Saturday 5 December 2020

যখন আমি থাকবো নাকো

কয়েক বছর আগের কথা, নিশি পঞ্চাশে পা দেয়ার কিছুদিন পরই হঠাৎ অসুস্থ হলো, আট দিনের অসুস্থতায়, মারা গেলো। গ্রুপে ম্যাসেজ এলো, “শি ইজ নো মোর”, “রেস্ট ইন পিস” ইত্যাদি। দু মাস পর আমি নিশির বরকে ফোন করলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ওকে যেহেতু কাজের জন্যে অনেক ট্রাভেল করতে হয়, ঘর আর চাকুরী সামলে বোধহয় একদম বিধ্বস্ত হয়ে গেছে বেচারা। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নিশিইতো সব দেখাশোনা করতো। সংসার, বাচ্চাদের পড়াশোনা, বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা, তাদের অসুস্থতা, আত্মীয়-স্বজন, লোক-লৌকিকতা, সবকিছু, সবকিছু, সবকিছু। সবসময় বলতে থাকতো, বাড়ি ছেড়ে বের হতে পারি নারে, আমাকে ছাড়া দুদন্ড চলে না। আমার বর তো চা-টাও বানিয়ে খেতে পারে না। সবাই সবকিছুর জন্যে আমাকেই ডেকে বেড়ায়। কিন্তু জানিসতো, এই যে সারাদিন বেগার খাটি তার জন্যে কারো কোন প্রশংসা পাই নারে, সবাই ভেবে নেয়, সবকিছু আমার দায়িত্ব। আমি নিশির বরকে ফোন করলাম, খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে, কোন কিছুর দরকার আছে কি না? যদি আমি কোনভাবে কোন সাহায্য করতে পারি। ভাবলাম, হঠাৎ করে একসাথে এত দায়িত্ব, নিশির বর বেচারা বোধহয় একেবারে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। বয়স্ক বাবা মা, বাচ্চা, অফিস ট্যুর, এ বয়সের একাকীত্ব, সব কি করে একা সামলাবে! মোবাইল একটানা বেজে গেলো, কেউ ধরলো না। এক ঘন্টা পর কলব্যাক করে ক্ষমা চাইলো সময়মত ফোন ধরতে পারেনি বলে। বললো, রোজ এক ঘন্টা করে টেনিস খেলা শুরু করেছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডাও হয়ে যায়, সময়টা ভাল কাটে। চাকুরীতে ট্রান্সফার নিয়েছে, আগের মত আর এত ট্রাভেল করতে হয় না। জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িতে সবাই ভাল আছে? বললো, রান্নার একজন লোক রেখে দিয়েছি, কিছু বাড়তি টাকা দেই, বাজারটাও সেই করে। বয়স্ক বাবা মায়ের দেখাশোনার জন্যে দিনরাতের আয়া রেখে দিয়েছি। বাচ্চারাও ভাল আছে, সব চলে যাচ্ছে, জীবন আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে আসছে। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না, কোনরকমে দু-চারটে কথা বলে ফোনটা রেখে দিলাম। দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। বারবার নিশির কথা মনে পড়ছিল, শাশুড়ির সামান্য অসুস্থতায় স্কুল পুর্নমিলনী বাদ দিয়ে দিলো, বাড়িতে মিস্ত্রি কাজ করছিলো তাই নিজের ভাতিজির বিয়েতে যায়নি। বন্ধুদের সাথে কত আড্ডা, সিনেমা, ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে দিয়েছে, কারণ বাচ্চাদের পরীক্ষা, রান্না করতে হবে, স্বামীর জন্যে এটা ওটা কত কি দরকারী কাজ। শুধু চাইতো, পরিবারের লোকেরা তার একটু প্রশংসা করুক, তার একটু মূল্য দিক, কিন্তু কখনোই সেটা সে পায়নি আজ মনে হচ্ছে নিশিকে ডেকে বলি, এই পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়রে পাগলী। কারো জন্যে পৃথিবীতে কিছু আটকে থাকে না। আমি না থাকলে কি হবে এটা আমরা ভেবে নেই। হয়ত নিছক নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া। সবসময় অন্যেদের গুরুত্ব দেয়ার জন্যে নিজেকে একটা কিছু দিয়ে বুঝিয়ে নেয়া। তুই নিজেই বুঝিয়েছিস সবাইকে, তোরটা পরে, তাদেরটা আগে। বাস্তব মেনে নেয়া কঠিন। তোর মৃত্যুর পর দুজন গৃহকর্মী এসেছে, বাড়ির সব কাজ ঠিক আগের মতই চলছে। আমাদের সম্মান, আমাদের মূল্য, আমাদেরকেইতো তৈরী করতে হবে, নয় কি? বাকিদের বলছি, জীবনকে উপভোগ করতে শেখো, আমাকে ছাড়া সংসার চলবে না ভাবনাটা বাদ দাও, দিনের শেষে সব চলে যায়। নিজেকে সময় দাও, নিজের জন্যে বাঁচো। বন্ধুদের সাথে বাইরে যাও, কথা বলো, আনন্দ করো। নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দাও, মাঝে মাঝে পছন্দের জিনিস নিয়ে সময় কাটাও। সবসময় অন্যের মাঝে নিজের সুখ খুঁজতে যেও না, তোমার নিজেরও সুখের দরকার আছে, নিজে সুখী না হলে অন্যকে কি করে সুখী করবে? সবার যেমন তোমাকে প্রয়োজন, নিজেকে সময় দেয়াও তোমার প্রয়োজন। যেসব মেয়েরা সমস্যায় আছে তাদের সাহায্য করো। চলো সবাই মিলে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলি। সবার শেষে বলি, জীবন আনন্দময় মূলভাবঃ অন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment