Saturday, 9 February 2013

বানী অফ আওয়ার বাচ্চাকাচ্চা

মিষ্টি মা, তোমাকে কনগ্র্যাটস।
কেনো আব্বু?
তুমি বুকফেয়ারে একটা বুক উইন করেছো
তাই? তুমি কি করে জানলে?
আম্মু বলেছে।

আরভিন বাচ্চা ০৭/০২/২০১৩

আমি সবার বিয়ে খেতে পারলাম মামা, শুধু তোমার আর পাপারটা বাদে
তোমরা কেনো আমাকে ফেলে একা একা বিয়ে করে ফেলেছো?

মেঘ বাচ্চা ০৬/০২/২০১৩

Tuesday, 5 February 2013

মন খারাপের দিন



আমার মেয়ে মাত্রই দশে পা দিলো। তাকে আমি সজ্ঞানে কখনো সেভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প করিনি। একটা বিরাট কারণ প্রবাসীনি হওয়ায়। আর মায়ের কাছে সন্তান সবসময় ছোট থাকে। মনে হতো এতো ভয়াবহ ঘটনা বাচ্চার মনে খারাপ প্রভাব ফেলবে, আর একটু বড় হোক সে, তারপর জানবে সব। কিন্তু যা হয়, বাসায় আলোচনা শুনে শুনে, খালা – মামা, গুগল থেকে সে জানে, ৭১ এ পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের সাথে “অনেক খারাপ” করেছিলো। মানুষ মেরে ফেলেছিলো, তাই পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের বন্ধু নয়, আমরা কখনো কোন কাজে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে পারি না, এটা কখনো আর সম্ভব নয়। যেহেতু এটা সে জানেই, তাকে আমি “আমার বন্ধু রাশেদ” সিনেমাটা বেশ কয়েকবার দেখতে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয় আমাদের বাচ্চাদের ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলার এর থেকে সুন্দর উপায় আর হয় না। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে আমি অনেক কারণেই অসম্ভব শ্রদ্ধা করি, তারমধ্যে এটিও একটি কারণ। 


যদিও সিনেমা দেখতে বসার আগে একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা দিয়েছিলাম। তাতে যুদ্ধের সিনেমা শুনে সে খুব ভয় পেয়ে গেছিলো। আগেই জিজ্ঞেস করলো, মা, রক্ত হবে? রক্তকে সে ভীষন ভয় পায়। তার কাছে, বাংলা – হিন্দী সিনেমাতে লোকে অনেক চিৎকার করে কথা বলে, মারামারি করে আর রক্ত হয়। সে খুব একটা পছন্দ করে না, মায়ের মতো ভীতু স্বভাব পেয়েছে। আমার বন্ধু রাশেদ সিনেমাটা দেখে শুধু শেষ দৃশ্যে অনেক ভয় পেয়েছে, তাতে পাকিস্তান সম্পর্কে – মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ভাবনা আরো গাঢ়ো হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের জন্যে সে পাগল। প্রধান আকর্ষন, মামার বাড়ি, দাদুর বাড়ি তারপর আছে ফুচকা, ঝালমুড়ি, বোরহানী, কাবাব। আর আমিও মনে ধারনা দিয়ে রেখেছি, চাকরী শেষ করে আমরা চলে যাবো, তার প্রিয় বাংলাদেশে। যদিও সে ভেবেই পায়না সব ছেড়ে রেখে কোন আক্কেলে এখানে আমরা চাকরি ফলাইতে এসেছি। 


