Thursday, 5 December 2013

আমার আমি


আমার পরিচিত কাছের মানুষেরা অভিযোগ করেন আমার কাছে, আমি বড় হই না, বাচ্চাদের মতো করি, বয়সটা আমার কোথাও একুশে আটকে আছে। হয়তো পিছনে পিছনে বলেন, আমি যা করি তা হয়তো আমাকে মানায় না। যিনি আমার এই ছেলেমানুষীর সবচেয়ে বেশী ভুক্তভোগী তিনি বলেন, শরীরটা শুধু ডেভেলাপ করেছে, ব্রেইনটা ডেভেলাপ করেনি। তবে তিনিও এটা বলতে বলতে এখন ক্লান্ত হয়ে ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন শুধু আমি যেমন ছিলাম তেমনই রয়ে গেছি। সবার অনুযোগের পরেও আজও নিজেকে সামলে সবার আকাঙ্খা অনুযায়ী নিজেকে বড় করে তুলতে পারিনি।

বদলে যাওয়া বড় হওয়া সব কী নিজের হাতে থাকে? সবাই কী চাইলেই নিজেকে ইচ্ছেমতো বদলে ফেলতে পারে? বড় হয়ে যেতে পারে?

অনেকেই বলেন ছোটবেলায় এই লেখকের বই আমার ভীষন প্রিয় ছিল, ঐ গায়ক বা নায়ককে আমার ভীষন ভাল লাগতো। ঐ খাবারটা খুব মজা লাগতো। আমার কোন অতীত নেই, নেই কোন পাষ্ট টেন্স। আমার তখনো যা প্রিয় তা এখনো প্রিয়, তখনো যা আমার ছিল এখনো তা আমারই আছে। আমি কোন কিছুর দাবী ছেড়ে দিতে শিখি না, যা আমার তা একান্ত আমার। আজো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা চটপটি আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের অনুভূতি দেয়, বসুন্ধরা ফুডকোর্টের দই ফুচকা আমার সে অনুভূতি একটুও কেড়ে নিতে পারেনি। ছোটবেলায় জিতু আঙ্কেলের বা মিঠুন আঙ্কেলের নাচ যে আনন্দ নিয়ে দেখতাম এখনো সেই আনন্দ নিয়েই দেখি, অক্ষয় কুমার কিংবা হৃত্তিক রোশান তার জায়গা ছিনিয়ে নিতে পারেনি। টিনটিন কিংবা ডলুমাসী, টম এন্ড জেরী আজো সেরকমই হাসায় কাঁদায়। যা যা কিংবা যাকে যাকে যতোটুকু ভালবাসতাম তা তা কিংবা তাকে তাকে আরো বেশী ভালবাসি আজো। বেলী কিংবা কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ দেহ মনে সেই সময় যে শিরশিরানি আনতো আজো তেমনই আকুল করে। চওড়া পাড় দেয়া ভাজ ভাঙ্গা বাসন্তী রঙের নতুন তাতের শাড়ি, হাতে রঙ বেরঙের লাল হলুদ সবুজ রেশমী চুড়ি, কপাল জুড়ে বড় চাঁদের মতো কালচে লাল টিপ আর ঘাড় গলা খোঁপা জুড়ে জড়িয়ে থাকবে অজগরসম কাঁঠালিচাঁপার মালা। তখনো প্রিয় এখনো প্রিয়।

দাদুর সাথে কতো দিন দেখা হয় না। কবে আবার কোন পৃথিবীতে দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কীনা জানি না। যদিও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি শক্তির ধ্বংস নেই আবার হয়তো কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যেতে পারে কোন না কোন রুপে, হয়তো দাদু নাতনী হয়ে নই তবুও তবুও। যাকে মন দিয়ে খুঁজে লোকে তা নাকি পেয়েও যায়। আমি কী দাদুকে ভুলে গেছি? কম ভালবাসি? বড় হওয়া মানে কী ছোটবেলা ভুলে যাওয়া? দাদুর জন্যে মন কেমন করলে কান্না না করা? কতো শীতের রাত লেপের নীচে দাদুর গায়ের ওম নিয়ে কেটেছে সেকি চাইলেই ভুলে যেয়ে বড় হওয়া যায়? নাকি শীতবেলায় সেই স্মৃতি মনে পড়লে দু ফোটা গড়িয়ে পড়া অশ্রুকে বড় হয়ে যাওয়ার অনুশাসনের মাঝে আটকে দেয়া যায়?

আজো শেষ বিকেলের গোধূলির সূর্যের লাল আভায় মন জানি কেমন কেমন করে ওঠে, কার জন্যে কীসের জন্যে জানি না। আজো কোকড়ানো চুলের উস্কো খুস্কো বাদামী তরুন দেখলে মনে রিনিক ঝিনিক সুরের দোলা নাচে, এক পলকের জন্যে হলেও আবার ফিরে তাকাই। এখনো শিমূল মুস্তফার কন্ঠে জয় গোস্বামীর “পাগলী তোমার সঙ্গে” কবিতার আবৃত্তি শুনলে নাম না জানা কারো পাগলী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আজো সমুদ্রের উষ্ণ নোনা জলে পা ভেজালে ভাষায় বর্ননা করা যায় না এমন অনুভূতি গা ছুঁয়ে মন ছুঁয়ে যায়। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এখনো মনে হয় হাত বাড়ালেই আকাশটাকে ছোঁয়া যায়। এখনো মায়ের চুলের তেলের গন্ধ সর্বাপেক্ষা প্রিয়, মন মাতায়। এখনো মিতালী মূর্খাজীর ‘আকাশটাতো নীল চিঠি নয়, জানলা খুলে আমার লেখা পড়বে, মনটা কী আর ময়না পাখি? মনটা কী আর ময়না পাখি সোনার শিকল দিলেই বাঁধা পড়বে” শুনলে মনে হয়, এতো আমার কথা, এতো শুধুই আমার কথা, মিতালী কী আমার কথাই গাইছে?

প্রিয় যা ছিল প্রিয় তাই আছে। কিছুই হারায়নি হয়তো হারাবেও না। সেই জ্বলে ওঠা নিভে যাওয়া জোনাকী পোকা, আমসত্ত্ব, চালতার আঁচার, সারা গায়ে সুর মেখে বৃষ্টিতে ভেজা। না গান না কবিতা না সেই কাউকে নাম না বলা হৃদয় গহীনে লুকিয়ে থাকা মানুষটা, চোখের কাজল কিংবা খোঁপার কাঁটা, তেতুল বনে জ্যোস্না দেখা কিংবা কপালে কারো নামের টিপ আঁকা। প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়েছে সমস্ত কিছু, তালিকাটা দীর্ঘ হচ্ছে দিন দিন এই যা। বড় হওয়া হবে না আমার, হলো না আমার আর

কিন্তু তারপরও কী কিছুই বদলায়নি? সবার চাহিদামতো বড় হয়তো আমি হয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু খানিকটা বদলে আমি নিশ্চয় গেছি। কারো নজরে সেটা না পড়লেও মাঝে সাঝে যখন অনেক ব্যস্ততার ফাঁকে একটু অবসরে নিজের দিকে ফিরে তাকাই, খুলে দেখি নিজেকে, কোথায় সেই পুরনো আমি? কিছুটা রুক্ষ আর অনেকটাইতো বদলে যাওয়া আমি।

তানবীরা

০৫/১২/২০১৩

Monday, 28 October 2013

জীবন থেকে নেয়া (চোর নিয়ে মেঘাডেট)

