Sunday, 11 April 2010

শুভ নববর্ষ ১৪১৭

বাংলা নতুন বছর উদযাপনের প্রতি আমার আগ্রহ অসীম। কেনো এই টান আমি নিজেও জানি না। এমনিতেই আমি পার্টি এ্যনিম্যাল কিন্তু বাংলা নতুন বছর নিয়ে আমার যেটা হয়, সেটা হলো উন্মাদনা। এ উন্মাদনা নিয়ে অনেক মজার এবং বেমজার ঘটনাও ঘটে।

একবার ঠিক করলাম রমনা বটমূলে সকাল ছয়টায় বর্ষবরন করতে যাবো। ঘুম থেকে উঠতে যদি না পারি তাই ভাবলাম রাতে ঘুমাবোই না। এমনিতেই পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে মাত্র কদিন আগে এখানে থেকে দেশে গিয়েছি, তাই না বলা গল্পের ঝুড়ি দুই প্রান্তেই অফুরন্ত। আমরা সারারাত ধরে সকালের শাড়ি চুড়ি সাজগোজ ঠিক করলাম, তারপর বসলাম হাতে মেহেদী দিতে। সাথে গান বাজনাতো আছেই। এ সময়টায় ঢাকায় বড্ড ঘন ঘন লোডশেডিং হয়। যত সম্ভব রাত তিনটার দিকে আবার কারেন্ট চলে গেলো। অনেক গরম তাই আমি ভাবলাম ঘরের লাগোয়া বারান্দায় একটু বসি, বাতাস আসবে। আমার ছোট দুবোন চার্জার নিয়ে রান্নাঘরে গেলো চা বানাতে।

আমি বারান্দায় বসে আছি, আমাদের রুমটা বাড়ির পেছনের দিকে। আমাদের ঠিক পাশের বাড়ির লোকরা তাদেরও সেই পেছনদিকের ঘরগুলোতে মেস করে ব্যচেলরদের ভাড়া দিয়েছেন। আমি অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি, জোনাকির মতো কিছু ওঠানামা করছে। অন্ধকার চোখে সয়ে গেলে বুঝলাম, সিগ্রেট। কারেন্ট নেই, ভ্যাপসা গরম, ঘুমানোর মতো কোন অবস্থা কারোই নেই। তারা স্যান্ডো গেঞ্জী গায়ে দিয়ে বাইরের খোলা হাওয়ায় ঘুরছেন। আমাকে অন্ধকারে তাদের দেখতে পাওয়ার কোন কারন নেই। যদিও আমি বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে নীচু হয়ে তাদের দেখতে পাচ্ছি। রাত নিঝুম তাই চারপাশের শব্দ পরিস্কার শোনা যায়।

তারা নিজেদের মধ্যে আমাদের নিয়ে আলোচোনা করছেনঃ

প্রথমজনঃ দ্যাশটার কি হইলো? রাইতের বাজে তিনটা মাইয়াগুলা এখনো গান বাজনা করতাছে?

দ্বিতীয়জনঃ অপসংস্কৃতি অপসংস্কৃতি, অশ্লীল

আরেকজনঃ (খুবই অভিজ্ঞতার সুরে) এইজন্যই মুরুব্বীরা আগেরদিনে কইতো বয়সকালে মাইয়াপুলার বিয়া দিতে হয়, বয়সকালে মাইয়াপুলার বিয়া না হইলে, এইগুলার মাতা নষ্ট হইয়া যায়, রাইতে বিরাইতে এইগুলা গান বাজনা করে।

অন্যরা সবাই তাদের মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তার বেদবাক্য সায় দিচ্ছেন।

আমি কোন রকমে হাসি চেপে মাথা নীচু করে ঘরে এসে (যাতে তারা আমাকে দেখতে না পায়) আমার ভাই আর স্বামীকে আমাদের বয়সকালে বিয়ে না হওয়ার গপ্পোটা দিলাম। যতোবার নতুন বছর ঘুরে আসে, সবচেয়ে প্রথমে আমার এ নাম না জানা কজন লোকের বেদবাক্যি গুলো মনে পড়ে।

তারচেয়ে বড় আইরোনি হলো, সেদিন কি আমরা সূর্যোদয়ের সময়ে বটমূলে পৌঁছতে পেরেছিলাম? না ভাই না। সারারাত গুলতানি করে ভোরের দিকে সবাই এদিক সেদিক কাত। আমাদের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আব্বু আমরা কি চলে গেছি না দেখতে এসে আমাদেরকে বেলা আটটায় ঘুম থেকে টেনে তুলেছিল
Cry

যাক আবার নতুন বছর আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। নতুন বছরের শুরু হবে কিছু নতুন চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খা আর বেদনা নিয়ে। সুস্বাগতম হে নতুন তোমায়।