আজকে কাদের মোল্লার রায়ের প্রেক্ষিতে দেশে কি হচ্ছে, দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি টিভি অন করেছি। কাদের মোল্লা, যুদ্ধ, রাজাকার শব্দগুলো শুনছে বারবার। একবার আমাদের মুখে আবার টিভির মুখে। তারপর জিজ্ঞেস করছে, কি হচ্ছে দেশে, টিভিতে আমরা কি দেখছি? তাকে “রাজাকার” সম্বন্ধে বলা মাত্র, তার প্রতিক্রিয়া ছিলো, “ওরা কি ওদের মাথা খেয়েছিলো”? “কতো বোকা হতে হয় এমন একটি কাজ দেশের লোকের বিরুদ্ধে করার জন্যে?”ওদের অনেক শাস্তি হওয়া দরকার।“ তখন কষ্ট লাগে যারা সব জেনে বুঝে বসে আছেন তাদের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে। তারা যদি বুঝতে পারতেন, এ ধরনের অন্যায় যারা করে তাদের আসলে অনেক অনেক অনেক শাস্তি হওয়া দরকার। চারধারে রাজনীতির কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে মানবতা, পরাজিত হতে হতে আজকাল একধরনের বিষন্নতায় ভুগি। গরীবের রক্ত, আর্তনাদ বিশ্বে কতো ডলারে বিকায়? প্রায় রোজই পত্রিকায় খবর পাই, আবুধাবী, দুবাই, বাহরাইনে, মালোশিয়াতে শ্রমিকের মৃত্যু, লাশ আসছে। স্বাধীনতা কি দিয়েছে তাদের? প্রবাসে আগুনে পুড়ে মৃত্যু? আর যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে অন্তত হাহাকার? কখনো ন্যায় বিচারের জন্যে আর কখনো দুমুঠো খাবার জন্যে? বিচারের বাণী আজীবন নিভৃতেই কেনো কাঁদবে? মাননীয় আদালত, হাতজোড় করছি, ছেলেমেয়ের সামনে মুখ রক্ষা হয় সে ইতিহাস তৈরি করুন। কি করে জানাবো তাদের, এই ঘৃণ্য অপরাধ নিয়ে আমরা রাজনীতি করেছি, স্বজনহারাদের আর্তনাদ মিশে গেছে রাজনীতির গুটির চালে। ন্যায় বিচার হয়ে গেছে শুধু “শেখ হাসিনার” মুখের বুলি আর রাজনৈতিক হাতিয়ার? বিয়াল্লিশ বছর অনেক সময়, শহীদের আত্মারা আজো কেঁদে ফিরছে তাদের প্রাপ্য বিচারের আশায়। একটু কান পাতুন মহামান্য আদালত। 


তারপরও সামনে স্বাধীনতা দিবসকে মাথায় রেখে মেয়েকে গান শেখাই,

আমায় যদি প্রশ্ন করে আলো নদীর এক দেশ
বলবো আমি বাংলাদেশ।
আমায় যদি প্রশ্ন করে কলকাকলীর দেশ
বলবো আমি বাংলাদেশ।

মেয়ে জিজ্ঞেস করে “কলকাকলী” কি মা? এই বিষন্নতার মাঝে কি করে বুঝাই “কলকাকলী” কি? 


তানবীরা
০৬/০২/২০১৩

Friday, 1 February 2013

প্রথম বইয়ের প্রথম প্রকাশ



http://www.amadershomoy2.com/content/2013/02/08/news0246.htm

http://www.ekusheyboimela.com/archives/20821

রাতে বসে বসে স্বামী স্ত্রী রোজকারের খেজুরে আলাপটা সেরে নিচ্ছিলাম। স্বামী টিভি অফ করে প্রায় ওপরে যাচ্ছেন যাচ্ছেন পর্যায়ে আছেন, আর আমাকে তাগাদা দিচ্ছেন যেনো আমিও শুয়ে পড়ি। পতিদেবের ধারনা রোজ কম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার মেজাজটা দিন দিন আরো খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তিনি নিয়ম করে দিয়েছেন, উইকডেজে রাত এগারোটার পর বাড়িতে কেউ আর জেগে থাকতে পারবে না। আমি ল্যাপি অফ করবো করবো অবস্থায় আছি, এমন সময় শেষবারের মতো ফেবুটা চেক করতে যেয়ে দেখি জাগৃতি প্রকাশনী তাদের এবারের বইমেলার প্রকাশনার এ্যালবাম আপলোড করেছেন।

