“ন হন্যতে” (২০১২) অর্ণব রিংগো ব্যানার্জির পরিচালনায় রূপা গাঙ্গুলী, রাহুল ব্যানার্জি, দেবশঙ্কর হালদার প্রমুখের অভিনয়ে একটি অনবদ্য সিনেমা। ছোটবেলায় পড়া মৈত্রীয় দেবী আর মির্চা এলিয়াদকে মাথায় রেখে সিনেমাটা দেখতে বসলে একটু আশাহত হতে পারেন। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখলেই সিনেমায় ডুবে যাবেন। কাহিনীটাই এমন টানের। পুরো সিনেমাটাই টান টানের। জীবন মানুষকে কখনো কখনো এমন জায়গায় এনে দাড় করিয়ে দেয় মাকে বেছে নিতে হয়, এক সন্তানকে বাঁচাতে পারবো, কাকে চাও, ছেলেকে না মেয়েকে?
রিংগো লিখেছেন, ছবিটা জিয়াং লিং-এর লেখা ‘দ্য গ্রেট তাংশান আর্থকোয়েক’ থেকে অনুপ্রাণিত। ‘ন হন্যতে’-র গল্প থেকে শুরু করে, বেশ কিছু দৃশ্য, এমনকী কিছু ডিটেলের কাজও জিয়াওগাং ফেং-এর ছবি, ‘আফটার শক’ (২০১০) থেকে হুবহু তুলে নেওয়া। সিনেমার শেষটা বড্ড সিনেমাটিক। বাচ্চা এডাপ্ট করা আর পরে বাচ্চার তার বায়োলজিক্যাল পেরেন্টসদের সাথে যোগাযোগ করা একটা সাধারণ ঘটনা। পরিচালক এটাকে এতো নাটকীয়রুপ না দিলেও পারতেন। হয়তো বাচ্চা মেয়েটার অভিমানের পাল্লাটা অনুধাবন করানোর জন্যে এই নাটকটার অবতারনা কিন্তু কোন বাচ্চাটা অভিমান করে না যখন জানতে পারে তার বায়োলজিক্যাল পেরেন্টস তাকে দিয়ে দিয়েছে? যাই থাকুক? শেষটুকু হয়ত অন্যভাবে দেখনো যেতো। ব্যাক্তিগত অনুভব, ক্ষমা এই জিনিসগুলোকে প্রাধাণ্য দেয়া যেতো। এসব কিছু ছাড়িয়েও অসাধারণ একটা মুভি, সিনেমাপ্রেমীদের জন্যে।
যারা “ন হন্যতে”ই দেখতে চান তারা ইউটিউবে পেয়ে যাবেন “লা নুইট বেংগলী” কিংবা “দ্যা বেংগলি নাইট” (১৯৮৮) সিনেমাটি। এটা মির্চা এলিয়াদের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বানানো। মৈত্রীয় দেবী আর মির্চা এলিয়াদ দুজন দুজনের মতো করে তাদের প্রেম কাহিনী লিখেছেন।
একজন লিখেছেন স্বাভাবিকভাবে কূল বাঁচিয়ে আর একজন কি কিছুটা প্রতিশোধমূলকভাবে?
