Wednesday 4 November 2020

আংশিক লকডাউন ও ঘোর বিপাকে ডাচ অর্থনীতি

https://www.bhorerkagoj.com/2020/11/03/%e0%a6%a7%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%89%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a7%8b%e0%a6%97-%e0%a6%a6%e0%a6%b0/ করোনায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতি লন্ডভন্ড, সতের মিলিয়ন অধিবাসী নিয়ে সেন্ট্রাল ইউরোপের ছোট্ট দেশ নেদারল্যান্ডস ও এর ব্যতিক্রম নয়। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। প্রথম ধাক্কা যেনো তেনো করে সামলে নিয়েছিলো কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় অনেকটাই মুর্মুষ। বিশ্বের সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে একটি দাবী করা ডাচেরা করোনার কাছে পর্যুদস্ত। সাথে বাড়ছে জনগনের অসন্তোষ, বছরের পর বছর প্রতি মাসে এত টাকার চিকিৎসা বীমা দিয়ে আসার পর, এখন যখন চিকিৎসা প্রয়োজন, তখন হাসপাতালে জায়গা নেই, আই-সি-ইউতে বেড খালি নেই শুনতে আর রাজী নয় জনগন। প্রতিজন ডাচ নূন্যতম এগারশো ইউরো বছরে নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যবীমা পরিশোধ করেন, এর বাইরে তার প্রতিষ্ঠান আর সরকারও স্বাস্থ্যবীমার নির্দিষ্ট অংশের ব্যয় ভার বহন করে থাকেন। সেগুলো যোগ করলে ব্যক্তিভেদে বছরে তিন হাজার ছয়শো আশি ইউরো থেকে পাঁচ হাজার তিনশো ইউরো পর্যন্ত দাঁড়ায়। প্রথমবার ছিলো “ইন্টিলিজেন্ট লকডাউন”, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলাধূলা, জিম, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি বন্ধ ছিলো যা পরবর্তীতে ধাপে ধাপে খুলেছে। অক্টোবরের চৌদ্দ তারিখ থেকে আবার রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ইত্যাদি বন্ধ করে দিয়েছে, রাত আটটার পর সব দোকান ও বন্ধ থাকবে, শুধুমাত্র ওষুধের দোকান আর সুপারমার্কেট খোলা থাকবে তবে সেখানে কোন এলকোহল বিক্রি করা যাবে না। রাত আটটার পর এলকোহল নিয়ে বাড়ির বাইরে থাকা নিষেধ। তবে এবার বলা হচ্ছে “আংশিক লকডাউন”, প্রিমিয়ে মার্ক রুতে বলছেন, জনগনের কল্যান আর সুস্বাস্থ্যের সাথে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে ক্যাবিনেট আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে পলিসি বের করছে যাতে সকলের কল্যান হয়। সরকার ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পাশে থাকবেন বার বার বলার পরও একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, থামছে না। এই বছরের বিয়াল্লিশ সপ্তাহ পর্যন্ত দুই হাজার সাতশো উনিশটি ব্যবসা দেওলিয়া ঘোষনা করা হয়েছে। যদিও দুই হাজার উনিশ সালের তুলনায় তিনশো নয়টি কম এরমধ্যে ছেচল্লিশটি ব্যবসা শুধু বিয়াল্লিশতম সপ্তাহে বন্ধ হয়েছে। সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটাস্টিক্সের মতে, প্রথম কোয়ার্টারের তুলনায় দ্বিতীয় কোয়ার্টারে আট দশমিক পাঁচ ভাগ প্রবৃদ্ধি কমেছে যা মূল প্রবৃদ্ধির অর্ধেকেরও কম আর সেটি মূলত দেশের আভ্যন্তরীন বানিজ্য ঘাটতির কারণে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গৃহস্থালী জিনিসপত্রের বিক্রি অনেক কমেছে আর মানুষ নতুন বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে। সার্বিক