ত্রিশে জানুয়ারী রাত এগারোটায় চুয়াল্লিশটা ফটো নিয়ে ভেসে এলো জাগৃতি আমার ফেবুর হোমপেজে। আমি লাইক করলাম ভদ্রতা করে আর উলটে উলটে ছবিগুলো সব দেখছিলাম, কারা সে ভাগ্যবান যাদের এবার জাগৃতি ডেকে নিলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পরিচিত অপরিচিত নামগুলো দেখে যাচ্ছি আর ভাবছি, আমার এবারো হলো না, কেউ বললো না, তানবীরা রেডী? এমন সময় ম্যাসেজ বক্সে একটা লাল টিপ ফুটে উঠল। আমি অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে টিপে ক্লিক করলাম, ঘুমের সময় উতরে যাচ্ছে, কার আবার কি দরকার পড়লো? দেখি জাগৃতি আমাকে বলছে, আমার এই লিষ্টে আপনার একটা ফ্ল্যাপ থাকার কথা ছিলো না এবার? হঠাৎ গোস্বা খাওয়ার প্রবণতা আমার চিরদিনের। ঝাঁঝিয়ে বললাম, হলো আর কই? জাগৃতি একটু অবাক হলেন হয়তো, বললেন, আপনিতো আর কোন যোগাযোগ করলেন না। আমিও সমান তেজেই বললাম, আপনিওতো কোনদিন জিজ্ঞেস করলেন না। তখন অবশ্য ভাবছিলাম এসেছে আমার কাঁটা ঘায়ে নুন ছিঁটাতে। 


বাদানুবাদ বেশি দূর গড়ানোর আগেই জাগৃতি একটা ম্যাসেজ দিলেন, ছয় ঘন্টা সময় দিলাম আপনাকে, আপনার লেখা গল্পগুলো যেখানে যা আছে, সব একসাথে করে আমাকে মেইল করেন ওয়ার্ড ফাইলে। আমি অবাক বলে কি? এসময়ে? কোন ধরনের কোন প্রিপারেশন ছাড়া? সারাজীবনের সংশয়বাদী মানুষ আমি আমার সংশয় প্রকাশ করলাম, পিছলাতে চাইলাম, ভাবলাম বলবে ফলবে কিন্তু করবে না। আমার মনোভাব বুঝতে পেরেই হয়তো জাগৃতি জানালেন, কোন নেগেটিভ চিন্তা মনে ঠাঁই না দিয়ে কাজ করুন। সময় ছয় ঘন্টা, শুরু হলো এখন। তবুও নাছোড়বান্দা আমি বললাম, সারারাত জাগিয়ে কাজ করিয়ে, পরে সর‍্যি বলে দিয়ে ধোকা দিবেন নাতো, আবার? এবার ওনার পালা ছিলো, জানালেন, দিতেই পারি। দেশে আসলেন, একটা ফোন নেই, কোন যোগাযোগ নেইযদিও দেশে যাওয়ার আগে আমি ফেবুতে ডিসক্লেমার দিয়েই গেছিলাম, যার যার ইচ্ছে ফোন করতে, আমি কাউকে করলে আর কাউকে করতে না পারলে ঝামেলা বেশি হয়, থাক তাই কাউকেই করবো না নীতি পালন করেছি। ফোন জাগৃতি করেন নাই কিন্তু সেটাতো আর মুখের ওপর বলা যায় না, মানী প্রকাশক তথা প্রকাশনা বলে কথা। 


