Tuesday 8 December 2020

মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়

ক্লোজ বন্ধু গ্রুপের মধ্যে নিশিই প্রথম মারা গেলো। এমনিতে যে নিশির সাথে খুব যোগাযোগ ছিলো তা নয়, গ্রুপ ম্যাসেজেই টুকটাক যা কথা হতো। কারণটা ওদের মধ্যে ছিলো না, ওরাতো মাঝে মাঝেই জমিয়ে আড্ডা দিতো, সংসার অন্তপ্রাণ নিশিরই সময় ছিলো না বন্ধুদের সাথে দেখা করার কিংবা অনলাইন আড্ডা দেবার। সংসার, সংসার, এই কাজ ঐ কাজ, ফিরিস্তি শুনতে বিরক্ত লাগতো, আর যেনো পৃথিবীতে কারো পরিবার নেই, পারিবারিক জীবন নেই। এরকম আদিখ্যেতা সহ্য করা যায়? ইরিটেশান এড়াতে অনেক সময়তো এড়িয়েই চলেছি আমি ওকে। তারপরও মনের মধ্যে কয়দিন খচখচানি লেগেই রইলো। কারণে অকারণে সাদাসিধে ভালো মানুষী মাখানো মুখটা মনে পরতো। একদিন সকালে ফেসবুক স্ক্রল করছি, দেখি নিশির বর খোকন ভাইয়ের প্রোফাইলে নতুন ছবি, তার পাশে ছিপছিপে সুন্দরী একটি মেয়ের মুখ, পাশাপাশি বসে দুজনেই গভীর আনন্দে হাসছে, নীচে তখনও একশো আটাত্তরটা মন্তব্য জমা হয়েছে, অভিনন্দনের বানে ভেসে যাচ্ছে দুজনে, অবাক হয়ে মন্তব্যগুলো পড়তে পড়তে কেনো জানি আমার দু চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়াতে লাগলো। আঙুলে গুনে দেখলাম মাত্র পাঁচটি মাসই পার হয়েছিলো, সময় কত দ্রুত যায় আর করোনা যেনো গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভদ্রতার বশেও আমার আঙুলে তাদের জন্যে অভিনন্দন আসলো না, আমি এড়িয়ে গেলাম। অথচ খোকন ভাই নিজে নিয়ে খেতে পারে না বলে, অন্য লোকের রান্না খেতে পারে না বলে, নিশি বাবার বাড়ি যেয়েও দুটো দিন আরাম করে থাকতে পারতো না। এই আমাদের সাথে আড্ডাতেই, কচিৎ কখনোই তো আসতো, তাতেও মোবাইল বেজে উঠতেই, না খেয়ে দ্রুত পড়িমড়ি ছুট লাগিয়েছে বরের জন্যে। সকালটাই শুরু হলো ভাঙা মন নিয়ে, বসে বসে খোকন ভাইয়ের টাইম লাইন দেখছিলাম, নিশির সাথে এরকম কোন ফটো আছে কিনা খোঁজার চেষ্টা করলাম। খুঁজে পেলাম না, ক্যাজুয়ালি পাশাপাশি দাঁড়ানো দু একটা আছে বটে কিন্তু আমি জানি বরের সাথে ছবি তুলতে নিশি কি ভালোটাই না বাসতো। গ্রুপের আড্ডাতেও দেখেছি, নিশি ফটো তুলতে চাইলে, বয়স হয়েছে, এসব কি বলে খোকন ভাই এড়িয়ে যেতো। শুধু কি তাই, নিশি নিজের ছবি আপ্লোড করলেও বিরক্ত হতো। গ্রুপে আমরা ক্ষ্যাপাতাম, কি করে, বরের জন্মদিনে স্পেশাল কি কি করলি, ছবি দিলি না? খেতে না হয় নাই ডাকলি, দেখতে তো পেতাম, সবই গোপন নাকি? কাঁচুমাচু নিশির জবাব, খোকনের পছন্দ নয়রে তাই দেই না। ছবি তুলতেই তো চায় না, দেবো কি? খোকন ভাইয়ের ট্যাগ করা নাম ধরে তার নতুন পার্টনারের ইনফো দেখেতো রীতিমত ধাক্কা