আজকে “আমরাবন্ধু”র জন্মদিন। বিগত যৌবনা এই ব্লগটাতে পারতে কেউ আজকাল আর উঁকি দেয় না। শুধু যারা মায়া কাটাতে পারে নাই তারা মাটি কামড়ে পড়ে আছে। হ্যাপি বার্থডে এবি, অনেক অনেক হাসি খেলার – আলোর বেলা কেটেছে এখানে। ভাল না থাকো, টিকে অন্তত থাকো।
প্রথমে সেদিন চোর এলো আমাদের বাড়িতে তারপর পুলিশ। ঘটনাটা এরকম, বুধবারে বাবা মেয়ে বাড়ি ফিরেছে এবং যথারীতি একজন টিভি আর একজন ল্যাপটপের মধ্যে ঢুকে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে খুব তাড়াহুড়া সব গোছাচ্ছি আবার বেরোতে হবে, আমাদের খুব কাছের বন্ধু একবছর আগে মারা গিয়েছেন, তার সেদিন মৃত্যুবার্ষিকী। মেঘকে ওপরে পাঠিয়েছি রেডী হতে। বাগানের দরজার নবটা দেখি অর্ধচন্দ্র। মুচড়ে আছে ঠিক অর্ধেক মাপে।
মেয়ের বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বাইরে গিয়েছিলে, বললো না।
আমি বললাম তাহলে এমন হলো কি করে লক?
তিনি বললেন, মেঘ হয়তো বাইরে গিয়েছিলো।
মেঘ নীচে আসতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে বললো, নাতো মা, আমি যাইনি।
আমি বললাম তাহলে কি চোর এলো নাকি।
বললেও ভাবার সময় নেই এখন প্রায় সাতটা বাজে, বেরোতে হবে। কেউ গা করলো না।
বেরোতে যাবো সেই মুখে প্রতিবেশী এলেন। তার আগের দিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। ময়লা যাওয়ার পাইপ নাকি ভরে আছে, পরিস্কার করার লোক ডাকবে। দুই বাড়ির যেহেতু লাইন একটাই তাই পয়সা ভাগাভাগি করতে হবে সমান সমান। আমরা বললাম করবো, তুমি ডাকো লোক। সে তবুও পিছনে যেতে চাইলো, অগত্যা বাগানের দিকের দরজা খোলা হলো। দরজা খুলতে পারছে না কারণ লকের অবস্থা বারোটা। কোনরকমে খুলে দেখা গেলো, সাইকেল গ্যারেজ, বাগানের দিক থেকে বাইরে যাওয়ার দরজা, এবং মেইন দরজার পিছন দিকে ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে রেখে গেছে। আমাদেরতো খবরই নেই।
মেঘ যারপর নাই আনন্দিত। নিরিবিলি জীবনে একটি এ্যাকশানধর্মী ব্যাতিক্রমী ঘটনা। আনন্দে দৌড়ে একবার বাবার কাছে যায়তো আমার কাছে আসে। আমিতো ধরি নাই, আমিতো জানি কিভাবে লক খুলতে হয়, আমিতো করি নাই, ওটা চোর করেছে। আমি তোমাকে সত্যি বলছি।
ওর বাকবাকুমের জ্বালায় আমি আর ওর বাবা কথা বলতে পারছি না। পুলিশ, ইন্স্যুরেন্স সব ফোন করতে হবে। আবার ঐদিকে যাওয়াও জরুরী, কারো জন্মদিন না যে, না করে দিবো। আমি যখন ধৈর্য্যহারা পয়েন্টে পৌঁছেছি আবার মুখ খুললে চড় দিবো, তখন আসল কথা পেট থেকে বের হলো।
মা, আমি ওখানে সবাইকে আর কাল স্কুলে সবাইকে বলতে পারি, আমাদের বাড়ি যে চোর এসেছিল। প্লীজ মা প্লীজ, প্লীজ।
অনেকসময় আমি বলি, এটা আমাদের প্রাইভেট ব্যাপার স্কুলে বা কারো সাথে গল্প করবে না তাই আগে থেকে সাবধানতাঃ।
আমি বললাম, ঠিকাছে।
আহা কি আনন্দ তার ঝরে গলে পড়ছে। এতো বড় রোমাঞ্চকর ঘটনা তাদের বাড়িতে।
বাড়ি ফিরে এসে পুলিশকে ফোন করেছি, তারা আসছেন। ফিল্মীধারা বজায় রেখে প্রথমে চোর তারপর পুলিশ।
মেঘ উত্তেজনায় ওপরে যেতে পারছে না, রাত বাজে দশটা। আমি বললাম, আসুক পুলিশ, দেখুক, কোন বাচ্চা হল্যান্ডে এতোক্ষণ জেগে থাকে। আমি কিচেনে পরদিনের লাঞ্চ বানাচ্ছি, এমন সময় কলিং বেল বাজলো, দেখলাম চারশো মিটার স্পীডে কি জানি নীচের থেকে সিড়িতে ওপরে গেলো। পুলিশ এসেছে আর বান্দা ওপর থেকে নীচে নামে না। অন্যদিন কাপড় বদলে ব্রাশ করে শুতে কমসে কম ত্রিশ মিনিট সময় লাগে আর সেদিন পাঁচ মিনিটে ওপরের লাইট অফ!!!।
পুলিশ এমন বস্তুর নাম।
চোর অবশ্য আমার মনোজগতেও অনেক ওলট পালট ঘটিয়ে দিয়ে গেছেন। চোরের কারণে আমার সারাক্ষণ চোর সংক্রান্ত গান কবিতা মাথায় আসতে লাগলো। এই চোর যায় চলে, এই মন চুরি করে ......... কিংবা চুরি করেছো আমার মনটা এই টাইপ। তারচেয়ে ভয়াবহ যাতে চোর নেই তাও চোরা চোরা রুপে ধরা দিতে লাগলো। বাসায় মেইল করেছি, ঘরেতে চোর এলো গুনগুনিয়ে .........
বন্ধু ধ্রুব আগে বলতো, মাথায় কিরা ঢুকছে, আসলে মাথায় কিছু গেঁথে গেলে, কিরা ঢুকার মতোই
চোর একবারই এসেছিল নীরবে
আমারই দুয়ারও প্রান্তে
সেতো হায় মৃদু পায়
এসেছিল পেরেছিতো জানতে
সে যে এসেছিল বাতাসতো বলেনি
হায় সেইক্ষণে এ্যার্লাম মোর চলেনি
তারে সে আলোতে চিনতে যে পারিনি
আমি পারিনি কিলায়ে তারে মারতে
পৃথিবীর সকল চোরকে আমার ওপরের চোরাসাহিত্য খানা উপহার দিলাম।
মেঘ অনেক দুঃখী মুখ করে আমাকে শুক্রবারে বলল, আম্মি পরীক্ষা কেন হয়?
আমি বললাম, ঠিক করে পড়েছো কীনা সেটা জানতে হবে না?
আমরাতো ক্লাশে পড়ি, টীচারতো দেখে, ওকি আমাদেরকে তাহলে বিশ্বাস করে না?
পড়লে পরীক্ষা দিতে সমস্যা কি?
আমার ভাল লাগে না
তুমিতো ঠিক করে পড়ো না তাই ভাল লাগে না, যারা ঠিক করে পড়ে তাদের নিশ্চয় ভাল লাগে না।
কারো ভাল লাগে না আম্মি, কারো ভাল লাগে না। আমি একদম সত্যি বলছি
তাই নাকি? কেন ভাল লাগে না?
আমাদের স্ট্রেস হয় আর স্ট্রেস শরীরের জন্যে ঠিক না।
মেঘের বাবা যেদিন দেরী করে অফিস থেকে ফিরেন, মেঘ অনেক গোপন সুখ দুঃখ মায়ের সাথে ভাগাভাগি করেন।
রোজ ভোরে উঠতে অনেক কষ্ট হয়, তাই না আম্মি।
হুম
বড় হওয়া অনেক কষ্ট। এরপর রোজ ভোরে উঠে চাকুরীতেও যেতে হবে। জীবনে আসলে আনন্দ কিছু নেই।

যুদ্ধ কান্না শিশু আর আমাদের রাজনীতি

মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি থেকে অনেক শিশুকে ইউরোপে দত্তক পাঠানো হয়েছিল। ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক “যুদ্ধ শিশু” বা “ওয়ার চাইল্ড” দত্তক এসেছে। তাদের বেশীর ভাগের বয়স এখন চল্লিশের কিছু ওপরে কিংবা কিছু নীচে। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর থেকে ধরা যাক ত্রিশ কিংবা মধ্য ত্রিশ থেকে নিজের শিকড় খুঁজে ফিরছেন। কেউ কেউ কাউকে খুঁজে পান, কেউ কেউ বিফল হন। কারো বায়োলজিক্যাল বাবা মা বেঁচে আছেন কিংবা দুজনের একজন আছেন কারো কারো কিছু নেই।

