Tuesday 16 November 2021

চোখবন্ধ অন্ধ সময়

ঝরঝরে বাংলায় লেখা বন্ধু লেখক শামীর রুনার প্রথম উপন্যাস “চোখবন্ধ অন্ধ সময়” পড়লাম। রুনার লেখার সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। মাঝে মাঝেই টাইমলাইনে এঁকে দেয় স্মৃতি জাগানিয়া, ব্যথা জাগানিয়া কিছু তুলি রেখা যা পড়লে ফেলে আসা শৈশব কৈশোরের জন্য মন উথালপাথাল করে। উপন্যাসটি আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেছে। সামাজিক পরিস্থিতি, মানুষের মানসিকতা, রাজনীতি, দাম্পত্য সম্পর্কের টানাপোড়েন, সমকামিতা সবই উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। দুই প্রান্তের দুই নারীর জীবন সংগ্রাম এই উপন্যাসের উপজীব্য। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অঞ্জলি যে বিয়ের পরে হয়ে যায় রেহানা। সাথে আসে হিজাব। তারপর স্বামীর অনুমতিতে চাকুরী, সংসারের বাইরে যাতে যেতে না পারে সেজন্য চাই বাচ্চা। পরিচিত লাগছে না? দ্যা স্টোরি নেক্সট ডোর। সেখানেই কি থামে? না, কখনোই না, বউ কার সাথে কথা বলবে, কার সাথে বন্ধুত্ব করবে, কোন আত্মীয়ের বাসায় কতটুকু বেড়াতে যাবে সব ঠিক করে দেয় শাশুড়ি আর বর। এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু উপন্যাসে অঞ্জলি যখন শিকল ভাঙতে চাইলো, তখন অঞ্জলির মা এগিয়ে এলো যেটা আমার কাছে খুব বাস্তব লাগেনি। বেশির ভাগ মেয়েই পরিবারের সমর্থন পায় না, মানিয়ে নে, কি করবি, এটাই জীবন, এরকমই সব, এসব কথার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে খুন পর্যন্ত হয়ে যায়। এছাড়াও, বন্ধু সুমন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে যে কিনা সমকামী, সেটাও আমার কাছে খানিকটা লেখকের “ইজি এস্কেপ” মনে হয়েছে। সমকামী না হয়ে, বিপদে বন্ধুর সাথে আগের দিনের হৃদ্যতা ফিরে আসতে পারতো কিংবা ধরা যাক প্রেম হতে পারতো। তবে লেখক যেহেতু একটা নির্দিষ্ট সময়কে ফ্রেমবন্দী করতে চেয়েছেন, মুক্তচিন্তার মানুষদের ওপর হামলা ও হত্যাকে সাহিত্যের পাতায় স্থান দিয়েছেন তাই হয়ত পটভূমিটি এভাবে সাজিয়েছে। উপন্যাসের দ্বিতীয় চরিত্র মনীষাকে আমার কাছে অঞ্জলির চেয়েও শক্তিশালী মনে হয়েছে। দরিদ্র সনাতন ধর্মালম্বী নিতান্ত কিশোরী মেয়েটিকে, দূর গ্রামের এক মতলবী পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। পণ নেবে না কিন্তু তাদের ধান্ধা অন্য। যে ধরনের সামাজিক পরিস্থিতি থেকে, ধর্মীয় চাপ অগ্রাহ্য করে, নিতান্ত শঙ্কা শঙ্কূল অজানার পথে পা বাড়িয়েছে সে, সেখানে ইতিবাচক পরিস্থিতি খুব কমই হয়, লেখককে ধন্যবাদ মনীষাকে আলোর দিকে ধরে রাখার জন্যে। ধর্মের নামে এই পীড়ন আর কতদিন? শেকল ভেঙে মনীষারা বাইরে আসুক, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজের অস্তিত্ব নিজে তৈরি করুক। নারীরা শিক্ষায়, কর্মে যতদূর এগিয়েছে, তাদেরকে সেভাবে গ্রহণ করার মানসিকতায় পুরুষেরা সেভাবে আগায়নি। সমাজও স্বাধীন মতামতের মেয়েদের গ্রহণ করতে এখনো প্রস্তূত হয়নি। বাড়ি থেকে মেয়েকে অফিস করতে যেতে দেয়, এইতো অনেক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, পুরুষের পাশে বসে কাজ করে মানেই অনেক আধুনিক। স্বাধীনতার এই সংঘর্ষ এক সময় অনিবার্য। ভেঙেচুরেই প্যাটার্ন তৈরি হয় আর হবে। অঞ্জলি আর মনীষাদের প্রতি অনুরোধ এই প্রতিবাদ যেনো তারা থামিয়ে না দেয়, তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি না লড়ি মা কেমনে সমাজ বদলাবে তোমার মেয়েরা লড়লেই মা গো রাত পোহাবে তবে। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, রুনার কাব্যিক গদ্যের কথা, বই থেকে দুটো লাইন তুলে না দিয়ে পারছি না, “ মুহূর্তে বাঁচি আর সেসব মুহূর্ত জড়ো করে একটি জীবন গড়ি। পরের দিন আচমকা সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মুহূর্তের বাঁচার জীবন মুহূর্তে থেমে যেতে পারে বৈকি!” কিছু মুদ্রন প্রমাদ আছে, সামনের সংস্করণে আশা করি শুধরে যাবে। চৈতন্য থেকে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি যারা পড়তে আগ্রহী (প্রবাসীরা) শুদ্ধস্বরের সাইটে গিয়েও পড়তে পারেন। সেখানেও ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। আমি সেখানেই প্রথম পড়তে শুরু করি। একবার শুরু করলে গল্পই আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
তানবীরা হোসেন ১১/০২/২০২১

No comments:

Post a Comment