোর্ট থেকে ফেরৎ আসলেতো প্রেস্টিজের ফালুদা হয়ে যাবে। উপায়ন্তর না দেখে অর্নের ফোনের অপেক্ষায় রইলো সে।
অর্ন ফোন করতেই কাঁদো কাঁদো গলায় অহনা বললো সর্বনাশ হয়ে গেছে। নেদারল্যান্ডসের ভিসার বদলে কোথাকার কোন ‘বেনেলুক্সের’ ভিসা দিয়েছে তাকে। অর্ন ৫,৮৫ গিলডার উইথ আউট ১৭,৫ পার্সেন্ট ট্যাক্স পার মিনিট এর ফোন কলে মোটেই তার নব পরিনীতা বউ এর সাথে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন কিংবা বেনেলুক্স নিয়ে সেই মূর্হুতে আলোচনায় যেতে কোন আগ্রহ দেখাল না বরং শান্ত গলায় বলল সর্বনাশের কিছু হয়নি, এতো কথা এখন না বুঝলেও চলবে, চুপচাপ প্লেনে চড়ে যেনো সে চলে আসে, অর্ন তার অপেক্ষায় আছে। যদিও অহনা একটু বেকুব হয়ে গেলো সে মুহূর্তে কিন্তু তখনও বেকুব অহনা বুঝতে পারেনি তার জীবনের বেকুব হওয়ার এইতো কেবল শুরু, এখন জীবনই যাবে বেকুব হয়ে হয়ে। সে যাই হোক, এক নিকষ কালো রাত্রিতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে মা, ভাই-বোন, বন্ধু - বান্ধব, চির পরিচিত দেশ আর পরিবেশ পিছনে ফেলে অহনা যাত্রা করলো অজানার উদ্দেশ্য। মায়ামায় বাবা সাথে এলেন তাকে এগিয়ে দিতে, দিল্লীতে এসে প্লেন চেঞ্জ করতে হবে। দিল্লী বিরাট এয়ারপোর্ট, নেমেই মনে হলো তার বাবা সাথে না এলে হারিয়ে সেতো যেতোই এখানে। কিন্তু সাথে বাবা, এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি, অথরিটি আর সিডিউল মনিটরিং বোর্ডের কারণে অহনা হারাতে পারলো না। সেখান থেকে কে।এল।মে চেপে অহনা নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। প্লেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তারায় তারায় ভর্তি নীল কোজাগরী আকাশ দেখছিলো সে চুপ করে। মাঝে মাঝে নাম না জানা কষ্টে হঠাৎ ভীষন চুপচাপ হয়ে গিয়ে কাঁদছিলো। কেনো চোখ ভিজে আসছিলো তা সে জানে না। তখনও সবাইকে ছেড়ে আসার কষ্ট সে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি আবার অর্নের কাছের যাওয়ার আনন্দও ছিল। একটা নাম না জানা ভীতি মিশ্রিত অনুভূতি সে সময়টায় তাকে ব্যকুল করে ফেলেছিল।
সে সময় খাবার দিতে আসা কে।এল।এম এর একজন বেঙ্গলী স্টুয়ার্ডেস পরিস্কার বাংলায় অহনাকে প্রায় ধমক দিয়েই দিলেন, ‘এই মেয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছো একা একা, আবার কাঁদছ’? ষ্টুয়াডের্সের ধমক খেয়ে অহনা একটু ভয় পেলো মনে মনে, আবার প্লেন থামিয়ে নামিয়ে দিবে নাতো? তাহলে হয়েই যাবে, সারা গোষ্ঠীর ধমক খেতে হবে তখন, বলবে, কাঁদতে গিয়েছিলি কেনো তুই? কোন ঝামেলা না হয় সেভেবে কোন উত্তর না দিয়ে সে চুপ করে রইলো। পাশের সীটে এক গুজরাটি কিংবা পাঞ্জাবী ভদ্রলোক ছিলেন অহনার সহযাত্রী, মোটামুটি তরুন বয়সী। তিনি তার কান্নাকাটি দেখে আর হয়ত নিজের কৌতুহল থেকেও খুটিনাটি জিজ্ঞেস করছিলেন। অহনার নিজের বন্ধু - বান্ধব আর তার বাড়ির বাইরের বর্হিবিশ্ব সমন্ধে কোন ধারণা ছিল না বিধায় যা যা তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন সে সবকিছুর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো, সাধারণ সৌজন্যতা ভেবে।
