Tuesday, 7 June 2016

প্রিয় গল্পগুলো

প্রিয় গল্পটি নিয়ে লিখতে বসা বড্ড কঠিন।

আমি অসংখ্যবার আমার অন্যান্য লেখায় এ-কথাটি উল্লেখ করেছি যে, এতো এতো মনোমুগ্ধকর লেখা ছড়িয়ে আছে চারপাশে, তার মধ্যে থেকে একটিকে প্রিয় বলে বেছে নেয়া অনেক শক্ত, অন্তত আমার জন্যে। এছাড়া  সময়ের সাথে, মানসিক অবস্থার সাথে, বয়সের সাথেও রুচি, পছন্দ, মন বদলাতে থাকে। দিনে দিনে দেশ বিদেশের নানা লেখকদের নাম যোগ হয়ে প্রিয় গল্পের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে।

এমনিতে আমি আমার নিজের ভাষার বই পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্ভার উপচে পড়ছে বিভিন্ন কৃতি লেখকদের অসামান্য সৃষ্টিতে। তার ওপর যতোদিন যাচ্ছে ততোই না-পড়া বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে কতো কী জানি না, পড়া হয় নি কিংবা হবে না তার হতাশা জাপটে ধরছে ক্রমশ।

সেই কঠিন কাজের ভার নিয়ে ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গেলাম ছোটবেলায়। প্রিয় যা ছিল, প্রিয় তাই আছে। কিছুই হারায় নি, হয়তো হারাবেও না। সেই জ্বলে-ওঠা নিভে-যাওয়া জোনাকি পোকা, আমসত্ত্ব, চালতার আচার, সারা গায়ে সুর মেখে বৃষ্টিতে-ভেজা। না হারিয়েছে গান বা কবিতা, না সেই কাউকে নাম না-বলা হৃদয়গহিনে লুকিয়ে থাকা মানুষটা, চোখের কাজল কিংবা খোঁপার কাঁটা, তেঁতুল বনে জ্যোৎস্না দেখা কিংবা কপালে কারো নামের টিপ-আঁকা। সময়ের সাথে প্রিয় থেকে আরো প্রিয়তর হয়েছে সমস্ত কিছু

অনেকে বেশ বলেন, ছোটবেলায় এঁর লেখা আমার ভাল লাগতো, কিংবা গান বা খাবার। আমি এমন কিছু শুনলে সংশয়ে পড়ে যাই, আমার কি তাহলে কোন অতীত নেই! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছোটবেলার ভালোলাগার রেশ আজোও আমাকে ছুঁয়ে রেখেছে। উন্মাদ কিংবা টিনটিন সামনে পেলে না-উলটে পারা যায়? কঠিন সময় হয়তো বদলে দেয় অনেককিছুই, শুধু পারে না হয়তো ভেতরের মানুষটাকে একেবারে বদলে ফেলতে তাই ছোটবেলার ভাল লাগার রেশ কোথাও না কোথাও রয়েই যায়। মানসিকতা, রুচি বদলে গেলেও, ভেতরে আবেশটা কোথাও রয়ে যায়।

আনমনে প্রিয় তালিকা ওল্টাতে ওল্টাতে যে-নামটি প্রথম মনে এলো, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা আমাদের আটপৌরে বাঙালিদের সবচেয়ে কাছের যে-মানুষটি, সেই রবি ঠাকুর। গল্পগুচ্ছের মোহে বয়ঃসন্ধিকাল কাটায় নি এমন বাঙালি খুব কম পাওয়া যাবে। বিভিন্ন স্বাদের গল্পে ঠাসা প্রায় সাতশ পৃষ্ঠার এই বইটি নেই এমন খুব কম বুকশেলফ আছে বাঙালি বাড়িতে। কাবুলিওয়ালা, গুপ্তধন, পোষ্টমাষ্টার, ল্যাবরেটরি, হৈমন্তী, নষ্টনীড়, মধ্যবর্তিনী, কঙ্কাল, সমাপ্তি প্রায় প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে ফিরে।

সেই গেরুয়া দুই মলাটের ভেতরে অজস্র কাব্যিক ও বাস্তবের চরিত্রের রূপমহলের চলচ্চিত্রে চোখ ধাঁধায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেও এখনো যার মুখ সবার প্রথমে আমার মনে ভেসে ওঠে সে হলো ‘মিনু’। মৃন্ময়ী বললেই বেশি কাব্যিক শোনায় কিন্তু তাতে সে বড্ড দূরের হয়ে যায়। মিনু’ বললে বুদ্ধিদীপ্ত দুষ্ট চোখের যে-নিষ্পাপ চেহারাটি মনে ভেসে ওঠে, সে যেন বড্ড চেনা, পাশের বাড়ির মেয়েটি। পিঠ পর্যন্ত ছোট ঈষৎ কোঁকড়ানো রুক্ষ চুলের শ্যামলা মেয়েটি উঁচু করে বাঙালি কায়দায় শাড়ি পরে বনে বাদাড়ে, উঠোনে মাঠে, গাছে, নদীতে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আপন মনে নেচে বেড়াচ্ছে যা হলো গেছো মেয়ের রাবীন্দ্রিক প্রতিকৃতি

বিভূতিভূষণের ‘দুর্গা’-র আদল কি খানিকটা ‘মিনু’-তে ছায়া ফেলে? নাকি মিনু সেই লৌকিক দেবী বনদুর্গার রূপায়ণ?

বাংলার শাশ্বতরূপ মেনে সে বাপের আদরের মেয়ে। কিন্তু গতানুগতিক ধারার চেয়ে আলাদা, সাধারণের চোখে লক্ষ্মীছাড়া, দুরন্ত। যেসব কাজে সাধারণ মেয়েরা লজ্জা পেয়ে গায়ের কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে ফেলে, সেসব ঘটনা সে কোঁকড়া চুল পিঠে দুলিয়ে, নিষ্পাপ হরিণ চোখ মেলে, নিদারুন কৌতূহলী চোখে কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর নিজের বালক সঙ্গীদের কাছে নিজের কল্পনার রঙ মিশিয়ে নিজের ভাষায় বর্ণনা করে।