খুঁজে পাওয়ার পর? বায়োলজিক্যাল বাবা মা নিতান্ত গরীব। রিকশা চালক, চায়ের দোকানে কাজ করেন ইত্যাদি। এপারে ছেলেমেয়ে বেশীর ভাগই উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত। তারা বাংলা বলতে পারেন না। বাবা মা ইংরেজী বলতে পারেন না। তখন কাউকে চাই যে দুজনের মাঝে সেতু গড়বে। মাঝে মাঝে আমি তাদের সেতু হই। বেশীর ভাগ বাবা মা, ভাইবোন কথা বলতে পারেন না, কাঁদেন বেশী আর ছেলেমেয়েরা পাথর মুখ করে তাকে নিয়ে বাবা মা, ভাইবোনদের সুখ কিংবা দুঃখ স্মৃতি শুনতে চান। ডাচ প্রকৃতির কারণে এরা কাঁদেন কম কিংবা শিশুকাল থেকে কেঁদে কেঁদে পাথর এখন। এতো আবেগী ঘটনায় জড়িয়ে কি খুব নির্লিপ্তভাবে কাজ করা যায়? একজন একপাশে ফোনে কাঁদেন আর একজন অন্যপাশে স্কাইপে উৎসুক চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। কি বললো আমার কথা? কি বললো? পড়াশোনা না জানা বাবা মা, ভাইবোনদের ভাষা নেই আছে বোবা কান্না। আর উচ্চশিক্ষিত এপারে সন্তানটির অনেক ভাষা চাই, জানার আঁকুতি দিনরাত তার সেখানে সে কেমন ছিল? কি খেয়েছিল সে, কি খেলতো? কি তার ভাল লাগতো? কে তাকে বেশি ভালবাসতো? ভাষান্তর তখন অনেক কঠিন। ভেবে ভেবে বের করতে হয় সন্তানকে মা কি বলতে পারেন।


চল্লিশ বছর নীড় খুঁজে ফেরা বৃন্তচ্যুত মানুষেরা এখনো কেঁদে যাচ্ছেন। এরপর যখন কেউ বলেন আপনারা “গনহত্যা” করিয়েছেন, আপনাদের মুক্তিযোদ্ধারা মানুষ মেরেছে তখন তাদেরকে ঘৃনা করার মত ঘৃনাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না। 