http://www.youtube.com/watch?v=-Uw2fhBiULc

তানবীরা
২৯শে চৈত্র ১৪১৬।

Friday, 9 April 2010

প্রজাপতি মন আমার

মেয়ের স্কুল থেকে নানান ধরনের চিঠিপত্র আসতেই থাকে। সারাদিন অফিস ঠেঙিয়ে বাড়ি ফিরে এই হলো আমার হোমওয়ার্ক। মেয়ের বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা গ্রহন করা। তারা বাইরে খেলতে যাবেন অমুকদিন তাদেরকে যেনো অমুক কাপড় আর তমুক স্যু দিয়ে দেই। অমুক দিন তমুক টীচারের জন্মদিন, টিফিন দিতে হবে না বাসা থেকে, হেনতেন ভেজালের চিঠি আসতেই থাকে। আজকেও মেয়ের স্কুল ব্যাগ খুলে চিঠি পেয়ে বিরস বদনে পড়ছি, হঠাৎ বুকের মাঝে ধাক্কা লাগলো। চিঠিতে লেখা আছে, বসন্ত শুরু হয়েছে তাই চলছে গরমকে বরন করার প্রস্তূতি। বাচ্চাদেরকে “সামার ক্যাম্প” এ নিয়ে যাওয়া হবে। আমার মেয়েকে সাথে দিতে চাই কি না? দিলে কি পুরো সপ্তাহন্তের জন্যই দিতে চাই নাকি একদিন বা দুদিনের জন্য? একদিনের জন্য হলে এতো টাকা, দুদিনের জন্য হলে ততো। ভাবছি মেয়ে আমার শেষ পর্যন্ত এতোটাই বড় হয়ে গেলো যে একা ক্যাম্পে যাবে? এতোদিন শুনেছি এর বাচ্চা যায় তার বাচ্চা যায়, এখন আমার বাচ্চার জন্য চিঠি!!! মেয়ে একবার এক রাতের জন্য পাশের বাড়ি বান্ধবীর কাছে থাকতে গিয়েছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে মেয়েকে আনতে ছুটেছি। সারাটা সন্ধ্যা আমার অস্থির লেগেছে। নিজেকে কতো ভাবে বুঝাতে হয়েছে। ভেবেছি আমি যখন বিদেশে আমার নিজের সংসার সাজাতে ব্যস্ত ছিলাম আমার মা’ও হয়তো ঠিক এভাবে আমাকে মিস করেছেন, কেঁদেছেন।

কিন্তু আমি নিজে কি এতো বড়ো হয়ে গিয়েছি? আমার মেয়ে ক্যাম্পে যাবে? এতো বড় মেয়ের মা কি আমি? আমারতো সারাক্ষন মনে হয়, এইতো সেদিন আমি স্কুলে যেতাম, দুষ্টুমী করতাম! সেদিন মাত্র নয়? কিছু কিছু জিনিসতো এখনো স্পষ্ট মাত্র কিছুদিনের আগের কথা মনে হয়। দু হাজার দুইয়ে রাইফেল স্কোয়ারে এগোরা খুললো সুপার মার্কেট। আমি আর ভাইয়া রোজ যাই দেখতে। তখন ধানমন্ডির আশে পাশে বাস করা সব সেলিব্রেটিরা বান্ডেল ভর্তি টাকা নিয়ে ওখানে বাজার করতে আসেন। আমরা ক্যাশের পাশের খাবারের দোকানে খাই আর কে কখন কতো ঘুষ খেয়ে এসে এখানে বাজার করছে তার কাল্পনিক হিসাব মিলাই। একদিন এগোরাতে ঘুরছি, আমাদের সামনে গায়ক সাদী মোহাম্মদ তার পরিপাটী নিভাজ চুল আর একজন কর্মচারী গোছের কাউকে নিয়ে ঘুরছেন আর বাজার করছেন। তারা সেলিব্রেটি সুতরাং বাজারে যেয়ে নিজের হাতে জিনিস তোলা তাদের সাজে না কাজ়েই সাথে কেউ। একটু পর পরই আমরা সাদী মোহাম্মদের মুখোমুখি হচ্ছি দোকানে, তখন আমরা তার পিছে পিছেই ঘুরতে লাগলাম। নামী দামী লোকদের দেখতেওতো অনেক সুখ। খেয়াল করলাম মাথার চুলগুলো যেনো কেমন একদম নিভাঁজ। ভাইয়াকে বলতেই ভাইয়া বললো, আরে এটাতো উইগ। হঠাৎ ভাইয়া বললো, চল এক কাজ করি, ওর উইগটা টান দিয়ে খুলে নিয়ে আমরা উঠে একটা দৌড় দেই। প্রথমে আমার একটু কেমন মনে হলেও পরে ভাবলাম কি আছে জীবনে, চল করি। আমি আর ভাইয়া পরের এক ঘন্টা ওর পিছে পিছে হাটলাম উইগ নিয়ে দৌড় দেয়ার জন্য কিন্তু কিছুতেই দৌড়ের সুযোগ করতে পারলাম না, এগোরা ভর্তি কর্মচারী গিজগিজ করে, ধরে ফেলবে সহজেই সেজন্য শেষ পর্যন্ত করা হলো না কিন্তু সেই এক ঘন্টার রোমাঞ্চ আজো আমি আমার রক্তে অনুভব করি। এটাকি অনেকদিন আগের কথা?

এইতো গতো বছরের জানুয়ারীতে আমরা সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গেলাম। সন্ধ্যেবেলা আমরা বোনেরা আমাদের আন্ডা বাচ্চা নিয়ে বীচে হাঁটছি, টুকটাক গল্প করছি এমন সময় দুটো দশ বারো বছরের স্থানীয় ছেলে এলো আমাদের কাছে। এসে জিজ্ঞেস করলো, আফু গান শুনবেন, গান? আমি বল্লাম, শোনাও। সে শুরু করলো, “সোনার ময়না পাখি………।“। আমার অন্যবোনেরা আমাকে চিমটি দিয়ে ধরলো তিনদিক থেকে। আমি বোনদের চিমটি অগ্রাহ্য করে মাথা নেড়ে নড়ে ওদের গান শুনতে লাগলাম। অসহ্য হয়ে স্বনার্লী বললো, ওরা কিন্তু গান শেষ করে টাকা চাইবে তোমার কাছে। আমি ফিঁচলা হাসি দিয়ে বল্লাম তাই নাকি? মুখ ভেংচে স্বর্নালী বললো, তাই না, আবার কি? এমনি এমনি নাকি? ওদের গান শেষ হওয়া মাত্র আমি বল্লাম, এবার আমাদের গান শোন। শুরু করলাম আমরা চারবোন মিলে গান। আমাদের গান শেষ হলে এবার আবার ওদের গান। কিশোর দুটো অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষন গান গান হওয়ার পর নিজেদের মধ্যে কীসব আলোচনা করে পিঠটান ওরা দিল। খুব জব্বর বোঁকা বানিয়ে ওদেরকে আমি বিমলানন্দ অনুভব করতে লাগলাম।নপরদিন সকালে ওরা আমাদেরকে “চীজ” স্বরুপ মুখ নিয়ে আবার দেখতে আসলো।