এই যে শ্রীমান অপূর্বকৃষ্ণ-এর গ্রামে ফেরার ঘটনাটাই ধরা যাক। গ্রামের অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে অপূর্ব কোলকাতায় থেকে পড়ে, তাকে গ্রামসুদ্ধ কে না চেনে। ছুটিতে গ্রামে ফিরে এসে অনেকদিনের অনভ্যস্ততায় সে স্যুটকেস হাতে জুতোশুদ্ধ নৌকোঘাটের কাদায় পড়ে গেলে অন্য মেয়েরা এ-দৃশ্য দেখে লজ্জায় হয়তো পালিয়ে যেতো কিংবা দেখেও না-দেখার ভান করতো। কিন্তু মিনুর দ্বিধাহীন বাঁধভাঙা উচ্চহাসিতে অপূর্বই হয়ে গেলো অপ্রস্তুতসত্যজিতের চলচ্চিত্রে এই দৃশ্য যেন সরাসরি গল্পগুচ্ছের পাতা থেকে উঠে-আসা।

সমবয়েসি মেয়েদের সাথে মিনুর ততো ভাব নেই। গ্রামের গুরুজনস্থানীয় পুরুষেরা তাকে স্নেহের চোখে দেখলেও বয়স্থা নারীরা তার ওপর নিদারুণ বিরক্ত ছিল। মিনুর মা এ সমস্ত নিয়ে দারুণ বিপাকে ছিলেন কিন্তু মিনুর বাবা দূরে থাকে, মেয়েকে যারপরনাই স্নেহ করে, তাই মিনুর মা পারতপক্ষে হাত তুলতো না মিনুর গায়ে  

আচ্ছা, এতো এতো গল্প বা চরিত্র থাকতে হঠাৎ ‘সমাপ্তি’ মানে অপূর্ব-মিনুই বা কেন মনে ভাসলো? তা কি এই অস্থির সময়ের কারণে?

যে-সময়ের মধ্যে আমরা এখন বাস করছি তার সাথে সেই সময় কি আসলে মেলানো যায়? অনেকদিনের চেনাজানা, পছন্দের সহপাঠী কিংবা সহকর্মী যখন জীবনসাথীতে রূপ নেয়, অনেক সময় দেখা যায় তারপর সে এক ভিন্ন মানুষ। যে-মানুষটিকে চিনে দুজন দুজনের কাছে এসেছিলো, এ আসলে সে নয়। যে-সময়ে দুজন মানুষ দুজন মানুষকে মতের কিংবা মনের অমিলের কারণে বরদাস্ত করতে পারে না, সেসময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতেও কষ্ট হয় অপূর্ব একবুক ভালোবাসা নিয়ে নীরবে তার বালিকা বধূর পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো। অপূর্ব তার বউকে কোন সময় বেঁধে দেয়নি, শর্ত দেয় নি, দিয়েছে একবুক শর্তহীন ভালবাসা।

কিন্তু সব ঘটনার সমাপ্তিই কি ঠিক এরকম মধুর?
সমরেশ মজুমদারের কালজয়ী উপন্যাস ‘সাতকাহন’-এর দীপাবলীও বালিকা বয়সে বউ সেজেছিলো, মাত্র এগারোতে তাকে বড় ঘরের রুগ্ন একটি পাত্রের হাতে তুলে দেয়া হয় যে নিজের অসমর্থতা ঢাকতে দীপাবলীর ওপর প্রথম রাতেই হামলা করে। পাত্রের ওপর তার পরিবারের চাপ ছিলো যেকোনো ভাবেই দীপাবলীকে গর্ভবতী করতে হবে। মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা সে বিবাহিত ছিলো তারপরই বিধবা। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন যা তাকে বালিকা থেকে এক ধাক্কায় পরিণত মানুষে পরিবর্তিত করে ফেলে। দুঃস্বপ্নের এই নিষ্ঠুর অতীতের কৃষ্ণচিহ্ন মুছে ফেলে সে শুরু করতে চেয়েছিল নতুন জীবন, জয় করতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। আর সেই চলার পথেও কাছের মানুষের বীভৎস, লোভী চেহারা তাকে বার বার আঘাত করে, কিন্তু পারে না পর্যুদস্ত করতে। তার জীবন এসে মেশে নাটকে, আবার জীবন কেবলই ছাপিয়ে যায় নাটকে। মিনু বয়ঃসন্ধিকালের যে সমস্ত ভালোবাসা আর আনন্দের সমাপ্তির মাঝে দিয়ে গেছে সেরকম কিছুতে কি অধিকার ছিলো না দীপাবলীরও? 

সমরেশ মজুমদারকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘দীপাবলী’ তিনি কেন আঁকলেন? লেখক জবাব দিয়েছিলেন, তিনি একবার তরুণ বয়সে জলপাইগুড়ি জঙ্গলে হাঁটছিলেন, সেখানের চা বাগানে বছর দশ/এগারোর একটি বেশ হাসিখুশী বিধবা মেয়েকে দেখেছিলেন সপ্রতিভ মুখে হাসছে, বেড়াচ্ছে, ঘুরছে। কেনো যেনো সেই মেয়েটির ছবিটি তাঁর মাথায় গেঁথেছিলো। সেই মুখটি মনে করেই ‘দীপাবলী’-কে রচনা আর কিছুতেই তিনি তাঁর উপন্যাসের ‘দীপাবলী’-কে হারতে দিতে চাননি তার জীবন সংগ্রামে, তাই ‘সাতকাহন’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শান্তিনিকেতনে জানিয়েছিলেন ‘সমাপ্তি’ গল্পের পটভূমির কথা। রবীন্দ্রনাথ একবার তাঁর জমিদারি দেখা উপলক্ষে একটি নদীর তীরে নৌকা লাগিয়েছেননৌকায় বসে তিনি কাজ করছিলেন। দেখলেন একটি বেশ বড়ো মেয়ে, অবিবাহিত, নদীর তীর থেকে তাঁর নৌকার দিকে দেখছে। তার সরল সতেজ দৃষ্টি, চলাফেরার মধ্যে একটি সহজ ফূর্তির ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথের খুব ভাল লাগলো। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে সেরকম ভাব তিনি দেখেনই নি বলা চলে। তারপর দিন দেখলেন তাঁর পাশের নৌকায় চাল, ডাল, তেল, নুন মশলা বোঝাই হচ্ছে আর সে মেয়েটিকে কনে সাজিয়ে অনেকে মিলে তার পাশের নৌকায় নিয়ে আসছে। মেয়েটি কিছুতেই নৌকায় উঠবে না, তাকে অনেক জোরজার করে নৌকায় তোলা হলো।