পরিবেশ নিয়ে মানুষ হতাশ আর তারা খরচ করতে অনেক ভাবছেন। জিনিসপত্র যদিও বা কিছু কিনছেন কিন্তু পয়সার বিনিময়ে কোন ধরনের সেবা নিতে তারা অনিচ্ছুক। তবে সবদিকেই অবস্থা এত খারাপ নয়, মেডিক্যাল সেক্টর, অনলাইন কনসাল্টিং, অনলাইন সুপারমার্কেট, নেটফ্লিক্স, আমাজন নেদারল্যান্ডস, প্যাকেট আর অনলাইন ডেলিভারী সার্ভিস এরা বেশ ভাল ব্যবসা করছে। ফিলিপ্স মেডিক্যাল সিস্টেম দুইগুন বেশি পন্য উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী পরিবহন করছে। করোনার কারণে সরকারের অর্থায়ন ধাক্কা খেয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাজেটের উদ্ববৃত্ততার পর দুই হাজার বিশ সালে ঐতিহাসিকভাবে বড় ঘাটতি হয়েছে। তাতে ঋণের পরিমান বেড়ে গেছে। তবে তার জন্যে জমানো অর্থ ছিলো, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অর্থনীতি যখন ভাল করছিল, সরকার তখন বাফার তৈরি করেছে। করোনা সঙ্কটের অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলা করার জন্যে সরকার প্রচুর অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে। বড় প্রতিষ্ঠান, ছোট ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী সবাইকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একই সময়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপাতত কর পরিশোধ না করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় করের পরিমান কমানো এবং ছাড় দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের সর্বমোট ব্যয় হবে বাষট্টি বিলিয়ন ইউরোর বেশি। এর মধ্যে দুই হাজার বিশ ও একুশ সালের অর্থ বছরে বড় প্রতিষ্ঠান, ছোট ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবীদের সাহায্য করার জন্যে পয়তাল্লিশ দশমিক নয় বিলিয়ন ইউরো ধরা হয়েছে। করের ছাড়, কর কমানো আর দেরীতে পরিশোধের কারণে খরচ হবে ষোল দশমিক ছয় বিলিয়ন ইউরো। গত পাঁচ বছরের পর এবার ঘাটতি বাজেট এলো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। গড় প্রবৃদ্ধি কমেছে শতকরা সাত দশমিক দুই যার পরিমান ছাপ্পান্ন বিলিয়ন ইউরো। দুই হাজার একুশেও ঘাটতি বাজেট হবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ধারনা করা হচ্ছে পাঁচ দশমিক পাঁচ ভাগ কম হবে যার পরিমান হবে পয়তাল্লিশ বিলিয়ন ইউরো। তবে সেটি এখনও নির্ভর করছে সামনের মাস গুলোতে করোনা ভাইরাস কোন দিকে মোড় নেবে তার ওপর। এত সঙ্কটের মধ্যেও রাজা এবং রানীর ভাতা শতকরা পাঁচ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, দুজনেরটা একসাথে ধরলে পরিমান দাঁড়ায় বার্ষিক সাত দশমিক দুই মিলিয়ন ইউরো। রাজকন্যা আমালিয়া এই ডিসেম্বরে আঠারো হবে, ডিসেম্বর থেকে সেও মাসিক এক লক্ষ এগারো হাজার ইউরো ভাতা পাবে যেটি সামনের অর্থ বছর দুই হাজার একুশ-বাইশে হবে এক দশমিক ছয় মিলিয়ন ইউরো। রাজ পরিবারের এই আয় সম্পূর্ন কর মুক্ত। এই প্রবৃদ্ধি বিরোধী দল আর জনগনের প্রবল সমালোচনার মুখে পরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের তির্যক আলোচনা ও মন্তব্য আসতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে আর রাজ পরিবারের মধ্যে দারুণ সখ্যতা। রাজ পরিবারের কর মুক্ত