 গতোবারো বইমেলায় বই বের হয় হয় করে দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে। তাই এবার পণ করেছিলাম কাউকে বলবো না। কাউকে মানে কাউকে না। স্বামী কন্যা কাউকে না। যদিও কথাটা পেটে খুঁচখুঁচ করছিলো। মেইলের পর মেইল আসছে। ফ্ল্যাপ দেখছি, লেখক পরিচিত, বই সম্বন্ধে দুটো কথা কতো কি। প্রথম বই বের হচ্ছে, ফ্ল্যাপে কি যাবে কারো সাথে আলাপ না করেই লিখছি। অন্যের ফ্ল্যাপ পড়া আর নিজের ফ্ল্যাপ লেখা কি এক বস্তু? বরং লোকেরটা লিখে ফেলা সহজ। নিজেরটা না। বিণয় আছেতো, আত্মপ্রচার নেইতো সব ভাবতে হয়। বেশিরভাগ দিনের অফিসের প্রথম বেলাটা যায়, ভাইবোনদের সাথে মেইলে আড্ডা দিয়ে। ছুটিতে দেশে যাবো সামনে। অনলাইনে কেনাকাটা, বাজার পছন্দ চলছে। বেশিরভাগ দিন আমি থাকি বেশি এক্টিভ। আর তখন বলে যাচ্ছি আমি ব্যস্ত, তোরা পছন্দ কর, আমি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। 

এতো কঠোর গোপনতার কারণ হলো আমার কন্যা। স্বামী এসব ব্যাপারে বেশি রিয়াক্ট করেন না। বলেছিলাম না সারা দুনিয়া হলো ধোকা, ঠিক হলোতো আবার আমার কথা, এ ভঙ্গীতে তাকানোই হবে তার প্রথম এবং শেষ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মেয়ে অনেক দুঃখ পায়। ফিলিপ্স থেকে একটা মডেলিং লটারীর মতো করলো, ওয়েক আপ এ্যালার্ম লাইট দিবে বলে জানিয়েছিলো। পরে কিছুই আর জানায়নি। মেয়ে খুব দুঃখ পেলো। রোজ মায়ের ফেসবুক খুলে লাইক গুনেছে, তারপর তার প্রশ্ন, তুমি কি “এনাফ” গুড করোনি? কতো পেয়েছো? কেনো তাহলে তুমি লাইট পেলে না? একটা কালচারাল অগার্নাইজেশনে অনেককেই তাদের অবদানের জন্যে পুরস্কার দেয়া হচ্ছিল, আমরা বসে দেখছি। তারা অনেকদিনের মেম্বার আর আমরা নতুন যুক্ত হয়েছি বলা চলে, স্বাভাবিকভাবে আমরা কিছুই পাইনি। সে ছলছল চোখে আমায় জিজ্ঞেস করে, কেনো তোমাকে কিছু দেয়নি মা? তুমি কি কিছুই গুড করো নাই? রিসেশানে চাকরি গেলো তাও তার কথা, মা কেনো, কি করেছিলে? কেনো ওরা তোমাকে আর চায় না? মেয়ের সামনে হিরোগিরি ছেড়ে দেয়া বড়ো কষ্ট। মেয়ে মাকে বড়ো একজন আইডল ভাবে। আমি যা বলি সেও তা আমাকে ফিরিয়ে বলে। আমি তোমাকে নিয়ে অনেক প্রাউড হতে চাই মা। 

শুধু তোর জন্যেরে মা অনেক কিছু ভাল করে করতে ইচ্ছে করে। বাবা মায়ের জন্যে যা করিনি কিংবা করতে পারিনি কিংবা হয়তো করতে চাইনি সেইসব তোর জন্যে করতে ইচ্ছে করে ময়না মা আমার। বই প্রকাশনা নিয়ে অনেক গল্প উপন্যাস পড়েছি, অনেকের কাছে অনেক গল্প শুনেছি। ভীষন ঝক্কির ব্যাপার স্যাপার। এতো ঝক্কি যে অনেক গ্রুপ বছরে একবার একখানা বই প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু বইযে কারো কারো এতো সহজে এতো দ্রুত প্রকাশ হয়ে যায় জানতাম না। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন ফায়সাল আরেফীন দীপন, বছরের শুরুতে এতোবড় একটা ধাক্কা দিয়ে বছরটাকে সারাজীবনের মাইলষ্টোন বানিয়ে দেয়ার জন্যে।  জাগৃতি নিজেও আমার মান্ধাতার আমলের লেখা যার ড্রাফট পর্যন্ত আর খুঁজে পাইনি তার পিডিএফ ভেঙ্গে, সাইজে এনেছেন বইয়ের জন্যে।  ত্রিশে জানুয়ারী ২০১৩, সারাজীবনের একটা মাইলষ্টোন থাকবে স্মৃতির মনিকোঠায়। মা হওয়ার আনন্দের মতো অনুভূতি হচ্ছে। 