সচরাচর মেয়ে পাঠাবার সময় যে কান্নাকাটি হয় তার কিছুই সেখানে ছিলো না। বরং অনেকের মধ্যে বেশ আমোদের ভাব ছিলো। পাশের নৌকাটি ছেড়ে গেলে, তীরের স্ত্রীলোকেরাও চলে গেলেন। দূর থেকে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুনতে পেলেন, একজন স্ত্রীলোক আর একজনকে বলছেন, “ওকে তো জানো বোন, ও ওই রকমই। কত করে বললাম, পরের ঘর করতে যাচ্ছিস, বেশ সাবধানে থাকিস, ঘাড় হেঁট করে থাকিস, উঁচু করে কথা বলিস নে, কিন্তু সে কি তা পারবে” ইত্যাদি ইত্যাদিএই ঘটনাটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সমাপ্তি’ লেখার পটভূমি। কিন্তু নৌকোঘাটে দেখা সেই তেজি মেয়েটির ‘সমাপ্তি’ কি রবীন্দ্রনাথের কল্পনার ‘সমাপ্তি’-র মতো হয়েছিলো? তার স্বামী কি তার মন বোঝার চেষ্টা করেছিলো? নাকি বাকি হাজার হাজার লুকনো কান্নার গল্পের মাঝেই মিশে গেলো সেই গল্পটি? অজানাই হয়তো রয়ে গেলো সেই কাহিনি

উপন্যাস কেনো শুধু, যদি আমাদের চারপাশে তাকাই বাংলাদেশের অনেক মেয়ের জীবনেইতো বয়ঃসন্ধিকালের সমাপ্তি অনেক করুণ। যদিও আমরা বাঙালি মেয়েরা আমাদের একান্ত ব্যাপারগুলো বাইরে বলতে ভয় পাই, এড়িয়ে যাই কিন্তু এর ভেতরও কেউ কেউ প্রথা ভেঙে কিছুতো লিখছেনতসলিমা নাসরিন তাঁর ‘আমার মেয়েবেলা’ বইটিতে লিখেছেন তাঁর বয়ঃসন্ধিকালের এবং তারও আগের অনেক নিপীড়নের কথা। লোভী পুরুষের অনেক অযাচিত স্পর্শ শিশুকালেই নিজের শরীর সম্পর্কে মেয়েদের মনে অজানা ভয়, ক্ষেত্রবিশেষে খানিকটা বিতৃষ্ণা এনে দেয়। পদে পদে মেয়েদেরকে ঘরেই করা হয় বঞ্চনা, নিপীড়ন। ছেলে সন্তান আর মেয়ে সন্তানের মধ্যে পার্থক্য করে, মেয়েকে পশ্চাৎপদ করতে প্রথমে উদ্যত হয় তার একান্ত আপনজনেরা। সবার কি আর মিনুর মতো অবাধ স্বাধীনতায় পাখা মেলে হাওয়া কাটার সুযোগ হয়? নাকি অপূর্বেরা গল্প উপন্যাস ছেড়ে বাস্তবের স্ত্রীদের পাশে এসে দাঁড়ায় অপূর্ব-পছন্দ নিয়ে?

এতো বড় ঘরে সেধে বিয়ে হলো মিনুর, কিন্তু বেচারি বুঝতেই পারে নি কী সে পেলো। বরং তার খেলাধূলা, ঘোরাফেরাতে বাধা-পড়ায় সে আরো বিরক্ত হয়ে উঠলো। অপূর্বকে সে তার জন্যে দায়ী করে তাকে দূরে ঠেললো। অপূর্ব মিনুর ভুল ভাঙানোর জন্যে, তার কাছে যাওয়ার জন্যে মিনুর সব খেলার, কাজের, দুষ্টুমির সহচর হলো। যেভাবেই হোক বউয়ের মন তাকে জয় করতে হবে। মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকলো সে, কখন মিনু বুঝতে শিখবে, সংসারের দায়িত্ব নেবে নিজের মনে করেছুটি ফুরিয়ে আসাতে, মিনুকে তার মায়ের কাছে রেখেই অপূর্ব কোলকাতা রওয়ানা হলো। যাওয়ার সময় স্ত্রীর কাছে একটি ‘চুম্বনের’ আবদার করেও অবুঝ মিনুর কাছে নিরাশ হলো। মিনু উপলব্ধিই করতে পারেনি স্বামী তার কাছে কী চেয়েছে। মিনু জানে অপূর্ব তার সকল দুষ্টুমির সহচারী যে তাকে তার বাবার মতো সবকিছুতে প্রশ্রয় দিয়ে যাবে, বিনিময়ে কিছুই চাইবে না।
অপূর্ব ও মৃন্ময়ীর তখনকার মানসিক অবস্থা রবীন্দ্রনাথেরই লেখা “নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ  কবিতা থেকে আমরা অনুভব করতে পারি,
বর।         তোমার অপার প্রেমপারাবার,
            জুড়াইতে আমি এনু তাই।
       বলো একবার আমিও তোমার,
            তোমা ছাড়া কারে নাহি চাই।
       ওঠ কেন, ওকি, কোথা যাও সখী?
                     
                   সরোদনে
কনে।
       আইমার কাছে শুতে যাই!

দু-দিন পরে

বর।  কেন সখী, কোণে কাঁদিছ বসিয়া
              চোখে কেন জল পড়ে?
              বসন্ত কি নাই, বনলক্ষ্মী তাই
              কাঁদিছে আকুল স্বরে?

কনে      পুষি মেনিটিরে
              ফেলিয়া এসেছি ঘরে

বর   গুন্গুন্ছলে  কার নাম বলে
            চঞ্চল যত অলিকুল?
        কানন নিরালা,  আঁখি হাসি-ঢালা,
            মন সুখস্মৃতি-সমাকুল
        কী করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
কনে
       খেতেছি বসিয়া টোপাকুল

বর   জগৎ ছানিয়া কী দিব আনিয়া
            জীবন যৌবন করি ক্ষয়?
       তোমা তরে, সখী, বলো করিব কী?
কনে
       আরো কুল পাড়ো গোটা ছয়

বর   তবে যাই সখী, নিরাশাকাতর
            শূন্য জীবন নিয়ে
        আমি চলে গেলে এক ফোঁটা জল
            পড়িবে কি আঁখি দিয়ে?
বিষাদিনী বসি বিজন বিপিনে
            কী করিবে তুমি প্রিয়ে?
       বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?
কনে
       দেব পুতুলের বিয়ে

অপূর্ব যখন ছিলো তখন অপূর্বের জন্যে বিশেষ কিছু অনুভব না করলেও, অপূর্ব চলে যাওয়ার পরে তার শূন্যতা মিনুকে অন্য মানুষে রূপান্তর করে দিলো। পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলার চেষ্টা করে দেখলো মন বসে না, নিজে নিজে একা একা বাগানে ঘুরে দেখলো আগের মতো ফুল চুরি কিংবা ফল চুরি কোনটাই তাকে আনন্দ দেয় না। বন্ধুদের সঙ্গও পানসে হয়ে গেলো। অপূর্বের জন্যে তার সারাবেলা মন কেমন করতে থাকলো সেটা সে কাউকে বলতেও পারলো না। এই প্রথম সে লজ্জা অনুভব করলো, জানলো সব কথা সব সময় মুখ ফুটে বলা যায় না।