প্লেন একটানা দশ ঘন্টা উড়ে ক্রিসমাস ইভের এক ঠান্ডা ভোরে নেদারল্যান্ডসে এসে পৌঁছলো। অহনা বোর্ড পড়ে পড়ে হেটে হেটে ইমিগ্রেশন অবধি পৌঁছলো সাথে সেই সহযাত্রী ভদ্রলোক, তিনি তখন তার পিছন ছাড় ছিলেন না, সে অবশ্য ভেবেছিলো পাছে সে যদি কোথায় হারিয়ে যায় সেই জন্য। ইমিগ্রেশনের জন্য কয়েকটা গেট আছে, তার মধ্যে পরিস্কার ইংরেজী ও অন্যান্য আরো কয়েকটি ভাষায় লেখা আছে যারা প্রথমবার নেদারল্যান্ডসে ঢুকছেন তারা যেনো এই পথে আসেন। অহনা সেই বিশেষ কাউন্টারের পাশে যেয়ে তার পাসপোর্ট সেখানে বসা একজন অফিসারকে দিলে, তিনি খুবই হাসি হাসি মুখে সেটি নিলেন, সাথে সাথে অহনার সহযাত্রী ভদ্রলোকও তার পাসপোর্ট দিলেন সেই অফিসারকে। সহযাত্রী ভদ্রলোক এমন ভাব ভঙ্গি করার চেষ্টা করছিলেন বার বার যে তিনি তার সাথেই ভ্রমন করছেন। পাশের যাত্রীর পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পরই সেখানে বসা অফিসার ভদ্রলোক তাদেরকে ওয়েট বলে দাড় করিয়ে দিয়ে পাসপোর্টগুলো নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। একটু পরেই তিনি তার এক সহকর্মীকে নিয়ে সেখানে ফেরত এলেন এবং তাদের বললেন তার সেই সহকর্মীর সাথে যেতে। বেচারী অহনার কোন ধারণাই নেই কেনো কার সাথে কোথায় যাচ্ছে, যেতে বলা মাত্র কোন প্রশ্ন করা ছাড়াই সে সেই ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে হেটে যাচ্ছিল। সবকিছু এতো দ্রুত আর অদ্ভূতভাবে ঘটছিলো যে তার সব তালগোল পাকানো লাগছিল, কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিল না।
(চলবে)
তানবীরা
পরিশোধিত ০৯.০৫.১০
অহনার অজানা যাত্রা
বেশ হুড়মুড় করেই ধরতে গেলে অহনার বিয়েটা হয়ে গেলো অর্নর সাথে। পাত্র অর্ন বিদেশ থাকে, তার ছুটি ফুরিয়ে এসেছিলো প্রায় এই মেয়ে বাছাবাছি করতে করতেই, অবস্থা অনেকটা সে পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে বিয়ে না করেই অর্নকে আবার কর্মস্থলে ফিরে যেতে হবে, যদিও পাত্রপক্ষীয় প্রথানুযায়ী অর্ন ছুটিতে আসার আগে থেকেই অর্নের পরিবার মেয়ে বাছার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক যেনো মিলাতে পারছিলেন না। এই মেয়ের বাবা পছন্দ হয়তো ভাই না, সে মেয়ের ভাই পছন্দ হয়তো মেয়ে না। সেই অন্তিম মূহুর্তে একজন কমন বন্ধুর মারফত পাত্রপক্ষের পাত্রীপক্ষের যোগাযোগ হলো। তারপর মেয়ে দেখার সেই চিরন্তন পালা। তবে অহনাকে স্বীকার করতেই হবে সে ভাগ্যবতী বর্তমান সময়ে জন্মানোর কারণে। আজকের আধুনিক সমাজে পড়াশোনা জানা সোকলড আধুনিক শিক্ষিত লোকজনের ভিতরে যাইই থাকুক, সবার সামনে আর সেরকমভাবে মেয়ের হাতের আঙ্গুল, পায়ের গোড়ালির পরীক্ষা তারা নিতে পারেন না, সাজানো মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে। সাধারণ মামুলী দু-চারটা কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই তাদের ‘মেয়ে দেখা’ পর্বটি শেষ করতে হয়। তো সে ধরনের সহজিয়া পরীক্ষার মধ্য দিয়েই উতরে গেলো মোটামুটি মিষ্টি চেহারার, মাঝাড়ি গড়নের সদ্য কুড়িতে পা দেয়া অহনা। বিয়ের পিড়িতে বসার সৌভাগ্য ঘটলো তার।