Thursday, 29 August 2013

নৈতিকতা নিয়ে আমার ভাবনা গুলো

মুক্তমনায় এখন লেখালেখি চলছে, সামনের বইমেলাতে প্রকাশিতব্য আমাদের বই “ধর্ম ও বিজ্ঞান, সংঘাত নাকি সমন্বয়”কে কেন্দ্র করে। একটি বিশেষ বিষয়কে ঘিরে সবাই তার পক্ষের - বিপক্ষের যুক্তি তুলে ধরছেন, নানা বড় বড় মনীষী, গবেষকদের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন যার যার নিজের লেখাতে। এর মধ্যে অবধারিত ভাবেই হয়তো একটা কথা বার বার চলে আসছে, ধর্ম মানুষের কি কাজে লাগে , ধর্মের প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা। এই লেখা গুলো পড়ার পর যখন নিজে নিজে সেগুলোকে নিয়ে ভাবি আর নিজের প্রতিদিনের জীবনের চারপাশটা মিলিয়ে দেখতে যাই, প্রায়শই একটা জিজ্ঞাসা মনে খেলে যায় । কোনটা তাহলে সত্যি? একটা জিনিস একই সাথে কালো এবং সাদা দুটো হতে পারে না, জিনিসটি হয় কালো নয় সাদা। নাকি আমরা চরম স্বাভাবিক সত্যকে মেনে নেয়ার মতো সাহস নিজেদের মধ্যে সঞ্চয় করতে পারি না, নিজেদের মানসিক দুর্বলতাকেই ধর্মের আবরনে মুড়ে নেই? আর বার বার কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার মতো কালো মেয়েকে উজ্জল শ্যাম বর্ন বলে চালাতে চাই, ব্যাপার তাই কি ? আমার চিন্তা ভাবনাই কি ধোয়াশা নাকি আমিই ঠিক বিষয়টি বুঝতে পারছি না। আমার এই লেখা অনেকটা আমার আত্ম জিজ্ঞাসা। এতে শুধুই আমার মনের ভাবনা গুলো যেগুলো অনেক সময়ই জট পাকিয়ে যায় তাই লিখছি। এতে কোন মনীষীর কিংবা গবেষকের উদ্বৃতি নেই, আছে সাধারন একজন মানুষের তার চারপাশ অবলোকন করা আর তার দ্বিধাগ্রস্ত মনের এলোমেলো ভাবনা।
অনেকেই তাদের লেখায় ধর্মের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, মানুষের মধ্যে নৈতিকতা সৃষ্টির জন্য ধর্মের প্রয়োজন আছে। সত্যিই কি তাই? কি সেই ধর্ম বিশ্বাস যার থেকে নৈতিকতা উৎপন্ন হয়ে এমন চরমে চলে যায় যে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেন না? কোন সেই নৈতিকতার কারনে প্রত্যেক ধর্মের ধর্মপ্রাণ লোকেরা অন্য আর ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের বাসায় জলগ্রহন করতে দ্বিধা বোধ করেন? একজন ধর্মপ্রাণ ব্রাক্ষণ কিছুতেই কোন হাজী মওলানার বাড়ীতে খাদ্য দ্রব্য স্পর্শ করবেন না, যেমন করবেন না একজন মওলানাও একজন ব্রাক্ষণের বাড়ীতে। অথচ দুজনেই যার যার ধর্মের মহারথী, দুজনেই নৈতিকতার ধারক এবং বাহক। এতে নৈতিকতাই বা কোথায় আর ধর্মই বা কোথায়? এটা কি তাদের প্রতি সৃষ্টি কর্তার কিংবা সৃষ্টি কর্তার প্রতি তাদের অনাস্থাই প্রমাণ করে না? মানুষকে ঘৃণা করা, একজন মানুষের প্রতি আর একজন মানুষের অবিশ্বাস ও সন্দেহই কি ধর্ম আর নৈতিকতা?
ধর্ম থেকে আসা নৈতিকতার কিছু উদাহরণঃ আমি এখানে আমার চোখে দেখা ধর্মের নৈতিকতা নিয়ে আমার ভাবনা গুলো লিখবো। বাংলাদেশ অত্যন্ত গরীব দেশ হওয়াতে আমাদের দেশের লোকের সর্বপ্রথম যে চিন্তাটা থাকে তাহলো যেনতেন প্রকারে নিজের এবং ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য যতো দ্রুত এবং যেকোন উপায়ে সম্ভব আখের গুছিয়ে ফেলা। অন্ততঃ জলপাই সরকার এসে অনেক রথী মহিরথীর বাড়ি থেকে যে হারে রিলিফের টিন উদ্ধার করেছেন তাতে এ ব্যাপারে অন্তত কারো দ্বিমত থাকার কথা না। যার যতোই থাকুক না কেন সোনার চামচে যেনো নিজের সন্তান খেতে পায় তার সুবন্দোবস্ত নিশ্চিত করে যেতেই হবে। যার যার সার্মথ্যনুযায়ী সে সে হাত বাড়ায়। মসজিদের শহর ঢাকা, সুমধুর আজানের ধ্বণিতে চারপাশ অনুরণিত সারাবেলা। মুসলমানদের দ্বিতীয় মহামিলন এজতেমা হয় এই দেশে। যে দেশের প্রায় নব্বই ভাগ লোক চূড়ান্ত ধর্মপ্রান সে দেশ দুর্নীতিতে ডাবল হ্যাট্রিক !!! এটাকে কি চোখে দেখবো? এই রঙের নাম কি কালো না সাদা? নাকি ছাই বর্ন এটাকেই বলব?
চরম দারিদ্রতার কারণে বাংলাদেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী, সে যে উপায়েই হোক বিদেশ পাড়ি জমান। দুর্ভাগা বাংলাদেশের চরম হতভাগা লোকগুলো সোনার হরিণের পিছনে বাবা - মায়ের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ছুটে আসে নিজের তথা পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। বারো থেকে ষোল লক্ষ টাকা ব্যয় করে এসে যখন দেখে হরিণ গলিয়ে সোনা বের করে নেয়া হয়েছে বহু আগেই তখন তারা স্তব্ধ হয়ে যান। পিছনের সব ইতিহাস ভুলে যেয়ে, বাংলাদেশে কি করতেন, কি পড়তেন সেই দিন খাচায় তুলে রেখে, সেই টাকা উদ্ধারের জন্য যে কোন কাজ পান তাতেই ঝাপিয়ে পড়েন। এরমধ্যে সবচেয়ে সহজ লভ্য কাজ হচ্ছে কোন ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে ঢুকে পড়া। ধার্মিক দাড়িওয়ালা, ক্ষেত্রবিশেষে টুপিওয়ালা মালিকরা তাদেরকে কখনো কখনো থাকা খাওয়ার জন্য কিছু দেন, অনেক সময় শুধু কাজের সুযোগটাই দেন, টিপসের টাকাই এলাহী ভরসা। আজকাল যেহেতু অবৈধ অভিবাসীদের উপরে বিদেশীরা খুবই ক্ষ্যাপা, অবৈধ কাউকে কাজে রাখা যে কারো জন্যই দশ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত। তাই অবৈধ অভিবাসীদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত হওয়ায় মাঝে মাঝে অনেক মালিক কৈফিয়ত দেন যে, এতো রিস্ক নিয়ে যেহেতু রেখেছি, পয়সা বেশি দিতে পারব না। অসহায় ছেলে গুলো কাগজ হলে একটা হিল্লা হবে এই আশায় বুক বেধে সেটাই নীরবে মেনে নেয়।
একশ্রেণীর ধর্ম পেশা লোকজন যে থালায় খাচ্ছে, সেই থালাকেই ফুটো করে যাচ্ছেন অবিরত। প্রথমতঃ অবৈধ একজনকে আশ্রয় দিচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে যেয়ে। অবৈধভাবে তার শ্রমকে অপব্যবহার করছে এবং সরকারকে প্রতিনিয়ত শুল্ক ফাকি দিচ্ছে। যে শুল্ক দ্বারা সবার সন্তানদের স্কুল - কলেজের খরচা আসবে, অসুস্থদের ভাতা আসবে, গৃহহীন কারো গৃহের ব্যবস্থা হবে, কর্মহীন কারো মাসিক ভাতা আসবে, সব কিছুর উৎস এই শুল্ক। একসাথে কতোজনকে ফাকি দিচ্ছে তারা? সৃষ্টিকর্তা, সরকার, বিবেক ???
কিন্তু এই তারাই আবার সরকারের কাছে আবেদন - নিবেদন করে রবিবারে বাচ্চাদের ধর্ম শিক্ষার জন্য সরকারের কাছ থেকে বিনা মূল্যে মিলনায়তন সহ ইমামের বেতন আদায় করছেন। এর মধ্যে ধর্ম কোথায় আর নৈতিকতা কোথায় ? কিসের মূল্যবোধ তারা তাদের সন্তানদেরকে তথা সমাজকে উপহার দিচ্ছেন? ঠিক আছে কাফের সরকারকে ঠকাচ্ছে, কাফেরদের প্রতি কোন মূল্যবোধের বা বিবেকের দরকার নেই, কিন্তু দেশী ভাইদেরকে ঠকানোর পেছনে কি যুক্তি? এদের অনেকেই প্রায় প্রতি বছর পরিবার নিয়ে হজ্বব্রত পালন করে আসেন, তারপর আবার অনেক সময়ই শোনা যায় এই রেস্টুরেন্ট মারামারি হয়েছে কারণ পাচ বছরের দিন রাত খাটা পয়সা না দিয়ে বরং সেই শ্রমিককে পাওনা টাকা দেয়ার ভয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, শ্রমিককে পুলিশে দিয়ে, মালিক হজ্বে !!!! জামিনে বেরিয়ে এসে তখন দেখা যায় সেই শ্রমিক মালিককে মারতে গিয়েছে, এদের সবাই কিন্তু ধার্মিক। এই রেষ্টুরেন্ট মালিকরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রাথমিক অবস্থায় একদা শ্রমিক ছিলেন যারা পরবর্তী জীবনে মালিক হয়েছেন। শ্রমিক অবস্থায় তারা যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, মালিক হয়ে তারা অন্যদেরকে সেই একই জিনিস ফিরিয়ে দিচ্ছেন, জীবন থেকে কি শিখেছেন তবে তারা কিংবা ধর্ম থেকে?
আজকাল আবার আর একটা ব্যাপার থাকে। মদ বিক্রি না করলে রেষ্টুরেন্ট চালানো যাবে না, আবার হাজী সাহবে মানুষরা মদ বিক্রি করতে পারবেন না। সামাজিক একটা ইয়ে ইয়ে ব্যাপার এসে যায়। তাই মালিকরা প্রত্যেকেই বয়ান করে থাকেন মদ বিক্রির পয়সা তারা খাবার বিক্রির পয়সা থেকে আলাদা রাখেন। কারন এটা হালাল না। এটা দিয়ে তারা কর্মচারীদের বেতন দেন। এখন, প্রথমতঃ যখন কেঊ বিল দেন, তখন তারা নিশ্চয়ই মদের টাকা আর হালাল খাবারের টাকা আলাদা করে দেন না। তারা তাদের কষ্ট করে উপার্জন করা হালাল টাকাতেই পাওনা পরিশোধ করেন। আর দ্বিতীয়তঃ যে ছেলে গুলো হাত পুড়িয়ে রেধে খাওয়াচ্ছে তারা হালাল পরিশ্রম করে তাহলে হারামের টাকায় বেতন নিচ্ছে!!!! যিনি কর্মচারীদেরকে হারাম বেতন দিচ্ছেন, তার বিবেক কিসের উপর ভর করেছে? এট কি ধর্ম না তার থেকে উৎপন্ন হওয়া নৈতিকতা?