সংসার কী জিনিস যে কখনো জানতোই না, সে ঘরের কাজে মন দিলো, শেখার আগ্রহ তৈরি হলো ভেতর থেকে। আস্তে আস্তে শুরু হলো মিনুর বালিকা বেলার সমাপ্তি। মিনু অপূর্বের চিঠি কিংবা তার ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনে যাচ্ছে সারাবেলা। শুধু আচার রোদে দিয়ে আর প্রদীপের সলতে পাকিয়ে কী করে সারাদিন কাটাবে সে! বিরহে কাতর তার প্রতিটি প্রহর, কাটছে একেলা বিরহের বেলা, কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না। মনে মনে ভেবে যাচ্ছে হয়তো অপূর্ব তার ওপর ভীষণ রেগে আছে, অভিমান তো সে অনুভব করতেই পারছে।

অপূর্ব ধনীর তনয়। ছুটিতে বাড়ি না-আসায় অপূর্বের মা তার স্ত্রীকে নিয়ে কোলকাতা যেয়ে ছেলের মানভঞ্জন করে। মায়ের সাথে পুত্রের মান অভিমানের সমাপ্তি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অশ্রুসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে স্ত্রী হিসেবে মিনুকে কাছে পাওয়ার আকুলতার সমাপ্তি। দুরন্ত মিনুর সদর্প সংসারে প্রবেশের মাঝে দিয়ে কৈশোরের সমাপ্তি। আর তারপর হ্যাপিলি এভার আফটারল্যান্ডের সুবাতাস।

আর এখন চারদিকে এতো পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যে দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের জীবন কাটছে। সম্পর্ক মানেই বেশির ভাগ সময় বিশ্বাস অবিশ্বাসের অম্লতিক্ত দোলাচলঅনেক প্রতীতি নিয়ে শুরু করা সম্পর্কেরও সমাপ্তি হয় বিচ্ছেদে। তাই কঠিন বাস্তব থেকে ছুটি পেতে গল্প হলেও খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে অপূর্ব মৃন্ময়ীর মিলনমধুর ‘সমাপ্তি’-কে।

তানবীরা
১৮/১১/২০১৪                



Monday, 30 May 2016

মাছরাঙা টিভি আর জিপিএ কান্ড




ফেসবুকে আজকে সারাদিন গেলো জিপিএ ফাইভের ভিডিও’র তোলপাদেখে। অনেকেই দেশের পড়াশোনার মান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস লিখেছেন। আবার অনেকেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, এথিক্স, সাংবাদিকতার নীতিমালা নিয়ে লিখেছেন। আমি ভাবছি সমস্যাটা কী আজকের? নাকি ফেসবুক হওয়াতে সমস্যা ডিটেক্ট করা সহজ হয়েছে আমাদের জন্যে? নাকি সাংবাদিক করাতে কাজটি অন্যায় হয়েছে, নিজেরা করলে ঠিকাছে?

নিজের এস।এস।সি, এইচ।এস।সির এর রেজাল্টের কথা ভাবছি। যেদিন রেজাল্ট বের হতো, কখনো কথা না বলা প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের বাবা মা, বাবা মায়ের বন্ধুরা কে না রেজাল্ট জানতে চাইতো। বেশীর ভাগই যাই রেজাল্ট হোক না কেন, শুভেচ্ছা জানাতেন, অনেকে আবার তার নিজের কে কে আমার থেকে কতো বেশি ভাল করেছে তার লম্বা ফিরিস্তি দিতেন। এ ছাড়া দু চার জন অতিরিক্ত শিক্ষিত, দায়িত্বশীল, পাকনা মুরুব্বী অবশ্যই থাকতেন, যারা এস।এস।সির রেজাল্ট শোনার সাথে পাস কোর্সে পড়ানো হবে, এমন সব ঐতিহাসিক ঘটনার প্রশ্ন, এনসাইক্লোপেডিয়া, এন্টার্কটিকা জাতীয় বানান, ট্রান্সলেশান, বাগধারা, সাধারণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে দিতেন। মুখের ওপর প্রমান করে দিতে চাইতেন, কত কম জেনে আমরা সত্তর পচাত্তর ভাগ নম্বর নিয়ে পাশ করেছি, আমাদের বয়সে তারা কত বেশী জানতেন। আমি অবশ্য ফাইটার ছিলাম, চিঁ চিঁ গলায় বলার চেষ্টা করতাম, এগুলো তো সিলেবাসে ছিলো না, তখন আর এক দফা অপমান, সিলেবাসের বাইরে বোকা গল্পের বই পড়ে এতো সময় নষ্ট করছি, কাজের বই পড়লে কতো কাজ হতো। আত্মীয়দের অপমান শেষ হলে শুরু হতো বাবা মায়ের রোষ। কেন গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে পরে থাকি, জ্ঞানের বই পড়ি না। আমি জানি, আমার মত এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমাদের সময়ে আরো অনেকেই হয়েছে।

এটাতো আজকের অসুখ না। মুখের ওপর অপমান করা বাংলাদেশীদের চিরন্তন রোগ বরং ওটা না করতে পারলেই তাদের কষ্ট লাগে। সেটা ছেলে মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট হতে পারে, মেয়ের বিয়ে নিয়ে হতে পারে, ছেলের চাকরী কিংবা কোরবানীর গরু নইলে ঈদের জামা। বাড়িতে ঢুকেই প্রথম প্রশ্ন হতো, তোমার রোল নম্বর কত? ক্লাশে কয়জন ছাত্র? আজকে এতো নীতির কপচাকপচি, এতো তাড়াতাড়ি আমরা বদলে যাবো! আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের জেনারশানের আমরা এ অপমান খেয়েই বড় হয়েছি।


প্রতিবার বইমেলাতেও টিভি ক্যামেরা সাথে নিয়ে এই ফাজলামোটা করা হয়। বেশ অনেক আগেই লিখেছিলাম এই নিয়ে। লেখার লিঙ্ক http://www.amrabondhu.com/tanbira/6355