বৃষ্টিভেজা এক সন্ধ্যায় মেহেদী রাঙ্গানো হাত নিয়ে ঝলমল করা আলোয় সাজানো বাড়িতে বউ সাজলো অহনা। তাড়াহুড়োর মধ্যে যতটা সম্ভব সেই আন্দাজের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়েই ঘটে গেলো অহনার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। যদিও ছোট ভাই বোনেরা প্রায়ই তার বিয়ে নিয়ে নানারকম প্ল্যানিং করতো। বোনদের মধ্যে বড় হওয়ায় কারণে অকারনেই বাড়িতে অহনার বিয়ের পরিকল্পনা চলতে থাকতো দিনমান বছর ধরে। নূতন কোন হিন্দী ফিল্মের গান হিট হলে তখনই সেটা অহনার গায়ে হলুদের নাচের জন্য ঠিক হয়ে যেতো, কদিন পর সেই গানের তোড় যেয়ে অন্য গান এলে দেখা যেতো আগেরটা বাদ হয়ে নতুনটা সিলেক্ট হয়ে যেতো। নতুন কোন শাড়ি বের হলোতো সব কাজিনরা মিলে ঠিক করে ফেলল অহনা বাজির গায়ে হলুদে তারা এটাই পড়বে। মাঝে মাঝে ছোট ভাইবোনদের সাথে অহনা নিজেও তার বিয়ের পরিকল্পনা করতে বসে যেতো, কোন গানের ব্যান্ড আনলে সস্তা হবে, কোন কমিউনিটি সেন্টার ভালো, কোন বান্ধবীর বিয়েতে নতুন কি দেখে এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বিয়ে নিয়ে পরিকল্পনাকারীদের লেভেলে অহনার বর বাদ দিয়ে আর সবই ঠিক করা ছিল বহুদিন ধরে। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেলো মাত্র দশ দিনের নোটিসের বিয়েতে অনেক ঠিক করা জিনিসই বাদ পড়ে গেলো সময়ের অভাবে। ছোটরা তাদের পরিকল্পনায় বাধা পাওয়ায় প্রথমে বেশ বিমর্ষ হলেও সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিন্তু তারাও সবাই খুশী।
অন্য সবার সাথে অহনা নিজেও খুশী তার বিয়েতে, তবে তার খুশীর উৎস অন্য জায়গায়। আর পড়াশোনা করতে হবে না এইভেবে সে আনন্দিত। রোজ রোজের টিউটোরিয়াল, ভাইভা, লাইব্রেরী, পরীক্ষা, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নোট মুখস্থ করার হাত থেকে অবশেষে পরিত্রান পাওয়া গেলো। যদিও বিদেশে বিয়ে করা নিয়ে অহনার প্রথমে খুবই আপত্তি ছিল কারণ পড়াশোনা করতে ভালো না লাগলেও টি।এস। সির ক্যাফেটেরিয়ায় কিংবা মাঠে, পাবলিক লাইব্রেরীর সিড়িতে, কলাভবনের মাঠে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে অহনার কোনই আপত্তি ছিল না। ভাবত শুধু আড্ডা দিয়ে আর হৈ- হুল্লোড় করেই যদি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যেতো। এখন বিয়ে হয়ে হঠাৎ করে সব ত্যাগ দিতে অহনার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। সকালে ডাসের কলিজা সিঙ্গারা কিংবা দুপুরে টি।এস।সির এক পিস মাংস দিয়ে দেয়া তেহারী মিস হয়ে যাবে, কেমন করে তা সম্ভব? কিন্তু পরে আত্মীয় স্বজনের অনেক বোঝানো সোঝানো আর বন্ধু বান্ধবের বিদেশ নামক বস্তুটা নিয়ে লোভনীয় অনেক গল্প শোনানোর পর অহনা অগত্যা রাজি হলো বিদেশী বিয়েতে।
এছাড়া অহনার সিক্স সেন্স এমনিতেও জানতো যে বেশী ট্যা - ফো করে কোন লাভ হবে না, বিয়ে তাকে বিদেশেই করতে হবে, পরিবারের মুরুব্বীরা কিছু অলিখিত কায়দা তৈরী করে ফেলেছেন। পরিবারের ছেলেরা বাপ - দাদার ব্যবসা বানিজ্য সামলাবে আর মেয়েদের বিদেশ পাঠিয়ে দিয়ে তাদের ভবিষ্যত নিশ্চিত রাখা হবে। এতে ডবল লাভ মেয়ে বিদেশে থাকে শুনতেও সামাজিকভাবে ভালো শোনায় সাথে মেয়েরা ভালো থাকলে বাবার সম্পত্তির পাওনাও আর দাবী করতে আসবে না। ঘরের মালকড়ি ঘরেই থেকে যাবে। যদি না জামাই ব্যাটা অনেক ছোটলোক হয়, তবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এম - এস, পি - এইচ - ডি করা ছেলেদের মনে যাইই থাকুক, বিদেশ ফেরতা হয়ে শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে দলাদলি করতে যাওয়াওতো তাদের পক্ষে আর সম্ভব না। সুতরাং বিদেশী পাত্রে, পাত্রী পক্ষের ডবল গ্যারান্টি, মেয়েও ভালো থাকবে সাথে বাবা - চাচারাও।