আমাদের কিশোর বয়সে একটা খেলা ছিল টাকাতে ফোন নম্বর লেখা। বেশীর ভাগ গ্রাম্য কিসিমের লোকেরাই এধরনের কাজ করতো। সেধরনের টাকা পেলে আমাদের কাজ ছিল নম্বরে ফোন করা। অনেক সময়ই দেখা যেতো নম্বর আর নাম মিলছে না। কিন্তু যদি মিলে যেতো আর মক্কেল টাইপ কাউকে পেতাম তাহলেতো সোনায় সোঁহাগা। ফোনেই শাঁসিয়ে শেষ করতাম, টাকার ওপর নম্বর লিখলেন যে, জানেন কতো বড়ো অপরাধ? পুলিশে ধরতে পারে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের কতো বড়ো ক্ষতি করেছেন? ফোনের ওপাশে প্রথম দিকে গাই গুঁই করে পরে যখন নিশ্চুপ হয়ে পড়তো তখন আমরা ক্ষান্ত দিতাম। কিন্তু নম্বরগুলো রেখে দিতাম।বান্ধবীদের মধ্যে আদান প্রদান করতাম। মেজাজ খারাপ হলেই কিংবা পড়তে পড়তে বোর লাগলেই ওঠে যেয়ে ফোন করে সেসব নম্বরের হাঁদাগুলোকে বঁকে দিয়ে আসতাম। কিন্তু আমিতো এখনো তাই আছি। আমারতো এখনো তাই ইচ্ছে করে যেগুলো আগে ইচ্ছে করতো। দু হাজার আটের ষোলই ডিসেম্বরে আমরা টি।এস।টিতে হাটছি খুব ভাব নিয়ে। মেয়েকে বিজয় দিবস উদযাপন দেখাচ্ছি। কিছু আমাদের থেকে ছোট কিন্তু নাঁকের নীচে মোঁছ গজানো ছেলেপেলে আমাদের পিছনে পিছনে ঘুরতে শুরু করে দিল। একী মহা জ্বালা। বাসায় আসার জন্য রিকশা নিলাম, দেখি পোলাপানও রিকশা নিয়ে আসে। যখন আগের দিনের মতো ঠিক এতোবড় করে মুখ ভেংচি দিলাম তখন দেখি রিকশা নিউমার্কেটের ঐদিকে ঘুরে গেলো। আমিতো এখনো ভেংচা ভেংচি, মারামারি, ঝাড়াঝাড়ির ফর্মে আছি, আমার মেয়ে যদি বড় হয়ে যায় তাহলে ক্যামনে কী?

তানবীরা
০৯.০৪.১০

Friday, 26 March 2010

স্মৃতি হয়ে শুধু আছি ছবি হয়ে রয়ে গেছি

অনেকদিন ধরে লেখালেখি বন্ধ, নানা কারণ আর অকারণে। আজ কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু অভ্যাস চলে যাওয়াতে কোথা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না কিংবা ভাবনাগুলোকে ঠিক গোছাতে পারছি না। অথচ অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। মনটা বিক্ষিপ্ত থাকলে, লেখার খাতায় আঁকিবুকি মনটাকে অনেকটাই শান্ত করে আনে। লেখালেখি আমার জন্য অনেকটা প্রার্থনার কাজ করে অনেক সময়।ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে সারাটাদিন ধরে। প্রচন্ড ব্যস্ততার জন্যই হয়তোবা।

এক সময় প্রতি বছর আমি বাড়ি ফিরে ছয় সপ্তাহের জন্য। এই ছয় সপ্তাহ আমাদের বাড়িটা অচল থাকতো। সেবা স্বনার্লী স্কুল ছাড়া বাড়ি থেকে বেড়োতো না কোথাও। ছাঁদে কিংবা বাসার সামনের ছোট পোর্চটাতে বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সাথে ওরা সারা বছর বিকেলে খেলা করতো শুধু ঐ ছয় সপ্তাহ বাদে। একদিন অন্য ফ্ল্যাটের খালাম্মা আম্মির কাছে নালিশ নিয়ে এলেন, ওনার মেয়েরা কাঁদছে, কেনো সেবা স্বনার্লী বোন এলে একদিনও খেলতে যায় না। ওরা একা একা আর কতোদিন খেলবে? আমাদের জন্য যে ছয় সপ্তাহ চোখের নিমেষে কেঁটে যেতো, সে সময়টুকু ওদের জন্য হয়তো পাহাড়সম ছিল। সুমি ইউনিতে ক্লাশ শেষ হওয়া মাত্র বাড়িতে দৌঁড়। কোন আড্ডা বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতো না, অনেক সময় ক্লাশও মিস করতো। আব্বু ভাইয়া যারা সন্ধ্যে পার না করে বাড়ি ফিরেন না তারাও রোজ দুপুরে বাড়িতে খেতে আসতেন। সবাই তাদের দৈনন্দিন কাজ কমিয়ে দিতেন, পরিবর্তন করে নিতেন শুধু আমি আছি বলে।

