Monday 8 March 2021

“‘মাইয়াফোয়া’র কহন”

রোঙ্গিগাদের সম্বন্ধে আমরা সাধারণত জানি, এরা মাদক ও চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত, অনেক সন্তানের জন্ম দিয়ে বাংলাদেশকে আরো ঘনবসতি করে তুলছে, পড়াশোনা করছে না, বেনামীতে রেশন কার্ড বানিয়ে, সিম কার্ড তুলে হেন কোন অপরাধ নেই যা বাংলাদেশে বা দেশের বাইরে করে যাচ্ছে না। কিংবা “রোহিঙ্গা” মানে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আর নোবেলজয়ী সুকির ঘৃণ্য রাজনীতি। এবারের বইমেলায় এসেছে ছোটবোন বন্ধু ফাহমি ইলার লেখা প্রথম গল্পের বই “‘মাইয়াফোয়া’র কহন”। ইউএনসহ আরো তিনটি সংগঠনের কর্মী হয়ে ইলা রোহিঙ্গাদের সাথে আঠারো মাস হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে, দিনের পর দিন ক্যাম্পে ক্যাম্পে তাদের সাথে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে এই গল্পগুলো লিখেছে। মেয়েদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাই প্রতিটি গল্পের উপজীব্য। শরনার্থী এসেছে, আমাদের ওপর বোঝা হয়েছে, আমরা এটুকুই জানি। ক্যাম্পে এই শরনার্থী জীবন সম্পর্কে কি কিছু জানি? কেমন কাটে সেই দিন? এই বইটি পড়তে যেয়ে লেখক নীলিমা ইব্রাহিমের “আমি বীরাঙ্গণা বলছি” বইটির কথা বারবার মনে পড়ছিলো। একটিতে আছে পাকিস্তানি সৈন্য আর তাদের বাংলাদেশি দোসরদের অত্যাচারের ইতিহাস আর তার পরবর্তী ইতিহাস হলো “মাইয়াফোয়া’র কহন”, রোহিঙ্গা সৈন্য, বাংলাদেশ আর্মি ও তাদের দোসরদের অত্যাচারের ইতিহাস। স্বজন-স্বজাতি দ্বারা মেয়েরা যতোটা নির্যাতিত হয়, বাইরের মানুষ তা থোড়াই করতে পারে। প্রতিটি গল্প আলাদা করে আলোচনা করে আমি স্পয়লার দিতে চাই না। যারা বইটি কিনে পড়বেন তাদের জন্যে কিছুটা সারপ্রাইজ থাকুক। শুধু বলবো, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান। পুরো বইয়ের সারাংশ লেখকের সংলাপ থেকেই উদ্ধৃত করা যায়, শায়লার কেনিয়ান বস মাকেনা বলেছে, ‘নারীর গায়ের রঙ, ধর্ম, পোশাক, দেশ, সংস্কৃতি আলাদা হলেও গল্পগুলো কিন্তু ঘুরে ফিরে এক।’ কিংবা কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা উত্যক্ত বিরক্ত মিতা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ভাবে- ‘আজও বাংলাদেশে যৌন হয়রানি বলতে মানুষ বোঝে ধর্ষণ। শরীরে বাজে স্পর্শ করলে সচেতন কেউ কেউ একে যৌন হয়রানি বলে, তাও বহু মানুষ এটা জানে না। আর সেক্সিস্ট কমেন্ট করা কিংবা শরীরের বিশেষ অঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকাতো এদের কাছে স্বাভাবিক। এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বা প্রতিবাদ করলে প্রথম দোষ দেয়া হয় মেয়েটিকেই। মেয়েটির পোশাক থেকে তার হাঁটা চলা, কথা বলা, বাইরে বের হওয়া, পর্দা না করা সকল কিছুকে দায়ী করা হয়।’ রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে যেয়ে পদে পদে বিদেশী এনজিওগুলো আমাদের দেশের সরকারি অফিসারদের অসহযোগিতা, রক্ষণশীলতা, অসদাচারণ, ক্ষমতার অপব্যবহারের কাছে জিম্মি হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে। নীলার পর্তুগীজ বস ম্যাথিলডা বলেছে, “একটা দেশের সরকারি প্রতিনিধি যদি ইন্সেন্সিটিভ হয় তাহলে কাজ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং তবে অসম্ভব না।“ তারপরেও একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে যতটুকু সম্ভব আন্তরিকতার জন্যে বাংলাদেশ সরকার নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পেতে পারে। খুব পরিচ্ছন্ন ভাষায় গোছানো লেখা। ব্লগিং এর কারণে বর্ননার বাহুল্যহীন মেদহীন লেখা পাঠককে আরাম দেয়। ইলা গল্পের সংলাপগুলো প্রথমে রোহিঙ্গা ভাষায় লিখে তারপরের লাইনে প্রমিত বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছে। রোহিঙ্গা ভাষার সাথে চট্রগ্রামের ভাষার অনেক মিল আছে (তথ্য সূত্রঃ লেখক)। এই জিনিসটা আমার কাছে একটু অন্যরকম লেগেছে, আঞ্চলিক গল্পের সংলাপের এরকম অনুবাদ সাধারণত দেখা যায় না। সংবাদপত্রে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেসব খবর আমরা নিয়মিত পড়ি তার পেছনের গল্পগুলো যদি জানতে চান কিংবা নির্মোহ বিশ্লেষণ আর সত্যের প্রতি যাদের আকর্ষণ আছে তাদের জন্যে এই বই অবশ্য পাঠ্য। আমি ইলাকে বলবো, এই পটভূমিতে একটা উপন্যাসে হাত দিতে। বিশাল ক্যানভাস, লেখার মত ইনাফ ম্যাটেরিয়াল তার বাস্তব অভিজ্ঞতাতে মুজুদ, শুধু রঙ-তুলির আঁচর লাগানো বাকি, আরো কত কি তুলে আনা এখনো বাকি, আর সেই উপন্যাসে ভর করে উঠে আসবে দারুণ চিত্রনাট্যের অসাধারণ এক ছবি। অপেক্ষায় রইলাম। বইটি গ্রন্থিক প্রকাশন প্রকাশ করেছে। আমি ফাহমি ইলার লেখক জীবনের আর তার বইয়ের উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করছি।

No comments:

Post a Comment