সবিণয় নিবেদনঃ এতোক্ষণ যে কারণে এই প্যাঁচাল লেখা হলো, আমার বইটা যদি বইমেলায় উপস্থিত বন্ধুরা জাগৃতির স্টলে যেয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখেন আমি ধণ্য হবো। আর কেউ কেউ যদি চটপটি – ঝালমুড়ি – গুড় দেয়া চা ইত্যাদি একদিন স্যাক্রিফাইস করে আমার বইখানা কিনেন তাহলে এই গরীব লেখিকার একটা ভবিষ্যত হয়, বাধিত হন তিনি। আট তারিখে বইমেলায় জাগৃতি এর স্টলে।

প্রচ্ছদ তৌহিন হাসান, ১৬০ পৃষ্ঠা, মূল্য ২৭৫ টাকা।


Monday, 14 January 2013

জীবন থেকে নেয়া (ঘুষাঘুষি)

১.
ছোটবেলায় পড়াশোনার করার সময় খুব আদর্শ মানুষ হওয়ার একটা স্বপ্ন দেখতাম, দেশের দশের জন্যে কিছু করব, অন্যায় করব না টাইপ ইত্যাদি। কালের আর্বতনে সব এখন গর্তে চলে গেছে। ভাইবোনদের মধ্যে এনিয়ে কখনো সরব প্রতিজ্ঞা হয়নি কিন্তু মনে মনে আমরা সবাই জানতাম, আমরা সবাই খুবই আদর্শ কিছু হবো। আমি বিয়ে করে দেশ ত্যাগ করে এলেও, দেশে যারা আছেন তাদের কাছে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা রেখে দিয়েছিলাম নিজের অজ্ঞাতেই হয়তো। একবার ঈদ করতে দেশে গিয়েছি। একদিন দেখি আম্মি ভাইয়াকে বলছে, ঈদে কিছু কিনে নাই কেনো? কালকে ঈদ? ভাইয়া বললো হাতে টাকা পয়সা নাই কি দিয়ে কিনবে? এই কথা শুনে মাতৃদেবীর কলিজা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তিনি তাড়াতাড়ি তিনার ব্যক্তিগত রিজার্ভ ভেঙ্গে পুত্রকে ঈদের কাপড়ের যোগাড় দিতে ছুটলেন। চার কন্যা ইস্টু এক পুত্র বিধায়, পুত্রের পাল্লা অলওয়েজ এই ভদ্রমহিলার কাছে ভারী। ঠিক হলো, আমিও যাবো কাপড় পছন্দ করে দিতে আর বাইরের ভাল মন্দ খেতে। রেডী হয়ে এসে দেখি বারান্দায় চোখ মুখ কুঁচকে মাতৃদেবী আর তার পুত্রজান দাঁড়িয়ে আছেন। নীচে এক ভদ্রলোক বেশ আনন্দিত ভঙ্গীতে চলে যাচ্ছেন। ভাইয়া কষে একখানা গালিও দিলো। ব্যাপার কি? 