Thursday, 26 May 2016

মানুষ মানুষের জন্যে



বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রয়াত লেখক ডঃ হুমায়ূন আহমেদের লেখা “হিমু” উপন্যাসটা প্রথমে ভাল লাগলেও শেষের দিকে আর সিরিজ গুলো পড়তে কোন আগ্রহ পেতাম না। একই রকম লাগতো অনেক সময় মজার পরিবর্তে কিছুটা ছ্যাবলামোও মনে হতো। তবুও তাতে লেখা একটা বিষয় বারবার মাথায় আসে। “হিমু”র বাবা হিমুকে (হিমালয়) মহামানব তৈরী করতে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন, বইটিতে বার বার ঘুরে ফিরে লেখক লিখেছিলেন। ট্রেনিং দিয়ে কী মহামানব তৈরী করা যায়? আজকাল মনে হয়, মহা মানব তৈরী করা না গেলেও হয়তো, মানুষ অনেকটাই বানানো যায়।

এদেশের বাচ্চাদের কে প্লে স্কুল থেকে হাতে বানানো জিনিস এবং সেবা প্রদানের মাধ্যমে টাকা অর্জন শেখানো হয়। স্কুলে জিনিস বানিয়ে, স্কুলেই বিক্রি করে, স্কুলেই সেই টাকা কোন মহৎ কাজের জন্যে দান করা হয়। সেই দান বেশীর ভাগই সময়ই যায় তৃতীয় বিশ্বের কোন দরিদ্র দেশের কোন সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে। চার বছর বয়স থেকেই তাদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক কাজেও বাধ্যতামূলক ভাবে অংশ গ্রহন করতে হয় বারো বছর বয়স থেকেই শেখানো হয়, পড়াশোনা করছো ভাল কথা, সে তো নিজের জন্যে, মানুষের জন্যে, দেশের জন্যে, দশের জন্যেও কিছু করো জানো, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে নিজের দেশে দরিদ্র, নিপীড়িত, সাহায্য প্রার্থী নেই তাহলে অন্য দেশে যাও কিন্তু জীবনে সত্যি কিছু করো।

ক’দিন আগে আমাদের বাসার কাছের হাই স্কুলের পরিকল্পনা জানলাম, পেরুতে বাড়ি বানাতে হবে, সেখানে অনেকের বাড়ি নেই। প্রথম ক্লাশ থেকে পঞ্চম ক্লাশ পর্যন্ত সবাই সে জন্যে পয়সা যোগাড় করবে। ষষ্ঠ মানে ফাইন্যাল ক্লাশের বাচ্চারা যাবে বাড়ি বানাতে। তারা সত্যি সত্যি ইট, কাঠ জোড়া দিয়ে, নিজেরা গায়ে গতরে খেঁটে বাড়ি বানাবে সেখানকার দুস্থ গরীব লোকদের জন্যে। ফেসবুকে গ্রুপ বানিয়ে সেখানে কর্মরত বাচ্চাদের ছবি, কাজের অগ্রগতি সব জানানো হচ্ছে ছবি দিয়ে, পোস্ট দিয়ে।

টাকা কীভাবে যোগাড় করবে? প্রত্যেক কে  নিম্নে ত্রিশ ইউরো যোগাড় করতে হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেটি শুরু করবে নিজের পকেট মানি দিয়ে নিজের পকেট মানির পর বাবা মা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, চেনা জানার মধ্যে থেকে নিতে হবেতার জন্যে ক্লাশে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, কেউ দিতে না চাইলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না, তাকে বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিয়ে, মাথা নীচু করে চলে আসতে হবে। টাকা দেয়া প্রত্যেকের ইচ্ছে, কাউকে জোর করা যাবে না। তারপর গ্রুপ করে দেয়া হয়েছে ক্লাশ থেকে, স্কুলের সীমানা থেকে প্রত্যেকটি বাচ্চা একেক দলে ভাগ হয়ে আট দশমিক এক কিলোমিটার হাঁটবে, এই পথের মধ্যে যত বাড়ি, পথচারী পরবে তাদের কাছে তাদের পিগি ব্যাঙ্ক বাড়িয়ে ধরে সাহায্য চাইবে। স্কুলে যেয়ে পিগি ব্যাঙ্ক খুলে টাকা গুনে দেখা হবে।

বারো থেকে আঠারো, প্রতি বছর তাদেরকে একবার এ ধরনের কিছু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও, এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি থাকবে, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে তুমি কী করেছো? যার কারণে দেখা যায়, মেধাবী সব ছেলে মেয়েরা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের অনেক প্রকল্পে, উন্নয়নের কাজে নিজের মেধা আর পরিশ্রম ব্যয় করছে। স্বার্থপরের মত শুধু নোট মুখস্থ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে, ভাল চাকরি করে দামী গাড়ি হাঁকাবে এর নামই কী তবে মানব জীবন? সমাজের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেটাও জানতে হবে, শিখতে হবে না? কে সে শেখাবে তা? হ্যাঁ রাষ্ট্র ... তার দায়িত্ব নিয়েছে।

মানুষ বানানোর মত আবার স্বার্থপর অমানুষও বানানো যায়। আমাদের দেশের বাচ্চাদের ছোট থেকে শেখানো হয়, বাড়িতেও তোমার কোন কাজের দরকার নেই, তুমি শুধু পড়বে আর রেজাল্ট ভাল করবে কারণ বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা রোজগার করতে হবে। হয়তো বাড়িতেই সেই বাচ্চাটার সম বয়সী আর একটা বাচ্চা আছে যে তার সব কাজ করে দিচ্ছে। সেই বাচ্চাটিকে অবহেলা করে নিজের কাজে ব্যবহার করতে সেই বয়স থেকেই তাকে শেখানো হয়ে যায়। অন্যেকে টেক্কা দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার এই নিম্ন মনোবৃত্তি নিজ পরিবার থেকেই বাচ্চারা প্রথম শেখে। কাউকে সাহায্য করবে না, খেলা ধূলা, গান বাজনা ইত্যাদি করে সময় নষ্ট করা যাবে না। বি।সি।এস দিতে হবে, বিদেশ যেতে হবে, নিজের ক্যারিয়ার, নিজের ভবিষ্যত সব সব নিজের নিজের নিজের জন্যে

না স্কুলে না পরিবারে না সমাজে বাচ্চাদের কোন সুযোগ আছে, পরের জন্যে কোন কিছু করার। তারা কাউকে করতে দেখে না, তারা জানে না “পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি” কী বস্তুর নাম। এই নেতিবাচক মনোবৃত্তির ফল আজকের এই অস্থির সমাজ। স্বার্থপর সমাজে রোজ নানান ঘটনা ঘটে চলছে, কেউ তা সামাল দিতে পারছে না, নাভিশ্বাস উঠছে সবার। মগজে পচন ধরেছে তাই সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। গত চল্লিশ বছর ধরে যে দিকে সমাজের মানসিকতা দৌড়েছে, আজ তারই ফল সবাই ভোগ করছি। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সবাই শক্ত করে ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। নৈতিকতা তো নেই কোথাও ধর্ম যদি রক্ষা করে এই সমাজকে। ধর্ম না কর্ম মানুষের পরিচয় নির্ধারন করবে?

