Thursday 3 December 2020

মূর্তি বনাম ভার্স্কয

আগে বিদেশ থেকে আত্মীয় আসবে শুনলে বিরক্ত হতাম। ভাবতাম, আমরা তো ভালোই আছি, আসবে এখন নাক উঁচু করে ডার্টি ডার্টি বলতে। তারা খাওয়ার টেবিলে বসে দেশ এবং বিদেশ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করতো আর হাসি হাসি মুখ করে আমরা যথারীতি তাদের অপছন্দ করতাম। এখন কপালের ফেরে বাইরে থেকে তাদের দলে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করলাম। পৃথিবীর যত ক’টা শহরেই গেছি, ছোট কিংবা বড় প্রায় সব শহরেই ছোট-বড় তাদের শহরের কিংবা দেশের বিখ্যাত লেখক, শিল্পী, গায়ক, নায়ক, রাজনীতিবিদ, প্রেসিডেন্টের মূর্তি আছে। হ্যাঁ, আমিতো ফাইন আর্টস কিংবা ধর্মের ছাত্রী না, আমার কাছে মূর্তিও ভাস্কর্য এবং বেশ নয়নাভিরাম ভার্স্কয। রাধাকৃষ্ণ, গনেশ, নটরাজের কি সুন্দর সুন্দর চোখ কেড়ে নেয়া শৈল্পিক ভার্স্কয আছে, তাকিয়ে থাকার মত। গ্রীকদের কথা আর নাই টানলাম। আফ্রোদিতি থেকে লাওকুনের লাইমস্টোন, মার্বেলের তৈরী মূর্তি ছুঁয়ে দেখে না এরকম কম পর্যটকই আছে। শত শত স্যুভেনীওর বিক্রি হয়, মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা প্রতি বছর। ছোট ছোট চত্বরে পর্যটকরা জাস্ট মূর্তির সাথে ছবি তোলে আর বড় বড় চত্বরে ক্লান্ত পর্যটকরা দুদন্ড বসে, জিরায়, পানি বা খাবার খায়, অবশেষে ছবি তুলে বিদায় হয়। এর বাইরে মূর্তি বা ভাস্কর্যের কোন উপযোগিতা আছে বলে আমি দেখিনি, শুনিনি। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে, তাদের সুবিধার জন্যেও বিভিন্ন শহরে পৌরসভা নিজ দায়িত্ব ও খরচে এগুলো তৈরী ও রক্ষনাবেক্ষন করে, রাষ্ট্রের ব্যাপারও না। নরওয়ের ছোট শহর সিয়েন লেখক হেনরিক ইবসেনের স্ট্যাচু বানিয়ে রেখেছে বলেই জানলাম তিনি এই শহরে জন্মেছিলেন, অপূর্ব সুরের জাদুকর নিজে বধির ওলফগ্যাংগ আমাদিউজ মোর্জাট সালর্সবুর্গে জন্মেছেন সেটা শহরে তার মূর্তি দেখে জেনেছি, চার্লি চ্যাপলিন সুইজারল্যান্ডের কোর্সিয়ার সার ভেভেইতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেই শহরে তার মূর্তি দেখেই জেনেছিলাম। ইতিহাস জানানোর খুব সহজ উপায় হলো মূর্তি। এরকম একটা আনপ্রোডাক্টিভ খাতে যে দেশে সপ্তাহভর টকশো চলতে পারে, তাও দুই হাজার একুশের দোর গোড়ায় তাদের জন্যে মামুন মারুফের ভ্যাক্সিনের ফর্মূলাই ঠিকাছে। সামনের সপ্তাহ থেকে ইউকে টিকা দেয়া শুরু করবে বলছে, হুজুরের ফর্মূলাটা যেনো কি ছিলো? মিলায়া দেখা দরকার লাস্ট বাট নট দ্যা লিস্ট, পনের বছর ক্ষমতায় থাকার পর বঙ্গবন্ধুর ভার্স্কয নিয়ে যদি এই অবস্থা হয়, সনাতন ধর্মালম্বীরা দেশে কি অবস্থায় আছে খুব সহজেই অনুমেয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, রোহিংগাদের মত আলাদা ভাসানচর তৈরী করা হোক। ******************************* মূর্তি বনাম ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে কচলাকচলি দেখি থামে নাই এখনো। "ভার্স্কয যে মূর্তি না" সুশীল সমাজের এটা প্রমাণের প্রাণপাত চেষ্টায় একটা পুরনো কৌতুক মনে পড়ে, হুজুর তার বউরে হাদিস শুনাইছিলো, রাত বারোটার পর চুরির মুরগী খাওয়া হালাল। সেই সূত্রানুসারে, মূর্তি হইলে ভাঙা জায়েজ? বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে যাহা মূর্তি, তাহাই ভাস্কর্য, উহাই স্ট্যাচু। কথা হইলো, হুজুর সমাজ রাস্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাইতে পারে কি না? বাংলাদেশের সংবিধানে মূর্তি ভাঙা পারমিটেড কিনা। স্মৃতি যদি ধোঁকা না দেয়, আমাদের ছোটবেলায় যা দুই-একটা নির্বাচন, প্রায় ঠিকঠাক টাইপ হয়েছিলো, একটা প্রবাদ বাক্যের মত ছিলো, নন মুসলিম ভোট সব নৌকায় যাবে, একমাত্র নৌকার দলীয় সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটির উল্লেখ আছে। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখা বঙ্গবন্ধু এ পরিস্থিতি হয়ত স্বপ্নেও ভাবেন নাই। হুজুরদের কেন জানানো হচ্ছে না, আইয়ামে জাহলিয়াতের যুগ পার হয়ে পৃথিবী এখন সামনে এগিয়ে গেছে। ধর্ম নিরপেক্ষ কিংবা ধর্মহীন লোকেরা উপসনালয় ভাঙে না কিংবা এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি হিংস্রতা দেখায় না। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বাণী, “যত মত তত পথ” সভ্য সমাজে, একটা স্বীকৃত পন্থা। পরমতসহিষ্ণুতা সমাজে বাস করার প্রথম শর্ত, পছন্দ না হলেই কোপানো বা ভাঙা যায় না। হুজুররা যদি তাদের ইল্যুশান থেকে বের হতে না চায়, সেটাও ভালো, ভাসানচরের মত তাদের আলাদা একটা হৌটি আরব কিংবা হাক্কা বা হাদিনা তৈরী করে দেয়া হোক। সাথে উষ্ট্র আর তরবারীও দেয়া হোক, তাদের জগতে তারা সুখে শান্তিতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলুক। শুধু বাইরে থেকে লক করে দিতে হবে, বের হতে পারবে না। বারো মাসে তের পার্বণের এই দেশে ইস্যুর অভাব নেই। মূর্তির সুরাহা হওয়ার আগেই শুরু হলো টিএসসি নিয়ে। দেশের বাইরে থেকে মেহমান এলে যারাই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর দেখেন, প্রায় প্রত্যেকেই বলেন, ঢাকার ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট পার্ট। নতুন নতুন হাইরাইজ তোলাতে বিশ্বাসী এমেরিকানরা প্রায় তিনগুন বেশি এক্সপেন্সিভ জানা সত্বেও, ইউরোপের পুরনো চার্চ, ক্যাসেল, কলোসিয়াম দেখার জন্যে প্রতি গরমে ভীড় করে। বিশ্বব্যাপি পুরনো ঐতিহ্য লোকে রক্ষা করে। প্রয়োজনে হাইরাইজ সহ নতুন স্ট্র্যাকচার আসবেই, সেটাকে ঐ জায়গাতেই হতে হবে? নতুন ভবনের জন্যে নতুন জায়গা নেই? ভাস্কর্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা ভবন কোনটাই আমাদের হাতে নিরাপদ নয়, আমরা এমন কেনো?

No comments:

Post a Comment