তখন বাসায় দস্তুর হয়ে গেছে, সবকিছু আমাকে না জানানো। আমি চিল্লাপিল্লা করবো, শান্তি ভঙ্গের দরকার কি? কয়দিনের জন্যে মাত্র যাই। কিন্তু কোন এক কারণে সেই মুহূর্তে আর লুকাতে পারল না, নীচে মিটার চেক করার লোক এসে ঈদের বখশীস কাম ঘুষ যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ভাইয়ার ঈদের কাপড়ের টাকা নিয়ে চলে গেছে। ভাইয়া ঘুষ দেয় শুনে আমার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। আমি বললাম ইউ টু ব্রুটাস? ভাইয়া বললো, উপায় নাইরে গোলাম হোসেন। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, একদিন এসে বলে মিটার বদলান, তারপর দিন এসে বলে রিডিং ঠিক না, তারপর দিন অফিসে ডাকে, চেক ঠিক না, সই ঠিক না এই ভং চঙ্গের মধ্যে দুইমাস চলে গেছে, তারপর আসে বিল বাকি বলে, লাইন কেটে দিতে। ভাইয়া বললো, এক বিল দেয়ার চক্করে আমার চাকরী যাওয়ার উপক্রম। এখন মাস কাবারী সেটেল বিজনেস। তারাও খুশি আমিও শান্তি। এদের এমন সিন্ডিকেট ওপর থেকে নীচ অব্ধি, তুই পারবি না কিছুতেই কুলাতে। পকেটে হাত না ঢুকিয়ে কোন উপায় নেই। শুধু আজকেরটা উপরি নিয়ে গেলো, ঈদ সামনেতো তাই।
২.
দেশে গেলে কিছু রুটিন বেড়ানো থাকে, দেখা করতে যাওয়া মুরুব্বীদের সাথে। যানজটের যা অবস্থা, তাতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো মুরুব্বীদের সাথে দেখা করতে যাওয়াও একটা অভিজ্ঞতা বটে। একদিন ঠিক হলো শুক্রবার খুব সকালে উঠে দূরের দেখাগুলো করে আসবো, জ্যাম শুরু হওয়ার আগে। তাই সকালে ভাইবোন মিলে বের হয়েছি। পান্থপথ এসে দেখি দুই সার্জন প্রত্যক গাড়ি, সিএনজি, হোন্ডা, বাস, ট্যাক্সি থামিয়ে কাগজপত্র সব পরীক্ষা করছেন, জরিমানা লিখছেন ঘসঘষ করে। আমি অবাক হয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে আজকে কি ট্রাফিক সপ্তাহ টাইপ কিছু নাকি? এই অবস্থা, সাত সকালে জ্যাম। মুখ তিতা করে ভাইয়া বললো, আরে কিসের ট্রাফিক সপ্তাহ। সকালে সার্জন ঘুম থেকে উঠছে, তার বউ ঝাড়ি দিছে, টাকা পয়সা কিছু নাই হাতে, শুক্রবার দিন শপিং যেতে পারছি না, তুমি কি করো? ব্যস, সার্জন এসে এখন লাগাইছে এখানে, দুই ঘন্টা পর পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে হাসিখুশি বউরে নিয়ে শপিং এ যাবে। মাঝখানে সবার ভোগান্তি। কার গাড়ির কি আছে না নাই তা ব্যাপার না, ব্যাপার হলো কার থেকে কতো খেতে পারবে।
৩.
এবার ঢাকা গেছি। বসুন্ধরা শপিং মলের একটু আগে প্রিমিয়ামের সামনে দুই সার্জন গাড়ি থামিয়েছে। ড্রাইভারের সাথে কথাকতি আর শেষ হচ্ছে না। ব্লু বুক নিয়ে মুখ চুন করে ড্রাইভার বেড়িয়ে গেলো আবার। ছোটবোন দেখি মোবাইলে ফেসবুক করে যাচ্ছে। আমি বার বার ড্রাইভার আর ছোটবোন দুজনকেই জিজ্ঞেস করলাম, সমস্যা কি? কেউই কোন উত্তর দেয় না। আমি বিদেশ থাকি, দেশের কি বুঝবো, ভাব তাদের। আমি গাড়ি থেকে নামতে চাচ্ছি বারবার কি ব্যাপার দেখার জন্যে। ছোটবোন মহাবিরক্ত হয়ে ধমক দিলো, চুপ করে বইস্যা থাকো। এমন মাসে দুই একবার ধরবেই। হাজার টাকা ফাইন দিয়ে ছেড়ে দিবে। কিন্তু ফাইন কেনো দিবে? ওদের ইচ্ছা দিবে আর নইলে এখন তুমি ক্যাশ পাঁচশো দাও, এমনিই ছেড়ে দিবে। আমি ভাবলাম যাই ক্যাশই দেই আবার আব্বুর থেকে তিনগুন নিয়া নিবোনে। যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জনাব সমস্যা কি? জনাব বললো, গাড়ির নাম্বার প্লেট ঠিক মাঝখানে লাগানো হয় নাই, একটু সাইডে চাপা, এটা সমস্যা। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে সত্যি নাকি? ড্রাইভার ভয়ে বললো, আপা সত্যিইতো মনে হচ্ছে, এতোদিনতো খেয়াল করি নাই, কিন্তু আমি স্যারকে বলছি, এখনি আপনাদেরকে নামিয়ে দিয়ে নাম্বার প্লেট ঠিক করে লাগাচ্ছি, স্যার শুনছে না, ফাইন দিচ্ছে। আমি জনাবকে বললাম, নাম্বার প্লেটতো আমরা লাগাই নাই, গ্যারেজ লাগিয়েছে, কিন্তু এটা কি ক্রাইম পর্যায়ে পড়ে? তিনি আমাকে অনেক কিছু বুঝালেন কেনো, গাড়ির নাম্বার প্লেট মাঝখানে থাকা আবশ্যক। আমি বললাম, ভুল হয়েছে এবং সে ভুল স্বীকার করে ঠিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাহলে সমস্যা কি? ব্লুক বুক আটকাচ্ছেন কেনো?