পাদটীকাঃ ধর্মহীন রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসে কয়েদীর অভাবে কয়েকটি জেল বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকবার নিউজে এসেছে আর বাংলাদেশে যত অপরাধী জেলে আছে তার চেয়ে কয়েক গুন বেশি বাইরে খোলা হাওয়ায় ঘুরছে

পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল !
 মুর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,–
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো
কাজী নজরুল ইসলাম





Thursday, 19 May 2016

জার্ণাল মে ২০১৬

১. আজকাল কথায় কথায় লোকে ফতোয়া দিচ্ছে, রাষ্ট্রদোহী-নাস্তিক! নাস্তিকরা কী রাষ্ট্রদোহী? রাস্ট্রের প্রতি আনুগত্য থাকতে হলে কী ধর্মপ্রাণ হতে হবে? নাস্তিকতা কী তাহলে রাষ্ট্রদোহীতার শামিল? কোন প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস না রাখা কী তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানে অপরাধ? সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে আছে এটি? বেগম রোকেয়া, রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমেদ শরীফ, আহমেদ ছফা, হুমায়ূন আজাদ, অজয় রায় তারা কি তবে অপরাধী? তারা দেশদ্রোহী হলে তবে দেশ প্রেমিক কারা?

২. মাইকে ঘোষনা দিয়ে, নামাজ, জানাজা, কিংবা বন্যা দুর্গতদের সাহায্য, ঘূর্ণি ঝড় আক্রান্তদের সাহায্য, আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষকে সাহায্যের জন্যে ডাকা হলে কেউ আসে না। শুধু আসে যেখানে লাঠি সোটার কারবার আছে। অথচ আমি হলফ করে বলতে পারি, আজ যদি এমেরিকা, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানী, নেদারল্যান্ডস বলে, বাংলাদেশ থেকে আমরা নাস্তিক কিংবা হিন্দু – খ্রিস্টানদের নিয়ে আসবো, পাকা পায়খানা মানে রাজনৈতিক আশ্রয় দিবো দেখা যাবে এই সব মাইক ওয়ালা মুমিন বান্দারা, লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে, বাবা – দাদার পরিচয় বদলে সবার আগে নাস্তিকের সার্টিফিকেট নেয়ার লাইনে এসে দাঁড়াবে ... জান বাজি রেখে নাস্তিক সাজার হুল্লোড় লেগে যাবে। বেহেস্তের মায়া পকেটে রেখে পশ্চিমের মায়ায় দৌড়াতে থাকবে

৩. বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষা করতে শেখ পরিবারের পরে সবচেয়ে যোগ্য হলো ওসমান পরিবার,  তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামের মত দুর্বল বস্তু, আল্লাহ নিজে রক্ষা না করে তাদের হাতেই ছেড়ে দিলেন কেন সেটাও বোধগম্য নয়। ওসমান পরিবারের সাথে শেখ পরিবারের গিরিঙ্গিটা ঠিক কোথায়, পরিস্কার হচ্ছে না। পার্সেন্টেজের সমস্যা? আপায় বিদেশ গেলো আর হুড়মুড় করে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীরা একে একে ন্যায় আর নীতির বাক্য আওরাতে শুরু করলো! ঘটনা কী, এতো দিন এতো নৈতিকতা আর্দশ কোথায় তেল নিতে গেছিলো! পুরাই, ডি।এম।কে।কে কেস

৪.  আইভি আপা কী নারায়নগঞ্জে নাই? ঢাকায় নাই? বাংলাদেশে নাই? পৃথিবীতে নাই? মহাবিশ্বে নাই?

৫.  ধর্ম ব্যবহার তো সবে জমতেছে ...খেলা আর বহুদূর যাবে। নাস্তিকের কল্লার পরও আরো কল্লা আছে ... এই কল্লা  নিয়ে যাবে সেই কল্লার কাছে