আয়ের সমালোচনার জবাবে তিনি বারবার একই কথা বলে যান, “আ ডিল ইজ আ ডিল”। ইউরোপের মধ্যে ডাচ রাজ পরিবারকে সবচেয়ে ব্যয় বহুল পরিবার হিসেবে ধরা হয়। মোটামুটিভাবে তারা বছরে চল্লিশ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে থাকেন যার মধ্যে তাদের নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত নয়। নেদারল্যান্ডসের জনগন তাদের নিরাপত্তা, প্যালেসের সংস্কার, ঘোড়া গাড়ির ব্যয় বহন করে থাকে। ডাচ প্রিমিয়ে মার্ক রুতে প্রায়ই তার ভাষণে “আ ডিল ইজ আ ডিল” কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। যদিও বিদেশি এক্সপাটদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তার কথা রাখেননি। বিদেশ থেকে স্পেশালিষ্ট নিয়ে আসার জন্যে ডাচ সরকারের কিছু করের সুবিধা ছিলো। যাদের বাৎসরিক বেতন নূন্যতম সাইত্রিশ হাজার ইউরো তাদের বেতনের শতকরা ত্রিশ ভাগ করের আওতামুক্ত ছিলো, আর এই সুযোগটি প্রতি জন প্রথম দশ বছরের জন্যে নিতে পারতো। সেটিকে কমিয়ে প্রথমে আট বছর আর এখন পাঁচ বছরের জন্যে করা হয়েছে। পহেলা জানুয়ারী দুই হাজার একুশ থেকে যারা নেদারল্যান্ডসে চাকুরী নিয়ে আসবেন তারা আর এ সুযোগটি পাবেন না। সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটাস্টিক্সের মতে, প্রায় সাতান্ন হাজার এক্সপাট বছরে এই করমুক্ত সুযোগটি ব্যবহার করে থাকে। এই করমুক্ত সুবিধার সময় কমিয়ে দেয়াতে প্রতি বছর ডাচ সরকার প্রায় তিনশো পঞ্চাশ মিলিয়ন ইউরো লাভবান হচ্ছে। এই সাথে এক্সপাটের বাচ্চাদের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ার খরচ দেয়ার করমুক্ত সুবিধাও কোম্পানীগুলোকে পাঁচ বছরের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। একজন এক্সপাটকে যেহেতু বেতনের শতকরা বায়ান্ন ভাগ কর দিতে হয়, ত্রিশ পার্সেন্ট কর মুক্ত বেতনের আওতায় পাওয়া টাকার সুবিধার পরিমান নেহায়েত কম নয়। ডাচ সরকারের এই ব্যবহারে এক্সপাটরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করেন। তাদের শ্লোগানে লেখা ছিলো, “প্রিমিয়ে রুতে, আ ডিল ইজ আ ডিল”। এতে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে, এক্সপাটদের নিজেদের দেশে ফেরত চলে যেতে বলেন। নেদারল্যান্ডসের রিসার্চ আর ডেভেলাপমেন্ট চলে আশি পার্সেন্ট বিদেশিদের দ্বারা। সে জায়গায় কোন সরকার প্রধান থেকে এ ধরনের বক্তব্য আশা নিতান্তই হতাশাজনক। ত্রিশে অক্টোবর থেকে বেলজিয়াম পুরোপুরি লকডাউনে চলে গেছে, নেদারল্যান্ডসকে অনুসরণ করে ফ্রান্স, ইতালি আর স্পেন আছে আংশিক লকডাউনে। ট্রেন দুই মিনিট দেরী করে প্ল্যাটফর্মে আসলে স্ট্রেস হয় যে জাতি তারা বিশ্বের আট নম্বর আর ইউরোপের ছয় নম্বর করোনা আক্রান্তের শীর্ষে অবস্থান করে কি করে এই মুমূর্ষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে সেটি এখন দেখার বিষয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এখনও দেশের অধিকাংশ জনগন প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতের ওপর আস্থা রেখেছে, তিনি অর্থনীতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমৃদ্ধ নেদারল্যান্ডস ফিরিয়ে আনবেন এই আশা ডাচেদের মনে দৃঢ়। তানবীরা তালুকদার ৩১/১০/২০২০

No comments:

Post a Comment