একটা সময় জীবনে যা অপরিহার্য ছিল আজ তার কথা মনেও পড়ে না। আমাদের পশ্চিমের টানা বারান্দায় ঝোলানো আমার দোলনাটার কথাটাই ধরি না কেনো? সকালে ঘুম থেকে ওঠে ওটাতে দুলে দুলেই আমাকে পড়তে হবে। গরমের ক্লান্ত দুপুরে কারেন্ট নেই, আমি বারান্দার দোলনায় দুলে দুলে সুনীল, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব কিংবা আশুতোষে মজ়ে আছি। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে দোলনাতেই ঘুমিয়ে থাকতাম। দোলানায় বসে পা দিয়ে জোরে ধাক্কা মেরে একবার শুরু করতাম, তারপর সামনে এগিয়ে গেলে, ধাম ধাম পিলারে লাথি মেরে চলত আমার দোলনা দোলা সারা বেলা। নিজের পা ক্লান্ত হলে পাশ দিয়ে যেই যাবে আব্বু আম্মি কিংবা ভাইয়া, আমার দোলনাটা দুলিয়ে দিয়ে যাও চিৎকারের আব্দার। আমার দোলনা আমার দোলনা করে বাড়ি মাথায় রাখতাম কেউ যেনো দোলনা নিয়ে পালিয়ে যাবে, এমন ভাব থাকতো আমার। অথচ দোলনা থাকলে বাড়িতে বাচ্চারা এসে প্রথমেই সেই দোলনায় চড়তে চায়। আমার চোখ মুখ বাঁচিয়ে সবাই সেদিকেই দৌড়াত। যখন আমি ছিলাম তখন আব্বু বকত, দোলনা কি ওড়ে যাবে, তুই এমন করিস কেনো? আর যখন আমি নেই, আম্মি আমায় গল্প করলেন, বাচ্চারা অবাধে এসে দোলনায় লুটোপুটি খায়। আব্বু হাটে দেখে কিন্তু সহ্য করতে পারে না। আম্মিকে একদিন বললেন, তুমি আমার মেয়ের দোলনাটা প্যকেট করে তুলে রাখো। আমার মেয়েকে পাঠিয় দিবো আমি এটা। আমার মেয়েটা তার লম্বা লম্বা পা তুলে সারা বেলা দোল খেতো, এখন অন্যেরা এসে এতে হুটোপুটি করে আমার ভালো লাগে না।

সেই ঘুম না আসা গরমের দুপুরগুলোতে হেটে হেটে আমি অমিয় চক্রবর্তীর অন্ত্রনীলা ঘুমাওনি জানি, কিংবা সুনীলের কেউ কথা রাখেনি, হুমায়ূন আজাদের আমি হয়তো খুব ছোট কিছুর জন্য মারা যাব, শামীম আজাদের সর্বসাধ্য মনে হলেও সকল কথা কইতে নেই আবৃত্তি করতাম। এক সময় একবিতাগুলো আমি মুখস্থ আবৃত্তি করতাম। এখন স্মৃতিতে ধূলো জমেছে, না বলতে বলতে আজ় আর কিছুই মনে নেই। অথচ আমার ছোট বোনেরা যারা আমার পাশে বসে পুতুল খেলতো তাদের এখনো মনে আছে। আমি গেলে তারা আবৃত্তি করে শোনায় আমায়। কি বিচিত্র মানুষের ভালোবাসা।

সেই সব দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি প্রচন্ডভাবে এখন মিস করি। একসময় যা কিছু সহজলভ্য ছিল, যার দিকে ফিরেও তাকাতাম না সেসমস্ত জিনিসের জন্য এখন আমার অন্তর আত্মা সারাবেলা কেঁদে ফিরে। প্রচন্ড ব্যস্ত এখন আমার দিনগুলো। এই দামি কর্পোরেট মূহুর্তে সবাই যখন ব্যবসা আর লাভ লোকসান নিয়ে ব্যস্ত, তখন দামি ইন্টেরিয়র দিয়ে সাজানো ডিজাইনার টেবল চেয়ারের ঘরে বসে হঠাৎ আমার বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু হয়। কর্মব্যস্ত ঘরে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি কিছু সময়ের জন্য। আমার অতি সাধারন মধ্যবিত্ত শোবার ঘরটার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতে থাকে। আমার সেই বিশ্রী পড়ার টেবলটা, যেটা বাংলাদেশের অতি সাধারন কাঠুরে কিংবা ছুতার তৈরী করেছেন, সেই চেয়ারটা যেটা কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার স্বাস্থ্যকর সার্টিফিকেট দেননি, কিন্তু আমি তাতে বসে গালে হাত দিয়ে আমার সমস্ত শরীর মনের ভার তাতে ছেড়ে দিতে পারতাম। বই সামনে নিয়ে পড়ার টেবলের সামনের জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কতোরকম বাস্তব অবাস্তব স্বপ্ন বুনতাম। তখনো ঢাকা শহর ভর্তি এতো আকাশ ছোঁয়া ইমারত হয়নি। জানালার ফাঁক গলিয়ে নীল আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলা যেতো অতি সহজেই।

কি পাগলের মতো একসময় সবকিছুতে আমি আমি আমি’র ছাপ দেয়ার জন্য উন্মত্ত হতাম। বিছানার এপাশটাতে আমি শোব, ডাইনীং এর এই চেয়ারটায় আমি বসবো, টিভি দেখার সময় এই সোফাটা আমার। দুবোনে একটা বাথরুম শেয়ার করতাম। সেটা নিয়েও কি ঝগড়া। ঠিক দুজনের দিনের একই সময় গোসলে যেতে হবে। সারাদিন বাথরুম ফাঁকা পরে থাকে কিন্তু সে সময় বাসায় কুরুক্ষেত্র। আম্মি কতো বকতো, কেনো আমার বাথরুমে যা, ঘাড় ত্যড়িয়ে জবাব দিতাম, কেনো আমি অন্যের বাথরুমে যাবো, এটা আমার বাথরুম। সবকিছু আমার, মোহর দেয়া। এখন এতো দূরে পরে আছি আমি, ঢাকায় থেকেও সুমি সপ্তাহে একদিনও বাসায় যাবার সময় পায় না নিজের সংসার সামলে। ফার্নিচারের মডেলের বিবর্তনে সেই খাট আর টেবলও বাড়িতে আর নেই। শুধু সেই মূহুর্তগুলো এই ব্রক্ষান্ডের কোথাও আটকে আছে। টাইম মেশিন চালু হলেই আবার ছুটে আসবে যেনো।