খেলাম আমি। বউ প্রকৌশলী, মাল্টি ন্যাশনালের সিনিয়ার কনসালটেন্ট। পেশাগত কারণে নানা জায়গায় ট্রাভেল, রেস্টুরেন্টে ডিনার ইত্যাদির প্রচুর ছবি তার টাইমলাইনে দেয়া আছে। ছেলেমেয়ে একটু বড় হওয়ার পর নিশিও শখ করলো অন্য সবার মত সে ও কিছু একটা করবে। এম-এ পাশ করেছে, তারও কিছু স্বপ্ন আশাতো ছিলো। সেটা শুনেই শ্বশুর-শাশুড়ি ভ্রু কুঁচকে ফেললো, তোমার বাচ্চাদের কে দেখবে? এ বয়সে আমরা কোন দায়িত্ব নিতে পারবো না। মেনিমুখো আপোষকামী নিশি সেবার বাবা-মায়ের দ্বারস্থ হয়েছিলো, মা, আমার বাচ্চাদের তুমি স্কুলের বাইরের টাইমটা দেখে রেখো, আমি ফেরার সময় নিয়ে যাবো। নিরীহ বাবা-মা, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, শ্বশুর-শাশুড়ি যখন চায় না তখন থাকুক, কিসের অভাবে চাকুরী করবে, কি নেই নিশির? খোকন ভাইতো সরাসরি বলেই দিলো, সবতো চলছে ঠিকঠাক তবে কেন সংসারে অশান্তি ডেকে আনা? একজন মায়ের দায়িত্ব কি কম? একজন কর্মজীবি মা হওয়ার চেয়ে একজন সফল মা হওয়া অনেক সম্মানের। বরবারের মত নিশি আপোষ করে নিলো। ক’দিন পর আবার আমার ফেসবুকের হোমফীডে খোকন ভাই আর তার নতুন পার্টনারের ছবি ভেসে এলো। গার্লিক এন্ড জিঞ্জার রেস্টুরেন্টে খেতে গেছে পরিবারের সবাইকে নিয়ে, নানা রকম খাবারের ছবি সাথে আবার নিজেদের সেলফিও পোস্ট করেছে। আনমনে ভাবছিলাম, শ্বশুর-শাশুড়ি বাইরের খাবার পছন্দ করে না বলে, সারা জীবন হাত পুড়িয়ে রেঁধে গেলো মেয়েটা অথচ বাইরে খেতে কি পছন্দই না করতো। নানারকম কুজিনের প্রতি কি আগ্রহ, ইউটিউব দেখে দেখে সেসব ট্রাই করা। রেঁধেই প্রথমে শ্বশুরকে দিতো, খাইয়ে যে কি সুখ পেতো। অথচ আজ সবাই হাসিমুখে একসাথে রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে। সমুদ্রের প্রতি কি ফ্যাসিনেশান যে ছিলো মেয়েটার। ফেসবুকে কেউ সী-সাইডে বেড়াতে যাওয়ার ছবি আপ্লোড করলে, কত আবেগী মন্তব্য করতো। শ্বশুর-শাশুড়িকে কার কাছে রেখে যাবে, তাদের কে দেখবে করে সমুদ্রে যেতে পারলো না নিশি। পাগলী পুরোটা সময় সংসারের জন্যেই বাঁচলি নিজের জন্যে খানিকটা সময় বাঁচলি না কেন তুই? কোথাও থেকে দেখে কি আফশোস করছিস? সুযোগ পেলে বদলে বাঁচবি ভাবছিস? খাঁ খাঁ নির্জন দুপুরে জানালার পাশে লো ভলিউমে চিত্রা সিং এর গান বাজছিলো, বুকটা ভাঙা ভাঙা লাগছিলো, মনে করো যদি সব ছেড়ে হায় চলে যেতে হয় কখনো আমায় মনে রবে কি রজনী ভরে নয়ন দুটি ঘুমে জড়াতে নিশি রাতে কে গান শুনাতো। কান্না চাপতে চাপতে তাই খোকন ভাইকে আনফলো করে দিলাম। নিশি নেই, অম্ল মধুর স্মৃতিটুকু থাকুক, তাতে কাঁটা মেশাতে চাই না। তানবীরা ১২/০৯/২০২০

No comments:

Post a Comment