২০/০৫/২০১৬


ব্লগারের দুরন্ত চোখে যেভাবে বাঁধা হল লাল কাপড়

প্রবাসের একাকিত্বে তখনও পুরো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি, পরিবার-পরিজন, বন্ধু, আড্ডা, সর্বোপরি ঢাকার দূষিত হাওয়ার অভাব তখনও খুঁজে ফিরছি। অন্তর্জালের আশীর্বাদে এ সময়ের আশ্রয় ছিল পাল টক, দেশি চ্যাট ইত্যাদি ভয়েস আড্ডা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাসী আর দেশিরা এক সাথে হয়ে, গান, কবিতা, আড্ডা কী না ছিল সেখানে। 
তখনও ওয়েবজিনে লিখি মাঝে মাঝে, পড়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেন, সেগুলো মেইলে আসে। সে সময় সামহোয়্যার ইন যাকে আমরা সামু বলি নিয়ে এল বিপ্লব। নিজে লিখে নিজেই পোস্ট করা যাবে, অন্যেরা পড়ে তার নিচে সরাসরি মন্তব্য করতে পারবে, কোনো সম্পাদক কিংবা কাটাছেঁড়ার ব্যাপার নেই— যাকে বলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন। ব্লগ শুরু হতে না হতেই বিস্তর ভিড় হল সামুতে। তারপর আস্তে আস্তে সচলায়তন, আমার ব্লগ, চতুর্মাত্রিক, আমরা বন্ধু, নাগরিক, নির্মাণসহ আরও কত কী। ওয়েবজিনের প্যাটার্ন পরিবর্তন করে মুক্তমনা, সদালাপও ব্লগে রূপান্তরিত হল।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঘা বাঘা প্রসিদ্ধ সাংবাদিক লেখকরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন— ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, প্রয়াত লেখক মুহাম্মদ জুবায়ের, আহমাদ মোস্তফা কামাল, পাপড়ি রহমান, শওকত হোসেন মাসুম ইত্যাদি আরও অনেকে। যখন তারা আমাদের মতো সাধারণদের ব্লগ পড়ে, বানান, বাক্যরীতি, গঠন ইত্যাদি নিয়ে উপদেশ দিয়ে যেতেন, সাত আকাশে উড়ে যাওয়ার আনন্দে ভাসতাম। 
প্রায় সবই ছিল লেখকদের সবার নিজের জীবনে প্রত্যহ ঘটে যাওয়া ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স। বানানো গল্পও নয়, ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়, যা পড়তে ভাল লাগলেও আজকের সময়ে অচল। এ সময়ে ঘটছে, ঘটে যাওয়া রোজ দিনের সব গল্প। সত্য আর বাস্তবের নির্মোহ বিশ্লেষণ ব্লগকে তরুণ প্রজন্মের কাছে এত দ্রুত এত তুমুল জনপ্রিয় করেছে। কত শিখেছি, কত জেনেছি, কত পড়েছি। সেসব বাছাই করা লেখা দিয়ে বানানো হতো ই-বুক। শোভা পেত সে সব ই-বুক নিজের ল্যাপটপের ডেস্কটপের এক কোণায়।
প্রকাশকরাও চোখ রাখতে শুরু  করল ব্লগের পাতায়। বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার সব লেখা লিখছেন একঝাঁক তরুণ মুখ যাদের মধ্যে ভণ্ডামি নেই, নেই মোহ। তারা জয়ের আনন্দেই লিখে চলেছেন। আমাদের মতোই আনকোরা কোনো ব্লগারের বই বের হলে আনন্দে আমাদের মধ্যে শোরগোল পরে যেত। এসএসসি’র সময় পাশের বাসার ভাইয়া ভাল রেজাল্ট করলে যেমন নিজের মধ্যেও পড়াশোনার অদম্য উৎসাহ চলে আসত, অনেকটা সেরকম। সাথে ছিল নানারকম সমাজসেবা ও সচেতনতামূলক কাজ— ব্লগাররা মিলে টাকা উঠিয়ে, শীতার্তদের বস্ত্র বিতরণ, রাজাকারদের বিচারের দাবি, যার সাম্প্রতিক আন্দোলন ছিল গণজাগরণ মঞ্চ। 
সেই একঝাঁক দুরন্ত ব্লগারদের চোখে বাংলাদেশের অযোগ্য শাসকশ্রেণি, আর ক্ষমতালিপ্সু শাসনব্যবস্থা বেঁধে দিল লাল কাপড়। ‘ব্লগার’ শব্দটি এখন ক্ষমতাসীনদের অসীম ক্ষমতার দাপটে, খুব নেতিবাচক কিছু, যাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে কেউ লিখছেন শুনলেই অন্যেরা বাঁকা চোখে তাকায়। সেই চোখের তিন রকম অর্থ হয়—
১. ব্লগার নয় তো আবার
২. আপনাকে দেখে তো বোঝা যায় না আপনি ব্লগার
৩. আপনাকে দেখে কোনোদিন বুঝতেই পারিনি, আপনি ব্লগার
রূঢ় বাস্তবতা থেকে বিরাম নিতে যে পরিচয়টি সবচেয়ে ভালবাসার আর আনন্দের ছিল, সেটিই এখন বেদনার নীল ছোঁয়া দিয়ে যায়। 
সমাজে ব্লগারদের দুষ্কৃতকারীর ইমেজ তৈরি করে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাব কী করে? প্রতিকার চেয়ে লাভ নেই সে আমিও জানি। কিন্তু পরিত্রাণ, তাও কি পাবার উপায় নেই?
http://www.banglamail24.com/news/152100
১৮-০৫-২০১৬

Monday, 16 May 2016

সরকারী কর্মচারী আর মন্ত্রীদের বেতন কী হালাল

যে কাজ দায়িত্ব নিয়ে করার জন্যে কেউ শপথ গ্রহন করে জনতা আর সৃষ্টিকর্তার কাছে ওয়াদা করে তারপর কাজটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন না করে দিনের পর দিন জনতার করের পয়সায় তার বেতন নেয়, সেই বেতন নেয়াটা কি হালাল?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজের তালিকায় কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ন্ত্রণ পরে না? প্রতিদিন দেশ জুড়ে এতো যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে তার দায় কার? অবশ্যই তার। কারণ কে কি কোথায় করেছে, ঘটনাটি ঘটে যাবার পর তা সম্বন্ধে তাৎক্ষনিক ভাবে তিনি আমাদেরকে তথ্য জানিয়ে দেন। সবই যদি তিনি জানেন তাহলে ঠেকান না কেন? পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে যারা এ সকল বিচ্ছিন্ন ঘটনা রোধ করার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে তারপর সেগুলো প্রতিরোধ না করে দায়িত্বহীনের মত নির্লজ্জ বক্তব্য দেন তাদের সম্বন্ধে জনতার কাছে জিজ্ঞাসা, তাদের বেতন কী হালাল? প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী কে ইসলামে কী বলে? জনগনের করের টাকায় বেতন নিয়ে তাদের জানমাল হেফাজত করার ওয়াদা দিয়েছিলেন তারা, একের পর এক খুন হচ্ছে যারা, তাদের টাকায় নেয়া বেতন কী হালাল রুজি?

ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানতদারী মানুষের কল্যাণমুখী গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তা সত্যবাদিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আল কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির পরিচয় ও গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেন: এবং যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সূরা মুমিনুন-৮) নেক বান্দা ও নেক আমলের আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তারা পূর্ণ করে। (সূরা বাকারা-১৭৭) ইসলামে প্রতিশ্রুতি পালন বাধ্যতামূলক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন : এবং তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তোমাদের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪)


নৈতিকতা, বৈধ এ শব্দগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আজ অচল। ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার এ জিনিসগুলো হালাল ধরে নিয়েই বাকীটা জিজ্ঞেস করছি, ওয়াদা করে ওয়াদা পালন  না কারীর রোজগার কী হালাল হয়?


১৬/ ৫/২০১৬

Wednesday, 11 May 2016

অনন্ত স্মরণে

রাজীবের পর “অন্ধকারের পানে যাত্রা” মিছিলের শুরু হলো অভিজিৎ রায়কে দিয়ে, তারপর পিপীলিকার সারির মত একজনের পর একজন, একটা ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আর একটা, মৃত্যুর মিছিল শেষ বেলার ছায়ার মত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো, প্রতিদিন এখনো মিছিলে নতুন নতুন নাম যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিচিত মুখ গুলো, ফেসবুকের পোস্ট, ব্লগের মন্তব্য থেকে “রিমেমবারিং” এ চলে যাচ্ছে। আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা প্রতিটি মৃত্যুর জন্যে ঘাতককে নয়, নিহতকেই তার নিজের খুন হবার জন্যে দায়ী করে দিচ্ছে। তাদের পছন্দ মত “হত্যার কারণ” জনগণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, মৃত্যু গুলোকে জনগণের সহ্য সীমার মধ্যে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যারা হত্যা করছে কারণ তারা বলছে না, বলছে তারা যাদের এই প্রাণ গুলো রক্ষা করার দায়িত্ব ছিলও। নিজের অপারগতা ঢাকতে কী নির্লজ্জতা। একদম যে সফল হচ্ছে না, তাই বা কী করে বলি? এখন কি আগের মত হঠাৎ পানি ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে যাওয়া মাছের মত ছটফট করি? না, শুধু খবরের কাগজ খুলে চুপচাপ জেনে নেই, কে গেলো আর কখন গেলো, এই তো। ঢাকার জ্যাম মানিয়ে নেয়ার মত আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের স্নায়ু, এই নৃশংসতার মধ্যে।  বরং নিজের অজান্তেই যেনো আজকাল অপেক্ষা করি, আজকে ক’জন, কোথায়, কে কে? 

