Tuesday 5 May 2020

দিনযাপণ ১৬-০৪-২০২০

ফিলিপ্সে কাজ করতাম তখন। বছরে চল্লিশ দিন ছুটি, তার সাথে ওভারটাইম আর সব মিলিয়ে টার্গেট থাকতো দু’মাস দেশে থাকা। কোনরকম দশ মাস এখানে বাকি দু’মাস দেশে। আমার ডাচ কলিগরা বিশ্বাস করতে চাইতো না হল্যান্ডের মত দেশ ফেলে আমি বাংলাদেশের জন্যে পাগল। একবার আমি দেশ থেকে ফিরলে, বললো, তোমার হলিডে’র এলবাম নিয়ে এসো তো, দেখি। এলবাম দেখে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে তারপর বলেই ফেললো, তোমরা ইটের বাড়িতে থাকো বুঝতে পারলাম, ঘূর্নিঝড় বা বন্যার পর টিভিতে যেমন দেখি আমরা সেরকম তুমি বা তোমার পরিবার থাকো না। কিন্তু তোমরা এরকম বাড়িতে ঘুমাও আর তোমার নিজের দেশের লোক রাস্তায় ঘুমায়, কি করে পারো তোমরা ঘুমাতে! ওরাতো তোমাদের নিজেদের লোক, এক দেশের মানুষ তোমরা। আমার কোন জবাব ছিলো না। কারণ আমি এর মধ্যেই বড় হয়েছি। একদল রাস্তায় থাকবে আর একদল বাড়িতে থাকবে এটা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক। বরং প্রশ্নটাই ছিলো অস্বাভাবিক।

রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার পর, সারাদিন ডাচ টিভিতে এর আপডেট দেখিয়ে যাচ্ছে। ক্যান্টিনে, করিডোরে, কনফারেন্স রুমে সব জায়গায় দিনভর টিভি চলে আর তারমধ্যে সব টিভি চ্যানেলে এই খবর। আমি অফিসে চোর মুখ করে থাকি, যার সামনেই পরি তারই একই কথা, কি করে সম্ভব! কয়েকটি ডাচ টিভি চ্যানেল গার্মেন্টস মালিকদের ল্যাভিস লাইফ আর শ্রমিকদের দুর্দশার রিপোর্টিং দেখালো, হিডেন ক্যাম নিয়ে ডেস্পারেট সাংবাদিকরা ফ্যাক্টরীর ভেতরে ঢুকে গেছিলো। এখানে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পরলো, প্রাইমার্ক, এইচ এন্ড এম, আইকিয়া, সি এন্ড এ সবাই ক্রেতাদের খাতিরে তাদের “বাংলাদেশ সাহায্য” প্রজেক্ট ভিজিবল করলো। আইকিয়া গার্মেন্টস মালিকদের চাপ দিয়ে সব শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরী নিশ্চিত করতে সব শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে বেতন দেয়া বাধ্যতামূলক করলো, তারা চেক করবে সেই ট্রান্সপেরেন্সী নিশ্চিত করলো, শুধু গার্মেন্টস মালিকরা একাউন্টে বেতন ট্রান্সফার করার পর, আইকিয়া চেক করার পর যে সেটা আবার তারা তুলে নিয়ে যায় সেটুকু আইকিয়া নিশ্চিত করতে পারলো না। সি এন্ড এ, এইচ এন্ড এম দোকানে প্রতীকী রক্তমাখা ডোনেশান বক্স রেখে দিলো “ হেল্প বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কাস” নাম দিয়ে। কাপড়ের দাম একটাকা কম রাখতো সেই টাকাটা সেই বক্সে দিতো সবাই। এই ছিলো এখানের মানুষের প্রতিবাদ। বাংলাদেশের মানুষরা ফেসবুকে ঝড় তোলা ছাড়া, সরকার বা গার্মেন্টস মালিকদের চাপ দিয়ে শ্রমিকদের জন্যে কিছু করতে পেরেছিলেন কি না জানা হয় নি কখনো। কারণ কদিন পর পর লঞ্চডুবি, ট্রেন-বাস দুর্ঘটনা, এরকম মৃত্যু এসবে আমরা অভ্যস্ত।

বহুবার লিখেছি, ছোটবেলা থেকে কোরবানিতে জবাই, রক্ত, প্রতিদিন মুরগী জবাই, দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু দেখতে দেখতে আমরা রক্তে অভ্যস্ত। অন্যের ন্যায্য অধিকার চুরি, রক্ত, জবাই, মৃত্যু সব আমাদের জন্যে খুব সাধারণ। তারওপর আছে তৌহিদী জনতা, তাদের আছে বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ। এরচেয়ে ও খুব নিকটে আছে মুঘল ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাস বইতে মুঘলদের খুব মহান আঁকা আছে, মূলত তারাও ব্রিটিশদের মত ভারতীয়দের হাত থেকে তাদের দেশ ছিনিয়ে নিয়েছিলো, সেই কথাটি খুব কম বইতে উল্লেখ আছে। মুঘল ইতিহাস, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, বাবার হাতে ছেলে বন্দী, ছেলের হাতে বাবা বন্দী, এন্তার লুটপাট আর খুনোখুনি। তাই এইযে ফেসবুকে লাইভে এসে বউকে কুপিয়ে খুন করে এটি একটি অতি সাধারণ বিছিন্ন ঘটনা মাত্র। এই যে করোনার মত বৈশ্বিক দুর্দিনে চাল চুরি হয়, তেল পাওয়া যায় খাটের তলে এগুলোই আমাদের পরম্পরা। আর এরকম ঘটনা এমেরিকা-সিঙ্গাপুরে অহরহ ঘটে তার চেয়ে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভাল। আসেন আমরা, ইউটিউবে রেসিপি দেখি, রান্না করি খাই, উই জাস্ট ক্যারি অন। কারণ আমরা এসবেই অভ্যস্ত।

No comments:

Post a Comment