অহনার মাথা ভর্তি অনেক আইডিয়া কাজ করতো, পাকা আইডিয়া আর দুষ্টু বুদ্ধির জন্য অহনা অনেকটা পরিচিত মহলে বিখ্যাত ছিল। বিয়ে করার জন্য সেজে গুজে বসে তারপর শুরু করা কান্নাকাটি। কেনো বাবা আগে জানতে না বিয়ে করতে যাচ্ছো? এখনতো আর কেউ বালিকা বধূ না কিংবা ছ মাস ন মাসে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসার হাঙ্গামাও নেই নৌকো করে। ইচ্ছে হলেই বাপের বাড়ি। তাহলে এতো আলহাদের কান্নাকাটিটা কীসের শুনি? এজন্য অন্যরা অহনাকে আগেই শাসিয়ে রেখেছিল, দেখবো তোর বিয়ের সময় কি করিস। আজ সেই মহা দিন। সাধারনতঃ বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন এর সাইন দেখার জন্য এতো পিচকি পাচকী ঘরে আসে না। মুরুব্বীরাই থাকেন ঘরে কিন্তু অহনা যে সবার লেজে পা রেখে আছে। তাই যখন কাজী সাহেব তার খাতাপত্র মেলে ধরে বসলেন অহনার সামনে, মাথা নীচু করে রেখেও অহনা বুঝতে পারছিল জোড়া জোড়া চোখ তাকে পাহারা দিচ্ছে আর হাসছে, বাছাধন এখন কেমন, দেখি? অহনাও শক্ত হয়েছিল, এতো জনের কাছেতো আর সে হেরে যেতে পারে না, না কিছুতেই না। কাজী সাহেব তার গৎবাঁধা কবিতা শেষ করা মাত্রই অহনা ভাবলো বলে ফেলবো নাকি এখুনি? আবার ভাবলো আম্মি যদি বকা দেয়, ভাবতে ভাবতেই কাজী সাহেব বললেন আবার, বলেন মা বলেন। অহনা ভাবার আগেই কখন যেনো মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো কবুল। বেশ স্পষ্ট আর জোরে। সবাই পরিস্কার শুনতে পেলো বলে কেউ হাসার সুযোগ পেলো না। শুধু অহনা তখনো অনুধাবন করেনি এখানে শুধু প্রতিপক্ষের লোকেরাই ছিল না, বর পক্ষও ছিল!
বিয়ের মাধ্যমে কতটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন অহনার জীবনে ঘটল সেটা অবশ্য তখনও সে আন্দাজ করতে পারেনি, তখনও সে নতুন শাড়ি, গয়না, বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড় আর নাচ-গানের আমেজের মধ্যেই মশগুল ছিল। অর্নের ছুটি তখন প্রায় ছিল না বললেই হয়। বিয়ের পরে সপ্তাহেই নতুন বিয়ে আর তরতাজা নতুন বউকে রেখে, বিয়ের কাগজপত্র সব বগল দাবা করে ভারাক্রানত মন নিয়ে অর্নকে বেরসিক চাকরীস্থলে ফিরে আসতে হলো। আর তার প্রায় মাসখানেকের মধ্যেই অহনার ডাক পড়ল এ্যাম্বেসীতে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে এ্যাম্বেসী নামক পদার্থটা নিয়ে অনেক রকম ভয়াবহ গল্প শোনার কারণে এই শব্দটাতে অহনার বিশেষ ভীতি ছিল, নাম না জানা ভীতি যাকে বলে। ইঞ্জেকশন শুনলেই যেমন অকারনে ভয় লাগতে থাকে অনেকটা সেই টাইপ। জীবনে অহনা বিদেশ নামক জিনিসটাই ভালো করে চোখে দেখেনি তায় এ্যাম্বেসী। যাওয়ার মধ্যে যাওয়া ঘরের কাছের ইন্ডিয়া তাও তার জন্য এ্যাম্বেসী চোখে দেখেনি অহনা। ঘটনাটা হলো এমন, একদিন