যদিও বাড়ি ছেড়ে আসার সময় আমার লাগানো মানি প্ল্যান্টের লতাগুলোর ওপর থেকে, ওয়ারড্রোবে যে অংশে আমার কাপড় থাকতো সে জায়গা থেকে, আমার বইয়ের তাক থেকে, দোলনা থেকে আমার স্বত্ব ত্যাগ করেই এসেছিলাম কিন্তু এখনো কেনো যেনো পুরোপুরি মন থেকে সবকিছু ত্যাগ করতে পারিনি বলে মনে হয়। বাড়িতে যেয়ে এটা ওটা ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ যখন কোন কিছু হাতে পরে যাতে বাংলায় আমার নাম লেখা, কিংবা কোন বৈশাখী মেলাতে আমার কেনা কোন শৌখীন জিনিস যার প্রয়োজন আজকে ফুরিয়েছে বলে স্টোরে ঠাসা আছে দেখতে পাই বুকের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে। কোথাও আমি নেই কিন্তু তবুও যেনো কোথাও আছি। মা দেয়াল ভর্তি করে তাঁর মেয়েদের নাতি নাতনীদের ছবি সাজিয়ে রেখেছেন, সারাদিন হাটেন ঘুরেন আর দেখেন, যখন সাজানো সে ছবিগুলোর বাইরেও নিজের অস্তিত্ব টের পাই তখন কেনো এমন লাগে?
তানবীরা
২৬।০৩।২০১০

Friday, 5 March 2010

কাদের কূলের মেয়েগো তুমি???

এদেশে পোষাক দেখে সহসা কে কোন ধর্মের ঠাহর করা মুশকিল। আধুনিক হিন্দু মেয়েরা যেমন শাখা সিঁদুর পরেন না তেমনি আধুনিকা মুসলমানরাও মাথায় হিজাব পরেন না। আর অনেক নাম থাকে যা বাংলা হিন্দু মুসলমান সবারই হতে পারে। আমাদের নামগুলোও আবার সেরকম।

আমাদের বাড়ি নতুন কেউ এলে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু অনেকে আবার ধর্ম নিয়ে খুব স্পর্শকাতর। বাংলাদেশের জানলে প্রথমে ধরেই নেয় মুসলমান হতে পারি। কিন্তু বাড়ি এসে যখন বাড়ি ভর্তি মূর্তি দেখে তখন সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস কর, আপনারা কি হিন্দু ? আমরা মাথা নাড়ি, না
মূর্তির দিকে ফিরে তাকিয়ে অবাক চোখে বলে, মুসলমান? আবারো মাথা নাড়ি না।
তারা আরো পাজলড হয়, বিস্ফোরিত চোখে জিজ্ঞেস করে তাহলে কি?
উত্তর দেই, আমরা মানুষ, শুধু মানুষ।
তারা অসন্তুষ্ট মনে চুপ করে যান।


আবার অনেকে এক ধাপ এগিয়ে যান
মরলে কি করবেন?
আমরা অম্লান বদনে উত্তর দেই, আমাদের শক্তি যখন অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হবে তখন আমাদের পুরনো জামা কাপড় কে কোথায় ফেলে দিলো সে নিয়ে আমরা ভাবি না
কখনো কখনো তারা আরো আগ্রাসী হয় খেতে বসে জিজ্ঞেস করেন, খাবার হালালতো?
তখন বলি খাবার স্বাস্থ্যসম্মত, পঁচা গলা নয় এর বাইরে আর কিছু বলতে অপারগ

এই হিন্দু মুসলমান প্রশ্নটা শুনতে শুনতে, আজকাল আমার ছোট মেয়েটা, যাকে এসব বিভেদ থেকে অনেক দূরে রাখার চেষ্টা করেছি সেও অপেক্ষা করে থাকে অনেক সময়, লোকজন এলে কখন এ প্রশ্নটা আসবে

জীবনে সবচেয়ে বেশি কোন প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়েছি, কেউ যদি এ প্রশ্নটি করেন তাহলে নির্দ্বিধায় উত্তর দিতে পারবো সেটি হলো এটি এটি কি জানা একান্তই জরূরী না বন্ধুত্ব করার জন্য প্রয়োজনীয়?

তানবীরা
০০৬.০৩.১০

Monday, 22 February 2010

কিছু সেটআপ গেমসের গেটআপ কথাবার্তা

সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ জীবিকার সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটছেন যার যার সামর্থ্য আর যোগ্যতানুযায়ী। কেউ মুন্সীগঞ্জের লঞ্চে ওঠে সদরঘাট নামে আর কেউ কুর্মিটোলার প্লেনে ওঠে ভিন দেশে নামে। যার যার যোগ্যতানুযায়ী তাকে অনেক ধরনের ট্যারা ব্যাঁকা প্রশ্নের মাধ্যমে ঝাঝড়া হয়ে, তীক্ষন এক্সরে মার্কা দৃষ্টির সামনে ফালা ফালা হয়ে তার গন্তব্যের টেবলে পৌঁছতে হয়। এরমধ্যে অনেক প্রশ্নই থাকে নেহাত গৎবাঁধা আর বেহুদা। প্রশ্নকর্তাকে যেহেতু কোন একদিন ইন্টারভিউতে এপ্রশ্ন করা হয়েছিল, তাই তিনি আজ সেই প্রশ্ন প্রতিশোধমূলকভাবে তার অধঃস্তনকে ফিরিয়ে দিয়ে তার উশুল তুলবেন টাইপ ব্যাপার।যেমন ফালতু প্রশ্ন তেমন তেলানী উত্তর। যুগ যুগ ধরে এই মিথ্যের বেসাতী চলছে চলবে টাইপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।তার সামান্য একটু নমুনা আজ পেশ করছি।