জনাব অনেককিছু ততোমতো বললেন যা আমার বোধগম্য হয়নি। দেখি ব্লু বুক ড্রাইভারকে দিয়ে সে অন্যদিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, অন্য কাউকে ডেকে আনতে যাচ্ছে বা কিছু ব্যাপার। পুলিশ সম্পর্কে যা যা পড়ি পত্রিকাতে তাতে নিস্তার পাওয়ার আশা মনে রাখি নাই। ড্রাইভার এসে বলে, আপা গাড়িতে উঠেন। আমি বললাম, কথাতো শেষ হয় নাই, ওনি কই গেলেন, আসবেন। ড্রাইভার বলে, কথাতো শেষ, সার্জন চলে গেছে। আমি বুঝতেই পারলাম না কি হলো, চলে গেলো মানে? ভাইয়াকে অফিসে ফোন করে বললাম, নাম্বার প্লেট ঠিক জায়গায় লাগানো হয় নাই। ভাইয়া হাসে, এখনো সেই নাম্বার প্লেট ব্যঁকাই আছে কিন্তু পুলিশের চোখে হয়তো আর পড়েনি। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার আমার বীরত্বে খুবই খুশি হয়েছে, আপা পুলিশকে ভাগায় দিছে এই গল্প সেই পাড়াশুদ্ধ সবাইকে করেছে কিন্তু আমি এখনো জানি না পুলিশ কি কারণে আমাকে জবাব না দিয়ে বিদায় না নিয়ে চলে গেলো? 