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে মানবিক অধিকার যাতে খর্ব না হয় এবং মানুষের জীবন যাত্রার মানের সমতা রাখতে বিভিন্ন ধরনের ভাতার প্রচলন আছে। এই ভাতার মূল উদ্দেশ্য থাকে দুর্বলদেরকে রক্ষা করা, তাদের নূন্যতম মানবিক প্রয়োজনগুলো মেটানো। প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের প্রত্যুৎপন্নমতি বুদ্ধির দ্বারা সরকারের সাথে টম এন্ড জেরীর হাইড এন্ড সিক গেম খেলে সারা বেলা। এমন কোন ভাতা নেই যা সরকারের কাছ থেকে তারা আদায় করেন না। এমনকি তালাকপ্রাপ্তা ভাতাও। আইনতঃ তারা বিবাহ বিচ্ছেদ করেন এবং ধার্মিক মতে বিবাহিত থাকেন। এই ভাতা কিন্তু খুব একটা সামান্য নয়। অনেকে এই টাকায় ঢাকায় গুলশানে, বারিধারায় তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনে নেন দু’বছরে। যদিও কাফের সরকারের এই পয়সাযে তাদের জন্য হালাল সেটা তারা কোরানের আয়াত, সুন্নাহ, ফিকাহকে ডলে পিষে বুঝিয়ে দিয়ে ছাড়বেন। ধর্মের মাধ্যমে নৈতিকতা শিক্ষার কি চরম উদাহরণ!!! তদুপরি বলব, যখন একজন অধার্মিক লোক চুরি করেন, তাকে নিয়ে উচ্চ বাচ্য করার হয়তো তেমন কিছুই নেই, তার জন্য হয়তো অন্যদের দৃষ্টিকোন থেকে সেটাই স্বাভাবিক। সে কোন কিছুর আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে না। কিন্তু একজন ধর্মপ্রান সমাজ স্বীকৃত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ব্যাক্তি যখন চুরি করে তখনতো ধর্মের দিকে অঙ্গুলী উঠবেই, ধর্ম আধারিত নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই স্বাভাবিক নিয়মে। প্রার্থনার ব্যাপারটি নিয়ে ধার্মিকরা সারাক্ষন মাতামাতি করেন। তারমানে কি এই ধরে নেয়া যায় না, অন্যায় করেন বলেই বারবার কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন আসে? যদিই অন্যায়ই না করেন, দুর্বলতাই না থাকে, তবে কিসের ক্ষমা চাওয়া? নিজেরা দুর্বল বলেই সারাক্ষন কারো আজ্ঞাবহ হওয়া কিংবা কারো উপড় নির্ভর করার ব্যাপারটা আসে।
আমার বিশ্লেষণে দুই ধরনের ধার্মিক আছে। এক ধরন হলো সাদা মাটা ধার্মিক। তারা কিছু না জেনে না বুঝেই ধার্মিক কিংবা বাবারেও করতে দেখছি তাই আমিও করি টাইপ। এই শ্রেণীর এমন অবস্থা বাবারও দশ খানা ছেলে পুলে ছিল তাই নিজেরাও সেই খাতায় নাম দিতে থাকে। যতক্ষণ না ডাক্তার এসে থামান স্বাস্থ্যগত কোন কারণ দেখিয়ে। এদেরকে আমি ঠিক ধার্মিক বলি না, বলি প্রথা পালনকারী, জিজ্ঞাসাহীন এক ধরনের আজ্ঞাপালনকারী বাহন। দ্বিতীয় দল হলেন আসল দল, মুখে দুনিয়া কয় দিনের কিন্তু কাজে সেই দুনিয়ার জন্য এমন কোন কর্ম নাই যা তারা করবেন না। সব জিনিসের একটা ধর্মভিত্তিক ব্যাখা তাদের কাছে পাওয়া যাবে। যেকোন জিনিসকে ধর্মের আলোকে তারা আলোকিত করে ফেলেন। নিজেদের মতো নৈতিকতার একটা ব্যাখা নিশ্চয়ই তাদের মন তৈরী করে রাখেন, যার খোজ খবর আমরা রাখি না। কবির কথানুযায়ী হয়তো দারিদ্রতা মানুষকে মহান করে কিন্তু টি। আই। বি’র রিপোর্টনুযায়ী মানুষকে চোর করে, অনন্ত বাংলাদেশের চৌদ্দকোটি মানুষ তাই প্রমান করেছে।
শুধু কি দারিদ্রতাই নৈতিকতাকে ক্ষয় করেঃ উপরের আলোচনা থেকে মনে হতে পারে শুধু দরিদ্র লোকেরাই ধর্মকে ব্যবহার করে কিংবা ধর্মের আড়াল বা আশ্রয় নিয়ে অন্যায় করে থাকেন। আসলে কি তাই? আমার সীমিত দৃষ্টিতে দেখা, অনুভব করা ও জ্ঞানের আলোক বলব না। তাহলে ধনী আরব রাষ্ট্রগুলো কিংবা কম্যুনিষ্টরা মানুষের উপর এতো অন্যায় করছেন, কেনো? বরং ধর্মের আবরনই অনৈতিক স্খলনের জন্য দায়ী। ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ নিজেকে আড়াল করে এবং সকল ধরনের অনৈতিক অপরাধ করে থাকে। দুবাই বা অন্য যেকোন মুসলমান রাষ্ট্রে গেলেই এটা দেখা যায়। আরবরা দরিদ্র না কিন্তু তারা দরিদ্র দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে টাকা - পয়সা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি বহু ব্যাপার নিয়ে দিন রাত মিথ্যে কথা বলছে, প্রতারণা করছে। সেই মিথ্যে কথা শুরুর আগে একবার ইয়াল্লাহ বলছে, শেষে একবার বলছে। দরিদ্র দেশের মানব সন্তানদের ব্যবহার করে উটের দৌড় করাচ্ছে, কিংবা যৌন হয়রানী করছে। কিন্তু আবার আজান দেয়ার সাথে নামাজ পড়ে চিত্ত শুদ্ধও করছে। বেশীর ভাগ আরবদের বেশ কয়েকটি করে বাড়ি থাকে, যার অনেক গুলোই ফাকা ও তালাবন্ধ থাকে বছরের পর বছর, সেই জায়গায়ই হয়তো পাচশ গজ দূরে একটি কুড়ের মধ্যে বারোজন মানুষ গাদাগাদি করে থাকেন। ধর্ম কি সেই শিক্ষায় দেন মানুষকে ? ধর্মের দ্বারা নৈতিকতা কতো জায়গায় ধর্ষিত এবং পদদলিত। তবে শক্ত আইনের বাধনে যেসব জায়গায় পড়তে হয় সেসব জায়গায় অনৈতিক কাজ অনেক কম হয়। উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, যেলোক দেদারসে ট্যাক্স ফাকি দিচ্ছে কিংবা ভীড়ের বাসে টিকেট ফাকি দিচ্ছে অথবা কর্মচারীর বেতন মেরে দিচ্ছেন, সেই তিনিই কিন্তু কখনও ভুল জায়গায় পার্কিং করার চিন্তা মাথায় আনবেন না, কিংবা মেয়েকে কাফের বিদেশী ছেলেদের সাথে কোএডুকেশনে পড়তে দিবো না কিংবা আঠারোর আগে আইনতঃ বিয়ে দিবেন, এই ধরনের চিন্তা মাথায় আনবেন না। যে আরবরা নিজের দেশে অ - আরবীয় সমাজের মানুষের সাথে গরু ছাগলের মতো ব্যবহার করেন, তারাই যখন ইউরোপে গরমের ছুটি কাটাতে আসেন, পরিবার পরিজন নিয়ে, অ - আরবীয় সমাজের সাথে তখন শিষ্ট ও চরম ভদ্র আচরন করে থাকেন। তাহলে কি শক্ত, কঠোর, অলংঘনীয় সব আইনগুলো অনেক সময় ধর্মের সমান্তরাল হিসেবে কাজ করে স্থান - কাল - পাত্র ভেদে নৈতিকতা শিক্ষা দেয় মানুষকে?
ধার্মিকরা হয়তো গুনাহ হবে সেইজন্য অনেক সময় অনেক অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন কিন্তু ভয় দেখিয়ে কি সব সময় নিজেকে বিরত রাখা যায় যদি অন্তর থেকে কেউ তাগিদ অনুভব না করেন? বিবেক থেকে অন্যায়কে অন্যায় ভাবেন না বলেই হয়তো সাধারনতঃ দেখা যায় যেকোন অন্যায় করার পর ক্ষমা চেয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে নেয়ার একটা ভরসা ওদের মধ্যে কাজ করে। যখন কেউ ভাবেন আমি অন্যায় করে উপাসনার দ্বারা তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারবো, সেই ভাবনার প্রেষনাই তাকে অন্যায়ের প্রতি জোর ধাবিত করে। ধার্মিকরা প্রায়ই তাদের ধর্মের প্রতি অত্যন্ত ভালোবাসা থেকেই হয়তো বলে বসেন, ধর্মের কোন দোষ নেই এর অপব্যাখা দেয়া হচ্ছে। তাই যদি সত্যি হয়, ধর্ম যদি এতোই নাজুক ব্যাপার হয়ে থাকে যে, যে খুশী সেই তার অপব্যাখা কিংবা ভুল ব্যবহার করতে পারে, তাহলে সেই দুর্বল জিনিসটা “নৈতিকতার” মতো একটা শক্ত জিনিসের ভার কিভাবে নিতে পারে? অজ্ঞতা থেকেই ভয়ের আর ভয়ের থেকে নানারকম কল্পনার সৃষ্টি হয়। রাক্ষস, খোক্কস, পরী, পংক্ষীরাজ ঘোড়া কিংবা এমন কোন অবয়বের যাকে সর্ব শক্তিমান মনে করার আপ্রান চেষ্টা চলে। যার উৎস হলো অজ্ঞতা কিংবা ভয় তা কি করে নৈতিকতা ধারন করতে পারে?
এই লেখাটা পড়ে আপাত মনে হতে পারে যে, ধর্ম সব অনৈতিকতার কারন বা ধার্মিক লোকেরাই অনৈতিক কাজ করে। কিন্তু আমার মতে ধর্মহীনতা মানেই যেমন নীতিহীনতা নয় তেমনি ধার্মিক মানেই নীতিবান, সচ্চরিত্রের লোক সবাই নন। শুধু ধর্ম মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়, এই ধারনাটা সাধারনের মাঝে বদ্ধমূল হওয়াটা বিপদজনক। এতে করে ধর্মের ঢাল ব্যবহার করে অনৈতিক কাজ গুলো হরদম করে যাওয়ার একটা একটা সুযোগ সে পাচ্ছে এবং আমাদের চারপাশের বাস্তব বলে দেয়, সেই সুযোগের সদ্বব্যহার সে করছে। ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারা আর সেই অনুভূতিকে বিবেকের কষ্টি পাথরে ঘষে নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটানোই আমার মতে নৈতিকতা, যা ধার্মিক অধার্মিক সকলের মধ্যেই থাকতে পারে কিংবা থাকেও। পরিশেষে নিজের একটা উপলব্ধি যেটা থেকে মুক্ত হওয়া এ জীবনে আর সম্ভব হবে না জানি, সেটা লিখছি। ধর্মের ব্যাখা বলি আর গল্পই বলি, যেখানে ধর্ম নিজেই বলেছে, প্রথমে মানুষে এসেছে এবং পরে তার কল্যানের জন্য ধর্ম এসেছে। প্রত্যেক ধর্মের এই একই গল্প, শুধু গল্পের চরিত্রের নাম আর প্লট আলাদা। সেজন্য যা মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের পরে এসেছে তা যেনো কখনই মানুষের থেকে বড় না হয়ে উঠে। প্রয়োজনের বস্তু যখন যাদের প্রয়োজন হবে তারা ব্যবহার করবেন নিশ্চয়ই , কিন্তু তাকে সবার জন্য অনিবার্য করে তোলার কোন কারন নেই। আজকের এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের যুগে এটুকু উপলব্ধি করতে পারি, এই পৃথিবীর এখন ধার্মিক মানুষের চেয়ে নীতিবান মানুষের প্রয়োজন অনেক অনেক অনেক বেশী।
তানবীরা তালুকদার
২৫.০৬.০৮