সব ভাইবোনরা ভালো জামা কাপড় পড়ে বাবার সাথে বাড়ির পাশের স্টুডিওতে গেলো, আর স্টুডিওর লোক গম্ভীর মুখে অহনাদের সব ভাইবোনদের আলাদা আলাদা করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলে দিলেন। স্টুডিওর লোকের গম্ভীর মুখ দেখে অহনারা কেউ কিছু বলার সাহস পেলো না শুধু অহনার বড় ভাই সাহস করে বলল, ‘ভাই একটু সুন্দর করে তুলে দিয়েন’, ভদ্রলোক ততোধিক গম্ভীর গলায় বললেন, ‘যেমন চেহারা তেমনই ছবি উঠবে, সুন্দর অসুন্দর নেই’। বড় ভাই এ কথা শুনে দমে গেলেন আর অহনাদেরতো ভয়ে মুখ দিয়ে রা’ই নেই। তো সেই ছবি বাবা নিয়ে গেলেন, কাকে যেনো দিলেন, সেই ভদ্রলোক পাসপোর্ট ভিসা সব করে বাড়ি এনে দিয়ে গেলেন, অহনাদের আর এ্যাম্বেসী যেতে হলো না, সোজা বাংলায় যাকে সবাই বলে ঝামেলা হলো না। তার কদিন পরে একদিন সবাই মিলে অহনারা তাজমহল দেখতে রওয়ানা দিল।
জীবনের প্রথম সেই বিদেশে গিয়ে অহনার মানসিক অবস্থা ভয়াবহ হয়ে গেলো। বিদেশ মানে অহনার কল্পনায় টিভিতে দেখা চার্লিস এ্যাঞ্জেলস এর মতো ঝকঝকে চারিধার, দামী দামী সাই সাই গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। কিন্তু দিল্লী, আগ্রা, আজমীর, জয়পুর গিয়েতো অহনা হতভম্ব, তাজমহলে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পড়া লোক ঘুরছে, রাস্তায় বোচা বোচা এ্যাম্বেসেডর গাড়ি চলছে, পুরনো দিনের সাদা - কালো ফিল্মের মতো তার পেছন দিকে দরজা খুলছে, বরং ঢাকায় এর চেয়ে ঢেড় ভালো। এই কাতর অবস্থা থেকে পাথর হলো অহনা যখন স্কুলে গেলো, স্কুলে গিয়েছিলো বড় খোশ মেজাজে বিদেশ ভ্রমনের এ্যালবাম বগলদাবা করে, হ্যা হ্যা এবার আমিও বিদেশ ফেরতা এই ভাব নিয়ে কিন্তু - - - অহনাকে দেখে বান্ধবীরা প্রায় আর্তনাদের সুরে বলে উঠল, ‘তুই বিদেশ ঘুরে এলি!!! দেখে মনে হচ্ছে তুই গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলি’। অহনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘কেনো’? বান্ধবীরা বলল,‘ গ্রামের থেকে বেরিয়ে এলে যেমন রোদে পোড়া কালসিটে চেহারা হয় তোর তো দেখি সেই অবস্থা’।
সেই থেকে বিদেশ নামক ব্যাপারটা নিয়ে অহনা নানা টেনশানেই থাকে। কদিন আগেও অহনা অবশ্য বাড়ির কাছের আর একটা ছোট বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছে, তখন অহনা এ্যম্বেসীর গেট পর্যন্ত গিয়েছিল ভিতরে ঢুকতে হয়নি, অর্নই সব ম্যানেজ করেছে । এবার এ্যম্বেসীর চিঠি পাওয়ার পর অহনা অর্নকে ফোনে তার এ্যাম্বেসী ভীতির কথা জানিয়েছিলো, কিন্তু অর্ন বিরাট এক ধমক দিয়ে বলল,‘ এর মধ্যে ভয়ের কিছু নেই তোমার জন্য। কাগজ পত্র সমস্ত আছে, তুমি শুধু যেয়ে দেখা করবে আর যা জিজ্ঞেস করবে তার ঠিক ঠিক জবাব দেবে।’ তো এবার যখন আর কোন উপায় নেই, বাড়ির মুরুব্বীদের সালাম করে, সবার দোয়া মাথায় আর ভীরু ভীরু হূদয় নিয়ে আল্লাহর নাম জপতে জপতে অহনা এ্যাম্বেসীতে গেলো বাবার সাথে কিন্তু সেখানকার সিকিউরিটি বাবাকে গেটেই আটকে দিলো, আর অহনা বেচারিকে একাই ভিতরে ঢুকিয়ে এস এস সি পরীক্ষার হলের মতো উচু গেট আটকে দিলো দারোয়ান। নিরুপায় বাবা ওধার থেকে অভয় দিলেন, ‘তুই যা আমি তো আছি।’
(চলবে)
তানবীরা
১০- ০৪ - ২০০৭