৪. সেই সত্যযুগে একবার বেনাপোল চেকপোষ্ট দিয়ে কোলকাতা গিয়েছিলাম। বাস থেকে নেমে সবচেয়ে আগে পাসপোর্ট নিজের হাতে জমা দিয়েছিলাম। তখন নিয়ম ছিল, দালালের কাছে পাশপোর্ট জমা দিবেন, সাথে টাকা। তারা সব করিয়ে এনে আপনার হাতে দিলে আপনি ট্যাক্সি চেপে কোলকাতা যাবেন। ব্যাস, যা হওয়ার হয়ে গেলো। ভোর পাঁচটায় নিজের হাতে পাশপোর্ট জমা দেয়ার অপরাধে ফেরত পেয়েছি সকাল আটটায়। যখন বাংলাদেশ থেকে কাক-পংখী সব কোলকাতা পৌঁছেছে তখন আমাদের পাশপোর্ট ফেরত দিয়েছে। এর আগে পাশপোর্টে – ভিসায় চিরুনী তল্লাশী চালানো হয়েছে, কোথাও কোন ছিদ্র যদি পাওয়া যায় তাহলে বেয়াদপ ছেলেমেয়েগুলোকে আটকে দেয়া যায়। আমাদেরও গোঁ, যা করার কর কিন্তু ঘুষ দিবো না। তবে দেরীতে ফেরত দেওয়াও খারাপ কিছু হয় নাই। সকালে যেই ট্যাক্সি সাতশ টাকায় যেতো আর যাত্রী পাবে না তাই দেরী হওয়াতে সেই ট্যাক্সি চারশো টাকায় গেলো। দুইজোড়া নাগরা কেনার পয়সা বেঁচে গেলো। 

আসার সময় আরো মজার খেলা। যাই করেছি কিছু বাজার টাজারতো করেছি। স্যুটকেস প্রতি দুশো টাকা এমন একটি রেট ধার্‍্য্য করা আছে বাংলাদেশ কাস্টমসে। আমরা আরো উলটা হম্বি তম্বি, স্যুটকেস খুললে খুলেন, কি আছে দেখেন, রেখে দেন, টাকা নাই, দিতে পারবো না। এমন হই চই যে উলটা পার্টি তারা আরো আমাদেরকে কাইন্ড অফ এপোলজি দিয়েছে। 

৫. ব্যাঙ্কে বহু আগের আমলের একখানা হিসাব খোলা ছিলো। তার একটা বই খুঁজে পেয়ে গেলাম ব্যাঙ্কে খোঁজ নিতে। তিনারা পাথর মুখ করে জানালেন, দুই বছর লেনদেন না করলে বনলতা সেন থুক্কু হিসাব “ফ্রীজ” হয়ে যায়। আমি বললাম আমি দেশে থাকি না, আর পাস বইও খুঁজে পাচ্ছিলাম না, একাউন্ট নাম্বারতো মুখস্থ নাই। কিছুতেই তাহাদের মন গলে না। “ফ্রীজ” হিসাবকে “থ” করতে আমারে বহু লাল কার্ড দেখানো হলো। আমি সোজা ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বললাম, আমার টাকা আমি নিবো, আপনি ব্যবস্থা করে দেন। ম্যানেজার আমার ডু অর ডাই ভাব দেখে, একজনকে ডেকে আনলেন। তিনি ব্যবস্থা করে দিবেন কিন্তু সময় লাগবে। আমি বললাম সময় নেই, আজকেই, যতক্ষণ লাগে। ম্যানেজার আমাকে শান্ত করলেন, আর একদিন আসতেই হবে। ওনাদের নিয়ম। আমার সাত বছর আগের হাতের লেখার সাথে এখনকার স্বাক্ষর মিলানোর প্রাণান্তকর পরিস্থিতি দেখে খুবই ভয় লাগছিলো, নিজেকেই স্বাক্ষর জালকারী চোর চোর মনে হচ্ছিল। ছবির ক্ষেত্রেও সেই একই দশা। এই পুলসিরাত পার হয়ে পরদিন টাকা ক্যাশ করতে গেছি, দেখি এই দশ হাজার টাকা ক্যাশ হওয়ার খবর সবাই জানে ব্যাঙ্কময়। সবাই আমারে ধরে, আপনি বিদেশ থাকেন, এই টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন, আমাদেরকে দিয়ে যান আমরা মিষ্টি খাই। এতো মিষ্টি খায়, এদের ডায়বেটিস হয় না? আবার বলে, দুলাভাইরে নিয়ে আসলেন না কেনো? তাহলেতো এই টাকা নিয়ে আপনাকে যেতেই দিতাম না। খাইছে!!!!! আপার লগে দেখা নাই, দুলাভাই লইয়া টানাটানি।

তানবীরা
১৫/০১/২০১৩