প্রশ্নঃ এই কোম্পানীতে কেনো কাজ করতে চাও?
সত্যি উত্তর মনে মনেঃ এই কোম্পানীতে এই পোষ্টটা খালি আছে, অন্য কোম্পানীতে নাই তাই চাই, শালা। তাছাড়া এই কোম্পানীর বেতন - বোনাস ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ভালো।
মিথ্যে উত্তর সামনা সামনিঃ এই কোম্পানী অনেক স্বনামধন্য। অর্থনীতি, সমাজে অনেক অবদান রেখেছে। নিজেকে উন্নত করার এবং নিজের প্রতিভা দ্বারা কোম্পানীর ও কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখার সুযোগ পেতে চাই এন্ড সো অন সো অন
প্রশ্নঃ তোমার জব প্রোফাইলের কোন কাজটা তোমার কাছে আকর্ষনীয়?
সত্যি উত্তর মনে মনেঃ কোনটাই না শালা কুত্তা। কিন্তু এগুলার বাইরে কিছু জানি না, এইটা গুতাইয়া খাই তাই এই প্রোফাইলের জবের জন্য বাধ্য হয়ে এ্যাপ্লাই করেছি।
মিথ্যে উত্তর সামনা সামনিঃ আমি চিন্তা ভাবনা করতে ভালোবাসি। জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারলে অনাবিল আনন্দ লাভ করি। স্ট্রেস হ্যান্ডল করা কোন ব্যাপার না। খুব ঠান্ডা আমার মাথা ব্লা ব্লা ব্লা
প্রশ্নঃ কাজ করতে পছন্দ করো নাকি নটা পাঁচটার রুটিন চাও?
সত্যি উত্তর মনে মনেঃ শালা কাজ দেখলে পালাতে ইচ্ছে করে। সারাদিন শুয়ে শুয়ে বই পড়তে, রিমোট নিয়া চ্যনেল ঘুরাতে ইচ্ছে করে। ঠ্যাং এর ওপর ঠ্যাং দিয়া ফেসবুক, জিটক করতে ইচ্ছে করে। কাঁধে ক্যাম, মাথায় টুপি বেড়িয়ে পড়ো অজানায় সেই চিন্তা মনে ঘুরে
মিথ্যে উত্তর সামনা সামনিঃ কাজকে আমি সন্তানতুল্য জ্ঞান করি। যতোক্ষন ক্লায়েন্ট সন্তুষ্ট না হবে ততোক্ষন নটা – পাঁচটা কেনো, দশটায়ও বাড়ি যবো না। দ্বায়িত্ব নিয়া কোন ছেলেখেলা না ইত্যাদি ইত্যাদি
প্রশ্নঃ কোম্পানীকে কিভাবে কন্ট্রিবিউট করবে বলে ভাবছো?
সত্যি উত্তর মনে মনেঃ তুই যেমনে করতেছস আমিও ঠিক সেভাবেই করবো। টেবিলের ঐপারে বইসা ফুটানী ঝাড়স? আমাদের ট্যাক্সের টাকায় বুড়া বয়সের পেনশন খাবি আবার আমাদের সাথেই শাতিলি ঝাড়স?
মিথ্যে উত্তর সামনা সামনিঃ দিনরাত এক করে দিয়ে ভাববো কি করে র‌্যান্ডম প্রসেসকে আরো নির্ভুল, এফিসিয়েন্ট আর ক্লায়েন্টের মনমতো করা যায়। অতি দ্রুত অতি নির্ভুল সেবা প্রদানের জন্য সদা নিয়োজিত থাকিব।
মনে মনেঃ নইলে তার কয়দিন পরে আবার আমাদের চাকরী খাবার প্ল্যান করবি কি করে? আমাদের দিয়ে অর্গানাইজেশন ডিজাইন করাইয়া আমাদের চাকরী খাইয়া দিবি, এহসান ফারমোশ কুত্তে।
প্রশ্নঃ তোমার পজিটিভ দিকগুলো সম্বন্ধে বলো?
সত্যি উত্তর মনে মনেঃ আমার সত্যিকারের পজিটিভ দিক শুনলে তোর কোম্পানীর ফিট খাইতে লাগবো। মেজাজ খারাপ হইলে এমন জোরে চিল্লান দেই যে ১৭৬০ বর্গফুট কভার করি। মাথা গরম হইলে এমন ঝগড়া করি যে ভূ-ভারতে কেউ আমার সাথে জিততে পারবে না। রান্না করতে পারি, ঘর মুছতে পারি, ভালো ফুল সাজাতে পারি ইকেবোনা শিখা ছাড়াই, মজার ব্লগ লিখতে পারি কিন্তু সেইগুলা তোর জবের সাথে রিলেট করে না ব্যাটা।
মিথ্যে উত্তর সামনা সামনিঃ আমার মাথা ঠান্ডা, এ্যাডজাষ্টম্যান্ট পাওয়ার ভালো, সদা হাস্যময়ী, লাস্যময়ী এন্ড দিস এন্ড দ্যাট এন্ড দিস
প্রশ্নঃ তোমার নেগেটিভ দিকগুলো সম্বন্ধে বলো?
সত্যি উত্তর মনে মনেঃ আসল কথা কইলে আর তুমি জব দিছো।
মিথ্যে উত্তর সামনা সামনিঃ (বিণয়ে বিগলিত ভাব ধরে)ডাচ উচ্চারনটা ঠিক পার্ফেক্ট না অনেক সময় মনে হয় ভাষার পিছনে আর একটু সময় দেয়া দরকার
তানবীরা
২২।০২।১০