১৯৮৭-র কোলকাতা। একটি ভিনদেশি ছবির শ্যুটিং নিয়ে খবরের কাগজে তোলপাড় খবর। একবার মাত্র ফেস্টিভ্যালে দেখানোর পরে সেই ছবি আর প্রদর্শিত হয়নি এদেশে। ফরাসি ভাষায় তোলা সেই ছবির পরিচালক ছিলেন নিকোলাস ক্লোৎজ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শাবানা আজমি, সুপ্রিয়া পাঠকের সঙ্গে নায়ক হিসেবে ছিলেন, হিউ গ্রান্ট নামক ব্রিটিশ অভিনেতা। ‘লা নুই বেঙ্গলি’-র কাহিনিতে নায়কের নাম অ্যালান, সে কলকাতায় এসে প্রেমে পড়ে গায়ত্রী নামের এক বাঙালি মেয়ের। তার সেই প্রেমের কথা জানাজানি হতেই মধ্যবিত্ত বাঙালি পারিবারিক ইথোজ-এ যে ঝড় শুরু হয়, তাই এই ছবির উপজীব্য। মির্চা এলিয়াদের লেখা এই কাহিনির আগে মৈত্রেয়ী দেবীর রচনায় যে ভার্সনটি পাওয়া গিয়েছিল, তার সঙ্গে এর মিল অতি সামান্যই। শেষ পর্যন্ত মৈত্রেয়ী দেবী ব্যক্তিগত বিষয়কে জনসমক্ষে আনার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মির্চার রচনাকে সিনেমায়িত করার অনুমতি প্রদানের জন্য তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন মির্চার বিধবা পত্নী ক্রিশ্চিনেলের প্রতি। ব্যাপারটি শেষমেশ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মৈত্রেয়ী দেবীর বক্তব্য ছিল— মির্চা তাঁকে কথা দিয়েছেলেন, তাঁর জীবদ্দশায় এই বই কখনওই ইংরেজিতে প্রকাশিত হবে না। এখন তা ইংরেজি সিনেমা হতে চলেছে। ফলত, ব্যক্তিগত পরিসরকে বাইরে নিয়ে আসা হচ্ছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। মৈত্রেয়ী দেবী অভিযোগ আনেন প্রযোজক ফিলিপ দিয়াজের বিরুদ্ধে। দাবি করেন এই ছবির বিষয়বস্তু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে আঘাত আনতে পারে এবং এই ছবি কোনও কোনও জায়গায় পর্নোগ্রাফিক। ছবিটি কোনও দিনই ভারতের পাবলিক-প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়নি।
“শব্দ” (২০১৩) খুব ব্যাতিক্রমধর্মী গল্প নিয়ে করা এই সিনেমাটি।
সেরা ছবি হিসেবে কৌশিক গাঙ্গুলির ‘শব্দ’জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। নৈঃশব্দ্যও যে সিনেমার অন্যতম ভাষা, দেখিয়ে দিলেন কৌশিক। ফলি আর্টিস্টের শব্দ ছাড়া অন্য কোনও আবহসঙ্গীত, মায় গানও নেই। “শব্দ’ শুধু বাংলা ছবির মান বাড়ায়নি, সিনেমার গ্ল্যামার আর জৌলুসের আড়ালে চাপা পড়ে-যাওয়া এক দল প্রান্তিক শিল্পীকে সামনে নিয়ে এসেছে যাদের বলা হয় ‘ফলি আর্টিস্ট”। একজন মানুষ যিনি সিনেমায় শব্দ নিয়ে কাজ করেন তাকে ঘিরে এই কাহিনী, যদিও কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে নানা শব্দের উৎপত্তি-ব্যাঞ্জনা, সিনেমায় যে শব্দগুলো আমরা শুনি সেগুলো কিভাবে তৈরী হয়, তার বেশ মজাদার উপস্থাপনা আছে। সংলাপ এবং আবহসঙ্গীত ছাড়া সিনেমায় আরও শব্দ থাকে। যেমন, ঘোড়া ছোটানোর খটাখট শব্দ, মারপিট, ঘুসির আওয়াজ, চালাঘর ভেঙে উদ্দাম দৌড়তে থাকে কয়েকটা গরু। শ্যুটিংয়ের সময়ের শব্দগুলি কিন্তু সিনেমায় থাকে না, পরে রেকর্ডিং স্টুডিওতে সংলাপ থেকে প্রতিটি শব্দ ডাবিং করা হয়। সেগুলো কি করে তৈরী করা হয় সেটিও দেখানো হয়েছে সিনেমাটিতে। ঋত্বিক চক্রবর্তী, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, রাইমা সেন, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকেই দূর্দান্ত অভিনয় করেছে। কিছুটা এধরনেরই কাহিনী ও মেকিং নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম দুই হাজার ছয় সালের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শাহবাগ জাদুঘর মিলনাতয়নে। সিনেমাটার নাম ছিলো “নিঃশব্দ”। সিনেমাটার বক্তব্য ছিলো সারাদিন আমরা অকারণে কতো শব্দ করি তা নিয়ে। শব্দ দূষনের ব্যাপারে মানুষকে সর্তক করা হয়ত ছিলো উদ্দেশ্য। ডিটেইলসে দেখিয়েছিলেন সারাদিন আমাদের চারপাশে অকারণে কতো শব্দ হয়। যার অনেককিছু হয়তো আমরা চাইলে এড়িয়ে যেতে পারি।
No comments:
Post a Comment