Tuesday, 13 August 2013

আমার যতো সিনেমা - ৩



“নহন্যতে” সিনেমার নামটা শুনছিলাম কদিন ধরেই। ছোটবেলায় পড়া মৈত্রীয় দেবী আর মির্চা এলিয়াদকে মাথায় রেখে সিনেমাটা দেখতে বসে প্রথমে একটু আশাহত হয়েছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনেমায় ডুবে গেলাম। কাহিনীটাই এমন টানের। পুরো সিনেমাটাই টান টানের। জীবন মানুষকে কখনো কখনো এমন জায়গায় এনে দাড় করিয়ে দেয় মাকে বেছে নিতে হয়, এক সন্তানকে বাঁচাতে পারবো, কাকে চাও, ছেলেকে না মেয়েকে? সিনেমার শুধু শেষটা ভাল লাগেনি বড্ড সিনেমাটিক লেগেছে। বাচ্চা এডাপ্ট করা আর পরে বাচ্চার তার বায়োলজিক্যাল পেরেন্টসদের সাথে যোগাযোগ করা একটা সাধারণ ঘটনা। পরিচালক এটাকে এতো নাটকীয়রুপ না দিলেও পারতেন। হয়তো বাচ্চা মেয়েটার অভিমানের পাল্লাটা অনুধাবন করানোর জন্যে এই নাটকটার অবতারনা কিন্তু কোন বাচ্চাটা অভিমান করে না যখন জানতে পারে তার বায়োলজিক্যাল পেরেন্টস তাকে দিয়ে দিয়েছে? নো ম্যাটার কারণ যাই থাকুক? আমি হলে হয়তো শেষটুকু অন্যভাবে লিখতাম। ব্যাক্তিগত অনুভব, ক্ষমা এই জিনিসগুলোকে প্রাধাণ্য দিতাম। তবুও বলবো অসাধারণ একটা মুভি, সিনেমাপ্রেমীদের জন্যে।

“নহন্যতে” ধরে ধরে ইউটিউব ঘাটাঘাটি করে যেয়ে পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত “লা নুইট বেংগলী” সিনেমাটি। এটা মির্চা এলিয়াদের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বানানো। মৈত্রীয় দেবী আর মির্চা এলিয়াদ দুজন দুজনের মতো করে তাদের প্রেম কাহিনী লিখেছেন। একজন লিখেছেন স্বাভাবিকভাবে কূল বাঁচিয়ে আর একজন কি কিছুটা প্রতিশোধমূলকভাবে? বরাবরের মতো বই আমার যতোটা ভাল লেগেছিলো সিনেমা ততোটা ভাল লাগেনি। বইয়ে জমজমাট প্রেম ছিলো, সামহাউ আমার মনে হলো সিনেমায় প্রেম সেভাবে দানা বাঁধেনি কিংবা ফুটেনি। মাথায় বই কিংবা কিশোরীবেলা বেশি কাজ করছিলো কিনা জানি না। কিংবা ওয়েস্টার্ণ মেকিং এর কারণেও হতে পারে। ইষ্টার্ন মেকিং হলে হয়তো বানিয়ে দিতো, হাম দিল দে চুকে সানাম। তারপরো কোন এক সময় যারা বই দুটো পড়েছেন বলবো, দেখতে পারেন, খারাপ লাগবে না।

“শব্দ” খুব ব্যাতিক্রমধর্মী গল্প নিয়ে করা এই সিনেমাটি। একজন মানুষ যিনি সিনেমায় শব্দ নিয়ে কাজ করেন তাকে ঘিরে এই কাহিনী যদিও কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে নানা শব্দের উৎপত্তি ব্যাঞ্জনা সিনেমায় যে শব্দগুলো আমরা শুনি সেগুলো কিভাবে তৈরী হয়, তার বেশ মজাদার উপস্থাপনা। যারা সিনেমায় এই কাজটি করেন তাদেরকেই সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়ে থাকে? অনেকে বললেন বেশ স্লো সিনেমা কিন্তু আমার গতিনুযায়ী ঠিকাছে।

কিছুটা এধরনেরই কাহিনী নিয়ে একটা মুভি দেখেছিলাম বছর কয়েক আগে ২০০৬ এর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শাহবাগ জাদুঘর মিলনাতয়নে। যতোদূর মনে পড়ে সিনেমাটার নাম ছিলো “নিঃশব্দ”। নেটে কোন ইনফরমেশান খুঁজে পেলাম না এই মুভিটার ওপর। সেই মুভিটার অবশ্য থীম ছিলো সারাদিন আমরা অকারণে কতো শব্দ করি তা নিয়ে। কিছুটা সাউন্ড পলিউশনের ব্যাপারে মানুষকে কনশাস করা টাইপ। ডিটেইলসে দেখিয়েছিলেন সারাদিন আমাদের চারপাশে অকারণে কতো শব্দ হয়। যার অনেককিছু হয়তো আমরা চাইলে ওভারকাম করতে পারি।

“গয়নার বাক্স” অপর্না কঙ্কনার সর্বশেষ কাজ। এই একটা সিনেমা প্রথম বারের মতো আমার বইপড়া ভালো লাগাকে কিছুটা ছাপিয়ে ওপরে উঠেছে। পিসিমাকে কিংবা রাসমনিকে আমার বইতে ঠিক এতোটা মজাদার লাগেনি যতোটা সিনেমাতে লেগেছে। আমার কল্পনা রাসমনিকে অপর্নার মতো এতোটা মজাদার ভাবেনি। মৌসুমী আমার অলটাইম ফেভরিট তার উচ্ছল স্বভাবের জন্যে, ভাল লাগার সেটাও একটা কারণ হতে পারে। সিনেমাটা দারুন মজাদার, বইটা পড়া না থাকলেও দারুন এঞ্জয় করা যাবে। শুধু কঙ্কনার প্রেমটাকে সিনেমায় গলা টিপে না মেরে দিলেই পারতেন। এখানে পরিচালকের সময়ের দাবীনুযায়ী কল্পনার অবকাশ ছিলো। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পটি অপর্নার হাতে পড়ে একটি অন্যরকম ব্যাঞ্জনা পেয়েছে।

হঠাৎ করে কোলকাতার সিনেমায় পড়াশোনা জানা ছেলেমেয়ে ঢুকে সিনেমার বৈশিষ্ট্য পালটে ফেলেছে। আবার “হোয়াট বেংগল থিংক্স টুডে ইন্ডিয়া উইল থিঙ্ক টুমরো” তে নিয়ে যাচ্ছে মুভির কাহিনী। আই উইশ তার ছিটেফোঁটা যদি আমাদের সিনেমার দিকেও আসতো। আমাদের সিনেমায় ঢুকে যায় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। তবুও আশা রাখি ফারুকী গ্যাং যদি সিরিয়াসলি সিনেমা নিয়ে ভাবেন তাহলে হয়তো হেমলক সোসাইটির মতো আমাদেরও অনেক কিছু দেয়ার আর পাবার থাকবে।