লিখতে চাইছিলাম অনন্তকে নিয়ে, কত কিছুই তো লিখতে চাই কিন্তু লিখতে বসলে নীরব যন্ত্রণায় শব্দ গুলো হারিয়ে যায়। মুক্তমনায় ওয়েব সাইটের বাইরেও যখন ইয়াহু গ্রুপে আমরা আলোচনা করতাম তখন থেকে অনন্তের সাথে পরিচয়। বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা সবাই যার যার মতামত লিখতাম, তর্ক করতাম, যুক্তি দিতাম, ঝগড়াও করতাম। নিজেদের যুক্তির ভুল ত্রুটি, দুর্বলতা সেসব নিয়েও মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য চলতো। যদিও কখনো সামনা সামনি বসা হয় নি চায়ের কাঁপে ধোঁয়া উড়িয়ে, তারপরও ...
আজও আমি জলের নীরবতায় কান পাতলে শুনতে পাই, কার্পাস তুলোর মত নরম সে গলা,  মুঠোফোনের ওপার থেকে বলছে, দিদি, দাদা আর মেয়েকে নিয়ে একবার সিলেট ঘুরে যান, প্লিজ। কিংবা ঠিকানাটা দেন দিদি, যুক্তির কয়েকটি কপি পাঠাবো। 
আমি পয়সা কী করে পাঠাবো অন্তত? পয়সা লাগবে না, আপনি ওখানে বিলি করবেন। 

-কার কাছে বিলি করবো অনন্ত! 
-আপনার বন্ধুদের মাঝে
-কেউ যুক্তির কথা শুনতে চায় না অনন্ত 
শুনবে দিদি, শুনবে। আমাদেরকে চেষ্টা করে যেতেই হবে। 
এতো পড়াশোনা, এতো জানতো অথচ কী বিনয়ী, কী নম্র গলা তার। কথা ছিলো, সিলেট গেলে একবার নিশ্চয় দেখা হবে, অনেক অনেক কথার মত, নাদের আলী, এ কথাটিও আমার রাখা হয় নি। রাখা হবে না আর কোন দিন, আমাদের জীবন আমাদেরকে এ সুযোগ আর কখনো দেবে না। 

এই মানুষ গুলো নিজের জীবন তুচ্ছ করে দিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে, একবার নয়, বার বার দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এদের হত্যার প্রতিবাদে সেভাবে ক’জন রাস্তায় নেমেছে? মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে সে সময়ের অসহায়তা  আজ অনুভব করতে পারছি। “ধর্মনিরপেক্ষতা” ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ভিত্তি। সে সময়ও ধর্মের নাম দিয়ে বাঙালিদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে, হত্যা গুলোকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করার জন্যে বার বার ধর্মের কারণ দেখানো হয়েছে। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ধর্মের নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছিলো এই ব্লগাররা। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তপ্রাণ মানুষের পরিবারের দাবীর সাথে তারাও গলা মিলিয়েছিলো। আজ যখন তারা বিপদে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার গুলো থেকে তেমন প্রতিবাদ চোখে পরে কি? অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানই তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় আছে, তাদের বিবেকের দায় কোথায় আজ? যারা দিনের পর দিন খুন হচ্ছে তারা আপনার বাবার মতই যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা ভাবতো, সে কি আপনারা অনুভব করেন? একজন মানুষের মৃত্যুতে প্রতিবাদ করা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান হিসেবে আপনার নৈতিক দায়িত্ব, জেনে রাখুন। এ আপনাদের রক্ত ঋণ তাদের কাছে, পিতৃ দায়। 

অনেক অনেক বিচার না পাওয়া মানুষের নামের সাথে খুব দ্রুত কতগুলো নাম আরো যোগ হলো। সাগর, রুনি, অনন্ত, অভিজিৎ, জুলহাস, তনয় কিংবা তনু। রোজ রোজ এতো নাম এই তালিকায় যোগ হচ্ছে যে, প্রতিবাদ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত। এক হত্যার ভীড়ে অন্য হত্যা হারিয়ে যাচ্ছে। ইস্যুর নীচে চাপা পরে যাচ্ছে মানুষ গুলো যাদের এই নীল আকাশের নীচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়ার কথা ছিলো, লাজুক গলায় কাউকে দেয়া কথা রাখার অঙ্গীকার ছিলো। আমরা ভুলে যাই কিন্তু যার যায় সে কী ভোলে? 

আমার শূন্যতা নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে পথ চেয়ে বসে থাকবে আমার মা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ যখন ধরণী পবিত্র করতে ব্যস্ত থাকবে, অসীম নীলের সাথে শুভ্র জলধারা দিয়ে চেষ্টা করবে এই পৃথিবীর পাপ ধুয়ে দিতে, তখন হয়তো কোন টগবগে তরুণ তার শোবার ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের বাসার ছাদে খোলা চুলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা লাজুক তরুণীটির দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে বিভোর। অন্য পাশের ফ্ল্যাট থেকে হাঁক শোনা যাবে বৃষ্টির আওয়াজ ভেদ করে, কী, বৃষ্টি দেখেছো আজ? -অফিস যাবো না ভাবছি। একটু খিচুড়ি করো না আজ, সাথে গরম গরম গাওয়া ঘি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা আর সর্ষের তেলে ইলিশ ভাজা।

এই শুনে আমার মা ডাক ছেড়ে বিলাপ করে কাঁদবেন, অনন্ত আমার অনন্ত! আমার অনন্ত বড্ড বৃষ্টি আর খিচুড়ি ভালবাসতো। দিনের শেষে শুধু সেই মনে রাখে যার ঘর শূন্য হয়, বুক শূন্য হয়, কোল শূন্য হয়।


http://www.sylhettoday24.com/opinion/details/8/461