Friday, 19 February 2010

ট্র্যাডিশনাল বিয়ের কান্না

বিয়ের সময় কান্নাকাটি করা আমাদের দেশের মেয়েদের এবং মেয়ের মায়েদের যেনো একটি অবশ্যই করনীয় প্রথা। যেকোন পরিস্থিতিতে, যেভাবেই বিয়ে হোক না কেন, কান্নাকাটি যেনো বিয়ের একটি আবশ্যিক আচার। সমাজে শত শত বছর ধরে এ আচারটি বহমান, কিন্তু কেনো? সামাজিকভাবে মেয়েরা দুর্বল আছে এবং থাকবে সেটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কি? একটি ছেলে হাসি মুখে গর্বিত ভঙ্গীতে বিয়ে করে একটি ক্রন্দনরতা মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ি যায়। এই ব্যাপারটা সমাজে ক্ষমতাবান ছেলে আর দুর্বল মেয়েদের অবস্থানের একটা বাস্তব প্রতিফলন। মেয়েদেরকে হাস্যকরভাবে দুবর্ল প্রমান করার একটি চিরাচরিত ও সযত্নে লালিত কায়দা। নতুন জীবন শুরু করার আগেই কাঁদিয়ে মানসিক শক্তি ভেঙ্গে দেয়া হয় যাতে স্বামীর ঘরে আর নিজের দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে। এমনকি অনেক সময় কোন মেয়ে কতোটুকু কাঁদল, কিভাবে কাঁদল সেটাও মার্ক করে তার ওপরে রেটিং করা হয়। মেয়েটার কলিজা কতোটুকু পাত্থর কিংবা কতোটুকু মায়াধরা তার একটা প্রাথমিক এসেস হয় এটা থেকে। সুতরাং কনে বেচারীর কান্নাকাটির বেষ্ট পার্ফমেন্স দেয়া ছাড়াতো উপায় নেই, মনে যাইই থাক না কেনো। আজকাল কনে সাজানোর বিউটি পার্লার গুলোও এ ব্যাপারে সর্তকতা অবলম্বন করে, ওয়াটার প্রুফ মাশকারা, আইলাইনার ইত্যাদি মেকআপ ইউজ করেন, কতোটুকু মেকাপ দেয়া হয়েছে, কতোটুকু কান্নাকাটি এ্যালাউড বলে দেন, যাতে পরবর্তীতে ভিডিওটা ঠিক ঠিক আসে, ভূতনী না দেখায়।

কোন মেয়ের হয়তো বহু দিন বিয়ে হচ্ছে না, বিয়ের জন্য অনেক চেষ্টা করছেন মা – বাবা, শাপ শাপান্ত করে অলক্ষী বলে গালি দিচ্ছেন, তারপর হয়তো অনেক সৃষ্ঠে বিয়ে ঠিক হলো, তারপর যেই না কাজী সাহেব খাতা খুলে বসলেন সাথে সাথেই বাবা – মায়ের যৌথ বিলাপের ধ্বনিতে পাড়া মুখরিত হবে। কেউ বা প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে, ধরে বেঁধে শেষ কালে মতান্তরে বিয়ে দিচ্ছে, এরমধ্যে কয়েক পশলা ঘরে আটকে রাখা, মারধোর হয়ে গেছে, কিন্তু আবার সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি, কাজী সাহেব যখনি বলবেন বলো মা কবুল, আরম্ভ হবে মায়ে – ঝিয়ের যুগল বন্দী। এধরনের বহু ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। কষ্টের জন্য কান্নার চেয়েও লৌকিকতার জন্য কাঁদা হয় বেশি। পাছে লোকে কি ভাবে সেই চিন্তায় ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা ভীষন দুর্বল। আর সেই সুযোগই কাজে লাগান অন্যেরা। কেউ কেউ আবার বিয়ে ঠিক হলে আয়নার সামনে দাড়িয়ে প্র্যাক্টিস করে নেন কিভাবে কাঁদলে ভালো দেখাবে, সুইট লাগবে। অনেকে গর্বও করেন বিয়ে ঠিক হয়েছে পর থেকে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত কেঁদেছি।

আগের দিনে কিশোরী বয়সে বিয়ে হতো, তারও আগে শিশু বয়সে। সে বয়সের বাচ্চা মেয়েরা অচেনা পরিবেশে অচেনা লোকের সাথে থাকতে হবে, কি ধরনের জীবন হবে তা নিয়ে ভয় পেতেন। বহুদিন বাবার বাড়ি আসতে পারবেন না, প্রিয় অনেক কিছুকে হারিয়ে ফেলবেন ভেবে হয়তো কাঁদতেন। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতো তার চেয়ে অনেক আলাদা। অনেক কিছুই বদলেছে দেশে। মেয়েরা পড়াশোনার জন্য প্রশান্ত-আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছেন একা। নিজের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছেন। অকারন অনেক কুসংস্কার, লৌকিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন। পোষাক বদলেছেন, জীবন যাপনের পদ্ধতিও বদলেছেন, দেশের অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী ভূমিকা রাখছেন। দেশে সিনেমা হচ্ছে বাস্তবমুখী, গান হচ্ছে। তাই আজ আশা রাখা যায় মেয়েরাও লোক দেখানো ভড়ং থেকে বের হয়ে আসবেন, শুধু মাত্র অপ্রয়োজনে, সামাজিকতার জন্য নিজেকে বলি দেয়া বন্ধ করে, যা বাস্তব, শোভন তাই করবেন। যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে বলে বিনা প্রয়োজনে অনেক কিছু আরো যুগ যুগ না টানাই ভালো।

বলছি আজ শোন মেয়েরা, নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজেদেরকে লড়তে হবে। কেঁদে কেটে কিছু আদায় হয়নি এই পৃথিবীতে, হবেও না। সংগ্রামের মাধ্যমেই আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে। তাই আর কেঁদে নিজেকে দুর্বল করো না বা কাউকে দুর্বল ভাবার সুযোগ দিও না। এগিয়ে যাও দৃঢ় পায়ে। নতুন জীবনের শুরু হোক শক্ত পায়ে, হাসি মুখে, হাতে হাত রেখে। অশ্রুসজল, ভীরু, কুন্ঠিত ভাবে আর নয়। পরিবর্তনের জন্য আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে, সুন্দর আগামীর সূচনা হোক আমাদেরই দ্বারা। অধিকার বুঝে নিতে হয়, এটা এক ধরনের অনুশীলন, অধিকার কেউ কাউকে এগিয়ে এসে দিয়ে যায় না।