১২/০৮/২০১৩

Friday, 14 June 2013

প্রসংগ হিন্দী ভাষা কিংবা ভিন্ন সংস্কৃতি




আজকাল বেশ একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে দেশের আধুনিক ছেলেমেয়েদের মধ্যে “হিন্দী ভাষা”কে ঘৃনা করি টাইপ কথা বলার। যদিও “ঘৃনা” শব্দটা খুবই শক্ত, কোন কিছুকে নিয়ে মন্তব্য করার জন্যে, “অপছন্দ করি” কথাটা হয়তো তাও চলে যায়। যারা এধরনের ঘৃনা শব্দগুলো উচ্চারন করেন তারা কিন্তু অবলীলায় ইংরেজি, আরবী, চায়নীজ কিংবা ফ্রেঞ্চ গান, সিনেমা, বই পড়ছেন - উপভোগ করছেন। একশ কোটির বেশি মানুষ যে ভাষায় কাঁদেন, হাসেন, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করেন, রাত জেগে বই লিখেন, আবেগে কেঁপে কবিতা লিখেন সেই ভাষাকে আমরা কেনো ঘৃনা করি? তার কি কারণ? এতোগুলো মানুষের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম কি করে অন্যদের ঘৃনার উদ্রেক করতে পারে? অনেকেই বলতে আসেন, তারা আমাদের সাংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিচ্ছে, তাই ঘৃনা করি। তাই কি? নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে অন্যকে ঘৃনা করাই সার? তারা এসে চড়ে বসেছে আমাদের ওপর? বাধ্য করেছে আমাদেরকে তাদের সিরিয়াল দেখতে, শাড়ি পড়তে, তাদের গরু, পেয়াজ খেতে?

তাই যদি হয় তাহলে আমাদের ছোটবেলার “খোদা হাফেজ” যে এখন “আল্লাহ হাফেজ” কেড়ে নিচ্ছে, মাথায় মাথায় নানা ঢংয়ের হিজাব বসছে, দাঁড়িতে মেহেন্দী আঁকা হচ্ছে, তার বেলায়? এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিচ্ছে না? কথায় কথায় ওহ মাই গড, কুল, অসাম এগুলোওতো হরদম সবাই ব্যবহার করছে। নাকি ইংরেজী দ্বারা, আরবী দ্বারা গ্রাসিত হলে সমস্যা নেই সমস্যা হলো শুধু হিন্দীর বেলায়? আমাদের দেশটা এতো ছোট আর এর মধ্যে ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, পোশাক, খাবার দাবারের বৈচিত্র্য এতো কম যে, ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি যে সহনশীলতা বা শ্রদ্ধা তা লোকজন শিখেইনি। সেদিন কোন একটি সংবাদপত্র বিদেশের কোন একটি জরিপের উদাহরন টেনে সংবাদ ছেপেছিলেন, “অসহনশীল” দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম বিশ্বের মধ্যে দু’নম্বরে আছে। এরচেয়ে সত্যি খবর বোধ হয় আর হতে পারে না। সর্ব ব্যাপারে উগ্রতা আর মৌলবাদ। ভাগ্যিস বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ একই ধারায় চিন্তা করে না। তাইতো বিদেশের বুকে আমরা তাদের সামাজিক অনুদানের সাহায্য নিয়ে, নিজেদের নববর্ষ, ঈদের নামাজ, মসজিদে প্রতি শুক্রবারে জুম্মা পড়া, রোববারে বাচ্চাদের কোরান পড়া, দুর্গাপূজা, দিওয়ালী এগুলো উদযাপন করতে পারছি। নিজেদের সংস্কৃতি নিজেদের ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি। শুধু টাকাই দেন না তারা, মেয়র আসেন, বক্তৃতা দেন, অনুষ্ঠান ভাল লাগুক আর মন্দ লাগুক দেখেন, খাবার টেষ্ট করেন। শুধুমাত্র গরীব বিদেশী যারা আছে বিদেশে তাদেরকে সাহস দিতে যে আমরা আছি তোমাদের পাশে। বাংলাদেশে বোধহয় এধরনের ঘটনা কল্পনাও করা যায় না।   

সহনশীলতা অবশ্য জাতিগত ভাবেই নাই, কোনদিন ছিলোও না। যারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সম্মান দেখিয়ে জাতিকে শিখাবেন সবাইকে পথ দেখাবেন তারা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন কামড়াকামড়ি করতে। বরং তাদেরতো আরোই নাই। সংসদ অধিবেশনের অর্ধেকের বেশি যায় দুই পক্ষের ডার্টি লন্ড্রী টানাটানি করতে করতে। জনগন বরং এটা শিখে যে যতো উগ্র সে ততো বড় বীর, ততো তাড়াতাড়ি সবার আলোচনায় আসবেন আর বিখ্যাত হবেন, চলে উগ্রতার চর্চা যার যার সামর্থ্যনুযায়ী। কারো জামা কাপড়ে মৌলবাদ প্রকাশ পায় তো কারো সিনেমা গানে। রাহাত ফাতেহ আলী খান, জাগজিত সিং, মেহেদী হাসান, আদনান সামী, গুলাম আলী এদের গান ভালো লাগলে কি করবো? বরং মাইকেল জ্যাকসান কিংবা জর্জ মাইকেল থেকে এরা বেশি মনপ্রাণ ছুঁয়ে যান। ধর্মের দোহাই দিয়ে? বর্ডারের দোহাই দিয়ে কান বন্ধ করে দিবো? কোন যুক্তিতে? ভারতীয়রা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করেন আর আমেরিকানরা আরবরা আমাদেরকে ভালো পান? আসলেই তাই কি? ভালো পান নাকি তারা আমদেরকে? কোন দিক দিয়ে? বর্ডারে বিনা বিচারে যেমন ফেলানী মারা যায় তেমন গরীবের বেতনের পয়সা মেরে দিয়ে, মেয়েদেরকে অত্যাচারকে আরবী ভাইয়েরাও কম কষ্ট দেন না আমাদেরকে। গরীব যেদিকে চায় ...... আরব আমেরিকা ভারত সব শুকাইয়া যায়।

তাই যদি বর্জন করতে হয় একযোগে সব বর্জন। আর ভারত বর্জন করলে শুধু সিনেমা টিভি না, গরুর মাংস, পেয়াজ, ঔষধ, ডাক্তার, কাপড়, মাছ সব বর্জন করতে হবে। আর নইলে সহনশীলতার মাত্রা বাড়ানো, ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা, ভালোবাসা থাকা একান্ত কাম্য। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মূলটা উপভোগ করে কিভাবে তার থেকে নিজেদের সংস্কৃতিকে আরো মজবুত বানানো যায় সেটা শিখে নিতে হবে। তাই একজন রবি শংকর সারা বছর আমেরিকার ট্যুর করে গেছেন। আমেরিকানরা রবি শংকরকে ভারতীয় বলে অবহেলা করেননি বরং তার গুনের জন্যে বুকে করে রেখেছেন। যেমন করেন ভারতীয়রা জেমসকে বাংলাদেশ থেকে ডেকে নিয়ে যান, রাহাত ফাতেহ আলী খানকে পাকিস্তান থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। ভালোটা গ্রহন করতে শিখা জানতে হবে। নিজেদের অজ্ঞানতা ও অক্ষমতার দোষ কি অন্যকে ঘৃনা করে ঢাকা যাবে, মনে হয় না, কোনদিনই না।

তানবীরা
১৫/০৬/২০১৩

Tuesday, 4 June 2013

যতোটা দূরে গেলে ভুলে থাকা যায়

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=ab370b1b126f971f334346994af22f6e&nttl=20130604070931201331