তানবীরা
মূল ভাবটি লেখা ছিল ০৬.১২.০৮
পরিশোধিত ১০.০২. ২০১০

Friday, 5 February 2010

অস্কার বিজয়ী “আভাতার” ও ঢাকাই ঢিষ্টিং ঢিষ্টিং ফ্লিমের সাদৃশ্যসমূহ

অনেক কষ্টে পকেটের টাকা গুনিয়া দিয়া অত্যাধুনিক থিয়েটারে বসিয়া চোখে কালো চশমা পরিধান করিয়া তিন মাত্রায় বিস্তৃত (3D) অস্কার তথা সারা পৃথিবী বিজয়ী চলচিত্র “আভাতার” দেখিয়া আসিলাম। অনলাইনে ফ্রীতে দেখি নাই মজা নষ্ট হইয়া যাইবে বিধায়। সাধারন সিনেমার টিকিটের থেকে বেশি মূল্যে তিন মাত্রায় বিস্তৃত সিনেমার টিকিট কিনিয়া হলে বসিয়া বসিয়া আমি পাপিষ্ঠা ভাবিতেছিলাম ঢাকাই ফিলিমের সাথে এটার এতো মিল মিল লাগে ক্যান?

১. নায়ক পড়বিতো পর মালীর ঘাড়ের মতো, বিপদে পড়লতো টারজান মার্কা নায়িকাই আসলো বাঁচাতে। যদিও পরে জংগল ভর্তি বহু সাহসী মানুষকে দেখা গিয়েছিল কিন্তু সেই মূহুর্তে নায়িকা সহায়।
২. নায়কের “জাংগল লাইফের” শিক্ষা দীক্ষার সব ভার অবধারিতভাবে নায়িকার ওপরই বর্তাইলো।
৩. প্যানডোরা দেশের নায়িকা প্রথমে পৃথিবীর নায়ককে “ক্ষ্যাত – গাধা” ভাবলেও অবশেষে দুজনের মধ্যে প্রেমতো হলোই।
৪. ‘গ্রেস’ যখন অসুস্থ হলো, সবাই গান গেয়ে প্রার্থনা করলো। সাধারনতঃ এধরনের গানে প্রায় সবসময়ই ঢাকাই ছবিতে কাজ হয় কিন্তু এটাতে ‘গ্রেস’ মরে গেলেও গান গাওয়া হয়েছিল।
৫. নায়ক প্রথমে বুঝে না বুঝে যেই অভিসন্ধি নিয়েই মিশনে নেমেছিলেন, পরে দুঃস্থদের স্বার্থ রক্ষা করতে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েই দিলেন।
৬. সমস্ত অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র , কৌশল, বোমা সব সাবেক কালের তীর ধনুক আর ছুরির কাছে ফেল মারলো।
৭. প্রথমে বিমানবাহিনী তারপরে সেনাবাহিনী যুদ্ধে ফেল মারলো। অবশেষে “আইওয়া” তাদের প্রার্থনা শুনলো এবং ঘোড়া, বানর ও আরো নাম না জানা নানা পশু মানে বনবাহিনী এসে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে তাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করলো
৮. ভিন গ্রহের মানুষ হয়েও নায়িকা এবং তার পিতা মাতা মাঝে মাঝে ভিলেনরা পর্যন্ত শুদ্ধ এ্যমেরিকান ইংলিশ ও একসেন্টে কথা কইলো
৯. শেষ দৃশ্যে নায়কের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়া মাত্র নায়িকা যে জীবনে চেয়ার টেবিলও চোখে দেখে নাই, সে অক্সিজেন মাস্ক টানিয়া আনিয়া নায়কের মুখে জায়গামতো পরাইয়া দিলো
১০. নায়িকাকে প্রানে রক্ষা করতে যাইয়াই নায়ক প্রচন্ড রকম আহত হইলো।
১১. নায়িকাকে ভালোবাসার কারনেই নায়ক নিজ গ্রুপের সাথে “বাগাওয়াত” করলো
১২. নায়িকাকে ভিলেন “পাইছি তোরে” ভাব নিয়া আটকে ফেলা মাত্র, নায়ক অন্য জায়গা থেকে উড়ে এসে নায়িকাকে রক্ষা করে ফেলল।
১৩. মুগাম্বোর মতো এখানেও “টরুক মাতুকা” আছেন তাদের ভগবান।
১৪. নায়ক তাদের ক্ষতি করতে এসেছিলো জেনে নায়িকা আর নায়কের মধ্যে ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই হলেও পরে নায়িকার ভুল ভাঙ্গে যে নায়ক আসলে “লুক” ভালো।
১৫. নায়িকার কথিত হবু স্বামী প্রথম থেকেই নায়ককে অপছন্দ করতো, নায়ক নায়িকা দুজনে দুজনের হয়ে যাওয়াতে তিনি প্রচন্ড নাখোশ হন
১৬. ভিনগ্রহের লোকজনেরও প্রার্থনার জন্য বিশেষ জায়গা আছে।
১৭. নায়িকা ভিনগ্রহের রাজকন্যা পরে নায়ক গোত্রের কর্নধার হয়
১৮. শেষ দৃশ্যে বিজ্ঞানের বদলে শুধুমাত্র তন্ত্র মন্ত্রের দ্বারা তারা নায়কের আত্মা এবং শরীরকে অন্য মাত্রা দিতে সাফল্য অর্জন করেন।

তানবীরা
০৫.০২.২০১০