ফোন বেজে যাচ্ছে ক্রিং ক্রিং, ল্যান্ডফোন। সারা বাড়িতে এক মৃত্যু শীতল নীরবতা। অপালা ঠায় মূর্তির মতো বসে ফোনের রিং শুনছে। এক একবার বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম মাদল বেজে উঠছে, এক একবার বিশাল শূন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে, তবুও কান ভরে প্রাণ ভরে সে ফোনের শব্দ শুনে যায় প্রায় রোজই। সে যেমন জানে ফোনের অপর প্রান্তে কে আছে, বাড়ির অন্যরাও জানে, এই ফোন কার জন্যে বেজে যাচ্ছে। চোখে বাধ না মানা অশ্রুর বন্যা, গাল বেয়ে আরো নীচে নামতে থাকে। যখন নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারে না তখন বাথরুমে যেয়ে কল ছেড়ে দেয় তারপর তোয়ালেতে মুখ ডুবিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদে। তাতেও যদি বুকের ব্যথা একটু কমে, সারাবেলা বুকে চাপ চাপ ব্যথা। কি এক নীল কষ্ট জমে আছে সেখানে, যা তাকে দিনভর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। দুদণ্ড আরামে খেতে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না। সবকিছু এতো ফাঁকা লাগে এতো অর্থহীন মনে হয়। একজনের পাশে থাকা না থাকায় বৃষ্টির মানে বদলে যায়, জ্যোৎস্নার মানে বদলে যায়, কবিতার মানে বদলে যায় যেমন যায় জীবনের মানে বদলে।

অপালার বাবা মায়ের ইচ্ছের সম্মান দিতে গিয়ে দুজনেই ঠিক করেছে আর এতো কাছে আসবে না দুজন কখনো। ঠিক যতোটা কাছে এলে আগুনের তাপে মোম গলে যায়, হৃদয়ের উত্তাপ ভালোবাসাকে নিংড়ায়। কিন্তু বন্ধু থাকবে আজীবন দুজন দুজনের। ভাবা আর প্রতিজ্ঞা করা যতো সোজা তাকে অন্তরে ধারণ করে নেয়া কি ততোটাই সোজা? যে কথাগুলো দুজন দুজনকে বলেছে, আর যে কথাগুলো বলবে ভেবেছিলো, বলা হয়নি কিন্তু দুজনের অন্তর জেনে গেছে, সে সব স্বপ্ন থেকে কি এক ঝটকায় মুক্তি পাওয়া যায়? না যায় না, তাই আপাতত বিরহ পালা চলছে শুধু তারা দুজনেই জানে এ বিরহ চিরদিনের বিচ্ছেদ, মধুমিলনে বদলে যাওয়ার নয়। নিজেদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গুছিয়ে নেয়ার মানিয়ে নেয়ার সময় দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরেও ক্ষণে ক্ষণে ফোন বেজে উঠে। যে মানুষটির কথা চব্বিশটি ঘণ্টা ভাবতো, যাকে ভেবে এতো গল্প কবিতা, কপালে নীল টিপ আঁকা, শাড়ি পড়া, গায়ে সুগন্ধী মাখা তাকে চাইলেই কি এক মুহূর্তে ফুলস্টপ দিয়ে আজ থেকে আর তার কথা ভাববো না, বললেই হয়ে যায়!!!

যাবে না যাবে না করেও কতো বেলা কোচিং-এ চলে গেছে অপালা, তার কোন ক্লাস নেই, কাজ নেই তবুও গেছে, বুকের মধ্যে রিনিক ঝিনিক সুরের কাঁপন অনুভব করতো, যদি সে থাকে। একি কথা কি তার বেলায়ও নয়? হয়তো অন্য অনেক জরুরি কাজ ফেলে রেখে, বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে কোচিং-এ যদি অপালা এসে থাকে। হয়তো কোন কথা বিনিময়ও হবে না তাদের মধ্যে, শুধু একটু চোখের দেখা কিংবা সামান্য দৃষ্টি বিনিময় অথবা দূর থেকে এক চিলতে হাসি। শেষের দিকে এটা অবশ্য রুটিনে পৌঁছে গেছিলো যতো কাজই থাকুক, কোচিং-এ নির্দিষ্ট সময়ে তাদেরকে ঢু মারতেই হবে।

হেসে বলতো সে, চার্জ হতে আসি। এইটুকু তোকে না দেখলে সারাদিনে কোন কাজের উৎসাহ পাই না, চলার হাসার কোন মানে থাকে না আমার। তুই হলি আমার সকল শক্তির উৎস, সকল কাজের প্রেরণা।

সে উৎসকে হারিয়ে থাকতে হবে সারা জীবনের জন্যে, সে প্রেরণাকে মুছে দিতে হবে সব কর্মযজ্ঞ থেকে। কাঁদছে দুজন দুপুর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যার যার বিছানায় মুখ ঢেকে, দুজনেই জানে দুজনের চাওয়াতে কোন পাপ ছিলো না, মিথ্যে ছিলো না তাদের এই চাওয়া, ফাঁকি নেই কোথাও। প্রকৃতি তাদের দুজনকে কাছে নিয়ে এসেছিলো প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই। কিন্তু নিয়তি নিয়ে এলো বিচ্ছেদ।

কতো দুপুর কেটেছে তাদের একসাথে গান শুনে বা শুনিয়ে, কবিতা শুনে বা শুনিয়ে, বই নিয়ে, সিনেমা নিয়ে গল্প করে। ভাববো না আজ থেকে তোকে আর বলতেই পারে কিন্তু যেই মুহূর্তগুলো একসাথে কেটেছে স্বপ্ন বুনে সেগুলো কি করে মুছে যাবে? কোথায় হারাবে সেগুলো? যখন সেই গান আবার বাজবে কোথাও, পা থেমে আসবে না, মনে পড়বে না কখনই কিছু? মনে পড়বে না, এই গান আমার ছিলো কিংবা আমাদের ছিলো, ঐ মুহূর্ত আমাদের ছিলো, ঐ চাঁদ আমাদের ছিলো, ঐ ফুল আমাদের ছিলো শুধু আমাদের। দুমড়ে মুচড়ে বিদ্রোহ করে ওঠে অপালার মন, কেন সে অপালার বাবা মায়ের কথা মেনে নিলো? কেন সে অপালার হাত ধরতে ব্যাকুল হলো না। তীব্র অভিমানের বিষে অপালার সারা শরীর নীল হয়ে থাকে সারাবেলা। ধরবো না ফোন তোর, কখ্‌খনো না, কিছুতেই না। আমি কষ্ট পাচ্ছি, তুইও পা। প্রতিশোধের নেশা ব্যাকুল করে তোলে অপালাকে সারাবেলা। কিন্তু কোন একটা শাস্তিও অপালা খুঁজে পায় না যেটাতে ও কষ্ট পেলে অপালাও কষ্ট পাবে না। সব শাস্তিই প্রথমে তাকে ভোগ করতে হবে তারপরতো তার কাছে যাবে। কোথাও গেলে যদি তার সাথে দেখা হয়ে যায় এজন্যে বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিলো অপালা, জানে তাকে একবার চোখে দেখার জন্যে বাড়ির আশেপাশেই কোথাও থাকবে সে। কিন্তু অপালার চোখও যে সারাবেলা তাকে খুঁজে ফেরে। আঠারো বছরের সদ্য যুবতী, নিজেকে সারাবেলা সামলে রাখে, ধরে রাখে কি অবর্ণনীয় কষ্ট। যখন ইচ্ছে করছে প্রেমিক পুরুষের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নখের আঁচড়ে দাঁতের কামড়ে রক্তাক্ত করতে, তখন সারাবেলা সে তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সামলাচ্ছে নিজের আবেগকে।

যেটুকু না পাওয়া তা না পাওয়াই থাক, সব পেলে নষ্ট জীবন? তাই কি? না পেলেই জীবন আর কতোটুকু সার্থক? সবই মিছে সান্ত্বনা। তাই যদি হবে তবে এই পালিয়ে বেড়ানো খেলায় অপালা আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে কেনো? মানসিক এই চাপ শুধু তার পড়াশোনাকেই বিধস্ত করছে না, সাথে তার রূপ লাবণ্যও নষ্ট করে দিচ্ছে।

পুরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে আস্তে আস্তে, খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। কি এক নাম না জানা অস্থিরতা সারাবেলা তাকে তাড়া করে ফিরে। এক সময়ের সব প্রিয় জিনিস আজ সাপে কাটার ভয় নিয়ে আসে তার কাছে। কি করে সব এভাবে বদলে যায়? সব যদি বদলায় সে বদলাচ্ছে না কেনো?